Press "Enter" to skip to content

সাদকাতুল ফিতরা ও তার পরিমাণ

ফিতরা বা ফেতরা(فطرة) আরবী শব্দ, যা ইসলামে যাকাতুল ফিতর (ফিতরের যাকাত) বা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) নামে পরিচিত। ইমাম জাফর বিন মুহাম্মদ আল সাদিক্ব (আঃ) বলেনঃ- ফেতরা প্রদান রোজাকে পূর্ণতা দান করে যেভাবে নামাযে মহানবীর উপর দরুদ পাঠ করলে নামাযকে পূর্ণতা দান করে। অতএব কোন ব্যক্তি যদি মাহে রমজানের রোজা পালনের পর ইচ্ছাকৃত ভাবে ফেতরা না দেন তাহলে তার অবস্থা ঐ লোকের মতো যে আদৌ রোজা রাখেনি। ঠিক একইভাবে নামাযে মহানবীর প্রতি দরুদ পাঠ না করলে তার নামে কোন নামাযই লিপিবদ্ধ করা হবে না।(সুত্রঃ মান লা ইয়াহদ্বারুল ফাক্বী, ২য় খন্ড ১৮৩ নম্বর পৃষ্ঠা।) অন্যান্য আহকামের মত ফিতরার ও কোরবাতের শর্ত আছে। ফিতরা বালেগ, আকেল, স্বাধীণ, স্বনির্ভরের ব্যাক্তির উপর ওয়াজেব।

ফেতরার আহকাম হচ্ছেঃ-

(১) যদি শাওয়ালের পহেলা চাঁদের (ঈদের চাঁদ) উদয়ের রাত্রিতে সুর্যস্তের সময় কোনো ব্যক্তি কারো ঘরে আসে, যদি সে এক সেকেন্ড আগেও আসে এবং আকেল, ও বালেগ হয় শুধু মাত্র পরোধীন ও ফকির বাদে বাকী সকলের উপরে ফেতরা দিতে হবে।

(২) যদি কোন ব্যক্তি নিজের এবং নিজের পরিবারের সারা বৎসরের খরচ বহন করতে না পারে এবং রোজগার করার সামর্থ্য না থাকে তাহলে এমন ব্যক্তির উপর ফেতরা ওয়াজেব নহে।

(৩) ফিতরার পরিমাপঃ প্রত্যেক ব্যক্তিকে তিন কিলো চাল, খোরমা, কিশমিশ, গম, ইত্যাদি থেকে যে কোন একটি দিতে হবে। উক্ত পরিমাপের মূল্য বা টাকা দিতে চাইলেও দিতে পারবে।

(৪) যারা সৈয়দ নয় তারা গায়েরে সৈয়দ বা সৈয়দের ফেতরা গ্রহণ করতে পারবেন। কিন্তু যারা সৈয়দ তারা গায়েরে সৈয়দের ফেতরা গ্রহণ করতে পারবেন না।

(৫) যারা ফেতরা পাওয়ার হকদার তাদেরকে কমপক্ষে একজনের পূর্ণ ফেতরা দিতে হবে।

(৬) ঈদের নামাযে গমনের পূর্বেই সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে।

–সুত্রঃ রমজানুল মোবারক, ১১২তম পৃষ্ঠা, প্রকাশনায়: নুরুস সাকলায়েন জন কল্যাণ সংস্থা, ঢাকা, বাংলাদেশ।

সদকায়ে ফিতরঃ মাথাপিছু “এক সা” (এ দেশীয় ওজনে এক সা’ সমান তিন সের এগার ছটাক) প্রচলন।

আবদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুসলিম দাস ও স্বাধীন ব্যক্তি নর ও নারী এবং বালক ও বৃদ্ধের ওপর সদকায়ে ফিতর (রোযার ফিতরা) এক, সা (এ দেশীয় ওজনে এক সা’ সমান তিন সের এগার ছটাক) যব নির্ধারিত করে দিয়েছেন । তিনি এটাও আদেশ করে দিয়েছেন যে, লোকদের ঈদের নামাযে যাবার পূর্বেই যেন তা আদায় করা হয়।

–সূত্রঃ সহীহ আল বুখারী, আধুনিক প্রকাশনী ২য় খন্ড, হাদীস: ১৪০৬, পৃষ্ঠা: ৬১।

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা (রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সময়ে) সদকায়ে ফিতরা বাবদ (মাথাপিছু) এক সা’ (তিন সের এগার ছটাক) পরিমাণ খাবার অথবা এক সা যব অথবা এক সা’ খেজুর অথবা এক সা’ পনির অথবা এক সা’ কিশমিশ প্রদান করতাম ।

–সূত্রঃ সহী আল বুখারী, ২য় খন্ড, হাদীস: ১৪০৯, পৃষ্ঠা: ৫৮, আধুনিক প্রকাশনী।

সদকায়ে ফিতরঃ মাথাপিছু “দুই ‘মুদ্দ’” (এ দেশীয় ওজনে এক সা এর অর্ধেক; অর্থাৎ একসের সাড়ে তের ছটাক) প্রচলন।

আবদুল্লাহ ইবনে উমর বলেন, নবী (সাঃ) সদকায়ে ফিত্র বাবত এক সা’ (তিন সের এগার ছটাক) খেজুর অথবা এক সা’ যব প্রদান করতে নির্দেশ দিয়েছেন আবদুল্লাহ বলেন যে (পরবর্তীকালে) লোকেরা (আমীর মুয়াবিয়া ও তার সঙ্গীরা) তার স্থলে দুই ‘মুদ’ গম (অর্থাৎ অর্ধেক সা এক সার দু ভাগের এক ভাগ যার পরিমান এক সের সাড়েতের ছটাক নির্ধারিত করেছেন) ।

–সূত্র: সহী আল বুখারী, ২য় খন্ড, হাদীস: ১৪১০, পৃষ্ঠা: ৬২, আধুনিক প্রকাশনী।

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, নবী (সাঃ) এর সময়ে আমরা ফিতরা বাবদ (মাথাপিছু) এক সা’ (তিন সের এগার ছটাক) খাবার অথবা এক সা’ খেজুর অথবা এক সা’ যব কিংবা এক সা’ কিশমিশ-মোনাক্কা প্রদান করতাম। মুয়াবিয়ার যমানায় যখন গম আমদানী হল তখন তিনি বললেন, আমার মতে এর (গমের) এক ‘মুদ্দ’ অন্য জিনিসের দুই মুদের সমান।

–সুত্রঃ সহীহ আল বুখারী, ২য় খন্ড, কিতাবুয যাকাত, পৃষ্ঠা: ৬২, হাদীস: ১৪১১, আধুনিক প্রকাশনী।

আল্-হায়ছাম ইবনে খালিদ (র) আবদুল্লাহ ইবনে উমার হতে বর্ণিত তিনি বলেন, লোকেরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর যুগে মাথাপিছু এক সা পরিমাণ বার্লি অথবা খেজুর বা বার্লি জাতীয় শস্য, অথবা কিশমিশ সদকায়ে ফিতর প্রদান করত রাবী (নাফে) বলেন, আবদুল্লাহ বলেনঃ অতঃপর হযরত উমরের সময় যখন গমের ফলন অধিক হতে থাকে, তখন তিনি আধা সা গমকে উল্লেখিত বস্তুর এক সা’ এর সম পরিমাণ নির্ধারণ করেন।

–সুত্রঃ আবু দাউদ শরীফ, ২য় খন্ড, কিতাবুয যাকাত, পৃষ্ঠা: ৪০৭, হাদীস: ১৬১৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।

মুসাদ্দাদ (র)….আবদুল্লাহ ইবনে উমার হতে বর্ণিত তিনি বলেন, পরবর্তী কালে লোকেরা (উমারের) অর্ধ সা গম দিতে থাকে নাফে বলেন, আর হযরত আবদুল্লাহ সদকায়ে ফিতর হিসাবে শুকনা খেজুর প্রদান করতেন। অতঃপর কোন এক বছর মদীনায় শুকনা খেজুর দুষপ্রাপ্য হওয়ায় তাঁরা সদকায়ে ফিতর হিসাবে বার্লি প্রদান করেন।

–সুত্রঃ বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ; আবু দাউদ শরীফ, ২য় খন্ড, কিতাবুয যাকাত, পৃষ্ঠা: ৪০৮, হাদীস: ১৬১৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসলামা (র) আবু সাঈদ আল- -খুদরী (রা) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের মাঝে (জীবিত) ছিলেন, তখন আমরা সদকায়ে ফিতর আদায় করতাম প্রত্যেক ছোট, বড়, স্বাধীন ও ক্রীতদাসের পক্ষ থেকে এক সা’ পরিমাণ খাদ্য (খাদ্যশস্য) বা এক সা পরিমাণ পনির বা এক সা’ বার্লি বা এক সা’ খোরমা অথবা এক সা’ পরিমাণ কিশমিশ । আমরা এই হিসাবে সদকায়ে ফিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম, এবং অবশেষে মুআবিয়া হজ্জ অথবা উমরার উদ্দেশ্যে আগমন করেন অতঃপর তিনি মিম্বরে আরোহণ পূর্বক ভাষণ দেন এবং লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, সিরিয়া থেকে আগত দুই ‘মুদ্দ’ (দুই মুদ হলঃ এক সা এর অর্ধেক; অর্থাৎ একসের সাড়ে তের ছটাক) গম এক সা খেজুরের সম পরিমাণ। তখন লোকেরা তাই গ্রহণ করেন। কিন্তু আবু সাঈদ আল খুদরী (রা) বলেন, আমি যত দিন জীবিত আছি সদকায়ে ফিতর এক সা’ হিসাবেই প্রদান করতে থাকব।

–সুত্রঃ বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজা, নাসাঈ, আবু দাউদ শরীফ, ২য় খন্ড, কিতাবুয যাকাত, পৃষ্ঠা: ৪০৮, হাদীস: ১৬১৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।

প্রিয় পাঠক, নবী (সাঃ)এর ফেতরার পরিমান, নবীর জীবদ্দশায় এক সা; (তিন সের এগার ছটাক) প্রদান করিতেন, নবীর (সাঃ)এর ওফাতের পর মুসলমানদের ও খলিফাদেরও একই নিয়ম ছিল, কিন্তু হযরত উমরের সময় ও মুয়াবিয়া যখন রাজতন্ত্র কায়েম করলেন তখন নবীর সুন্নতকে বদলে দিলেন ও নিজের মত নিয়ম জারী করলেন। এখন আপনাদের সামনে প্রমান স্বরূপ সহীহ আল বুখারী ও আবু দাউদ থেকে উল্লেখ করা হল যে, নবী (সাঃ)এর ফিতরার পরিমান এক সা’ (তিন সের এগার ছটাক)। কিন্তু মুয়াবিয়ার প্রদত্ত অর্ধেক সা (এক সের সাড়ে তিন ছটাক) দিতেন। এখন আমাদেরকে দেখতে হবে যে আমরা কার অনুসরণ করবো ? আলাহর নবী (সাঃ) এর নাকি মুয়াবিয়ার? এটা যার যার বিবেকের ব্যাপার। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন আমি সব সময় এক সা-ই দিব রাসূল (সাঃ) এর জীবদ্দশায় আমরা ঐ পরিমান ফিতরা দিতাম। অর্থাৎ রাসূলের সময় তাদের যে খাদ্য ছিল সেটার উপর তারা ফিতরা দিতেন। যেমন আমাদের দেশে প্রধান খাদ্য চাল। কিন্তু দেওয়া হয় গম। আবার সবাই কিন্তু এক দামের চাল খায়না, কেউ খায় বাসমতি চাল, কেউ খায় নাজিরশাইল প্রিমিয়াম, কেউ খায় পোলাওয়ের চাল, আবার কেউ খায় সাধারণ ১৮ থেকে ৪০ টাকা কেজি দামের চাল । এই হিসাবে ফেতরা বের হয়। কিন্তু তা না করে নিজের ইচ্ছেমত ফেতরা বের করতে হবে, এটা কি রকম ইনসাফ? রাসূল (সাঃ)এর বিশিষ্ট সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) মুয়াবিয়ার প্রদত্ত (দ্বীনে পরিবর্তন বা নতুন সংযোজন বেদআত) মানতে অস্বীকার করেন। কিন্তু আবু সাঈদ খুদরীর হাতে কোন ক্ষমতা ছিলনা। ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল মুয়াবিয়া ও তার উমাইয়া বংশ্বের হাতে। আর তারই ফলে আমাদের কাছে রাসূল (সাঃ)এর সুন্নাত না এসে এসেছে মুয়াবিয়ার সুন্নাত। আজ অধিকাংশ মুসলমানরা নবী (সাঃ)এর প্রদত্ত সুন্নাত অনুসরণ না করে বেদআত ফিতরা অনুসরণ করছে যেমন এক সার’ বদলে অর্ধ সা’ ফিতরা দিচ্ছে এবং উদাহরণ দিচ্ছেন যে দুই মুদ্দ এক সা’র সমান তখনকার যুগে কিশমিশ, খোরমা তাঁদের খাদ্য ছিল তাই তারা সেই খাদ্য অনুসারে ফিতরা প্রদান করত পরবর্তীকালে লোকেরা আধা সা’ গমকে এর (এক সা’ খেজুরের) সমান ধরে নিয়েছেন। সকল সহীহ হাদীস অনুযায়ী সুন্নতে রাসূল (সাঃ)-এ ফিতরার পরিমাণ সমান কিন্তু পণ্য ভিন্ন ভিন্ন অর্থাৎ পণ্য নয়, পরিমাণ-ই মূল বিবেচ্য বিষয়। তাই সুন্নাতে রাসূল হিসেবে নবী (সাঃ)এর প্রদত্ত এক সা ফিতরা আমাদেরকে দিতে হবে যার পরিমান (তিন সের এগার ছটাক) সচেতন মুসলমান বিষটি ভেবে দেখবেন।

১ সা’ = এ দেশীয় ওজনে ১ সা’ সমান ৩ সের ১১ ছটাক = ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম × বর্তমান স্থানীয় বাজার মুল্য = টাকা।

২ ‘মুদ্দ’ = ১ সা’র অর্ধেক, অর্থাৎ ১ সের সাড়ে ১৩ ছটাক = ১ কেজি ৬৫০গ্রাম × বর্তমান স্থানীয় বাজার মুল্য = টাকা।

পরিশেষে আল্লাহর দরবারে এই প্রার্থনা যে, আল্লাহ আমাদের সবাইকে তার নবীর প্রদত্ত সঠিক ফেতরা প্রদান করে রোযার হক আদায় করার তৌফিক দান করুন, মুহাম্মদ ও আলে মুহাম্মদ ‘আহলেবায়তের’ পথে চলার ও জানার তৌফিক দান করুন।

সূত্র: লেখাটি মোঃ সাব্বির আলমের সম্পাদনায় “কোরআন ও হাদিসের আলোকে মাহে রমজান” বই থেকে সংকলিত।

—সৈয়দ হোসাইন উল হক আল-হোসাইনী