আবু হাশেম জা’ফরী বলেন : এক ব্যক্তি ইমামকে জিজ্ঞেস করেন, অসহায় সত্ত্বেও নারী জাতি পিতার সম্পত্তির একভাগ পায় অথচ ছেলে পায় তার দ্বিগুণ ?
ইমাম বললেন : কারণ জিহাদ করা, সাংসারিক খরচাদি চালানো পুরুষের দায়িত্ব এবং ভুলবশত কাউকে হত্যা করলে তার জরিমানাও (দীয়া)( ভুলবশত কেউ কাউকে হত্যা করে ফেললে তার ‘দীয়া’ বা রক্তপণ পরিশোধ করার দায়িত্ব হত্যাকারীর পুরুষ অবিভাবক : ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্র, চাচা, চাচাত ভাই, বাবা অথবা হত্যাকারীর পুত্র সন্তানের উপর অর্পিত) পুরুষের উপর অর্পিত। এর সব কিছুই মহিলাদের দায়িত্ব বহির্ভূত।
আবু হাশেম বলেন : আমি মনে মনে বললাম এর আগেও শুনেছি যে, ইবনে আবিল উজজা ইমাম সাদিক (আ.)-এর কাছে ঠিক একই প্রশ্ন করেছিল এবং ঠিক এরকমই জবাব পেয়েছিল।
ইমাম আসকারী (আ.) তখন আমার দিকে ফিরে বললেন : হ্যাঁ, ঠিক একই প্রশ্ন ইবনে আবিল উজজা করেছিল। আমাদের যে কারো কাছেই এক প্রশ্ন করা হবে তার উত্তরও আমরা একই রকম দিয়ে থাকি। পরবর্তী ও পূর্ববর্তী ইমামের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। জ্ঞানগত বিষয়ে আমাদের প্রথম ও শেষ সমমর্যাদার অধিকারী তবে হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.)-এর বিশেষত্ব ও মর্যাদা অতুলনীয়। (এলামুল ওয়ারা, নাজাফ প্রিন্ট, পৃ. ৩৭৪)
খ) হাসান ইবনে জারিফ ইমাম আসকারী (আ.)-এর নিকট লিখেন : হযরত আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) সম্পর্কে রাসূল (সা.)-এর বাণী, (مَنْ كُنْتُ مَوْلاهُ فَعَلىُّ مَوْلاَهُ) এর অর্থ কি?
ইমাম বললেন : রাসূল (সা.)-এর উদ্দেশ্য ছিল আলী (আ.) কে ইমামতের পদে নিযুক্ত করবেন যাতে তার উম্মতের মধ্যে সৃষ্ট বিভেদ ও অনৈক্যের ক্ষেত্রে সত্যপন্থী সহজে চেনা যায়। (কাশফুল গুম্মাহ, তাবরীজ প্রিন্ট, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩০৩)
গ) হারভী বলেন : আসবাতের এক ছেলে আমাকে বললো, একদা ইমাম আসকারী (আ.)-কে লিখে জানালাম যে, তাঁর প্রতি ভালবাসা পোষণকারীদের মধ্যে বিভেদ বিদ্যমান। এ জন্য আমি চাইলাম ইমাম যাতে এমন কিছু মুজেজা দেখান যাতে এই সমস্যার সমাধান হয়।
ইমাম জবাবে লিখেন : “ সত্য এই যে আল্লাহ্ তা’য়ালা শুধুমাত্র জ্ঞানী ব্যক্তির সাথে কথা বলেন। রাসূল (সা.) যে সকল নিদর্শন (মুজেজা) দেখিয়ে ছিলেন তার অধিক কোন নিদর্শন আর কেহই কখনও দেখাতে পারবে না। তথাপি তার সম্প্রদায় তাকে যাদুকর বলে আখ্যায়িত করেছিল। যে সকল লোক হেদায়েত পাওয়ার যোগ্য ছিল তাদেরকে তিনি হেদায়েত করেছেন। তবে কিছু লোক এমনও আছে যারা মুজেজার মাধ্যমে হেদায়েত প্রাপ্ত হয়। আর এই মুজেজা একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালার অনুমতি সাপেক্ষে। আল্লাহ্ তা’য়ালা যেখানে আমাদেরকে নিষেধ করেন আমরা সেখানে একটি কথাও বলি না।
যদি আল্লাহ্ তা’য়ালা না চাইতেন সত্য প্রকাশিত হোক তাহলে রাসূলগণকে মানুষের সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্র্রেরণ করতেন না। আল্লাহর নবী রাসূলগণ দুর্বল অথবা সবল যে অবস্থায়ই ছিলেন সত্যকে প্রকাশ করেছেন। তারা মাঝে মাঝে কিছু কিছু আদেশ ও হুকুম প্রদান করতেন আর আল্লাহ্ তা’য়ালার অনুমতিক্রমে তা কার্যকর ও বাস্তবায়িত হতো।
মানুষ কয়েক ভাবে বিভক্ত; একদল এমন যে, জেনে বুঝে মুক্তির পথে অবস্থিত, সত্য প্রাপ্ত ও দীনের মুখ্য ও গৌণ বিষয়ে আমল করতে দৃঢ় প্রত্যয়ী। তাদের অন্তরে নেই কোন সন্দেহ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন আশ্রয়স্থলও তারা খোঁজে না।
আর একদল লোক এমন যে, সত্যকে তার ধারক ও বাহকের কাছ থেকে গ্রহণ করেনা; এরা সমুদ্রে ভ্রমণকারী ঐ লোকদের ন্যায় যারা সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে তাদের হৃদয় চমকিত হয় আবার সমুদ্র যখন শান্ত হয় তাদের হৃদয়ও শান্ত হয়।
তৃতীয় দলটি এমন যে, শয়তান তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে। তারা হিংসার বশবর্তী হয়ে সত্যের বিরোধিতা করে এবং সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখে। যারা (সত্য ও সঠিক পথ বাদ দিয়ে) ডানে-বায়ে চলছে তুমি তা করিও না। রাখাল তার সুশৃংখল পশু পালকে সহজেই একত্রিত করতে পারে। ঠিক তেমন যারা আমাকে অনুসরণ করে আমিও তাদের পরিচালনা করতে সক্ষম।
অনারব মুসলমান (মাওয়ালী) ও আমাদের অনুসারীদের মাঝে মত পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেছো; যদি মহত্ত্বই সত্যের মাপকাঠি হয়ে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে যে ব্যক্তি ইমামতের পদে নিযুক্ত, তিনি সিদ্ধান্ত নেয়া ও আদেশ দানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত। যাদের সম্পর্কে তুমি অভিযোগ করেছো তাদের সাথে সদাচরণ কর, আমাদের গোপন তথ্যাদি প্রকাশ ও নেতৃত্বের লিপ্সা থেকে বিরত থাক। এই কাজ দুটি মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
পারস্যে যাওয়ার আকাঙ্খা পোষণ করেছো, যেতে পারো, আল্লাহর কাছে তোমার মঙ্গল কামনা করি, ইনশাআল্লাহ্ সুস্থ ও নিরাপদে মিসরে যাবে।
আমার নির্ভরযোগ্য সহযোগীদের নিকট আমার সালাম পৌঁছাবে। তাদেরকে বলো : আমাদের গোপন তথ্যাদি নিয়ে আলোচনা করা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করা আমাদের সাথে যুদ্ধের সমতুল্য।”
হারভী বলেন : ইমামের এ কথাটি “সুস্থ ও নিরাপদে মিশরে যাবে” প্রথমে বুঝতে পারি নি। যখন বাগদাদে এলাম পারস্যের দিকে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হলো। ফলে সেদিকে আর যাওয়া হলো না। অতঃপর মিশরে গেলাম এবং তখন বুঝতে পারলাম ইমাম কেন ঐ কথাটি বলেছিলেন। (কাশফুল গুম্মাহ, তাবরীজ প্রিন্ট, ৩য় খণ্ড, পৃ২৯৩-২৯৪)
ঘ) মুহাম্মদ ইবনে হাসান ইবনে মায়মুন বলেন : একবার ইমাম আসকারী (আ.)-এর নিকট আমার অভাব অভিযোগের কথা জানিয়ে অনুযোগ করে চিঠি লিখলাম; অতঃপর মনে মনে বললাম, ইমাম সাদিক (আ.) তো বলেছেন :
الْفَقْرُ مَعَناخَيْرٌ مِنَ الْغِنىَ مَعَ غَيْرِنا وَ الْقَتْلُ مَعَنا خَيْرٌ مِنَ الْحَياةِ مَعَ عَدوِّنا
-সম্পদশালী অবস্থায় অন্যদের সাথে থাকার চেয়ে অভাবী হয়ে আমাদের সাথে থাকাও উত্তম, ঠিক তেমন আমাদের শত্রুদের সাথে থেকে বেঁচে থাকার চেয়ে আমাদের সাথে থেকে মৃত্যুবরণ করাও শ্রেয়।
জবাবে ইমাম (আ.) লিখেন : আল্লাহর ওলি ও আমাদের অনুসারীরা যখন অনেক বেশী গুনাহ করে ফেলে তখন আল্লাহ্ তা’য়ালা তাদেরকে অভাব অনটন দিয়ে সে ওসিলায় গুনাহ ও ভুলত্রুটিসমূহ ক্ষমা করে দেন এবং অধিকাংশ গুনাহ এইভাবে মাফ হয়ে যায়। যেমনটি তুমি নিজেই বলেছো, “সম্পদশালী অবস্থায় অন্যদের সাথে থাকার চেয়ে অভাবী হয়ে আমাদের সাথে থাকাও উত্তম, ঠিক তেমন আমাদের শত্রুদের সাথে থেকে বেঁচে থাকার চেয়ে আমাদের সাথে থেকে মৃত্যুবরণ করাও শ্রেয়।” যারা আমাদের কাছে জ্ঞান কামনা করে আমরা তাদেরকে জ্ঞান দিয়ে থাকি এবং আমাদেরকে যারা আঁকড়ে ধরে আমরা তাদেরকে পাহারা দিয়ে রাখি, যারা আমাদেরকে ভালবাসে তারা আমাদের কাছে গর্বিত এবং যারা আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যায় তারা আগুনে পতিত হয়। (কাশফুল গুম্মাহ, তাবরীজ প্রিন্ট, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩০০)