আব্বাসী শাসকদের সৃষ্ট শ্বাস রুদ্ধকর পরিবেশ ও ইমামের উপর কড়া নজর থাকার কারণে ইমামের সহযোগীদের সংখ্যা নিতান্ত কম হলেও যারা ইমামের বিশেষ সান্নিধ্য লাভ করতে পেরেছে তারাই মহান দীনী ব্যক্তিত্ব ও পরহেজগার আলেমে পরিণত হয়েছেন। তাদের কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরবো:
১.আহমাদ ইবনে ইসহাক আশআরী কোমী : তিনি কোমের মহান ব্যক্তিদের মধ্যে ইমামের একজন বিশেষ সহযোগী ও প্রতিনিধি ছিলেন। কোমবাসীদের বিভিন্ন বিষয়ের সমস্যামূলক প্রশ্নাদি ইমামের কাছে নিয়ে যেতেন এবং ইমামের কাছ থেকে প্রাপ্ত জবাব কোমবাসীদের নিকট পৌঁছে দিতেন। তিনি ইমাম জাওয়াদ ও ইমাম হাদী (আ.)-এরও সাহাবী ছিলেন। এই দুই ইমামের কাছ থেকেও হাদীস বর্ণনা করেছেন। (আনওয়ারুল বাহীয়্যাহ্, মাশহাদ প্রিন্ট, পৃ. ১৬০-১৬১)
“আহমাদ ইবনে ইসহাক” হুসাইন ইবনে রুহ নওবাখতী (ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময়ের তৃতীয় বিশেষ প্রতিনিধি) এর কাছে হজ্বে যাওয়ার জন্য অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখেন। হজ্বের অনুমতিপত্রের সাথে কিছু পরিমান কাপড়ও হস্তগত হলো। আহমাদ বললো আমার মৃত্যু সংবাদ এসেছে (যে কাপড়টি পাঠানো হয়েছিল তা ছিল কাফনের কাপড় এটা দেখেই সে বুঝে নিয়েছিল তার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে) এবং হজ্ব থেকে ফেরার পথে হালওয়ান যার বর্তমান নাম পুলে জাহাব সেখানে তার মৃত্যু হয়। (এখতিয়ারে মা’রেফাতুর রেজাল, পৃ. ৫৫৭)
“সাদ ইবনে আব্দুল্লাহ্” আহমাদ ইবনে ইসহাকের মৃত্যু সম্পর্কে বলেন: হালওয়ানে পৌঁছার তিন ফারসাখ (এক ফারসাখ = ৬.২৪ কি.মি.) পূর্বেই তার জ্বর হয় এবং মারাত্বক অসুস্থ হয়ে পড়েন ফলে আমরা নিরাশ হয়ে পড়লাম। বুঝতে পারলাম সে আর বাঁচবে না। যখন হালওয়ানে পৌঁছালাম সরাই খানায় আশ্রয় নিলাম। আহমদ বললো আজ রাতে আমাকে একা থাকতে দাও তোমরা তোমাদের গন্তব্যে চলে যাও। সবাই চলে গেলেও আমি গেলাম না। ফজর নামাজের ঠিক পূর্বে জেগে দেখি ইমাম আসকারী (আ.)-এর খাদেম কাফুর সেখানে উপস্থিত। সে বললো :
اَحْسَنَ اللَّهُ بالْخَيْرِ عَزائَكُمْ وَ جَبَرَ بِالْمَحْبوبِ رَزِيَّتَكُمْ
– আল্লাহ্ তোমার মঙ্গল করুন এবং তোমার ঊপর আপতিত এই মুসিবতের প্রতিদান স্বরূপ উত্তম পুরস্কার দান করুন।
অতঃপর বললেন : তোমার সাথী আহমাদের গোসল ও কাফন সম্পন্ন হয়েছে। এখন যাও তার দাফনের ব্যবস্থা কর। সত্যিই আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের কারণে ইমামের দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে আহমাদ শ্রেষ্ঠ ছিল। একথা বলে কাফুর অদৃশ্য হয়ে গেল। (মুনতাহিউল আমাল, পৃ. ২৭৯)
২.আবু হাশেম দাউদ ইবনুল কাসেম জা’ফরী : তিনি জনাব জা’ফর তাইয়ারের (জামেয়ার রুয়াত, ১ম খণ্ড, পৃঃ- ৩০৭, (দাউদ ইবনুল কাসেম ইবনে ইসহাক ইবনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে জা’ফর ইবনে আবু তালেব) বংশধর এবং তার বংশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বাগদাদে বসবাস করতেন। ইমামদের কাছে তার যথেষ্ট মূল্য ও কদর ছিল। তিনি ইমাম জাওয়াদ, ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারী (আ.)-এর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং মাহ্দী (আ.) এর বিশেষ উকিল ও বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন।
আবু হাশেম ইমামদের খুব ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ সাথিদের মধ্যে পরিগণিত। ইমামদের হতে প্রচুর হাদিস তিনি বর্ণনা করেন এবং এ সম্পর্কিত একটি বইও লিখেন। শিয়াদের প্রসিদ্ধ আলেমগণ তার এ বইয়ের প্রশংসা ও তা থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। (তানকিহুল মাকাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১২-৪১৩, ও বিহারুল আনওয়ার, ৯ম ও ১১তম খণ্ড)
আবু হাশেম একজন স্বাধীনচেতা, অকুতোভয় ও সাহসী লোক ছিলেন। যখন ইয়াহিয়া ইবনে ওমর জায়দী (ইয়াহিয়া আলী (আ.)-এর বংশধর, একজন ধর্মপ্রাণ ও সাহসী পুরুষ ছিলেন। যিনি আব্বাসীয় শাসক মুসতা’ইনের আমলে অভ্যুত্থান করে নিহত হয়) এর কর্তিত মাথা বাগদাদের গর্ভণর মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ তাহের এর নিকট নিয়ে আসা হয় অনেকেই তখন এ ঘটনাকে মহা বিজয় উল্লেখ করে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। আবু মুহাম্মদ গভর্ণরের কাছে গিয়ে সম্মান ও সম্বোধন ব্যতীরেকেই বললেন : হে আমির, তোমাকে এমন এক বিষয়ে সম্বর্ধনা জানাতে এসেছি যদি রাসূল (সা.) এখন জীবিত থাকতেন তার জন্য শোক প্রকাশ করতেন। গভর্ণর আবু হাশেমের এ কথার কোন প্রকার জবাব দিল না। (কামুসুর রেজাল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৫৯)
৩.আবদুল্লাহ্ ইবনে জা’ফর হামিরী : তিনি কোম শহরের এক মহান ব্যক্তি এবং ইমাম আসকারী (আ.)-এর বিশিষ্ট সঙ্গীদের একজন। তিনি অনেক বই লেখেন এর মধ্যে “কুরবুল আসনাদ” আজও পর্যন্ত মহান শিয়া আলেম ও ফকীহদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। আবদুল্লাহ্ ইবনে জা’ফর ২৯০ হিজরীতে কুফায় গমন করেন। কুফার জনগণ তার কাছ থেকে হাদিস শিক্ষা নিত। (তানকিহুল মাকাল, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৭৩)
৪.আবু আমর ও উসমান ইবনে যাইদ আমরী : ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময়কার প্রথম প্রতিনিধি। তিনি ইমাম হাদী, ইমাম আসকারী ও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে যাকাত ও খোমস সংগ্রহের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি ১১ বছর বয়স থেকে ইমাম হাদী (আ.)-এর বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভে ধন্য হন। ইমাম হাদী, ইমাম আসকারী ও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আমলে জনগণ এবং ইমামদের মাঝে যোগ সূত্র হিসেবে কাজ করতেন। তার থেকে মাঝে মাঝে জনগণ কেরামতিও লক্ষ্য করেছেন। পূর্বেও বলা হয়েছে তিনি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রথম ও বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন এবং এর আগেও ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারী (আ.) শিয়াদেরকে তার কাছ থেকে ধর্মীয় ও শরিয়তী বিষয়াদি শিক্ষা নেয়ার জন্য বলতেন। ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারী (আ.) তার ব্যাপারে বলেছেন: আবু ওমর আমাদের বিশ্বাসভাজন ও আস্থাবান, সে যাই বলুক তা সবই আমাদের কথা এবং তোমাদের নিকট যে খবরই পৌঁছাবে তা সবই আমাদের পক্ষ থেকে। (তানকিহুল মাকাল, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪৫, কামুসুর রেজাল, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৪৫)