আল্লামা মুহাম্মদ বাকের মাজলিসি (রহ.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনি-১
অনুবাদ: ড. আবু উসামা মুহাররম
আল্লামা মাজলিসি, তার পূর্ণাঙ্গ নাম মুহাম্মদ বাকির বিন মুহাম্মদ তাকী মাজলিসি (১০৩৭-১১১১ হিজরি) যিনি আল্লামা এবং দ্বিতীয় মাজলিসি নামে পরিচিত। আল্লামা মাজলিসি হিজরি ১১ এবং ১২ শতকের একজন মহান শিয়া আইনবিদ এবং হাদিস বিশারদ ছিলেন।
তিনি আবদুল্লাহ শুশতারি শেখ আবদুল্লাহ বিন জাবের আমেলি, শেখ আলি জাবাল আমেলি এবং মুল্লা মোহসেন ফয়েজ কাশানির অন্যতম ছাত্র ছিলেন। তিনি মোল্লা সদর থেকে বর্ণনা করার অনুমতি প্রাপ্ত ছিলেন। তিনি ইলমে সরফ, ইলমে নাহু, ইলমে বায়ান, ইলমে লোগাত, গণিত, ইতিহাস, দর্শন, হাদিস, রিজাল, দারাইয়া, উসুল, আইনশাস্ত্র এবং কালাম বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন এবং এই উল্লেখিত বিষয়গুলির মধ্যে কয়েকটিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিখ্যাত কিছু বই লিখেছেন যেমন: বিহার আল-আনওয়ার, যাকে শিয়া হাদিসের বিশ্বকোষও বলা হয় এবং এটি ইমামি হাদিসের বিশাল সংগ্রহ। তিনি তার ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং তার সময়ের মানুষের চাহিদার উপর ভিত্তি করে অনেক বই লিখে শিয়া মাযহাব ও সংস্কৃতির বৃহৎ সেবা করেন। মুহাম্মদ বাকের সাবজেভারির পরে, আল্লামা শায়খুল ইসলাম অভিধায় অভিষিক্ত হন। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ইরান এবং শিয়া ধর্মকে তিনি অনেক সেবা দিয়েছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় কাজ ছিল সুফিদের বিরুদ্ধে লড়াই।
১. জন্ম তারিখ
আল্লামা মুহাম্মদ বাকের মাজলিসি ১০৩৭ হিজরিতে “জামি কিতাব বিহার আল আনওয়ার” বাক্যের বর্ণানুক্রমিক সংখ্যার সমান তারিখে পৃথিবীতে আগমন করেন [১] তার পিতা মোল্লা মোহাম্মদ তাকি মাজলিসি ছিলেন শেখ বাহাইয়ের একজন ছাত্র ছিলেন। তিনি ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে তার সময়ের অন্যতম সেরা ছিলেন। এহয়াউল আহাদিস ফি শারহি তাহযিবিল হাদিস গ্রন্থসহ তার অনেক কাজ রয়েছে। “তার মা সদরুদ দ্বীন মোহাম্মদ আশুরির কন্যা” [২] যিনি জ্ঞানে গুনে বৈশিষ্টমণ্ডিত পরিবারে বেড়ে উঠেন।
২. পূর্বপুরুষ
আল্লামা মাজলেসির পরিবার মূলত লেবাননের একটি অঞ্চল জাবালে আমাল এলাকায় বসবাস করতেন। সেদেশের আলেমদের একটি গ্রুপের সাথে হান এই পরিবারটিও ইরানে প্রবেশ করে। তবে এই পরিবারের নাম মাজলেসি হওয়ার কারণ ছিল আল্লামা মাজলেসির দাদার নাম “মোল্লা মাকসুদ” ” শিয়া ধর্মের একজন ধার্মিক আলেম ও প্রবর্তক ছিলেন। তার সুন্দর কথা, মনোরম কবিতা, উত্তম আচরণ ও কথাবার্তার কারণে সমাবেশে তাকে “মাজলেসি” ডাকনাম দেওয়া হয়েছিল এবং তার পরিবারও এই নামেই পরিচিত ছিল। [৩,৪,৫]
৩. শিক্ষা
আল্লামা মাজলিসি চৌদ্দ বছর বয়সে শিক্ষকতা শুরু করেন। তাঁর সমৃদ্ধ এবং আশ্চর্যজনক বুদ্ধিমত্তা এমন ছিল যে, চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি ইসলামের মহান দার্শনিক মোল্লা সদরের কাছ থেকে বর্ণনা করার অনুমতি পান। আল্লামা মাজলিসি, যিনি জানতে ভালোবাসতেন, অল্প সময়ের মধ্যে সে সময়ের পাঠ্যক্রমের বিভিন্ন জ্ঞা্ন-বিজ্ঞানে যেমন ইলমে সরফ, নাহু, বালাগাত, লোগাত, গণিত, ইতিহাস ও দর্শন, হাদিস, সেইসাথে আইনশাস্ত্র এবং ধর্মতত্ত্ব পান্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি একজন সফল শিক্ষক ছিলেন এবং তিনি অনেক বই লিখেছেন। যুবক বয়সে তিনি আল্লামা, আলেম ও তৎকালীন পণ্ডিত ব্যাক্তিদের জ্ঞান চর্চার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন যেমন:
১. মোল্লা আবদুল্লাহ শুশত্রী।
২. শেখ আবদুল্লাহ বিন জাবের আমোলি।
৩. শেখ আলি জাবাল আমিলি।
এছাড়াও তিনি ধর্মীয় পণ্ডিতদের, বিশেষ করে একজন আইনবিদ, ও মুহাদ্দিস মুল্লা মোহসেন ফয়েজ কাশানি (যিনি) ইসফাহান সফরে আসেন এবং (সেই দেশে থেকেছেন) যথেষ্ট উপকৃত হন। [৬]
আল্লা্মা মাজলিসি, যিনি মোল্লা আবদুল্লাহর স্কুলে নামায পড়ানো ও শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁর সম্মানিত পিতার মৃত্যুর পর তিনি ইসফাহান জামে মসজিদে নামায ও শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিলেন। মির্জা আবদুল্লাহ এসফাহানী তার “রিয়াজ উলামা” গ্রন্থে বলেছেন: এক হাজারেরও বেশি লোক আল্লামার পাঠে অংশ নিতেন।
৪. আল্লামা মাজলিসির শিক্ষকগণ
১. মোহাম্মদ তাকি মাজলিসি: চার বছর বয়সে তিনি তার পিতার সাথে শিক্ষকতা ও আলোচনা শুরু করেন।[৭]
২. মোল্লা সদরা: তাঁর প্রতিভা এমন ছিল যে “চৌদ্দ বছর বয়সে, তিনি ইসলামের মহান দার্শনিক মোল্লা সদরের কাছ থেকে বর্ণনা করার অনুমতি পেয়েছিলেন”।[৮]
৩. আল্লামা হাসান আলি শুশতারি
৪. আমির মোহাম্মদ মমিন ইসরাবাদি,
৫. মির্জা জাযায়েরি,
৬. শেখ হার আমেলি,
৭. মোল্লা মুহসেন ইসরাবাদী,
৮. মোল্লা মুহসেন ফয়েজ কাশানি,
৯. মোল্লা সালেহ মাজান্দারানি।[৯]
৫. শিক্ষাদান
আল্লামা মাজলিসি, যিনি মোল্লা আবদুল্লাহ নামক স্কুলে নামাযে জামাআতের ইমাম ও শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি তার পিতার মৃত্যুর পর, ইস্ফাহানের জামে মসজিদে নামাযের ইমাম ও শিক্ষাদানে নিযুক্ত ছিলেন। [১০] তার এক ক্লাসে হাজারেরও বেশি ছাত্র বসত। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ছাত্র সাইয়্যেদ নেমাতুল্লাহ জাযায়েরী, বলেন: “যদিও তিনি অল্প বয়সী ছিলেন, তবুও তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানে এতটাই অগ্রসর হয়েছিলেন যে তার সময়ের পণ্ডিতদের কেউই সেই স্তরে পৌঁছাতে পারেন নি।” [১১] “যখন তিনি ইসফাহান জামে মসজিদে লোকদের কাছে খুতবা দিতেন, তখন আমরা তার চেয়ে বেশি বাগ্মী কাউকে দেখিনি। যে হাদিসটি আমি রাতে অধ্যয়ন করতাম, সকালে যখন তার কাছ থেকে শুনতাম, তখন তিনি এমনভাবে বলতেন যেন আগে কখনো শুনিনি। [১২] তাঁর নম্রতা ও মহানুভবতা সীমাহীন ছিল। তরুণ ছাত্রদের কাছে আল্লামার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রে প্রবীণ শিক্ষকও কখনও কখনও তাঁর ক্লাসে আসতেন। “শেখ মোহাম্মদ ফাজিল যদিও তিনি আলাদা পাঠ দান করতেন তিনিও আল্লামার শ্রেণীকক্ষে আসতেন এবং প্রকৃতপক্ষে ছাত্রদের নম্রতা শেখাতেন, এবং আল্লামা তার ছাত্রদের বলতেন যে আমি তার থেকে বেশি উপকৃত হয়েছি যতটা না তিনি আমার থেকে উপকৃত হয়েছেন ” [১৩]
৫ – আল্লামা মাজলিসির ছাত্র
আল্লামা-এর বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে আমরা যে মহান ছাত্রদের নাম উল্লেখ করতে পারি যেমন:
১. সাইয়্যেদ নেমাতুল্লাহ আল-জাযায়েরি।
২. আবদুল্লাহ ইবনে ঈসা তাবরিজি যা এফেন্দি নামে পরিচিত।
৩. সাইয়্যেদ মুহাম্মদ সালেহ ইবনে আবদুল ওয়াসে খাতুনাবাদি।
৪. মোল্লা মুহাম্মদ কাজেম শুশতারি।
৫. আবদুল হোসাইন মাজান্দারানি।
৬. মোল্লা মুহাম্মদ বাকের লাহিজি সহ আরো অনেকে। [১৪]
যৌবনের শুরু থেকেই আল্লামা তার সমগ্র জীবন উলুমে নাকলি বা বর্ণনামূলক জ্ঞানকে (আয়াত ও হাদিস) পুনরুজ্জীবনের জন্য উৎসর্গ করেন। এবং প্রথম ধাপে, তিনি কুতুবে আরবাআ বইগুলিকে সেই সময়ের সেমিনারিগুলির পাঠ ও আলোচনায় নিয়ে আসেন। “উসুল কাফী” এবং “আত তাহযিব” এর একটি তাফসীর লেখার সময় তিনি তার এক ছাত্রকে “ইসতবাসার” এর উপর একটি তাফসির লিখতে উৎসাহিত করেছিলে।
আল্লামার কয়েকজন ছাত্রের নাম হল:
১. মৌলভি ইবরাহিম জিলানি;
২. মৌলভি মোহাম্মদ ইবরাহিম বোওয়ানাতি;
৩. মির্জা ইবরাহিম হুসাইনি নিশাবুরি;
৪. মাশহাদের আবুল বারাকাত বিন মুহাম্মদ ইসমাইল খাদিম;
৫. মৌলভি আবুল আল-বাকাহ;
৬. আবু আশরাফ ইসফাহানি
৭. মৌলভি মুহাম্মদ বাকের জাওযি;
৮. মোল্লা মুহাম্মদ বাকের লাহিজি;
৯. শেখ বাহাউদ্দিন কাশি;
১০. মৌলভি মোহাম্মদ তাগি রাযি;
১১. মির্জা মোহাম্মদ তাগি আলমসি;
১২. মৌলভি হাবিবুল্লাহ নাশরাবাদি;
১৩. মোল্লা হুসাইন তাফরশি
১৪. মোহাম্মদ রেজা আরদাবিলি;
১৫. মোহাম্মদ তাহের ইসফাহানি;
১৬. আব্দুল হোসেন মাজান্দারানী;
১৭. সৈয়দ আজিজুল্লাহ জাযাইরি;
১৮. মোল্লা মোহাম্মদ কাজেম শুষতারি;
১৯. শেখ বাহাউদ্দিন মোহাম্মদ জিলি;
২০. মৌলভি মাহমুদ তাবসি;
২১. মোহাম্মদ ইউসুফ কাজভিনি;
২২. সাইয়্যেদ নেমাতুল্লাহ জাযায়েরি।[১৬][১৭]
(যিন্দেগিনামায়ে আল্লামা মাজলেসি গ্রন্থের লেখক সাইয়্যেদ মোসলেহউদ্দীন মাহদাভি আল্লামার ১৮১ জন ছাত্র ও অনুসারীর নাম উল্লেখ করেছেন।)
গ্রন্থসূচি:
১.মুদারিরসে তাবরিযি, মুহাম্মদ আলি, রাইহানাতুল আদাব, খণ্ড, ৫, পৃ. ১৯৬।
২.আগা বুযুর্গে তেহরানি, আজ জারুরাতু ইলা তাসনিফিশ শিয়া, খণ্ড ১, পৃ.১৫১।
৩. আগা বুযুর্গে তেহরানি, আজ জারুরাতু ইলা তাসনিফিশ শিয়া, খণ্ড ৯, পৃ. ৯৬৬।
৪. আতাই খোরাসানি, আলি আসগর, কারনমেহ আল্লামা মাজলিসি, পৃ. ১৪৫।
৫. মাহদাভি সাইয়্যেদ মুসলেহউদ্দিন, যিন্দেগিনামায়ে আল্লামা মাজলেসি, খণ্ড ১, পৃ. ৫৩।
৬. সোবহানি জাফর, মাওসুআতু তাবাকাতুল ফুকাহা, খণ্ড ১২, পৃ. ৩৫১।
৭. মাহদাভি সাইয়্যেদ মুসলেহউদ্দিন, যিন্দেগিনামায়ে আল্লামা মাজলেসি, খণ্ড ১, পৃ. ৫৫।
৮. মাহদাভি সাইয়্যেদ মুসলেহউদ্দিন, যিন্দেগিনামায়ে আল্লামা মাজলেসি, খণ্ড ১, পৃ. ৪২৬।
৯. পান্দনামায়ে আল্লামা মজলেসি পৃ. ৫।
১০. পান্দনামায়ে আল্লামা মজলেসি পৃ. ৫।
১১. জাযায়েরি, সৈয়দ নেমাতুল্লাহ, নাবেগিয়ে ফিকহ ওয়া হাদিস পৃ. ১৪৮।
১২. মাহদাভি সাইয়্যেদ মুসলেহউদ্দিন, যিন্দেগিনামায়ে আল্লামা মাজলেসি, খণ্ড ১, পৃ. ১৪৮।
১৩. মাহদাভি সাইয়্যেদ মুসলেহউদ্দিন, যিন্দেগিনামায়ে আল্লামা মাজলেসি, পৃ. ৬৬।
১৪. সোবহানি জাফর, মাওসুআতু তাবাকাতুল ফুকাহা, খণ্ড ১২, পৃ. ৩৫২।
১৫. আমিন, সৈয়দ মোহসেন, আয়ানুশ শিয়া, খণ্ড ৯, পৃ. ১৮৩-১৮৪।
১৬. মাহদাভি সাইয়্যেদ মুসলেহউদ্দিন, যিন্দেগিনামায়ে আল্লামা মাজলেসি, খণ্ড ২, পৃ. ৪।
১৭. মাহদাভি সাইয়্যেদ মুসলেহউদ্দিন, যিন্দেগিনামায়ে আল্লামা মাজলেসি, খণ্ড ২, পৃ. ১১৫।
চলবে…..