অনুবাদ: ড. আবু উসামা মুহাররম
হযরত আলি (আ.) এর প্রশংসায় ইসলামের খলিফাগন ও আহলুস সুন্নাহ এর জগৎবিখ্যাত আলেমগনের হার্দিক অভিমত কেমন ছিল, নিম্নে এ সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা উপস্থাপনের প্রয়াস পাবো।
হযরত আবু বকর
قال الشعبی: بینا ابوبکر جالس اذ طلع علی بن ابی طالب من بعید فلما رآه ابوبکر قال: من سره ان ینظر الی اعظم الناس منزلة و اقربهم قرابة و افضلهم دالة و اعظمهم غناء عن رسول الله صلی الله علیه (و آله) و سلم، فلینظر الی هذا الطالع
ইমাম শা‘বি বলেন, হযরত আবু বকর বসেছিলেন। এমন সময় হযরত আলি (আ.)এর আগমন ঘটলো। আবু বকর তাকে দেখে বলেন, যদি কেউ এমন একজন ব্যক্তিকে দেখতে চায় যে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি মর্যাদার অধিকারী, আত্মীয়তার দিক থেকেও রাসুল সা. এর সবচেয়ে নিকটবর্তী, অন্যের অভাব বিদুরনকারী, যিনি আত্মমর্যাদা সম্পন্ন তাহলে তার উচিত হযরত আলি (আ.)এর দিকে দৃষ্টি দেয়া। (কানযুল উম্মাল, খণ্ড ১৩, পৃ. ১১৫)।
হযরত উমর বিন খাত্তাব
হযরত উমর বি খাত্তাব তিনি বলেন: (আলি) আমার মনিব। কারণ নবি (সা.) হযরত আলি (আ.)কে অভিভাবকত্বের সম্মানিত আসন দান করেছেন। একারণে তিনি বলতেন: সম্মানিত ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্কোন্নয় ও তাদের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করো। আর তোমার সুনাম বজায় রাখার জন্য, নীচু ও চরিত্রহীন লোকদের এড়িয়ে চল ও সতর্ক থাক। আর জেনে রেখো যে আলির অভিভাবকত্ব ব্যতীত আর কোন সম্মান পূর্ণতা অর্জন করতে পারে না। (আল-মানাকিব আল-খায়ারিজমি, পৃ. ৯৭)।
“আলির মতো কারোর অধিকার নেই অহংকারী হওয়ার এবং নিজের সম্পর্কে গর্ব করার। খোদার কসম, তার তরবারি না থাকলে ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত হতো না। আর তা ছাড়াও তিনি এই উম্মতের মধ্যে ন্যায়বিচারের ব্যাপারে সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি এবং তিনিই তাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত । (তাবাকাতে ইবনে সাদ, খণ্ড ২, পৃ. ৩৩৭)।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)
আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, ইতোপূর্বে আমার এবং আলির মধ্যে স্ত্রী এবং স্বামীর মধ্যে যা রাগ অভিমান থাকে তার মত ছাড়া আর কোন সমস্যা ছিল না… এবং আমার মতে, তিনি একজন ধার্মিক… কামিল ইবনে আছির, খন্ড ১. ৩, পৃ. ১৯৭)।
হযরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস
সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের ছেলে আমের বর্ণনা করেন: দারুন নদওয়াতে কাবা প্রদক্ষিণ করার পর, মুয়াবিয়া আমার পিতাকে তার পাশের আসনে বসিয়ে আমার পিতাকে বললেন, “আবু তালিবের পুত্রকে অভিশাপ দিতে আপনাকে কী বাধা দিচ্ছে?” আমার পিতা মুয়াবিয়ার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন: আমি আল্লাহর শপথ করছি, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার সম্পর্কে আল্লাহর রাসূলের তিনটি কথা মনে রাখব, আমি তাকে অপমান করব না। কারণ ঐ তিন কথার একটি যদি আল্লাহর রাসূল আমার সম্বন্ধে বলতেন, তবে আমি সব মূল্যবান সম্পদের চেয়ে এটাকেই বেশি প্রাধান্য দিতাম।
প্রথমত, আমি আলি সম্পর্কে শুনেছি যে কিছু যুদ্ধের সময় যখন রাসুল আলিকে নিজের স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করেন। ফলে আলিকে রেখেই যুদ্ধে যান তখন আলি দুঃখিত হয়ে বলেছিলেন: আপনি কি আমাকে জিহাদের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত করছেন? রাসুল (সাঃ) বললেনঃ তুমি কি মূসার কাছে হারুনের মত হতে পেরে সন্তুষ্ট নও? পার্থক্য শুধু এতটুকু যে আমার পরে আর কেউ নবি হবে না?
দ্বিতীয়ত, আমি রাসুল সা. কে খাইবার বিজয়ের দিন তার সম্পর্কে বলতে শুনেছি: আগামীকাল আমি এমন একজনকে যুদ্ধের পতাকা দেব যে আল্লাহর রসূলকে ভালোবাসে এবং আল্লাহ ও রাসূলও তাকে ভালোবাসেন। যখন পরদিন এলো, আমরা সবাই সজাগ ছিলাম, হয়তো তিনি আমাদেরকে তার কাছে ডাকবেন। কিন্তু হঠাৎ তিনি বললেন: আলিকে আমার কাছে ডাক। যখন তাকে ডাকা হলো, তখন তার চোখে ব্যাথা ছিল। তখন তিনি তার চোখে থুথু দিয়ে মালিশ করে তাকে যুদ্ধ করার অনুমতি দান করেন । ফলস্বরূপ, আল্লাহ তার জন্য দুর্গ খুলে দেন।
তৃতীয়ত,
اِنَّمَا یُرِیْدُ اللّٰہُ لِیُذْھِبَ عَنْکُمُ الرِّجْسَ اَھْلَ الْبَیْتِ وَ یُطَہِّرَکُمْ تَطْھِیْرًا
আয়াতটি নাযিল হলে তিনি আলি, ফাতিমা ও হাসনাইন (আ.)কে নিজের কাছে ডেকে বললেন:, এরাই আমার আহলে বাইত। (সহীহ মুসলিম, খন্ড ৭, পৃ. ১২০)
হযরত তালহা
আল্লামা খাওয়ারযমি আবু আমের আনসারি রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, জঙ্গে জামালে তালহার মৃত্যুর শেষ মুহুর্তে আমি তার কাছে পৌছালাম। তিনি বললেনঃ তুমি কে? বললাম, আমি আমীরুল মুমিনিন আলি (আ.)-এর সহচরদের একজন। তিনি বললেন, আমাকে তোমার হাত দাও যাতে আমি আমীরুল মুমিনীনের কাছে আনুগত্য করতে পারি। আমি আমার হাত বাড়িয়ে দিলাম এবং তিনি আনুগত্যের অঙ্গীকার করলেন। (আল-মানাকিবুল-খাওয়ারিজমি, ১১২)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর
এ ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কোন আফসোস নেই যে আমি কেন আলির সাথে বিদ্রোহী দল এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি (আল-মুসতাদরাক, খণ্ড ৩, পৃ. ১১৫)
ইবনে উমর একজন লোকের জবাবে যে তাকে বলেছিল: আমি আলিকে শত্রু মনে করি; তাকে বলেন, তাই আল্লাহও আলির কারণে তোমাকে শত্রু মনে করেন। (আল মুসনাদুল জামে, খণ্ড ১০, পৃ. ৭৭১)।
হযরত আবু সাঈদ খুদরি
আমরা আনসার মুনাফিকদের আলি (আ.)র সাথে শত্রুতা কারনে চিনতাম। (ফাযাইলুস সাহাবা, খণ্ড ২, পৃ. ৫৭৯)
হযরত জাবের বিন আবদুল্লাহ আনসারি
তিনি সর্বোত্তম মানব। (ফাযাইলুস সাহাবাহ, খণ্ড ২, পৃ. ৫৬৪) আলি (আ.)এর সাথে শত্রুতার কারণে আমরা মুনাফিকদের চিনতাম। (ফাযাইলুস সাহাবাহ, খণ্ড ২, পৃ. ৬৩৯) আমি পৃথিবীতে আলি বিন আবি তালিবের চেয়ে বেশি দুনিয়াত্যাগী কাউকে দেখিনি (মানাকিবুল-খাওয়ারিজমি, পৃ. ৭১)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ
মদিনাবাসীদের মধ্যে সর্বোত্তম হলেন আলি বিন আবি তালিব (আ.)। (ফাযাইলুস সাহাবাহ, খন্ড, ২, পৃ. ৬৪৬)
হযরত হাসান বসরি
আল্লাহ আলি (আ.)এর মঙ্গল করুন। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি যে, তিনি ছিলেন তার শত্রুদের জন্য একটি নির্ভুল তীরের মতো । আলি (অ.) ছিলেন সবার চেয়ে জ্ঞানী এবং নবির নিকটতম এবং এ জাতির দরবেশ। যেহেতু তার পার্থিব সম্পদের প্রতি কোনো আকাঙ্ক্ষা ছিল না, এবং তিনি আল্লাহর আদেশ পালনে কঠোর ছিলেন, তিনি সমালোচকদের তিরস্কারে ভীত ছিলেন না। কুরআন ছিল তার লক্ষ্য, জ্ঞান ও কর্মের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি এ উপায়ে জান্নাতের সর্বোচ্চ আসনে পৌঁছেছেন। (আল-বিদায়াহ ও ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ৮, পৃ. ৬)
হযরত আবু হানিফা
আলি (আ.) এবং তার বিরোধীদের মধ্যে যুদ্ধে আলি (আ.) সঠিক ছিলেন। আল ইসাবা ইবনে হাজার, খণ্ড ২, পৃ. ৫০)।
হযরত ইমাম শাফিই
যে ব্যক্তি ইমাম শাফেইকে বলেছিল, আপনি আলি বিন আবি তালিব (আ.)এর সাথে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। উত্তরে ইমাম শাফেই বলেনঃ আলির পক্ষ থেকে এ বিষয়টিকে দলীল ও প্রমাণসহ পেশ করুন যাতে আমি আমার কপাল মাটিতে রেখে আমার ভুল ঘোষণা করি এবং আমার মতামত থেকে ফিরে যাই এবং আলির সাথে একমত হই। (আল-আইম্মাতুল আরাবাহ, খণ্ড ৪, পৃ. ১১৪।
হযরত আহমদ বিন হাম্বল
আহমদ ইবনে হাম্বলের পুত্র আবদুল্লাহ তার থেকে বর্ণনা করেছেন: “আলি ইবনে আবি তালিব (আ.) আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের সাথে কারো তুলনা করা যায় না।” আবদুল্লাহ আরও বর্ণনা করেছেন:
আলি (আ.) সম্পর্কে, আমি অবশ্যই বলব যে খিলাফত আলি (আ.)কে মর্যাদা দেয়নি, বরং আলি (আ.) খিলাফতকে মর্যাদা দিয়েছে। (আল আইম্মাতুল আরাবাহ, খণ্ড ৪, পৃ. ১১৭)।
চলবে….