হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন আলী নওয়াজ খান
সারাটি জীবন ধরে ইসলামী উম্মাহর ইহ-পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর এ সংগ্রামের ফলে ১৯৭৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ইরানের বুকে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ী হয় এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় । তাই ইরানের বিপ্লবী মুসলিম জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে নেতৃত্বে বরণ করে নেয়। এ বিপ্লব বিজয়ী হবার পরে ও ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ইসলামী বিপ্লবের হেফাযত, বিস্তার এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মুক্তি ও কল্যাণের জন্য কথা, লিখা ও চিন্তার মাধ্যমে সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করে গেছেন। এমনকি তাঁর ইন্তেকালের পরে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ বিশেষত ইরানের বিপ্লবী জনগণ কিভাবে পথ চলবে সে ব্যাপারে পথনির্দেশ দানের জন্য তিনি তাঁর অন্তিম বাণী রেখে গেছেন। আর অন্তিম বাণীসহ তাঁর এ সমগ্র ততপরতারই একটি মাত্র লক্ষ্য ছিল, তা হচ্ছে, মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একজন মুমিন বান্দার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে প্রশান্ত চিত্তে তাঁর সমীপে হাজির হওয়া। আরেফে রব্বানী হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) প্রতিটি মুহূর্তেই খোদার দিদারের জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত ছিলেন। তাই ইন্তেকালের সাড়ে ছয় বছর পূর্বে তিনি তাঁর অন্তিমবাণী রচনা করেন এবং রচনার সমাপ্তিতে হিজরি ১৪০৩ সালের পহেলা জমদিউল আওয়াল (মোতাবেক ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩) তারিখে স্বহস্তে লিখিত এ বাণীতে সমাপ্তি স্বাক্ষর ও তারিখ লিপিবদ্ধ করেন। এ অন্তিমবাণীর প্রতিটি পৃষ্ঠার শেষে তিনি স্বাক্ষর করেন এবং তাঁর সীলমোহর সহকারে তা ধর্মীয় নগরী মাশহাদে আহলে বাইতের অষ্টম নিষ্পাপ ইমাম হযরত রেযা (আ.)-এর মাযারে হেফাযতের ব্যবস্থা করা হয়। এর একটি অনুলিপি তিনি নিজের কাছে সংরক্ষণ করেন। বছর দুই পূর্বে তিনি তাঁর এ অন্তিমবাণীর মূল কপি মাশহাদ থেকে আনিয়ে নেন এবং কিছুটা সংশাধন করে পুনরায় সীলমোহর করে মাশহাদে পাঠিয়ে দেন।
হযরত ইমামের ইন্তেকালের পরদিন ৪ঠা জুন (১৯৮৯) সকাল ৯টা ১০ মিনিটের সময় মজলিশে শুরায়ে ইসলামী ভবনে অনুষ্ঠিত নেতা নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যগণ, মজলিশে শুরায়ে ইসলামীর সদস্যগণ, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যগণ এবং দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিত্বের যৌথ সমাবেশে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ততকালীন প্রেসিডেন্ট (বর্তমান রাহবার) হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী কর্তৃক এ অসিয়তনামা পঠিত হয়। এরপর জাতীয় প্রচারমাধ্যমসমূহে তা প্রচারিত হয়।
হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী কর্তৃক হযরত ইমামের অন্তিম বাণীটি মরহুমের সংরক্ষিত অনুলিপি থেকে পঠিত হয়; পরে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাশহাদে সংরক্ষিত মূল কপিটি খোলা হয়। হযরত ইমামের স্বহস্তলিখিত এ অসিয়তনামার মূল অংশটি ২৯ পৃষ্ঠা, ৬ পৃষ্ঠা ভূমিকা ও ১ পৃষ্ঠা পরিশিষ্টসহ মোট ৩৬ পৃষ্ঠা।
হযরত ইমামের অসিয়তনামার পূর্ণ বিবরণ
নবীপাক (সা.) বলেন : ‘আমি তোমাদের কাছে অতীব মূল্যবান ও সম্মানিত দু’টি জিনিস (সাকালাইন) রেখে যাচ্ছি : আল্লাহর কিতাব এবং আমার আহলে বাইত। অতঃপর নিশ্চয়ই এ দুটি জিনিস হাউজে (কাউসারে) আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।’-হাদীসে সাকালাইন১
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের, যিনি সকল কিছু থেকে পবিত্র। হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের উপর অবারিত শান্তি বর্ষণ কর, যাঁরা তোমার সৌন্দর্য ও মহিমার বহিঃপ্রকাশ। তাঁরা তোমার আসমানি গ্রন্থের গুপ্ত রহস্যের ভাণ্ডার। এটা এমন এক গ্রন্থ যার মাঝে তোমার সকল পবিত্র নাম, এমনকি ইসমে মুন্তাসার (ইস্মে আযম) সহ একত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, যে ইসমে মুন্তাসার-এর প্রকৃত তাৎপর্য সম্বন্ধে তুমি ব্যতীত আর কেউ অবহিত নয়। আর অপবিত্র বৃক্ষের মূল যালেমদের প্রতি তোমার অভিশাপ বর্ষিত হোক।
অতঃপর এই ‘দুই পবিত্র আমানত’ (সাকালাইন) সম্পর্কে সংক্ষেপে আপনাদের কিছু অবহিত করা আমি যুক্তিযুক্ত মনে করছি। এদের অলৌকিক, আধ্যাত্মিক বা মরমি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। যেখানে আমার মতো খালকের লেখনি কূল মখলুকের সেই সুবিশাল সাম্রাজ্যে এগিয়ে যেতে অক্ষম, যা দুনিয়া থেকে সপ্ত আসমান এবং সেখান থেকে সুমহান খোদায়ী অস্তিত্ব অবধি পরিব্যাপ্ত। যার ধারণা আমার এবং আপনার বোধগম্য নয়, বরং সাধ্যেরও বাইরে। যদিও এটাকে অসম্ভব বলছি না। সর্বোত্তম আমানত ‘আল কোরআন’ ও তার পরের মর্যাদায় ‘আহলে বাইত’ বস্তুতপক্ষে এই ‘আহলে বাইত’ সমগ্র অস্তিত্বশীল সত্তার মাঝে সর্বোত্তম আমানত ছাড়া আর কিছুই নয় যা ‘পরম শ্রেষ্ঠতম’ (আকবরই মতলুক)। সর্বোত্তম আমানতদ্বয়ের প্রকৃতি ও গুণাবলির প্রতি অবহেলা ও এর থেকে দূরে থাকার কারণে মানবজাতির পরিণতি কি হয়েছে তার কোন ফিরিস্তি আমি দিচ্ছি না কিংবা আল্লাহর দুশমনদের এবং কুচক্রী শাসকদের তরফ থেকে এই দুই আমানতের প্রতি কী আচরণ করা হয়েছে তারও কোন হিসাব আমি তুলে ধরছি না। এদের সংখ্যা এতো বেশি যে, সময়ের অভাবে ও সীমিত জ্ঞানের দ্বারা তার সম্যক অনুধাবন আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আমি শুধু পবিত্র এ দুই আমানতের ভাগ্যে কী ঘটেছে তারই খানিকটা বক্তব্য তুলে ধরা উপযুক্ত মনে করছি।
‘এই দুটি কখনো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না আমার সাথে হাউজে (কাওসার) মিলিত না হওয়া পর্যন্ত’- কথাটি দ্বারা সম্ভবত এটাই ইংগিত বহন করে যে, নবী করিম (সা.)-এর তিরোধানের বেলায়ও ঘটেছে তাই। একটিকে অমান্য করা মানে অপরটিকেও অমান্য করা ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না হাউজে কাওসারে, রাসূলুল্লাহর সাথে উভয়ের মিলন ঘটে। এ ‘হাউজ’ বলতে কি একত্বের মাঝে একাধিকত্বের সম্মিলন, না বারিবিন্দুসমূহের মহাসমুদ্রে বিলীন হওয়ার মতো অবস্থা, না অন্য কিছু তা সাধারণ মানববোধের অতীত বিষয়! এটাও প্রণিধানযোগ্য যে, আল্লাহর রাসূলের দুই আমানতের প্রতি অত্যাচারীদের পক্ষ থেকে যে অন্যায় করা হয়েছে ঠিক তদ্রূপ অবিচার করা হয়েছে সাধারণ মুসলিম জাতির (উম্মতে ইসলামীয়া) প্রতি, তথা গোটা মানবজাতির প্রতি, যার বর্ণনা দানে এই ক্ষুদ্র লেখনি অপারগ।
এটা উল্লেখ করা অত্যাবশ্যক যে, ‘হাদীসে সাকালাইন’ রাসূলে পাক (সা.) থেকে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে (মুতাওয়াতির) বর্ণিত হয়ে এসেছে। এই মহান হাদীস সমগ্র মানবজাতির জন্য বিশেষভাবে মুসলমানদের সকল মাযহাবের জন্য এক অকাট্য দলিল (হুজ্জাতে কাতে)। সব মুসলমানের ক্ষেত্রেই এই দলিল প্রযোজ্য। অজ্ঞ-মূর্খদের এতে ওজর থাকলেও মাযহাবসমূহের আলেমদের কোন অজুহাতই নেই।
এখন দেখা যাক সুমহান খোদায়ী নেয়ামত এই আল্লাহর কিতাব এবং ইসলামের নবী (সা.)-এর রেখে যাওয়া পবিত্র আমানতের ভাগ্যে কী ঘটেছে। সেই দুঃখজনক ঘটনাবলি শুরু হয়েছিল ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর থেকেই- যার স্মরণে অবশ্যই রক্তাশ্রু ঝরা উচিত। কোরআনবিরোধী শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থে স্বার্থান্বেষী লোকজন ও যুলুমবাজের দল কোরআনকে উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল। কুরআনের প্রকৃত ব্যাখ্যাকারীদেরকে, শিক্ষিত ও জ্ঞানীদেরকে, যাঁরা সরাসরি রাসূলে পাক (সা.)-এর কাছ থেকে কুরঅআনের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা লাভ করেছিলেন তাঁদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন অজুহাত তুলে দৃশ্যান্তরালে নিক্ষেপ করা হয়েছিল; যাঁদের কানে অনুরণিত হচ্ছিল বারবার সেই নবীবাণী- ‘আমি তোমাদের কাছে অতীব মহান ও মূল্যবান দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি।’
প্রকৃতপক্ষে যে কোরআন মানবজাতির জন্য নিয়ে এসেছে সর্বোতকৃষ্ট জাগতিক ও আধ্যাত্মিক পথনির্দেশনা সেইদিন পর্যন্ত যেদিন হাউজে কাওসারে নবীর সাথে ঘটবে মিলন, সেই কোরআনুল কারিমকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। পবিত্র কিতাবের অন্যতম আদর্শ, সঠিক খোদায়ী ইনসাফভিত্তিক হুকুমতকে তারা বাতিল ঘোষণা করে এবং আল্লাহর দ্বীন, তাঁর পবিত্র কিতাব ও সুন্নাহ থেকে এত বেশি বিভ্রান্তিকর ধারণার জন্ম দেয় যে, তা বর্ণনা করতে রীতিমত হতবাক হতে হয়। আর যতই এই ভ্রষ্ট কাঠামোটি এগিয়ে যেতে লাগল ততই বক্রতা ও বিচ্যুতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে লাগল। আর তা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হলো যে, পাক কোরআন- যে পবিত্র গ্রন্থ মহানবী মুস্তাফা (সা.)-এর ওপর পূর্ণাঙ্গভাবে ও ওহীর সমাপ্তি হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিল দুনিয়ার মানবজাতিকে সমুন্নত করতে, মুসলমানদের ঐক্য, এমনকি গোটা মানবজাতির ঐক্যের উতস হিসেবে, যাতে মানবতার যথার্থ উন্নয়ন সাধিত হয়, যার আগমন শয়তান এবং তাগুতীদের হাত থেকে আল্লাহ পাকের পবিত্র নামোদ্ভূত জ্ঞানের সৃষ্টি মানবসন্তানদের (ওয়ালীদা-ইলমুল আসমা) রক্ষা করতে, ন্যায়বিচার (আদল) এবং সাম্য (ক্বিস্ত) প্রতিষ্ঠা করতে, হুকুমতকে আল্লাহর মাসুম বন্ধুদের (তাঁদের উপর দরুদ ও সালাম পৃথিবীর আদিকাল হতে তার সমাপ্তিকাল পর্যন্ত) হাতে সমর্পণ করতে, যেন তাঁরা মানবতার স্বার্থে উতসর্গকৃত ব্যক্তিদের হাতে অর্পণ করতে পারেন, কিন্তু এই কোরআনকে এমনভাবে ময়দান থেকে বিদায় দেয়া হয়েছিল যে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল যেন মানবতার পথনির্দেশনায় এর কোন ভূমিকাই নেই। এই বিচ্যুতি এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে, স্বৈরাচারী সরকারগুলো এর অপব্যবহার শুরু করেছিল। পরম প্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দুশমন এবং যালেমদের শাসনকে বৈধ রূপ দেবার জন্য এবং সমাজে অবিচার ও দুর্নীতি প্রতিষ্ঠার (হুকুমতে গায়ের) জন্য অত্যাচারী শাসকদের চেয়ে নিকৃষ্ট দুর্নীতিপরায়ণ আলেমদের (আখুন্দ) দ্বারাই কোরআনের অপব্যবহার হয়েছিল বেশি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, কুচক্রী ও মূর্খ বন্ধুদের কাছে এই ভাগ্যনির্ধারক কিতাব আল-কোরআন এর কবরস্থান আর দাফন অনুষ্ঠানগুলোতে আবৃত্তি ছাড়া যেন অন্য কোন ভূমিকাই আর থাকল না। যে কিতাব হওয়ার কথা ছিল মুসলমানদের তথা সমগ্র মানবজাতির একতার উতস এবং তাদের এক জীবন্ত নিদের্শনা, অথচ হয়ে গেল অনৈক্য আর বিচ্ছিন্নতার উতস। কিংবা কোরআনকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলা হলো যে, কেউ যখনই ইসলামী সরকার বা ইসলামী রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলত অর্থাত সেই সুমহান ইসলাম- যা মহানবী (সা.)-এর জীবন এবং কোরআন-সুন্নাহর বিষয়বস্তুর পূর্ণাঙ্গ রূপ, তখনই ‘রাজনৈতিক আলেম’ (আখুন্দে সিয়াসী) তথা পরিপূর্ণ ধর্মচ্যুত আলেম নামে আখ্যয়িত করা হত। যেন ইসলামী রাজনীতির কথা বলে সে কোন মহা-অপরাধ করে ফেলেছে। এ অবস্থা বর্তমানকালেও বিদ্যমান।
অতি সম্প্রতি পাক কোরআনের সঠিক পরিচয় মুছে ফেলার লক্ষ্যে এবং বৃহত শক্তিগুলোর স্বার্থ হাছিলের উদ্দেশ্যে শয়তান শক্তিগুলো ইসলামের প্রতি দায়িত্বশীল বলে মিথ্যা দাবিদার, পথভ্রষ্ট মুসলিম সরকারগুলোর মাধ্যমে চোখধাঁধাঁনো লিপি-চাতুর্যের সাহায্যে রঙচঙে কোরআন শরীফ প্রকাশ করে। লোকজনকে মিথ্যার মোহজালে বিভ্রান্ত করার মানসে সর্বত্র এই ধরনের কোরআন শরীফ ছড়িয়ে দেয়। এটা হলো কোরআনকে জীবনপট থেকে সরিয়ে ফেলার অপকৌশল। আমরা সকলেই নিজ চোখে দেখেছি, মুহাম্মাদ রেযা খান পাহলভী (শাহ) কর্তৃক মুদ্রিত কোরআন কিভাবে কতিপয় মৌলভীসহ লোকজনকে প্রতারণা করেছে। ইসলামের লক্ষ্যসমূহ সম্পর্কে অজ্ঞ এসব লোকজন শাহের গুণগানে ছিল মুখর। আমরা আরো দেখেছি, প্রতিবছর কিভাবে বাদশাহ ফাহদ জনগণের বিপুল পরিমাণ সম্পদের অপচয় করে এই ধরনের কোরআন শরীফ অজস্র পরিমাণে প্রকাশ করে থাকে। এর মাধ্যমে সে কোরআনবিরোধী ওয়াহাবী মতবাদ (যা কুসংস্কারপূর্ণ ও ভিত্তিহীন একটা জঘন্য মতবাদ) এর ঘৃণ্য প্রচারণায় লিপ্ত। এর ফলে অজ্ঞ ও নিরীহ জনসাধারণ ও বিভিন্ন জাতি বৃহত শক্তিগুলোর প্রতি আকর্ষিত হয়। আর এই অপকৌশল থেকে ফায়দা হাছিল করে তা তারা প্রিয় ইসলাম এবং পবিত্র কোরআনের ধ্বংসের কাজে নিয়োজিত করে।
আমরা গর্ব অনুভব করি এই জন্য যে, আমরা মহান ইসলাম ও কোরআনের প্রতি আত্মোতসর্গকৃত জাতি। গৌরবান্বিত এই জন্য যে, আমরা এমন একটি মাযহাবের অনুসারী যা কোরআনী সত্যকে কালের সমাধি খুঁড়ে উন্মোচনে ততপর, সে সত্য মুসলমানের ঐক্য, এমনকি মানবতার ঐক্যের কথা বলে। যে সত্য সকল প্রকার বন্ধন ও শৃঙ্খল থেকে মানবতার মুক্তির ব্যবস্থাপনা- যে বন্ধন ও শৃঙ্খলসমূহ মানবতার হাত-পা, অন্তর ও বিবেকের টুটি চেপে ধরেছে আর তাকে (মানবতাকে) ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংস ও তাগুতীদের (মিথ্যাশ্রয়ীদের) দাসত্ব ও উপাসনার দিকে।
আল্লাহ তাআলার অনুশাসনের উপর ভিত্তি করে নবীপাক (সা.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সে পবিত্র মাযহাবের অনুসারী হয়ে আমরা আজ গর্বিত এবং আমরা এ জন্যও গর্বিত যে, বিশ্বাসীদের মহান নেতা আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) ইবনে আবি তালিব-সকল শৃঙ্খল থেকে মুক্ত মহান সেই বান্দা-যাঁর উপর মানুষকে দাসত্বের সকল প্রকার শৃঙ্খল থেকে মক্ত করার ভার অর্পিত।
আমরা গৌরবান্বিত যে, নাহজুল বালাগাহ্ নামের মহাগ্রন্থটি আমাদের নিষ্পাপ (মাসুম) ইমাম [হযরত আলী (আ.)] থেকে- যে নাহজুল বালাগাহ হচ্ছে কোরআনের পর মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ও জাগতিক জীবনব্যবস্থা ও মানবজাতির মুক্তির সর্বোতকৃষ্ট গ্রন্থ। যে গ্রন্থের আধ্যাত্মিক ও প্রশাসনিক অনুশাসন ও নীতিমালাগুলো হচ্ছে পরম মুক্তির শ্রেষ্ঠ পথ।
আমরা এজন্য গর্বিত যে, আমদের মাসুম ইমামগণ হচ্ছেন হযরত আলী বিন আবি তালিব (আ.) থেকে মানবজাতির ত্রাণকর্তা যামানার সর্দার হযরত মাহদী (আ.) পর্যন্ত যিনি সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাকের কুদরতে জীবিত (আছেন) ও আমদের সকল কার্যকলাপ অদৃশ্য থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন।
আমরা এজন্যও গর্ব অনুভব করছি যে, প্রাণসঞ্জীবনী দু’আ বা প্রার্থনাসমূহ যা ‘কোরআনে সায়েদ’ অর্থাত ‘ঊর্ধ্বগামী কোরআন’ নামে পরিচিত তা আমাদের ইমামদেরই রচিত। ইমামদের শা’বানীয়া মুনাজাত, ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আরাফাতের দু’আ, আলে মুহাম্মাদ (সা.)-এর ধর্মীয় বন্দনা বা ‘যাবুর-ই আলে মুহাম্মাদ’ নামে প্রসিদ্ধ ‘সাহীফা-ই-সাজ্জাদিয়াহ’, হযরত ফাতেমা যাহরা মারযীয়ার প্রতি আল্লাহপাকের তরফ থেকে ইলহামকৃত ‘সাহীফা-ই ফাতেমীয়া’- এগুলো সবই হচ্ছে আমাদের।
পঞ্চম ইমাম বাকের-উল উলুম (আ.)-কে নিয়েও আমরা গর্বিত। তিনি হচ্ছেন ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। একমাত্র আল্লাহ জাল্লা শানুহু, তাঁর পেয়ারা রাসূল (সা.) এবং মাসুম ইমামাগণই তাঁর মর্যাদা যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম।
আর আমরা গৌরবান্বিত যে, আমরা জাফরী মাযহাবের অনুসারী। সীমাহীন মহাসমুদ্রের মতো বিশাল এই (ফিকহী) চিন্তাধারা তাঁর [ইমাম জাফর সাদেক (আ.)] দ্বারাই বিকশিত হয়েছে। আমরা সকল মাসুম ইমাম (আ.)-কে নিয়েই গর্ব অনুভব করি এবং তাঁদের অনুসরণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
আমরা গৌরবান্বিত এজন্যও যে, মাসুম ইমামগণ ইসলামকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে, সত্য ও ন্যায়নীতির হুকুমত প্রতিষ্ঠায় কোরআনের প্রয়োগ করতে গিয়ে এবং তাঁদের যামানার স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীকে এবং যুলুমবাজদের উতখাত করতে গিয়ে কারাবরণ করেছেন, নির্বাসিত জীবন যাপন করেছেন এবং পরিশেষে শাহাদাতবরণ করেছেন। আমরা এজন্য গৌরবান্বিত যে, আমরা চাই পাক কোরআন ও সুন্নাহর নীতিমালাকে কার্যে পরিণত করতে এবং এও গৌরবের বিষয় যে, আমাদের জাতির বিভিন্ন স্তর ও শ্রেণির জনগণ এ মহান ভাগ্যনির্ধারক প্রচেষ্টায় আল্লাহর রাহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের জানমাল ও প্রিয় বস্তুসমূহ কুরবান করে দিচ্ছে।
আমাদের জন্য এও গৌরবের বিষয় যে, আমাদের নারীরা সকল বয়সের, খ্যাত কিংবা অখ্যাত, সবাই ইসলামের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করতে, ইসলামের সৌন্দর্যকে সমুন্নত রাখতে, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক অঙ্গনে পুরুষের পাশাপাশি- অনেক সময় অধিকতর যোগ্যতায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। যে সকল নারী যুদ্ধ করতে সক্ষম তারা মিলিটারি ট্রেনিং নিচ্ছে- যা ইসলাম ও ইসলামী ভূখণ্ডের প্রতিরক্ষায় এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। তারা সাহস ও দৃঢ়তার সাথে উপেক্ষা করেছে- কুচক্রী দুশমন ও মূর্খ সুহৃদ কর্তৃক তাদের উপর তথা ইসলামের অনুশাসন ও কোরআনের উপর আরোপিত হীনতা ও বঞ্চনাকে। সাধারণ মুসলমানদের স্বার্থহানি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার মানসে দুশমনরা মূর্খ ও ভণ্ড আলেমদের দ্বারা যে সমস্ত কুসংস্কারের জন্ম দিয়েছে, সেসবের শৃঙ্খলও নারীরা নির্ভয়ে ভেঙে ফেলেছেন। আর যারা যুদ্ধ করতে অক্ষম তারা যুদ্ধময়দানের পশ্চাতে বিভিন্ন সেবামূলক কাজে এত বেশি নিবিষ্টচিত্ত যে, তা দেখে আমাদের গোটা জাতি আজ অভিভূত এবং তাদের মহতী সেবা দেখে দুশমন ও দুশমনদের চেয়ে নিকৃষ্ট মূর্খদের অন্তর ক্রোধ ও উষ্মায় ফেটে পড়ছে।
বারবার আমাদের চোখে পড়ছে মহিয়সী নারীরা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করছে, সেই মহাসম্মানিতা নারী হযরত যায়নব (আ.)-এর মতো যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর রাহে এবং মহা ইসলামকে বুলন্দ করার লক্ষ্যে তাদের সন্তানদের কুরবানি দিয়ে আজ তাঁরা গর্বিত এবং তাঁদের সবকিছু তাঁরা এভাবে বিলিয়ে দিতে সদা প্রস্তুত। তাঁরা জানেন যে, এর ফলে তাঁরা যা কিছু অর্জন করেছেন তা দুনিয়ার তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিস তো কোন ছার, স্বয়ং বেহেস্তের অফুরন্ত নেয়ামতের চেয়েও মর্যাদাপূর্ণ। আমাদের জাতি তথা সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্ ও অন্যান্য নির্যাতিত জাতি এজন্য আজ গর্বে উদ্বেলিত যে, তাদের দুশমন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দুশমন, কোরআন এবং সত্যধর্ম ইসলামের দুশমন। যারা নিষ্ঠুর-বর্বর এবং যারা নিজেদের ঘৃণ্য দুষ্কর্ম হাসিলের উদ্দেশ্যে তাদের আধিপত্য বিস্তারে শত্রুমিত্র নির্বিশেষে সকলের প্রতি পাশবিক আচরণ ও বিশ্বাসঘাতকতা করতেও দ্বিধাবোধ করে না। এদের প্রধান হচ্ছে জাত সন্ত্রাসবাদী আমেরিকান সরকার, যে সারা দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসের অগ্নিশিখা। তার অন্যতম দোসর আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদ, যে নিজের শয়তানি খায়েশ পুরো করার মানসে যে কোন অপকর্ম করতে ততপর, যার হিসাব লিখতে গেলে কলম থেমে যায়, বর্ণনা দিতে গেলে কণ্ঠ লজ্জায় রুদ্ধ হয়ে আসে। বৃহত্তর ইসরাইল গঠনের ঘৃণ্য দুরাশা তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে সব রকমের ইবলিসি ততপরতায়। মুসলিম জাতি এবং দুনিয়ার মযলুম জনগণ আজ এটা উপলব্ধি করে গর্বিত যে, পেশাদার বর্বর জর্দানের বাদশাহ হোসেন, মরক্কোর বাদশাহ হাসান ও মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক তাঁদের দুশমন এবং অপরাধী আমেরিকা ও ইসরাইলের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ। এরা নিজেদের জাতি ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের বিশ্বাসঘাতকতামূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হতে মোটেও ইতস্তত নয় এবং আমরা আরও গৌরবান্বিত এ জন্য যে, ইরাকের বামপন্থী সাদ্দামও আমাদের দুশমন যাকে তার দোস্ত ও দুশমনরাও মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘনকারী অপরাধী হিসেবেই জানে। সকলের কাছেই এটা পরিষ্কার যে, ইরাক ও পরস্য উপসাগরীয় শেখশাসিত রাষ্ট্রগুলোর জনসাধারণের বিরুদ্ধে সাদ্দামের যে বিশ্বাসঘাতকতা, তা ইরানী জাতির বিরুদ্ধে তার বিশ্বাসঘাতকতার চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
বর্বর পরাশক্তিগুলোর দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রচারযন্ত্রগুলো যে আমাদের দোষী সাব্যস্ত করেছে তাতেও আমরা এবং পৃথিবীর অন্যান্য জাতি গর্বিত।
এরচেয়ে সুখবর আর গৌরবের বিষয় কী হতে পারে যে, বিশ্বের নির্যাতিত ও পশ্চাদপদ বিপুল বৈভবের উপর একচ্ছত্র অধিকার, সামরিক শক্তি, বিভিন্ন পুতুল সরকারের সমর্থন এবং প্রচারমাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা পেয়েও আমেরিকার সরকার তার সকল নির্জলা মিথ্যা দাবি নিয়ে বাহাদুর ইরানী জাতি এবং হযরত বাকিয়াতুল্লাহ (আ.) (তাঁর পবিত্র আগমনে আমাদের জীবনসমূহ কুরবান হোক) এর দেশ ইরানের মোকাবেলায় এমনভাবে পর্যুদস্ত ও লাঞ্ছিত হয়েছে যে, এরপর কোন্ উপায় অবলম্বন করতে হবে সে জ্ঞান পর্যন্ত তার (আমেরিকার) লোপ পেয়ে গেছে। অতঃপর সে যার কাছেই যায় তার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। এটা সম্ভব হত না মহাপ্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের গায়েবি মদদ ছাড়া। যিনি জাতিসমূহকে বিশেষভাবে ইরানী জাতিকে জাগ্রত করেছেন, তাদেরকে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের ঘোর অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে ইসলামের পবিত্র নূরে করেছেন আলোকিত। এহেন সন্ধিক্ষণে মযলুম মহান জাতিসমূহ এবং প্রিয় ইরানী জাতির প্রতি আমার অসিয়ত, তাঁরা যেন নাস্তিক প্রাচ্য বা অত্যাচারী কাফের পাশ্চাত্যের কোন পথই অনুসরণ না করেন। একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রদত্ত সিরাতুল মুস্তাকীমে স্থির সংকল্প, দৃঢ়চিত্ত ও আনুগত্যের সাথে অবিচল থাকেন। খোদার নিয়ামতের শোকর আদায় করতে মুহূর্তের জন্য যেন উদাসীন না হন এবং পরাশক্তিগুলোর দোসরদের নাপাক হস্তসমূহকে প্রশ্রয় না দেন- তারা বিদেশি হোক বা দেশি- যারা বিদেশি দুশমনদের চেয়েও জঘন্যতম এবং এরা যেন আপনাদের নিয়তের পবিত্রতা এবং দৃঢ় সংকল্পের মধ্যে কোনরকম নাড়া দিতে না পারে। আপনাদের জেনে রাখা উচিত যে, আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলো যতই আপনাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে ততই আপনাদের খোদায়ী শক্তি প্রস্ফুটিত হবে এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে (পরাশক্তিগুলো ও তাদের দোসরদেরকে) ইহজগত ও পরজগত উভয় জগতেই শাস্তি বিধান করবেন। নিশ্চয়ই তিনি সকল নিয়ামতের সর্বময় কর্তা, ‘তাঁর অধিকারেই সকল কিছুর কর্তৃত্ব’ (আল-কোরআন ২৩ : ৮৮)। মুসলিম জাতিসমূহের প্রতি আমি একান্ত বিনীতভাবে আরজ করছি, পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আত্মোতসর্গের মনোভাব নিয়ে যথাযোগ্য আদবের সাথে মানবজাতির সর্বোত্তম পথনির্দেশক মাননীয় পবিত্র ইমাম (আ.) গণের অনুসরণ করতে; বিশেষ করে তাঁদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক কায়দাকানুন, অর্থনৈতিক ও সামরিক নীতিমালাকে মেনে চলতে এবং আহ্বান জানাই ফিকহ-ই সুন্নাতী থেকে সামান্যতমও সরে না যেতে। এই সুন্নাতী ঐতিহ্যই নববী এবং ইমামী চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ এবং জাতিসমূহের উন্নতিবিধান এবং মর্যাদার নিশ্চয়তা প্রদানকারী। যদিও বা তা ‘প্রাথমিক অধ্যাদেশসমূহ’ (আহকাম-ই আওয়ালিয়াহ্) বা ‘দ্বিতীয় পর্যায়ের অধ্যাদেশসমূহ’ (আহকাম-ই সানাভিয়াহ্) হয় যেগুলো উভয়ই ইসলামী আইনশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। হক ও মাযহাবের বিভ্রান্ত দুশমন শয়তানদের প্রলুব্ধকর বিষয়াদির দিকে কখনো যেন মনোযোগ না দেন। এক বিঘত পরিমাণ বিচ্যুতি ধর্মের তথা ইসলামী অধ্যাদেশ এবং ইনসাফপূর্ণ খোদায়ী হুকুমত ও আইন-কানুনের ধ্বংসসাধন করার জন্য যথেষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, কখনো জুমআর নামাযের প্রতি অবহেলা করবেন না। এই নামায, নামাযের রাজনৈতিক তাতপর্য ফুটিয়ে তোলে। শুক্রবারের এই জুমআর নামায আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত যা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জন্য তিনি মনোনীত করেছেন। ইমামগণের শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত শোক অনুষ্ঠানগুলোর প্রতিও অবজ্ঞা প্রদর্শন করবেন না। বিশেষ করে সাইয়্যেদুশ শুহাদা ও মযলুমদের নেতা হযরত আবি আবদিল্লাহ হুসাইন (আ.)-এর শোক অনুষ্ঠানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন। (মহান আল্লাহ্, তাঁর ফেরেশতাকূল, নূরনবী এবং সকল সালেহ বান্দার পূর্ণ দরুদ ও সালাম তাঁর পবিত্র ও নির্ভীক রুহের উপর বর্ষিত হোক)।
জনগণের স্মরণ রাখা উচিত কারবালার প্রেরণাদায়ক ঐতিহাসিক মহাঘটনার স্মৃতিচারণের জন্য ইমামদের নির্দেশনাবলি। নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের দুশমনদের উপর যেসব ধিক্কার ও অভিশাপ আপতিত হয়েছে তা আসলে যুগ যুগ স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিসমূহের বীরত্বপূর্ণ প্রতিবাদ। আপনাদের জানা উচিত, উমাইয়্যাদের (তাদের উপর আল্লাহ্র লা’নত) অত্যাচার আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে ধিক্কার, নিন্দাবাদ ও অভিশাপের কথা। যদিও তারা এখন পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে জাহান্নামের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত, তথাপি এই ফরিয়াদ ইঙ্গিত বহন করে বর্তমান দুনিয়ার যালেমদের বিরুদ্ধে মজলুম জনতার আর্তচিতকার। এ যুলুমবিধ্বংসী ফরিয়াদকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। ইমামদের স্মরণে শোকগাথা ও প্রশংসাসূচক কাব্যগুলোতে প্রতিটি যুগের যালেমদের দ্বারা সংগঠিত অত্যাচার ও দুঃখজনক ঘটনাগুলো জোরালোভাবে আলোচিত হওয়া উচিত। আর বর্তমান যুগ- যা হচ্ছে আমেরিকা, রাশিয়া ও তাদের দোসরদের বিশেষ করে আল্লাহ পাকের পবিত্র হারামের প্রতি বিশ্বাসঘাতক সৌদি রাজবংশের (তাদের উপর আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতা ও রাসূলগণের লা’নত বর্ষিত হোক) হাতে মুসলিম বিশ্বের নির্যাতিত হওয়ার যুগ, (এই যুগেও) জোরালোভাবে (সত্য ইমামগণের স্মরণে শোকগাথা ও প্রশংসাসূচক কাব্যগুলোতে) আলোচনা করা, অভিশাপ ও ধিক্কার দেয়া উচিত। আমাদের সকলেরই বুঝা উচিত, যে জিনিস মুসলমানদের ঐক্য সাধন করবে তাহলো এই রাজনৈতিক অনুষ্ঠানমালা- যেগুলো মুসলমানদের বিশেষ করে বার ইমামের অনুসারী শিয়াদের জাতিসত্তাকে সংরক্ষণ করবে।
এখানে প্রত্যককে যা স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি তা হলো, আমার ধর্মীয়, রাজনৈতিক এই অসিয়ত শুধু ইরানের মহান জনগণের জন্য লিখিত নয়; বরং এটা সকল মুসলমান তথা জাতিধর্ম নির্বিশেষে দুনিয়ার তাবত মযলুম জনগণের জন্য এক উপদেশ হিসেবেও পরিগণিত।
মহামহিম আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের খেদমতে আমার সবিনয় নিবেদন, আমাদের এবং আমাদের জাতিকে যেন তিনি কখনও একা ছেড়ে না দেন। ইসলামের সন্তানদের এবং আমাদের প্রিয় সৈনিকদের যেন এক মুহূর্তের জন্যও স্বীয় গায়েবি মদদসমূহ থেকে বঞ্চিত না করেন।
রুহুল্লাহ্ আল-মুসাভী খোমেইনী