অনুবাদ: -ড. আবু উসামা মুহাররম
ইমাম সাদিক (আ.)-এর মহত্ত্বের কথা শুধু শিয়ারাই নয়, আহলে সুন্নাহ ও জামাতের অনেক আলেম ও বুজুর্গও এ বিষয়ে কথা বলেছেন। ইমাম হেদায়েত ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর বিজ্ঞতা, নৈতিকতা, মর্যাদা ও মহত্ত্ব সম্পর্কে সুন্নি সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ, বিখ্যাত ইসলামী পন্ডিত এবং মহান বিশেষজ্ঞরা অনেক কথা বলেছেন। এই নিবন্ধে আমরা সংক্ষেপে তাদের মন্তব্য ও স্বীকারোক্তি প্রকাশ করবো।
১. আবু হানিফা ও ইমাম সাদিক (আ.)
“নুমান বিন সাবিত বিন জুতি” যিনি “আবু হানিফা” (৮০-১৫০ হিজরি) নামে পরিচিত। হানাফি সম্প্রদায়ের নেতা যিনি ইমাম সাদিক (আঃ)-এর সমসাময়িক ছিলেন। ইমামের মহত্ত্ব সম্পর্কে ভাল মন্তব্য এবং স্বীকারোক্তি প্রদান করেছেন। তিনি সেই ইমাম সম্পর্কে বলেছেন: ما رایت افقه من جعفربن محمد و انه اعلم الامه “আমি আমার বন্ধু জাফর বিন মুহাম্মাদকে দেখেছি । তিনি সকলের শিক্ষক ছিলেন। জাফর বিন মুহাম্মাদ এর চেয়ে অধিক জ্ঞানী কোন ফকীহ আমি দেখিনি। তিনি এই উম্মতের সবচেয়ে জ্ঞানী।
২. মনসুর দেওয়ানকি এবং ইমাম সাদিক
ইমাম সাদিক (আ.) এর সময় শক্তিশালী আব্বাসীয় খলিফা মনসুর দেওয়ানকির রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল। তিনি সর্বদা বনু আলী এবং বনু ফাতিমার গৌরব ও মহিমা, বিশেষ করে ইমাম সাদিক (আ.) এর গৌরব ও মহিমায় মানষিক কষ্টে ভুগতেন। এই কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পেতে তিনি মাঝে মাঝে ইমাম সাদিক (আঃ)-এর সামনে দাঁড়াতে আবু হানিফাকে উস্কে দিতেন। মনসুর আব্বাসি তাকে যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলেম হিসেবে সম্মানিত করেন। যাতে তিনি ইমাম জাফর বিন মুহাম্মদ (সা.)-এর মহানুভবতাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হন।
এ প্রসঙ্গে আবু হানিফা বলেন:
“একদিন মনসুর দেওয়ানকি আমার কাছে একজনকে পাঠিয়ে বললেন, হে আবু হানিফা! লোকেরা জাফর বিন মুহাম্মদের প্রতি মুগ্ধ। তিনি জনগণের মধ্যে একটি বিস্তৃত সামাজিক সম্মান উপভোগ করেন। জাফর বিন মুহাম্মদের এ সম্মানকে ভুলন্ঠিত করতে এবং মানুষের দৃষ্টিতে তার বিশেষ মহত্ত্বকে হ্রাস করার জন্য আপনি কিছু জটিল এবং রহস্যময় বিষয় প্রস্তুত করুন। সঠিক সময়ে তাকে জিজ্ঞাসা করুন, যাতে জাফর বিন মুহাম্মদ উত্তর দিতে সক্ষম না হন। আপনি তাকে অপমান করবেন এতে লোকেরা তার প্রতি আর মুগ্ধ হবে না এবং তার থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে ফেলবে।
৩. আবু হানিফার প্রশ্ন
আবু হানিফা বলেন এই বিষয়ে আমি ৪০টি সমস্যা প্রস্তুত করলাম। যেদিন মনসুর হিরাতে ছিলেন এবং তিনি আমাকে ডেকেছিলেন, আমি তার কাছে গেলাম। আমি প্রবেশের সাথে সাথে জাফর বিন মুহাম্মাদকে তার ডান পাশে বসে থাকতে দেখলাম। যখন আমার দৃষ্টি তার উপর পড়ল, আমি তার মহিমা দেখে এতটাই মুগ্ধ হলাম যে, আমি তা বর্ণনা করতে অক্ষম। আমি যখন খলিফা মনসুর আব্বাসিকে দেখেছিলাম, তখন আমি সেই মহিমা অনুভব করিনি। যখন খলিফা মনসুর এর জাঁকজমক থাকা উচিত কারণ তার রাজনৈতিক সক্ষমতা রয়েছে। আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম এবং তাদের পাশে বসার অনুমতি চাইলাম। খলিফা ইশারা দিয়ে অনুমতি দিলেন এবং আমি তাদের পাশে বসলাম। তারপর মনসুর আব্বাসি জাফর বিন মুহাম্মদের দিকে তাকিয়ে বললেন:
আবু আবদুল্লাহ! ইনি হলেন আবু হানিফা। তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, আমি তাকে চিনি। তখন মনসুর আমার দিকে তাকিয়ে বললেনঃ আবু হানিফা! আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে আবু আবদুল্লাহ জাফর বিন মুহাম্মদকে জিজ্ঞাসা করুন। এবং তার সাথে আলোচনা করুন। আমি বললামঃ খুব ভালো। আমি সুযোগটা কাজে লাগালাম এবং একের পর এক যে চল্লিশটি বিষয় আগে থেকেই প্রস্তুত করে রেখেছিলাম তার সামনে উপস্থাপন করলাম। প্রতিটি বিষয় বর্ণনা করার পর ইমাম সাদিক (আঃ) জবাবে বলতেনঃ
এ বিষয়ে আপনার মতামত অমুক, এ বিষয়ে মদীনার আলেমদের অভিমত এই এবং আমাদের অভিমতও এই। কোন কোন বিষয়ে তিনি আমাদের মতের সাথে একমত এবং কোন কোন বিষয়ে তিনি মদীনার আলেমদের মতামতের সাথে একমত পোষণ করেছেন এবং কখনো কখনো উভয় মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করে তৃতীয় মত বেছে নিয়ে নিজেই তা প্রকাশ করেছেন।
আমি তার সাথে একের পর এক বেছে নেওয়া চল্লিশটি কঠিন প্রশ্ন তার সামনে উপস্থাপন করলাম এবং জাফর বিন মুহাম্মাদ সেগুলিকে সম্পূর্ণ দৃঢ়তার সাথে এবং বিশেষ দক্ষতার সাথে যেভাবে বলা হয়েছিল তার উত্তর দিলেন।।
তারপর আবু হানিফা বলেন: ان اعلم الناس اعلمهم باختلاف الناس “আলম প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিরা তারাই যারা বৈজ্ঞানিক বিষয়ে পন্ডিতদের বিভিন্ন মতামত এবং তত্ত্ব দ্বারা বেষ্টিত এবং আয়ত্ত।” এবং যেহেতু জাফর বিন মুহাম্মদের এই পরিবেশ রয়েছে, তাই তিনি ভবিষ্যতের সবচেয়ে জ্ঞানী।”
৪- আবু হানিফা ও ইমামের জ্ঞানের মহত্ত্ব
তিনি ইমাম সাদিক (আ.)-এর মহত্ত্ব সম্পর্কে আরও বলেন:
لولا جعفربن محمد ما علم الناس مناسک حجهم জাফর বিন মুহাম্মদ না থাকলে মানুষ হজের নিয়ম-কানুন জানত না।
৫. মালিক বিন আনাস এবং ইমাম জাফর সাদিক (আ.)
মালিক বিন আনাস (৯৭-১৭৯ হি.) হলেন আহলে সুন্নাহ ও জামায়াতের চার নেতার একজন এবং মালিকি সম্প্রদায়ের প্রধান। যিনি কিছু সময়ের জন্য ইমাম সাদিক (আঃ)-এর শিষ্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। তিনি ইমাম সাদিক (আঃ)-এর মহত্ত্ব এবং বিজ্ঞতা ও নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে বলেন:
ولقد کنت آتی جعفربن محمد و کان کثیرالمزاح و التبسم، فاذاذکر عنده النبی صلیاللهعلیهوآلهوسلّم اخضر و اصفر، و لقد اختلفت الیه زمانا وماکنت اراه الا علی ثلاث خصال: اما مصلیا و اما صائما وامایقراء القرآن. و ما راءیته قط یحدث عن رسول الله صلیاللهعلیهوآلهوسلّم الا علی الطهاره و لا یتکلم فی مالا یعنیه و کان من العلماءالزهاد الذین یخشون الله و ماراءیته قط الا یخرج الوساده من تحته و یجعلهاتحتی
“কিছু সময় ধরে আমি জাফর বিন মুহাম্মদের কাছে আসতাম। তিনি একজন রসিক মানুষ ছিলেন। তার ঠোঁটে সব সময় মৃদু হাসি দেখা যেত। ইসলামের প্রিয় রসূল, আল্লাহ্র বরকতময় নামটি যখন তাঁর উপস্থিতিতে উল্লেখ করা হত, তখন জাফর বিন মুহাম্মদের মুখের রঙ সবুজ এবং তারপর হলুদ হয়ে যেত। যে সময় আমি মহানবী (সা.)-এর গৃহে গিয়েছিলাম, আমি তাঁকে সালাত, রোজা বা কুরআন তিলাওয়াত এই তিনটি বৈশিষ্ট্য ও অবস্থার কোনো একটিতে দেখেছি। আমি দেখিনি যে জাফর বিন মুহাম্মাদ আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, অযু ও পবিত্রতা ছাড়াই। আমি তাকে ফালতু ও বাড়াবাড়ি কিছু বলতে দেখিনি। তিনি ছিলেন তপস্বী প-িতদের একজন যারা আল্লাহকে ভয় করতেন। আল্লাহর ভয় তার সর্বত্র ছিল। কখনও এমন হয়নি যে আমি তাঁর উপস্থিতিতে সম্মানিত হব, তবে তাঁর পায়ের নীচে যে মাদুরটি বিছিয়ে ছিল, তিনি তা তাঁর পায়ের নিচ থেকে সরিয়ে আমার পায়ের নীচে বিছিয়ে দিতেন।”
তথ্যসূত্র:
১. সিয়ার আলমিন নুবালা, শামসুদ্দিন আযযাহাবি, খ- ৬, পৃ. ২৫৭।
২. তারিখুল কাবির, খ- ২, পৃ. ১৯৮-১৯৮, পৃ. ২১৮৩।
৩. সিয়ার আলমিন নুবালা, শামসুদ্দিন আযযাহাবি, খ- ৬, পৃ. ২৫৮।
৪. বিহারুল আনওয়ার, আল্লামেহ মাজলেসি, খ- ৪৭, পৃ. ২১৭।
৫. শেখ সাদুক, মান লা ইয়াহযুরুহল ফকিহ, তাবায়ে কওম, নাশর-ইসলামি, খ- ২, পৃ. ৫১৯।
৬. সিয়ার আলমিন নুবালা, শামসুদ্দিন আযযাহাবি, খ- ৬, পৃ. ২৫৬।
৭. ইবনে তাইমিয়া, আত্তাওয়াসসুলু ওয়াল ওয়াসিলাহ, পৃ. ৫২।
৮. জাফরিয়ান, হায়াতে ফিকরি ওয়া সিয়াসি ইমামানে শিয়া, পৃ. ৩২৭।
চলবে…..