অনুবাদ: ড. আবু উসামা মুহাররম
শেষ অংশ…
হযরত রাসুল (সা.) থেকে বর্ণিত যে, সন্তানরা যখন অবাধ্য হয়, তখন এর দায়ভার পিতা-মাতাকেও বহন করতে হয়। তিনি আরো বলেন, আল্লাহ ঐ পিতামাতাকে রহম করুন যাদের সন্তান তাদের সাথে নম্রতার আচরণ করে।
হযরত জাফর সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে তার সন্তানকে ভালো কাজে উৎসাহিত করে আল্লাহ তার প্রতি রহম করুন। রাবি বলেন কীভাবে উৎসাহিত করব? তিনি বলেন, যে কাজগুলো সে করতে পারে, তা গ্রহণ করে নিবে আর যা সে করতে পারে না তাতে তার উপর কঠোরতা করবে না।
অন্য হাদিসে উল্লেখ আছে যে, এক ব্যক্তি হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.)কে বললেন, আমি কার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবো? তিনি বললেন, তোমার পিতা-মাতার সাথে। লোকটি বললেন, তারা তো মৃত। তিনি উত্তরে বললেন, তাহলে তোমার সন্তানদের সাথে ভালো আচরণ করো।
অন্য হাদিসে এসেছে, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে, তুমি তোমার সন্তানদের ভালবাস এবং তাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ কর। যদি তাদের কোন প্রতিশ্রুতি দাও তবে তা পালন কর। কারণ তারা মনে করে যে তুমিই তাদের ভরণপোষণ দাও।
হযরত ইমাম মুসা কাযিম (আ.) বলেছেন, নারী ও শিশুদের ওপর অত্যাচারের জন্য যে পরিমান রাগ করেন তা অন্য কোন কারনে করেন না।
একটি সহিহ হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তি তার সন্তানকে চুম্বন করবে, আল্লাহ তার জন্য নেকি দান করবেন। যে তার সন্তানকে খুশি করবে, আল্লাহ তাকে কেয়ামতের দিন খুশি করবেন। যে ব্যক্তি তার সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দিবে কিয়ামতের দিন তারা তাদের পিতামাতাকে আহবান করবে। যেন তাদের জান্নাত দেয়া হয়। তাদের দুটি নুরের টুপি পড়ানো হবে যাতে পুরা জান্নাত আলোকিত হবে।
অন্য হাদিসে তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে এসে বলল যে, সে কখনো তার সন্তানদের চুম্বন করেনি। লোকটি চলে যাওয়ার পর নবি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এই লোকটি আমার দৃষ্টিতে জাহান্নামিদের একজন।
অন্য হাদিসে তিনি বলেন, যার সন্তান আছে সে যেন তার সাথে শিশুর মতো খেলা করে।
হযরত জাফর সাদিক (আ.) বলেন, আল্লাহ ঐ বান্দার প্রতি রহম করুন যে তার সন্তানকে খুব ভালোবাসে।
অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে দেখলেন যার দুটি পুত্র ছিল; সে এক পুত্রকে চুম্বন না করে অন্য পুত্রকে চুম্বন করেছিল। তাদের উভয়ের সাথে সমান আচরণ করছিল না। এটা দেখে তিনি বললেন কেন সে এ দ্বীচারিতামূলক আচরণ করছে? সন্তানদের সাথে এমন বৈপরিত্বমূলক আচরণ কাম্য নয়। তবে যদি একজন দ্বীনদার হয় তাহলে ভিন্ন কথা।
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে একটি সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, যখন একটি বালক তিন বছর বয়সে পরিণত হয়, তখন তাকে বলবে যে সে যেন সাতবার বলে, لااِلهَ اِلاّ اللّهُ,
তারপর যখন তিনবছর সাতমাস বিশদিন হবে তখন তাকে সাতবার বলতে বলবে مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللّهِ
তারপর যখন তার বয়স পাঁচ বছর হবে, তখন তাকে আল্লাহর সামনে সিজদা করতে বলবে। তারপর যখন তার বয়স ছয় বছর হবে, তখন তাকে নামাযের তালকিন দেবে। যখন তার বয়স সাত বছর হবে, তাকে ওযু শেখাবে ও নামাযের হুকুম করবে। যখন সে অযু এবং সালাত ছেড়ে দেবে তখন তাকে প্রহার করবে। এরপর যখন সে অযু ও সালাত শিখে যায়, তখন আল্লাহ তায়ালা তার পিতামাতার প্রতি করুণা করবেন।
অন্য এক রেওয়ায়েতে উল্লেখ আছে যে, হযরত আমিরুল মুমিনিন শিশুদের লোহার বর্ম পরিধান করতে বা তাদের হাতে দিতে নিষেধ করেছেন।
অন্য একটি সহিহ হাদিসে তিনি বলেন, রাতে ঘুমানোর আগে শিশুদের হাত ও মুখমন্ডলের ময়লা ধুয়ে ফেলা উচিৎ। কেননা শয়তান এসে তাদের গন্ধ শুকে আর তারা ঘুমের মধ্যে ভয় পায়। আর এগুলোর গন্ধে হিসাবলেখক ফেরেশতারা কষ্ট পান ও অসন্তুষ্ট হন।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তি বাজারে যায় এবং কিছু ক্রয় করে এবং তা তার পরিবার-পরিজনের জন্য বাড়িতে নিয়ে আসে, তাহলে সে যেন একদল গরীব লোকের জন্য দান-খয়রাত করলো। সে যেন ছেলেদের আগে মেয়েদের দেয়। তারপর ছেলেদের দেয়। যে ব্যক্তি তার মেয়েকে আনন্দ দিল বা খুশি করলো, সে যেন হযরত ইসমাইলের সন্তানদের থেকে একজন গোলামকে মুক্ত করলো। আর যে ব্যক্তি তার ছেলের দৃষ্টিকে পরিতৃপ্ত করলো বা আনন্দ দান করলো সে যেন আল্লাহর ভয়ে কাঁদলো। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত আছে যে, তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে শক্ত খাবার খাওয়াও। কারণ গোশত তাদের শরীর বৃদ্ধি করবে এবং তাদের হাড় মজবুত করবে।
অন্য হাদিসে তিনি বলেছেন, তোমরা ডালিম খাও। কারণ এগুলো তোমাদের যৌবন ও শক্তি খুব দ্রুত বৃদ্ধি করবে।
তিব্বুল আইম্মা গ্রন্থে আমিরুল মুমিনিন (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, যদি কোন শিশু খুব কান্নাকাটি করে, তবে সম্ভবত সে ঘুমের মধ্যে ভয় পায়। অথবা ঘুমের মাঝে সে স্বপ্ন দেখে। এমন হলে তাকে এই আয়াতটি পড়ে ফুঁ দাও।
فَضَرَ بْنا عَلى اَذنِهِمْ فى الْكَهْفِ سِنينَ عَدَدا ثُمَّ بَعَثْناهُمْلِنَعْلَمَ اَىُّ الْحِزْبَيْنِ اَحْصى لِما لَبِثُوا اءَمَدا.
‘অতঃপর আমরা তাদেরকে গুহায় কয়েক বছর ঘুমন্ত অবস্থায় রাখলাম।পরে আমরা তাদেরকে জাগিয়ে দিলাম জানার জন্য যে, দু’দলের মধ্যে কোনটি তাদের অবস্থিতিকাল সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে। অর্থাৎ কানে পর্দা সৃষ্টি করে তা বন্ধ করে দিলাম। যাতে বাইরের শব্দের কারণে তাদের ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে। অর্থাৎ, আমি তাদেরকে গভীরভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় রাখলাম। (সুরা কাহাফ, আয়াত, ১১-১২)।
একটি মেয়ে ছয় বছর বয়সী হলে তাকে নামাহরাম পুরুষ যেন চুম্বন না করে এবং সে যেন বেপর্দা না হয়।
অন্য হাদিসে উল্লেখ আছে যে, হযরত ইমাম রেজা (আ.) একটি সমাবেশে ছিলেন। একটি মেয়েকে সমাবেশে আনা হলো। লোকেরা তাকে চুম্বন করছিল এবং তার কোলে বসছিল। যখন তার পালা এলো, তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন তার বয়স কত? বলা হলো পাঁচ বছর। তখন তিনি না তাকে চুম্বন করলেন এবং না তাকে কোলে বসিয়ে নিলেন।
অন্য একটি হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ছয় বছর বয়সী কোনো মেয়েকে যেন তার মা তার পাশে উলঙ্গ করে ঘুমাতে না দেয়। কারণ এ বয়সে সে নারী হিসেবে বিবেচিত।
অন্য হাদিসে উল্লেখ আছে যে, ছেলেরা ছয় বছর বয়সী মেয়েকে চুম্বন করবে না এবং সাত বছর বয়সী ছেলে মেয়েদের চুম্বন করবে না।
সহিহ হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি তার সন্তানদের অবহেলা করে এবং তাদের ভরণ-পোষণ দেয় না সে অভিসপ্ত।
হযরত ইমাম মুসা কাযিম (আ.) বলেছেন, কোন মানুষের সন্তান-সন্ততি তার নিকট বন্দীর মত। তাই আল্লাহ যাকে সন্তান দান করেছেন সে যেন বন্দীদেরকে মর্যাদা দান করে। তার উচিত তার সন্তানদের জন্য খরচের হাত প্রসারিত করা। যদি সে তা না করে, তাহলে শীঘ্রই তার কাছ থেকে সেই নেয়ামত উঠিয়ে নেয়া হবে।
হযরত ইমাম জাফর সাদিক বলেন, যে ব্যক্তি দুই মেয়ে, দুই বোন, দুই খালা বা দুই ফুফুর জন্য অর্থ ব্যয় করবে, তারা তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন।
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বেহেশতে এমন একটি স্তর রয়েছে যে স্তরে তিন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ পৌঁছতে পারবে না: একজন ন্যায়পরায়ন শাসক, আরেকজন ব্যক্তি যে তার পরিবারের সাথে সদ্ব্যবহার করে এবং অপরজন পরিবারের কর্তা যে তার সন্তানদের জন্য অর্থ খরচ করে এবং তাদের কষ্ট সহ্য করে।
হযরত জাফর সাদিক (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, পাঁচজন লোকের ভরণ-পোষণ দিতে হয়: সন্তান, পিতা-মাতা, স্ত্রী, চাকর-বাকর এবং সন্তান-সন্ততি ও তাদের সন্তান, এভাবে অধস্তন। পিতা-মাতা ও তাদের উপরে অর্থাৎ দাদা-দাদি, এমনকি আরো যদি কেউ উপরে থাকে।
তথ্যসূত্র:
আল্লামা মুহাম্মাদ বাকের মাজিলিসি, হিলয়াতুল মুত্তাকিন, পৃ. ১০৯।