Press "Enter" to skip to content

ফাযল বিন সাযান (রহ.) কে ছিলেন?

এস, এ, এ

বংশ:

ইতিহাসে ফাযল বিন সাযান’র সঠিকভাবে জন্ম তারিখ কোথাও বর্ণিত হয়নি। তবে ধারণা করা হয় যেহেতু তিনি ইমাম রেযা (আ.) হতে সেহেতু ধারণা করা যেতে পারে যে, তিনি দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষে অর্থাৎ প্রায় ১৮০ হিজরীর দিকে নিশাবুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দৃশ্যত তিনি নিশাবুরের নিবাসী ছিলেন, কিন্তু তাঁর পূর্বপুরুষগণ ছিলেন আরবের অধিবাসী। তাঁর পিতার নাম ছিল সাযান বিন খালিল। তিনি একজন ইমামীয়া হাদীস বর্ণনাকারী, যুক্তিবাদী এবং ফক্বিহ ছিলেন।

নাজ্জাশি মত অনুযায়ি ফাযল বিন সাযান ইয়েমেনের প্রসিদ্ধ ‘আযদ’ গোত্রের লোক ছিলেন এবং তাঁর পিতা ইউনুস বিন আব্দুর রহমানের ছাত্র ছিলেন। কিছুজন আবার মনে করেন যে, তাঁর পিতা ছিলেন ইরানী বংশভূত।

কিন্তু সিন্দি উল্লেখিত মতকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না। কেননা রেওয়ায়েতের বর্ণনা অনুযায়ি ফাযল আলী বিন মূসা (আ.) হতে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন সুতরাং বলা যেতে পারে যে, তিনি প্রায় ১৮০ হিজরীর দিকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

জ্ঞান অর্জন:

কাশশি’র বর্ণনা অনুযায়ি ফাযল বিন সাযান আব্বাসীয় খলিফা হারুন’র মৃত্যুর পরে তাঁর পিতার সাথে বাগদাদে চলে যায়। সেখানে তিনি ইসমাইল বিন ইবাদ’র কাছে কোরআন শিখে।

ফাযল বিন সাযান  বাগদাদে বিভিন্ন পন্ডিতদের যেমন: মুহাম্মাদ বিন আবি উমাইর এর কাছে জ্ঞান অর্জন করেন। (রেজালে নাজ্জাশি, পৃষ্ঠা ৩৪) অতঃপর তিনি কুফায় যান সেখানে হাসান বিন মাহাবুব, আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন আবি নাসর, সাফওয়ান বিন ইয়াহিয়া, নাসর বিন মুযাহিম প্রমুখদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করেন।

স্বদেশে প্রত্যাবর্তন:

ফাযল বিন সাযান পুণরায় নিশাবুরে প্রত্যাবর্তন করেন। সেখানে তিনি কিছু দিন অতিবাহিত করেন। আব্দুল্লাহ বিন তাহিরের শাষনকালে তিনি শিয়া আকায়েদ প্রচার প্রসারের কারণে নিশাবুর থেকে নির্বাসিত হন। ইমাম হাসান আসকারী (আ.)র যুগে খোরাসানে তিনি একজন বিশ্বস্ত ইমামীয়া আলিম হিসেবে প্রসিদ্ধতা অর্জন করেছিলেন এবং তিনি ইমামের কাছ থেকে দূরে থেকেও যো ‘বাইহাক্বিতে’ ফাযল বিন সাযান থেকে রেওয়ায়েত এবং তাঁর জীবনের অন্তিম সময়ের কিছু কথা বর্ণিত হয়েছে।

ইমামতের সংস্পর্শে:

ইতিহাস এটা উল্লেখ করেনি যে, ফাযল কখন ইমাম রেযা (আ.)র সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। তবে তিনি ইমাম রেযা (আ.) থেকে অনেক রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন। শেখ তুসী’র বর্ণনা অনুযায়ি ফাযল বিন সাযান ইমাম হাদী (আ.) এবং ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র সাহাবী ছিলেন। তবে নাজ্জাশির মত অনুযায়ি তিনি ইমাম মুহাম্মাদ তাক্বি (আ.) থেকে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন।

জ্ঞানের অবস্থা:

ফাযল বিন সাযান যুক্তিবিদ্যায় পটু ছিলেন। শেখ তুসী তাঁকে ধর্মতত্ত্ববিদ বলে মনে করতেন।

ফাযল বিন সাযান’কে ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র যুগে খোরাসানে ইমামী বিশ্বাসের একজন বিশ্বস্ত পন্ডিত হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ইমাম হাসান আসকারী (আ.) হতে ফাযল বিন সাযান দুই ধরণের রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন

১. বক্তৃতা।

২. সহানুভূতিমূলক।

ফিক্বাহ:

ফাযল বিন সাযানকে তাঁর যুগের ফক্বিহ বলা হতো। মুহাকেকে হিল্লি প্রথম শ্রেণীর ফিকাহবিদদের একজন মনে করতেন। তবে দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে তাঁর ফিক্বাহ সংক্রান্ত অল্প কিছু তথ্য অবশিষ্ট রয়েছে। ইবনে শাজানের ন্যায়শাস্ত্রের কোন অংশ ইমামদের বিখ্যাত মতামতের স্পষ্ট বিরোধিতা করে না।

হাদীস:

ফাযল বিন সাযান হাদীসের সনদ বর্ণনার ক্ষেত্রে ইমামদের সূত্র ব্যাবহার করেছেন। নাজ্জাশি তার নিশ্চিতকরণ বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন।

ফাযলের আকায়েদ:

ইবনে শাজানের ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষা ভিত্তির যে সামান্য তথ্য পাওয়া যায় যেমন:

১. আল্লাহর নির্বাচিত ইমামদের কর্তৃত্বের স্বীকারোক্তি পরিলক্ষিত হয়।

২. তিনি রাজআতে বিশ্বাসী ছিলেন।

৩. হযরত ওমরের সাথে ইমাম আলী (আ.)র কন্যা উম্মে কুলসুমের বিবাহকে তিনি অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন যে তিনি অন্য উম্মে কুলসুম ছিলেন।

৪. ইমামতে তাঁর বিশ্বাস ইমামীয়া বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল কেননা তিনি ইমামতকে রাসুল (সা.)’র বংশধারা মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং ইমামের অনুসরণকে তিনি ওয়াজিব বলে মনে করতেন। তিনি মনে করতেন যে, একই সময়ে দুইজন ইমামতের পদে অধিষ্ঠিত হতে পারে না।

৫. তিনি মনে করতেন যে, ইমাম (আ.)গণ অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন কেননা তাঁদের কাছে ঐশী জ্ঞান ছিল।

৬. তিনি মনে করতেন রাসুল (সা.) ইসলাম ধর্ম পরিচালনার জন্য নিজের স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করেছিলেন।

৭. ইমাম (আ.) রাসুল (সা.) থেকে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।

আলী (আ.) – এর ইমামতের প্রমাণ:

ইবনে সাযান তাঁর ‘এলাল’ নামক গ্রন্থে ইমাম আলী (আ.)’র ইমামত প্রমাণ করেছেন এবং অন্যান্যদের খেলাফতকে অস্বীকার করেছেন এবং তিনি ইমামতের বিভিন্ন বিষয়কে বর্ণনা করেছেন।

অন্যান্য মাযাবের সাথে সখ্যতা:

ফাযল বিন সাযান যখন ইরাকে ছিলেন তখন ফাতাহিয়া এবং ওয়াকেফিয়া ফেরক্বার নেতৃস্থ পর্যায়ে ব্যাক্তিদের সাথে সখ্যতা ছিল। ফাযল বিন সাযানের মুনাযিরার (তর্ক বিতর্ক) অনুষ্ঠানে ফাতাহিয়া ফেরক্বার ব্যাক্তিত্বরা অংশগ্রহণ করতো এবং তিনি তাদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলেন যেমন: ফাতাহিয়া ফেরক্বার আলী বিন আসবাত, ওয়াকেফিয়া ফেরক্বার সাইফ বিন উমাইরাহ, উসমান বিন ঈসা, আব্দুল্লাহ বিন কাসিম হাযরামী এবং আব্দুল্লাহ বিন জাবালা।

রচনাসমূহ:

নাজ্জাশি লিখেছেন যে, কাশশি তাঁর গ্রন্থসমূহে ফাযল বিন সাযান’র প্রায় ১৮০টি এবং শেখ তুসি প্রায় ৩০ সূত্র উল্লেখ করেছেন। রয়েছে তন্মধ্যে কিছু যুক্তিবিদ্য এবং কিছু ফিক্বাহ সংক্রান্ত। নাজ্জাশি তার রেজাল নামক গ্রন্থে এবং তুসী তার আল ফেহরেসত নামক গ্রন্থে ফাযল বিন সাযান’র কিছু লেখনীর উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন যেমন:

১. ইসবাতুর রাজাআ।

২. তালাক্ব।

৩. এলালুশ শারায়েহ।

৪. ফারায়েযুল কাবীর।

৫. ফারায়েযুল আওসাত।

৬. ফারায়েযুস সাগীর।

৭. মাসায়েলুল বোলদান।

৮. ইয়াউম ওয়া লাইল।

৯. ইযাহ: এই গ্রন্থটি বিভিন্ন ফেরক্বার মতবাদের অপনোদনের উদ্দেশ্যে লিখা হয়েছিল।

১০. ফারায়েযে আমিরুল মুমিনিন।

১১. কিতাবুল ঈমান।

১২. কিতাবুত তালাক্ব।

১৩. কিতাবুন নাজাহ।

১৪. কিতাবুত তাফসীর।

১৫. কিতাবুল কেরাআত।

১৬. কিতাবুল আরায ওয়াল জাওয়াহির।

১৭. আল গ্বিবা যা হুজ্জাত বিন হাসান সম্পর্কে লিখা হয়েছে।

নাজ্জাশি এবং তুসী ফাযল বিন সাযান’র যে লেখনীগুলো তুলে ধরেছেন তা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয় যে, তিনি বিভিন্ন মতাদর্শের যেমন: মোতাযেলে, মাতালা, মুরজেআ, খারিজি, গ্বালি শিয়া লোকদের সাথে জ্ঞানগর্ভ বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং পত্র বিনিময় করতেন।

মৃত্যু:

শেখ মুহাম্মাদ কাশশি লিখেছেন: ফাযল বিন সাযান যখন বেইহাক্বির পাশের একটি গ্রামে অবস্থান করছিল তখন তিনি খারেজিদের বিদ্রোহের খবর শুনতে পান এবং তাদের কালো থাবা থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে আবার তিনি উক্ত এলাকাটি পরিত্যাগ করেন। ফাযল বিন সাযান তাঁর দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত করার পরে অতিরিক্ত ভ্রমনের কষ্টের কারণে তিনি ২৫৯ হিজরীতে অসুস্থ হন এবং ২৬০ হিজরীর শুরুতে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁকে নিশাবুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। নিশাবুরের সাধারণ কবরস্থানটি ফাযল বিন সাযানের কারণে নামকরণ করা হয় বেহেশতে ফাযল।

গ্রন্থসূত্র:

১. উয়ুনে আখবারে রেযা, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১১৮।

২. মোজামে রেজালিল হাদীস ওয়া তাফসিল তাবাকাতির রাওয়াত, খন্ড ২১, পৃষ্ঠা ৩২৭।

৩. রেজালে নাজ্জাশি, পৃষ্ঠা ৩৪, ৩০৭।

৪. ইখতিয়ারে মারেফাতুর রেজাল, পৃষ্ঠা ৫৩৯- ৫৪১।

৫. মোজামে রেজালিল হাদীস, খন্ড ১৪, পৃষ্ঠা ৩১৫।

৬. রেজালে তুসি, পৃষ্ঠা ৩৯০, ৪০১।

৭. আল মোতাবার, পৃষ্ঠা ৭।

৮. আল ফেহরেস্ত, পৃষ্ঠা ১২৪।

৯. আল গ্বিবা, পৃষ্ঠা ২৪৮।

১০. উসুলুল আসিল, পৃষ্ঠা ৫।

১১. আল কাফি, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ৯৩- ৯৬।

১২. শারহে নাহজুল বালাগা, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২২৮।

১৩. এলালুশ শারায়েহ, পৃষ্ঠা ১- ৪।

১৪. ফুসুলুল মোখতারা, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৮৩- ৮৫।

১৫. মুখতাসার ইসবাতুর রাজাআ,

১৬. তারিখে কুম, পৃষ্ঠা ১৯৩।

১৭. মুখাতালিফুশ শিয়া, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৭৯।

১৮. আর রেজাল, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২১৫।

১৯.  মান লা ইয়াহযারুহুল ফাক্বিহ, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৯৭।

২০. উয়ুনুল আখবার, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১১৯।

২১. আল খেসাল, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৫৮।

২২. আত তৌহিদ, পৃষ্ঠা ১৩৭।