এস, এ, এ
আরবীতে ‘হাজর’ শব্দের অর্থ পাথর আর ‘আসওয়াদ’ শব্দের অর্থ কালো। ‘হাজরে আসওয়াদ’—কাবাঘরের দেয়ালে বিশেষভাবে স্থাপনকৃত কালো রঙের প্রাচীন একটি পাথরের নাম। যা কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মাতাফ থেকে দেড় মিটার (চার ফুট) উঁচুতে অবস্থিত। মুসলিম বিশ্বাস অনুযায়ী এই পাথর আদম ও হাওয়ার সময় থেকে পৃথিবীতে রয়েছে। ‘হাজরে আসওয়াদ’ বেহেশতের মর্যাদাপূর্ণ একটি পাথর। হাদীসের গ্রন্থগুলোতে হাজরে আসওয়াদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে প্রচুর আলোচনা এসেছে।
হাজরে আসওয়াদ মূলত পাথরের একটি একক অংশ ছিল তবে আজ বেশ কয়েকটি টুকরো নিয়ে গঠিত যা একসাথে সিমেন্ট করা বা জোড়া দেওয়া হয়েছে। এগুলি একটি রূপালী ফ্রেম দ্বারা বেষ্টিত যা কাবার বাইরের দেওয়ালে রুপোর নখর দ্বারা বাঁধা থাকে। টুকরোগুলি নিজেরাই ছোট ছোট টুকরো দিয়ে গঠিত যা আজ দৃশ্যমান সাত বা আটটি টুকরো তৈরি করেছে। পাথরের উন্মুক্ত মুখের পরিমাপ প্রায় ২০ সেন্টিমিটার (৭.৯ ইঞ্চি) × ১৬ সেন্টিমিটার (৬.৩ ইঞ্চি )। এর মূল আকার অস্পষ্ট এবং রেকর্ড করা মাত্রা সময়ের সাথে সাথে যথেষ্ট পরিবর্তিত হয়েছে, কারণ টুকরোগুলি বেশ কয়েকবার তাদের সিমেন্ট ম্যাট্রিক্সে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়েছে। দশম শতাব্দীতে, একজন পর্যবেক্ষক কালো পাথরটিকে এক কিউবিট (৪৬ সেমি বা ১৮ ইঞ্চি) দীর্ঘ বলে বর্ণনা করেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, এটি ১৪০ বাই ১২২ সেমি (৪ ফুট ৭ ইঞ্চি বাই ৪ ফুট ০ ইঞ্চি) পরিমাপ হিসাবে রেকর্ড করা হয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আলী বে’র মতে, এটিকে ১১০ সেন্টিমিটার (৩ ফুট ৭ ইঞ্চি) উঁচু হিসেবে বর্ণনা করা হয় এবং মুহাম্মদ আলী পাশা এটিকে ৭৬ সেন্টিমিটার (২ ফুট ৬ ইঞ্চি) লম্বা বাই ৪৬ সেমি (১ ফুট ৬ ইঞ্চি) চওড়া বলে জানিয়েছেন। আসুন জেনে নেই রেওয়ায়েতের আলোকে হাজরে আসওয়াদের ইতিকথা:
হালাবি বলেন: আমি আবি আব্দুল্লাহকে হাজরে আসওয়াদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন: কেন লোকজন হাজরে আসওয়াদকে স্পর্শ করে? তিনি বলেন: এইজন্য যে, যখন আল্লাহ আদমের সন্তানদের কাছ থেকে ওয়াদা গ্রহণ করছিলেন। তিনি হাজরে আসওয়াদকে নির্দেশ দেন যে সকল বান্দাগণ ওয়াদা করেছে তুমি তাদের সাক্ষি থাক। সুতরাং যারা নিজেদের অঙ্গীকারের উপরে অটল ছিল হাজরে আসওয়াদ তার পক্ষে সাক্ষ্য দিত যে, উক্ত ব্যাক্তি নিজের ওয়াদার উপরে অটল ছিল।
হাজরে আসওয়াদ সম্পর্কে মুহাম্মাদ বিন সানান-এর উত্তরে আবাল হাসান আলী বিন মূসা রেযা (আ.) বলেন: হাজরে আসওয়াদকে স্পর্শ করার উদ্দেশ্যে হচ্ছে যখন আল্লাহ আদমের সন্তানদের কাছ থেকে ওয়াদা গ্রহণ করছিলেন। পাথরটি তাদের সাক্ষ্যকে নিজের ভিতরে সংরক্ষিত রাখে আর এই কারণে লোকজন নিজেদেরকৃত ওয়াদাকে পরিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে পাথরটিকে স্পর্শ করে এবং যখন তারা পাথরটির কাছে পৌছায় তখন বলে: আমার রক্ষিত আমানতকে দাও আমি আবার নিজের ওয়াদাকে পূণরাবৃত্তি করতে চাই যেন তুমি সাক্ষ্য দিতে পার যে, আমি আমার ওয়াদাকে পূর্ণ করেছি। সালমান ফার্সি (রা.)-এর কথা দ্বারা এটাই প্রমানিত হয় যে, তিনি বলেছিলেন: কেয়ামতের দিন হাজরে আসওয়াদ উপস্থিত হবে এবং যারা তার কাছে নিজেদের কৃত ওয়াদাকে পুণরাবৃত্তি করেছিল তাদের পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবে।
মুহাম্মাদ বিন মুসলিম হযরত আবি আব্দুল্লাহ থেকে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন যে, রাসুল (সা.) বলেছেন: যখন তোমরা বাইতুল্লাহ-এর তাওয়াফ করবে তখন হাজরে আসওয়াদকে স্পর্শ করবে কেননা তা হচ্ছে পৃথিবীর বুকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকত স্বরূপ। যে ব্যাক্তি হাজরে আসওয়াদকে স্পর্শ করবে পাথরটি তার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, উক্ত ব্যাক্তিটি নিজের কৃত অঙ্গীকারকে পূর্ণ করেছে।
ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) বলেছেন: হাজরে আসওয়াদ হচ্ছে আমাদের নৈকট্য লাভের একটি দ্বার স্বরূপ আমরা ঐ দরজার দিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করবো। আর এই কারণে ইমাম (আ.) হাজরে আসওয়াদকে বেহেশতের একটি দরজা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
হযরত আবি আব্দুল্লাহ (আ.) হতে একজন রাভী বর্ণনা করেছেন যে, আমি ইমাম (আ.)কে জিজ্ঞাসা করলাম যে ব্যাক্তি হাজরে আসওয়াদের কাছে যাবে সে কি চাইবে? ইমাম (আ.) বলেন: হাজরে আসওয়াদের পাশ দিয়ে বেহেশতের একটি নহর প্রবাহিত হয়েছে এবং প্রত্যেক বৃহস্পতিবারে উক্ত নহরে বান্দাদের আমলকে ঢেলে দেওয়া হয়।
আব্দুর রহমান বিন কাসীর হাশেমী হযরত আবি আব্দুল্লাহ হতে বর্ণনা করেন যে, একদা উমর বিন খাত্তাব হাজরে আসওয়াদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পাথরটিকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন: হে পাথর! আল্লাহর শপথ আমরা জানি যে, তুমি শুধুমাত্র একটি পাথর ব্যাতিত আর কিছু না, তুমি না কোন উপকার করতে পার আর না কোন ক্ষতি করতে পার, আমরা যেহেতু দেখতাম যে রাসুল (আ.) তোমাকে ভালবাসতেন তাই আমরাও তোমাকে ভালবাসি। আমিরুল মুমিনিন (আ.) হযরত উমরকে বলেন: হে খাত্তাবের সন্তান! তুমি কিভাবে এই কথাটি বলতে পারলে, কেয়ামতে আল্লাহ এই পাথরকে এমন অবস্থায় উপস্থাপন করবেন যে, তার একটি জিহ্ববা এবং দুটি ঠোট থাকবে এবং সে ঐ ব্যাক্তির পক্ষে সাক্ষ্য দিবে যে, নিজের অঙ্গীকারের উপরে অটল ছিল। কেননা উক্ত পাথরটি পৃথিবীর বুকে আল্লাহর বরকত স্বরূপ। সৃষ্টিকূল তার কাছে বাইয়াত করে। তখন উমর বলেন: হে আল্লাহ যেই শহরে আলী বিন আবি তালিব থাকবে না সেখানে আমাকে রেখ না।
আবান বিন তাগ্বলাব হযরত আবু আব্দুল্লাহ (আ.) হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন: হে আবান তুমি কি জান কেন লোকজন হাজরে আসওয়াদ পাথরকে চুম্বন করে?
আবান বলে না আমি জানি না।
ইমাম (আ.) বলেন: হযরত আদম (আ.) পৃথিবীতে ভয়ে আল্লাহর কাছে অভিযোগ করলে, হযরত জিব্রাইল তাঁর কাছে আসেন এবং বেহেশত থেকে একটি ইয়াকুত পাথর নিয়ে আসেন। বেহেশতে যখন হযরত আদম (আ.) এই পাথরে পাশ দিয়ে যেতেন তখন তিনি তাতে লাথি মারতেন। যখন তিনি উক্ত পাথরটিকে দুনিয়ার বুকে দেখেন এবং চিনতে পারেন তখন তাড়াতাড়ি পাথরটিকে তুলে নেন এবং তাতে চুম্বন করেন আর এই কারণে লোকজন পাথরকে চুম্বন করে হয়তো এই পাথরটি হচ্ছে সেই ইয়াকুত।
ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন যে, একদা রাসুল (সা.) তাওয়াফ করছিলেন এবং হযরত আয়েশা তাঁর সাথে ছিলেন। যখন তিনি রুকুনে পাথরকে স্পর্শ করার জন্য আসেন তখন তিনি হযরত আয়েশাকে বলেন: যদি এই পাথরে সকল অজ্ঞতা এবং অপবিত্রতা স্থান্তরিত না হতো তাহলে উক্ত পাথরের মাধ্যমে সকল অসুস্থ ব্যাক্তি সুস্থতা লাভ করতে পারতো এবং প্রথম যখন আল্লাহ তায়ালা তাকে দুনিয়ার বুকে প্রেরণ করেন অনুরূপ অবস্থায় থাকতো। বস্তুত এই পাথটি ছিল সাদা ইয়াকুত যা বেহেশতের সাদা ইয়াকুত পাথরসমূহের মধ্যে একটি।…..
ওহাব ইয়ামানী বলেন: রুকুন এবং মাকাম-এর উভয় ইয়াকুত পাথরদ্বয় হচ্ছে বেহেশতের পাথর যা দুনিয়ায় সাফা পাহাড়ের বুকে এসেছিল, যেমনভাবে প্রদীপ অন্ধকারকে দূরীভুত করে অনুরূপভাবে উক্ত পাথরদ্বয় পূর্ব থেকে পশ্চিমে অবস্থিত মানুষের জন্য পৃথিবীকে আলোকিত করতো।
অন্য একজন রেওয়ায়েত বর্ণনাকারী বলেন: আমার পিতা সাআদ বিন আব্দুল্লাহ থেকে এবং তিনি আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন ঈসা থেকে এবং তিনি আব্দুর রহমান বিন আবি নাজরান এবং হুসাইন বিন সাঈদ ইনারা সকলে হাম্মাদ বিন ঈসা থেকে এবং তিনি হারিয বিন আব্দুল্লাহ থেকে এবং তিনি আবি আব্দুল্লাহ থেকে তিনি বলেন: হাজরে আসওয়াদ পাথরটি প্রথমে দুধের চেয়ে সাদা ছিল, যদি অজ্ঞতা এবং অপবিত্রতা তার সংস্পর্শে না আসতো তাহলে যেই অসুস্থ ব্যাক্তি তা স্পর্শ করতো সে সুস্থ হয়ে উঠতো।
মুহাম্মাদ বিন হাসান বিন আহমাদ বিন ওয়ালিদ (রা.) তিনি সাআদ বিন আব্দুল্লাহ থেকে এবং তিনি ইসমাঈল বিন মুহাম্মাদ তাগ্বলাবী থেকে তিনি আবু তাহির ওয়াররাক্ব থেকে এবং তিনি হাসান বিন আইয়ুব থেকে এবং তিনি আব্দুল কারিম বিন আমরু থেকে এবং তিনি আব্দুল্লাহ বিন আবি ইয়াফুর থেকে এবং তিনি হযরত আবি আব্দুল্লাহ (আ.)-এর কাছে যখন হাজরে আসওয়াদের কথা উত্থাপন করেন তখন তিনি বলেন: লক্ষ্য রেখ হাজরে আসওয়াদের দুইটি চোখ, একটি নাক এবং একটি জিহ্ববা রয়েছে ইতিপূর্বে সে দুধের চেয়েও সাদা ছিল এবং বর্তমানের ন্যায় তার তখনও তা যথেষ্ট সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিল।
তথ্যসূত্র: এলালুশ শারায়ে, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৬২- ৩৭৫।