অনুবাদ: ড. আবু উসামা মুহাররম
“আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইদ্রিস বিন আল-আব্বাস”, যিনি “ইমাম শাফিই” (১৫০-২০৪ হি) নামে পরিচিত, তিনি শাফিই মাযহাবের প্রবর্তক। শাফিই মাযহাব চারটি সুন্নি মাযহাবের একটি। মুহাম্মদ বিন ইদ্রিস শাফিইর জন্ম ফিলিস্তিনের গাজায নামক স্থানে। তিনি কোরেশী পিতা-মাতার সন্তান। দুই বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। অতঃপর তার মা তাকে মক্কায় নিয়ে যান এবং সেই সময়ের আলেমদের দ্বারা তাকে শিক্ষা দেন। তার সময়ের জ্ঞান এবং আরবি সাহিত্যের মৌলিক বিষয়গুলি শেখার পর তিনি মুসলিম বিন খালিদ নামে একজন মক্কার আইনজ্ঞের কাছে আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।
তেরো বছর বয়সে, শাফিই মদিনায় ইমাম মালিকের নিকট অধ্যয়ন শুরু করেন। যৌবনে তিনি কুরআন মুখস্থ করেন এবং বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করেন। শাফিই আরবি সাহিত্যে দারুণ দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। এবং শব্দের সঠিক শিকড় খুঁজে বের করার জন্য হাযিল, রাবিয়া এবং মুদার গোত্রের মধ্যে কিছু সময় কাটিয়েছিলেন। তিনি ইবনে আব্বাসের ছাত্রদের কাছ থেকে আইনশাস্ত্র শিখেছিলেন। যিনি নিজে আমিরুল মুমিনিন হযরত আলি ইবনে আবি তালিবের (আ.)-এর ছাত্র ছিলেন। এছাড়াও আহলে বাইত (আ.)-এর আরও কয়েকজন ইমামের ছাত্র ছিলেন। তিনি ইরাক ও মিশরে ফতোয়া দিতেন। আব্বাসিয় খিলাফতের সময় বসবাসকারী শাফিই ২০৪ হিজরিতে মিশর ভ্রমণের সময় মারা যান এবং কায়রোতে তাকে সমাহিত করা হয়। শাফিই ছিলেন সেই যুগের ফকিহদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী লেখক। তিনি সাহিত্য, শিল্পকলা, আইনশাস্ত্র ও হাদিস শাস্ত্রে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। তিনি আইনশাস্ত্র, কুরআন, হাদীস, বিজ্ঞান, কবিতা এবং শব্দভান্ডারে উচ্চ স্তরে পৌঁছেছিলেন। তিনি প্রায় ১১০টি গ্রন্থ রচনা করেন। এসব গ্রন্থের অধিকাংশই আইনশাস্ত্র বিষয়ে রচিত। শাফিইর “আলউম্ম” এবং “আররিসালাহ” নামে দুটি সুপ্রশিদ্ধ গ্রন্থ রয়েছে। শাফিই জ্ঞান অর্জনের জন্য বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। মক্কা ও মদিনা থেকে কুফা ও বাগদাদ, মিশর ও ইয়েমেন। এসব ভ্রমণে তদঞ্চলের জনসাধারণ ইমাম শাফিই (রহ.)-এর চিন্তা, মতামত ও আইনশাস্ত্র ও ধর্মতত্ত্বের সাথে পরিচিত হন। তিনি তাদের সাথে ধর্ম বিষয়ে মুক্ত আলোচনা করতেন এবং কখনও কখনও সেখানকার ধর্মবেত্তাদের সাথে বিতর্ক করতেন।
“শাফিই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের ইমামদের চেয়েও আলি বিন আবি তালিব (আ.)-এর প্রতি বেশি অনুগত ছিলেন এবং তিনি তাঁকে ভালোবাসতেন। তিনি আলি (আ.) সম্পর্কে বলেন: আলি ইবনে আবি তালিব (আ.)এর মধ্যে চারটি গুণ ছিল যেগুলোর একটি যদি একজন ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যায়, তাহলে তিনি সম্মানিত হবেন। শাফিই আরও বলেন যে নবি (সা.) আলিকে কুরআনের জ্ঞানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন; কারণ নবি তাকে ডেকেছিলেন এবং লোকদের মধ্যে বিচার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তার ফতোয়ায় নবি স্বাক্ষর করেছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন যে আলি সঠিক এবং মুয়াবিয়া ভুল ও মিথ্যা”। শাফিই এর রচনায় যে বিষয়গুলো প্রচুর পরিমানে পরিলক্ষিত হয় এবং খুব বেশি জোর দেন, তা হল আহলে বাইত (সাঃ) এর শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাদের প্রতি ভালবাসা।
মিনায় হজ্জের একটি মহান অনুষ্ঠানে একদল হজযাত্রীর সামনে যখন আহলে বাইতের শত্রুরাও উপস্থিত ছিল এবং তাদের জন্য বিপদের আশঙ্কা ছিল, তখন তিনি আহলে বাইতের প্রতি তাঁর ভালবাসা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি একটি কবিতা লিখেন
یا راکِباً قِف بالمُحَصَّبِ مِن منیً
وَاهتِف بِقاعِدِ خَیفِها وَالنَّاهِضِ
سَحَراً إذا فاضَ الحَجیجُ إلی مِنیً
فَیضاً کَمُلتَطِمِ الفُراتِ الفائِضِ
إن کانَ رَفضاً حُبُّ آلِ مُحمَّدٍ
فَلیَشهَدِ الثَّقَلانِ أنّی رَافضِی
‘হে অশ্বারোহীরা, আমার বালুচরে অবস্থান কর এবং
উপত্যকা ও উচ্চতার অধিবাসীদের বল।
যারা ফজরের সময় অবস্থান করে এবং
গর্জনকারী ফুরাত নদী আমার দিকে প্রবাহিত হয়
তাদেরকে বল: যদি আহলে বাইতের ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান ও কুফর হয়,
তাহলে জ্বীন ও মানবজাতি যেন জেনে নেয় যে আমি রাফেযী।’
তার কবিতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে বিষয়গুলো পাওয়া যায়; কারণ তিনি রাসূল (সা.)-এর পরিবারের প্রতি ভালোবাসাকে তার অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করেন। শাফিই বিশ্বাস করেন যে কেউ যদি নামাযের সময় নবির পরিবারকে সালাম না পাঠায় তবে তার প্রার্থনা সঠিক নয়:
یَا آلَ بَیتِ رَسولِ الله حُبُّکُمُ
فَرضٌ مِنَ الله فی القُرآنِ أنزَلَهُ
کَفاکُم مِن عظیمِ القَدرِ أنّکُم
مَن لَم یُصلِّ عَلَیکُم لَا صَلَاهَ لَهُ
হে নবুওয়াতের পরিবার, তোমাদের ভালবাসা
ফরজ যা আল্লাহ কোরানে নাযিল করেছেন।
আপনাদের মর্যাদার মাহাত্ম্যের জন্য এটাই যথেষ্ট, যে ব্যক্তি আপনাদের
সালাতে সালাম দেয়নি, তার নামাজ নেই, (তার নামাজ সঠিক নয়)।
শাফি’র অন্যান্য কবিতার মধ্যে আলি (আ.) সম্পর্কে তাঁর লেখা একটি কবিতা। শাফেয়ীকে ইমাম আলি (আ.) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বেদনাদায়কভাবে বলেছিলেন:
إنّا عَبــیدٌ لِفتیً أنزلَ فِیـــهِ هَل أتَی
إلی مَتــی أکتُمُهُ؟ إلی مَتی؟ إلی مَتی
আমরা সেই সাহসী ব্যক্তির অনুগত যার সম্পর্কে সূরা (হাল আতা – সূরা ইনসান) অবতীর্ণ হয়েছিল
আমি কি এটি লুকিয়ে রাখব? কতক্ষণ? কতক্ষণ?
আলি (আ.)-এর প্রেমিকদের বিরুদ্ধে বনী আল-আব্বাস কর্তৃক প্রবল প্রচারণার পরিবেশে তিনি স্পষ্টভাবে নবির কার্যকর্তার প্রতি তাঁর ভক্তি প্রদর্শন করেন এবং বলেন:
قَالُوا: تَرَفَّضتَ قُلتُ: کَلَّا
مَا الَّرفضُ دینی وَ لا إعتِقادی
لکِن تَوَلَّیتُ غَیرَ شَکٍّ
خَیرَ إمَامٍ وَ خَیرَ هَادی
إن کَانَ حُبُّ الوَلِیِّ رَفضاً
فإنَّنی أرفَضُ العِبادَ[
তারা বলে: আপনি রাফিযি ও মুরতাদ হয়ে গেছেন, আমি বলি: কখনই না।
তবে নিঃসন্দেহে, আমি সর্বোত্তম ইমাম এবং সেরা পথপ্রদর্শককে ভালোবাসি।
যদি আলির প্রেম রাফিযি ও ধর্মত্যাগের কারণ হয়,
তাহলে বিশ্বকে জানুক যে আমি সবচেয়ে ধর্মহীন মানুষ।
গ্রন্থসূচি:
১. অধিকাংশ মুসলমান যে চারটি মাযহাবের অনুসারী তা হল: মালিকি, হানাফী, শাফেয়ী এবং হাম্বলী।
২. বদি ইয়াকুব, এমিল, দিওয়ানুল ইমাম আশ শাফিই , বৈরুত-লেবানন, দার আল-কিতাব আল-আরাবি, ১৪৩০ হিজরি।
৩. মাসুদি, আলি বিন হুসাইন, মরুজুয যাহাব, খণ্ড ৩, পৃ. ৪৩৭, তেহরান, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক প্রকাশনা, ১৩৭৪।
৪. তাওয়াককুলি, মোহাম্মদ রউফ, চাহার ইমাম আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত, তেহরান, তাওয়াককুলি, ১৩৭৭।
৫. মুহাম্মদ আবু জাহরা, পৃ. ৩, ২৫২; গুলজিহার, আল-আকিদাহ ওয়াশ শরিয়াতুল ইসলামিয়া পৃ.২০০ ; চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত শিয়া এবং ইসলামের সম্প্রদায়ের ইতিহাস থেকে উদ্ধৃত, মোহাম্মদ জাভেদ মাশকুর, তৃতীয় সংস্করণ, পৃ. ১০৩-১০৪ , এশরাগী বুকস্টোর, ১৩৬২।
৬. দিওয়ান আল-ইমাম আল-শাফিই , পৃ.৯৩, দার আল-কাতব আল-আরাবি, বৈরুত, ১৪১৪ হি.
৭. তদেব, পৃ. ১১৫।
৮. তদেব, পৃষ্ঠা ৫৯।
৯. তদেব, পৃ. ৭২।