অনুবাদ: ড. আবু উসামা মুহাররম
৬. ইমাম মালিক (রহ.) এর দৃষ্টিতে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)এর আধ্যাত্মিকতা:
মালিক বিন আনাস ইমাম সাদিক (আ.)-এর ইবাদত এবং আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে বলেন: ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এর সাথে আমরা মক্কার উদ্দেশ্যে এবং হজের আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য মদিনা ত্যাগ করি। আমরা পৌঁছে গেলাম শাজরা মসজিদে; যেটি মদিনাবাসীদের জন্য মিকাত। আমরা ইহরামের কাপড় পরিধান করলাম। ইহরামের কাপড় পরিধান করার সময় তালবিয়্যাহ বলা আবশ্যক। অন্যরা যথারীতি এ জিকির শুরু করেন। মালিক বলেন, আমি ইমাম সাদিক (আ.)-কে লক্ষ্য করলাম এবং দেখলাম যে ইমাম সাদিক (আ.)-এর অবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে। ইমাম সাদিক (আ.) কথা বলতে চান, কিন্তু তার চেহারার রং বদলে গেছে। আবেগ ইমামকে স্পর্শ করেছে এবং গলার আওয়াজ ভেঙ্গে গেছে এবং তিনি তার স্নায়ুর নিয়ন্ত্রণ এতটাই হারিয়ে ফেলেছেন যে তিনি যেন বাহন থেকে নিচে পড়ে যাবেন। ইমাম মালিক (রহ.) বলেন, আমি এগিয়ে এসে বললাম: হে নবির সন্তান! এ যিকির করা ছাড়া কোন উপায় নেই। যে কোনো উপায়ে এই যিকির করা উচিত। হযরত বললেন-
یابن ابی عامر! کیف اجسر ان اقول لبیک اللهم لبیک و اخشی ان یقول عزوجل لا لبیک و لا سعدیک
হে আবু আমেরের পুত্র! আমি কিভাবে সাহস করি এবং নিজেকে বলার অনুমতি দিই যে বলি লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। (অর্থ হে প্রভু! আপনি আমাকে ডাকছেন আমি তার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে সাড়া দিয়েছি এবং আমি তা করতে সর্বদা প্রস্তুত)। আমি ভয় পাই, যদি আমার আল্লাহ আমাকে বলেন, না তোমাকে ডাকিনি, আর তোমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে না। সে সময় আমি কী করবো?
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)এর ফজিলত ও মহত্ত
ইমাম সাদিক (আ.) এর ফজিলত ও মহত্ত¡ সম্পর্কে অন্য একটি বক্তব্যে ইমাম মালিক (রহ.) বলেন:
ما راءت عین و لا سمعت اذن و لا خطر علی قلب بشر افضل من جعفربن محمد
‘কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শোনেনি এবং জাফর বিন মুহাম্মাদ (রা.)-এর চেয়ে বেশি গুণী কোন ব্যাক্তি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারেনি।’
৮. ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে ইমাম মালিকের হাদিস বর্ণনা
মালিক বিন আনাস সম্পর্কে বলা হয়েছে-
و کان مالک بن انس یستمع من جعفربن محمد و کثیرا مایذکر من سماعه عنه و ربما قال حدثنی الثقه یعنیه
মালিক বিন আনাস জাফর বিন মুহাম্মাদ (আ.) থেকে হাদিস শুনতেন এবং তিনি তার কাছ থেকে যা শুনেছেন তার অনেক কিছু প্রকাশ করতেন এবং তিনি সম্ভবত বলতেন: এই হাদিসটি আমার কাছে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, যার অর্থ (বিশ্বস্ত ব্যক্তি) জাফর বিন মুহাম্মদ।
৯ .মালিক সম্পর্কে হুসাইন বিন ইয়াজিদ নফলির বক্তব্য
سمعت مالک بن انس الفقیه یقول والله ما راءت عینی افضل من جعفربن محمد علیهالسّلام زهدا و فضلا و عباده و ورعا. و کنت اقصده فیکرمنی و یقبل علی فقلت له یوما یاابن رسول الله ما ثواب من صام یوما من رجب ایمانا و احتسابا فقال (و کان والله اذا قال صدق) حدثنی ابیه عن جده قال قال رسول الله صلیاللهعلیهوآلهوسلّم من صام یوما من رجب ایمانا و احتسابا غفرله فقلت له یا ابن رسول الله فی ثواب من صام یوما من شعبان فقال حدثنی ابی عن ابیه عن جده قال قال رسول الله صلیاللهعلیهوآلهوسلّم من صام یوما من شعبان ایمانا و احتساباغفرله
আমি মালিক ইবনু আনাস ফকিহ (রা.) থেকে শুনেছি যে, তিনি বলেছেনঃ আল্লাহর কসম! তপস্যা, জ্ঞান, পুণ্য, ইবাদত ও তাকওয়ার দিক থেকে জাফর বিন মুহাম্মদ (আ.)এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন ব্যক্তিকে আমার চোখ দেখেনি। আমি তাঁর কাছে যেতা। তিনি আমাকে উন্মুক্ত হৃদয়ে গ্রহণ করতেন এবং সমাদর করতেন। একদিন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, হে নবির সন্তান! রজব মাসে রোজা রাখার সওয়াব কী? জবাবে তিনি নবি (সা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেন। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, তিনি যখনই কারো কাছ থেকে কিছু বর্ণনা করেন, তিনি তা সঠিকভাবে বর্ণনা করেন। তিনি উত্তরে বললেনঃ আমার পিতা তার পিতা থেকে, তার দাদা থেকে এবং নবি (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রজব মাসে রোযা রাখার সওয়াব হলো রোযাদারের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। অতঃপর আমি শা’বান মাসে রোজা রাখার ব্যাপারে এ প্রশ্ন করলেও তিনি একই উত্তর দেন।
১০. ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এবং ইবনে শবরমাহ
আবদুল্লাহ বিন শবরমা বিন তুফাইল যবিবি যিনি “ইবনে শবরমা” নামে পরিচিত (৭২ জন্ম-১৪৪ মৃত্যু হিঃ), কুফার বিখ্যাত বিচারক ও আইনবিদ ছিলেন, তিনি ইমাম জাফর সাদিক (আ.) সম্পর্কে বলেছেন:
ماذکرت حدیثا سمعته من جعفربن محمد علیهالسّلام الا کادان یتصرع له قلبی سمعته یقول حدثنی ابی عن جدی عن رسول الله
তিনি বলেন: আমি জাফর বিন মুহাম্মাদ থেকে একটি হাদিস শুনেছি বলে মনে করি না। তবে এটি আমার আত্মাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। আমি তাকে বলতে শুনেছি যে, আমি আমার পিতা থেকে, আমার দাদা থেকে এবং আল্লাহর রসূল থেকে হাদিস বর্ণনা করছি।
হামু বললেন:
و اقسم بالله ما کذب علی ابیه و لا کذب ابوه علی جده و لا کذب جده علی رسول الله
খোদার কসম! জাফর বিন মুহাম্মদ হাদিস বর্ণনা করার ক্ষেত্রে তার পিতা সম্পর্কে মিথ্যা বলেননি, তার পিতা তার পিতামহ সম্পর্কে মিথ্যা বলেননি, তিনি নবির সম্পর্কে মিথ্যা বলেননি। আল্লাহ তার উপর রহমত বর্ষণ করুন। অর্থাৎ জাফর বিন মুহাম্মদের রেওয়ায়েতের শৃঙ্খলে যা আছে তা সম্পূর্ণ সত্য।
১১. ইবনে আবি লায়লা’র দৃষ্টিতে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)
শেখ সাদুক একটি রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন যে, মুহাম্মদ বিন আবদুর রহমান “ইবনে আবি লাইলা” (৭৪-১৪৮ হিজরি) নামে পরিচিত। একজন ফকিহ, মুহাদ্দিস, মুফতি এবং কুফার বিচারক ছিলেন, তিনি ইমাম সাদিক (আ.)-এর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন? ইবনে আবি লাইলা তার সকল প্রশ্নের উত্তর শুনে ইমামকে সম্বোধন করে বললেনঃ
اشهد انکم حجج الله علی خلقه
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর বান্দাদের উপর তার হুজ্জাত বা প্রমাণ।
১২. আমর বিন ওবায়েদ মু‘তাযিলি’র দৃষ্টিতে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)
আমরু বিন উবাইদ মুতাযিলি ইমাম জাফর বিন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে দেখা করতে গেলেন এবং তিনি এসে এই আয়াতটি পাঠ করলেন:
الذین یجتنبون کبائرالاثم و الفواحش
তারপর চুপ হয়ে গেলেন। ইমাম সাদিক (আ.) বললেনঃ তুমি চুপ কেন? তিনি বললেনঃ আমি চেয়েছিলাম আপনি আমাকে কুরআন থেকে একের পর এক বড় গুনাহের কথা বলবেন। হযরত শুরু করলেন এবং একের পর এক সবচেয়ে বড় গুনাহের কথা উল্লেখ করলেন। এটাই যথেষ্ট যে উত্তম ও মহান ইমাম আমর বিন উবায়েদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, আমর বিন উবায়েদ পরিশেষে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কেঁদেছিলেন এবং চিৎকার করে বলেছিলেন:
هلک من قال براءیه و نازعکم فی الفضل و العلوم
যে তার নিজস্ব মতের কথা বলে যে জ্ঞান ও বিজ্ঞতা নিয়ে আপনার সাথে বিবাদ করবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে।
১৩. জাহিয বসরি’র দৃষ্টিতে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)
“আবু বাহার জাহেয বসরি (১৬০-২৫৫ হিজরি), যিনি তৃতীয় শতাব্দীর অন্যতম বিখ্যাত আলেম ছিলেন, তিনি ইমাম জাফর সাদিক (আ.) সম্পর্কে বলেছেন:
محمدالذی ملاالدنیا علمه و فقهه و یقال ان اباحنیفه من تلامذته و کذلک سفیان الثوری و حسبک بهما فی هذاالباب.
জাফর বিন মুহাম্মাদ সেই ব্যক্তি ছিলেন যার জ্ঞান এবং আইনশাস্ত্রে পরিপূর্ণ ছিল এবং বলা হয় যে আবু হানিফা এবং সুফিয়ান ছাওরি তার ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাঁর জ্ঞানের মাহাত্ম্যের জন্য এটাই যথেষ্ট।
গ্রন্থসূচি:
১. আমালি, শেখ সাদুক, পৃ. ২৩৪।
২. শহিদ মোতাহারি, সাইরি দার সিরায়ে আইম্মায়ে আতহার (আ.), পৃ. ১৪৯।
৩. শারহুল আখবার ফি ফাযাইলিল আইম্মাতুল আতহার, খন্ড ৩, পৃ. ২৯৯, ১২০৩।
৪. আমালি, শেখ সাদুক, পৃ. ৪৩৫-৪৩৬।
৫. আমালি, শেখ সাদুক, পৃ. ৫০৭।
৬. আমালি, শেখ সাদুক, পৃ. ৫০৭ ।
৭. মান লা ইহজারুহুল ফকিহ, খন্ড ১, পৃ. ১৮৮।
৮. সূরা নাজম, ৫৩, আয়াত ৩২।
৯. কাফি, শেখ কিলিনি, খন্ড ভ২, পৃ. ২৮৭-২৮৫।
১০. রাসাইলে জাহিয, পৃ. ১০৬।
১১. হায়াতে ফিকরি ওয়া সিয়াসি ইমামানে শিয়া, পৃ. ৩২৮।
চলবে……