Press "Enter" to skip to content

খলিফাবৃন্দ ও আহলুস সুন্নাহ আলেমদের বর্ণনায় ইমাম আলি (আ.) এর মর্যাদা- ২

অনুবাদ: ড. আবু উসামা মুহাররম

শেষ অংশ…

ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসমাইল বুখারি রহ.

ইমাম বুখারি তার সহিহ বুখারি গ্রন্থে মানাকিবে আলি (আ.) বা হযরত আলি (আ.) মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে যেসকল বিষয়ের অবতারণা করেছেন তন্মধ্যে আবু তুরাব উপনাম, খায়বার দিবসে আলি (আ.)কে বিজয়ের পতাকা প্রদান এবং তার মর্যাদাসম্পর্কিত হাদিস রয়েছে। তিনি দ্বিতীয় খলিফা থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত রাসুল (সা.) দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন এমন অবস্থায় যখন তিনি হযরত আলির উপর সন্তুষ্ট ছিলেন। হাদিসটি নিম্নরুপ-

عن عمر – رضي الله عنه – قال : ما أحد أحق بهذا الأمر من هؤلاء النفر الذين توفي رسول الله – صلى الله عليه وسلم – وهو عنهم راض فسمى عليا ، وعثمان ، والزبير ، وطلحة ، وسعدا ، وعبد الرحمن

হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব বর্ণনা করেন যে, খেলাফতের এই বিষয়টি নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের চাইতে আর কেউ অধিক হকদার নন। যাদের প্রতি নবি সা. সন্তুষ্ট থাকা অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তারা হলেন আলি, উসমান. যুবাইর, তালহা, সা‘দ ও আব্দুর রহমান। (সহিহ বুখারি, খন্ড ৫, পৃ. ২২-২৪)।

ইমাম মুসলিম বিন হাজ্জাজ আল কুশাইরি রহ.

সহিহ মুসলিম গ্রন্থের মানাকিবুস সাহাবা অংশে ইমাম মুসলিম নবি (সা.) থেকে আলি (আ.)-এর মর্যাদার ব্যাপারে অনেক হাদিস উপস্থাপন করেছেন। তিনি বিভিন্ন সনদসহ খাইবারের দিনে আলি (আ.)কে যুদ্ধের সেনাপতির দায়িত্ব ও ঝান্ডাবাহী পতাকা প্রদান, নবি (সা.) এর পক্ষ থেকে আলি (আ.)-কে আবু তুরাব বলে সম্বোধন এবং আহলে বাইতদের সম্মান করার জন্য নবির বিভিন্ন হাদিসসমূহ বর্ণনা করেছেন। সেই সাথে মুয়াবিয়ার বিপরীতে সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের কথাও বর্ণনা করেছেন।যেমন:

 خلف رسول الله صلى الله عليه وسلم علي بن ابي طالب في غزوة تبوك، فقال: يا رسول الله، تخلفني في النساء، والصبيان، فقال: اما ترضى ان تكون مني بمنزلة هارون من موسى، غير انه لا نبي بعدي

তাবুক যুদ্ধে রাসুল সা. আলি (আ.)কে রেখে যান। তখন আলি বলেন হের রাসুল সা. আমাকে কি নারী শিশুদের দেখভালের জন্য রেখে যাচ্ছেন? তখন রাসুল সা. বলেন হে আলি তুমি কি আমার ক্ষেত্রে  মূসার কাছে হারুনের মত হতে পেরে সন্তুষ্ট নও,  পার্থক্য শুধু এতটুকু যে আমার পরে আর কেউ নবি হবে না? (সহিহ মুসলিম, খন্ড ৭, পৃ. ১২০-১২৪)।

ইমাম নাসাই রহ.

” خصائص امیرالمومنین علی بن ابی طالب کرم الله وجهه আমিরুল-মুমিনিন আলি বিন আবি তালিব কাররামুল্লাহ ওয়াজহুহুর বৈশিষ্ট্য অধ্যায় লিখে তিনি প্রায় ১৭৮টি হাদিস উল্লেখ করেছেন। খাওয়ারযমি বর্ণনা করেছেন যে ইমাম নাসাই বলেছেন যে, আলি (আ.)-এর মর্যাদার মত নবি (সাঃ) এর আর কোন সাহাবীর মর্যাদা সম্পর্কে এত বর্ণনা নেই। (আল-মানাকিবুল-খাওয়ারিযমি, পৃ. ৬)

ইবনে আব্দুল বার রহ.

ইবনে আব্দুল বার বলেন, আলির গুণাবলী কিতাবের পাতায় ধরে না। উমাইয়ারা আলিকে অপমান করত এবং তাকে অপবাদ দিত, কিন্তু এই কাজগুলি আলিমদের দৃষ্টিতে আলির উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করেছে এবং তারপ্রতি ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই যোগ করেনি (ইসতিয়াব দার হাশিয়ায়ে ইসাবা, খণ্ড ৩, পৃ. ২৬)।

ফখরুদ্দিন রাযি রহ.

ইমাম ফখরুদ্দিন রাযি বলেন, যে কেউ আলিকে তাদের ধর্মীয় নেতা সাব্যস্ত করেছে, তিনি ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে একটি শক্ত ভিত্তি ধরে রেখেছেন। (তাফসিরে কাবির, খণ্ড ১, পৃ. ২০৫)।

যে ব্যক্তি আলি বিন আবি তালিবকে তার ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে অনুসরণ করে সে সত্যের দিকে পরিচালিত হয়েছে। কারণ নবি (সা.) বলেছেন:

হে আল্লাহ, আলি যে পথে ঘুরেছেন সত্যকে সেই পথে ফিরিয়ে দিন। (তাফসিরে কবির, খণ্ড ১, পৃ. ২০৭)।

ইবনে হাজার আসকালানি:

বেশিরভাগ পণ্ডিতদের মতে, আলি (আ.) হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মহানবি (সা.)-এর কোলে বেড়ে ওঠেন। সারাজীবন কখনও তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। তিনি তাবুক ব্যতীত সকল যুদ্ধে রাসূল (সাঃ) এর বন্ধু ও সঙ্গী ছিলেন। এই যুদ্ধে আলি (আ.) এর বিলম্বের কারণে নবি (সাঃ) তাকে বললেনঃ তুমি কি আমার ক্ষেত্রে মূসার কাছে হারুনের মত হতে চাও না? (আল ইসাবাহ, খণ্ড ২, পৃ. ৫০৭)।

জালালুদ্দিন সুয়ুতি:

তিনি তার বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থ “জামে আল-আহাদিস” এ আলি (আ.)-এর সনদে প্রায় ৩১৫৮টি বর্ণনা বর্ণনা করেছেন। (জামিউল আহাদিস, খণ্ড ১৫, পৃ. ১৬)।

শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভি হানাফি

শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভি বলেন, হযরত আলি (আ.) এর প্রশংসা সীমা ও পরিসংখ্যানের বাইরে। (মানাকিব আলি ইবনে আবি তালিব “রহঃ”, পৃ. ৩৫৪)।

শেখ মুহাম্মদ আবদুহু

শেখ মুহাম্মাদ আবদুহু বলেন, আরবি ভাষা ও সাহিত্যের পণ্ডিত ও বাগ্মিদের মধ্যে আলি (আ.) এর মহত্ত্ব ও পাণ্ডিত্য স্বীকার করেন না এমন কেউ নেই। আল্লাহ ও তাঁর নবির বাণীর পর ইমাম আলি বিন আবি তালিবের বক্তব্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিষয় ও মহৎ কথা  উল্লেতি রয়েছে। আমি যখন নাহজুল-বালাগাহ-এর কিছু বাক্যাংশ মনোযোগ সহকারে পড়ি, তখন আমার মনে এমন দৃশ্য ভেসে ওঠে যা বাকশক্তি ও বাগ্মীতার জীবন্ত সাক্ষী বলে মনে হয়। যেখানে সত্যের প্রমাণের সাথে হৃদয় মিশ্রিত হয়েছিল এবং শক্তিশালী শব্দের গাথুনি দিয়ে মিথ্যাকে ধ্বংস করতে এবং সত্যকে  সমুন্নত করতে চেয়েছেন। এর প্রতিটি শব্দসম্ভার সকল সন্দেহ ও মিথ্যাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ময়দানে মাহশারের মহান নায়ক হলেন আমির আল-মুমিনিন আলি বিন আবি তালিব। (শারহে নাহজুল বালাগাহ আবদুহু, পৃ. ৩)।

ইবরাহিম নিজাম মুতাযিলি:

আলি (আ.) তার যুদ্ধে সঠিক ছিলেন এবং যারা তার সাথে যুদ্ধ করেছিল তারা ভুল ছিল। তারিখে আন্দিশেহায়ে কালামি খণ্ড ১, পৃ. ২২৯, আল-ইসলামিনের প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত, খণ্ড ২, পৃ. ১৩০)।

আবু জাফর মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ ইসকাফি মু’তাযিলি

মুয়াবিয়াকে আলির (আ.) সাথে তুলনীয় মনে করাই সবচেয়ে বড় অজ্ঞতা ও মুনাফিকি। সত্যবিমুখ হাশিশি ও নীচু মানুষ বিশ্বাস এধরণের ধারণ পোষণ করেছে। (আল ‘মি‘ইয়ার ওয়াল মুওয়াযানাহ, পৃ. ৩৭)।

ইবনে আবি আল-হাদিদ মুতাযিলি:

আপনি যদি আলি (আ.)এর নৈতিক গুণাবলী এবং আধ্যাত্মিকতার দিকে দৃষ্টি বুলান তাহলে আপনি তাকে ধর্ম পালনে কঠোর, নৈতিক গুনাবলিতে সমুজ্জ্বল এবং সম্মানের উচ্চ আসনে সমাসীন পাবেন। বীরত্বের ক্ষেত্রে তিনি তার পূর্বের সকল সাহসী পুরুষের নাম ভুলিয়ে দিয়েছেন। তার পরে যারা এসেছেন তাদের সকলের নাম মুছে ফেলেছেন, এটাই সুস্পষ্ট। তিনি রোজা রাখতেন এবং যদিও তিনি ক্ষুধায় দুর্বল হয়ে যেতেন। তিনি তার খাদ্য ও মালপত্র কুরবানী করতেন এবং তার সম্পর্কে সূরা আল-ইনসানের নবম এবং দশম আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে:

وَ یُطۡعِمُوۡنَ الطَّعَامَ عَلٰی حُبِّهٖ مِسۡکِیۡنًا وَّ یَتِیۡمًا وَّ اَسِیۡرًااِنَّمَا نُطۡعِمُکُمۡ لِوَجۡهِ اللّٰهِ لَا نُرِیۡدُ مِنۡکُمۡ جَزَآءً وَّ لَا شُکُوۡرًا

আহার্যের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীকে অন্নদান করে।তারা বলে,) ‘শুধু আল্লাহর মুখমন্ডল (দর্শন বা সন্তুষ্টি) লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে অন্নদান করি, আমরা তোমাদের নিকট হতে প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও নয়। (নাহজুল-বালাগা ইবনে আবি আল-হাদিদের ভূমিকা, খণ্ড ৩, পৃ. ৫)।

ইবনে মাইছাম বাহরানি:

আমাদের মহান নেতা আমিরুল-মুমিনিন আলি বিন আবি তালিব তাঁর যে সকল বক্তব্য আমাদের কাছে পৌঁছেছে, তার যেসকল আমলের পদ্ধতি আমাদের নিকট পৌঁছেছে, এসবগুলোর সুস্পষ্ট অর্থ হল এগুলোই মূল শরিয়ত। কুরআন ও হাদিস যা বর্ণনা করেছে তিনি তা হুবহু পালন করে দেখিয়েছেন। এমনকি একটি বাক্যও এমন পাওয়া যায়নি যা কুরআনের পরিপন্থি।তাই অকুন্ঠচিত্তে একথা বলার অবকাশ আছে যে তার সকল আমল শরিয়তের নিক্তিতে গ্রহনযোগ্য ও আমলযোগ্য। তার প্রতিটি বাক্য ও আমল থেকে সঅেভেভ আসে ভেসে আসে রাসুলুল্লাহ সা. এর সুঘ্রাণ। (শারহ নাহজুল-বালাগা ইবনে মাইছাম, খণ্ড ১, পৃ. ৩৩)।

সুবহি সালেহ

এমন কোনো মুসলিম নেই যে মহানবি (সা.)-এর চাচাতো ভাই হযরত আলি কাররামুল্লাহ ওয়াজহুহ-এর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা ও বিশেষ মর্যাদাকে স্বীকার করেনা.. আলি কাররামুল্লাহ ওয়াজহুহ মহানবি (সা.)-এর সহযোগিতায় যত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন যে জগৎবিখ্যাত যোদ্ধারা তা নিতে অক্ষম এমনকি তারা এমনকি তারা পদস্খলিত হতো। একারণে  ইতিহাসের পাতায় তার নাম সমুজ্জল ও ভাস্বর হয়ে আঝছে  ও থাকবে। বদরের যুদ্ধে তার পদক্ষেপ,  খন্দকের যুদ্ধে আমর বিন আবদুদকে হত্যা করা, উহুদ ও হুনাইনের যুদ্ধে অবিচলতা ও বিশ্বস্ততা এবং খায়বারের দিনে পতাকা ধারণ করা ছিল তার জন্য অগ্নিপরীক্ষা। (মুকাদ্দামায়ে শারহে নাহজুল-বালাগা, সুবহি সালেহ পৃ. ১-২)।