এস, এ, এ
রোবাব (আ.) ছিলেন আমরু আল-কায়স কোলবির কন্যা, হযরত আলী আসগর (আ.) এর মা, কারবালার তিনি একজন পণ্ডিত, বাগ্মী, মহীয়সী, বিখ্যাত, বিশিষ্ট এবং সবচেয়ে প্রিয় ও ঘনিষ্ঠদের কাছে একজন আদর্শ নারী হিসেবে সুপরিচিতি ছিলেন। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর স্ত্রী এবং তার যুগের একজন বিখ্যাত, গুণী ও বিশ্বস্ত নারী। এই মহীয়সী নারীর প্রতি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বিশেষ দৃষ্টি এবং অগাধ ভালবাসা ছিল। হযরত রোবাব ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একজন বিশ্বস্ত ও উত্তম স্ত্রী ছিলেন। কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার পরে হযরত রোবাব তাঁর কবিতা দ্বারা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্যাদা বর্ণনার মাধ্যমে নিজের জ্ঞানের মহিমা প্রকাশ করেন।
বংশ:
রোবাব আমরু কায়স বিন উদাই-এর কন্যা ছিলেন। তার পিতা একজন সিরিয়ান আরবীয় খ্রিস্টান ছিলেন। তিনি উমর বিন খাত্তাবের খিলাফতকালে [খিলাফত: ১৩-২৩ হিজরি] সময় মুসলমান হয়েছিলেন। রোবাবের মাকে হিন্দ আল-হনাউদ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি রাবি বিন মাসউদ বিন মাসাদ বিন হিসান বিন কাবের কন্যা ছিলেন। [আয়ানুশ শিয়া, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ৪৪৯]
হযরত রোবাবের ব্যক্তিত্ব এবং নৈতিক বৈশিষ্ট্য:
ঐতিহাসিকগণ সুস্পষ্ট তথ্য সহ প্রমাণ যে, হযরত রোবাব একজন শিক্ষিত, পণ্ডিত ও গুণী মহিলা ছিলেন। যিনি হযরত হুসাইন (আ.)-এর দৃষ্টিতে সম্মানের উচ্চ স্থান অধিকার করেছিলেন।
সাইয়্যেদ মোহসেন আমিন বলেছেন: আল-আগানী নামক গ্রন্থে হিশাম কালবী থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে যে রোবাব সেই যুগের শ্রেষ্ঠ নারীদের মধ্যে অন্যতম, সুন্দরী, ভদ্র ও বুদ্ধিমত্তায় সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। [আয়ানুশ শিয়া, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ৪৪৯]
আল-ওয়াফি ওয়াল ওয়াফিয়াত-এ সাফাদি নিম্নরূপ লিখেছেন:
হযরত রোবাব মহিলাদের মধ্যে ফযিলতপূর্ণ, সবচেয়ে সুন্দর এবং উত্তম নারী ছিলেন। [আল-সাফাদী, ৭৫/১৪]
ইবনে আসাকার তারিখে দামেস্ক নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: হযরত রোবাব সবচেয়ে সুন্দরী এবং বুদ্ধিমান নারী ছিলেন। [তারিখে দামেস্ক, ইবনে আসাকার, খন্ড ৯, পৃষ্ঠা ৭৩]
সাইয়্যেদ মোহসেন আমিন আয়ানুশ শিয়া নামক গ্রন্থে হযরত রোবাবের গুণাবলী এভাবে বর্ণনা করেছেন: হযরত রোবাব একজন সুন্দরী এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে জ্ঞানী নারী ছিলেন। [আয়ানুশ শিয়া, আমিন, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ৪৪৯]
হজরত রোবাব (আ.) ছিলেন সৌন্দর্য, ভদ্রতা ও বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে শ্রেষ্ঠ নারীদের একজন।
হিশাম কোলবি হযরত রোবাব সম্পর্কে বলেছেন: হযরত রোবাবের সদগুণ এবং বৈজ্ঞানিক ও ব্যবহারিক কর্তৃত্ব কারো থেকে গোপন নয়। [ইসমাইলি ইয়াযদি, ৫৩৮]
হজরত রোবাব বুদ্ধিমত্তা ও আচার-আচরণে শ্রেষ্ঠ নারীদের মধ্যে একজন ছিলেন এবং তার পিতাকে আরবের অভিজাত পরিবারের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
হযরত রোবাবের বিবাহ:
ইবনে আসাকার তার ইতিহাস গ্রন্থ “তারিখে মদীনাতুদ দামেস্ক” হযরত রোবাবের সাথে ইমামের বিবাহের ঘটনাটি নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেন:
উমরের সময় আমর আল-কায়েস মসজিদে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি যখন মসজিদ থেকে তার বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়, ইমাম আলী (আ.) ও হাসনাইনের সাথে মসজিদ থেকে বাহিরে আসেন। ইমাম আলী (আ.) তাকে বললেন: আমি আলী বিন আবি তালিব, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চাচাতো ভাই এবং এরা দুজন আমার সন্তান। আমরা আপনার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করতে চাই। হযরত আলীর প্রতি তার চরম আগ্রহ ও ভক্তির কারণে তিনি তার কন্যা সালমীকে ইমাম হাসানের সাথে এবং রোবাবকে ইমাম হুসাইনের সাথে বিয়ে দেন। [ইনসাবুল আশরাফ, বালাযুরী, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৯৫, আল ইরশাদ, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৩৫, তারিখে মাদীনা দামেস্ক, খন্ড ৬৯, ১১৯]
সন্তান সন্ততি:
ইমাম হোসাইন (আ.) থেকে রোবাবের দুটি সন্তান ছিল, একটি সাকিনা এবং অন্যটি আবদুল্লাহ। আবদুল্লাহ রাযী [আলী আসগার] যখন তিনি মাত্র শিশু ছিলেন আশুরার দিনে পিতার কোলে শহীদ হন। [আল ইরশাদ, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৩৫]
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর দৃষ্টিতে হযরত রোবাব:
ইমাম হুসাইন (আ.) রোবাবকে খুব ভালবাসতেন এবং তাঁকে নিয়ে কবিতাও লেখেন। ইমাম হোসাইনের একটি কবিতায় তিনি বলেছেন: “আমি এমন একটি ঘর পছন্দ করি যেখানে রোবাব ও সকিনা থাকে।” [আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ২২৮, আয়ানুশ শিয়া, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ৪৪৯, তাজুল উরুস, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১০, ইনসাবুল আশরাফ, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৯৬]
ইমাম হোসেন (আ.)-এর প্রতি রোবাবের ভালোবাসা:
হজরত রোবাব একজন জ্ঞানী মহিলা ছিলেন এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর প্রতি হযরত রোবাবের ভালবাসা ছিল অগাধ। ইতিহাসে এই সম্পর্কে রোবাবের একাধিক পদক্ষেপ বর্ণিত হয়েছে:
ক. হজরত রোবাব (আ.) মদীনায় ফিরে এলে কুরাইশের কিছু প্রবীণ ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তি তাকে প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি মানেননি এবং তিনি বলেন: (لایَکُون لی حمو بَعدَ رَسُولِ الله) “আমি বিয়ে করব না এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পর কাউকে শশুর হিসেবে মেনে নিব না”।
খ. কারবালার পর রোবাব তার স্ত্রী ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য যে কবিতাগুলো লিখেছেন তা তার ভালোবাসার উচ্চতার নিদর্শন।
গ. উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের মজলিসে হজরত রোবাব (আ.)-এর পরিস্থিতিতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, হযরত রোবাবের দৃষ্টি যখন ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পবিত্র মস্তকের ওপর পড়ল, তখন তিনি অত্যান্ত অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মাথাটা কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে পাশে রেখে বিলাপ করলেন।
কারবালায় উপস্থিতি:
উদ্ধৃত প্রমাণ ও সাক্ষ্য অনুযায়ী হযরত রোবাব কারবালায় উপস্থিত ছিলেন এবং বন্দীদের সাথে সিরিয়ার দামেস্কে গিয়েছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কোলে আলী আসগার (আ.)কে শহীদ হতে দেখেছিলেন। ইবনে কাসীর বলেন: রোবাব কারবালায় হোসাইন (আ.)-এর সাথে ছিলেন এবং হোসাইনকে যখন হত্যা করা হয়েছিল, তখন তিনি অত্যন্ত অধৈর্য ও অস্থির হয়ে গেছিলেন। [আয়ানুশ শিয়া, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ৪৪৯, আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ২২৯]
শামে গারিবাতে রোবাব (আ.)-এর ধৈর্য:
১১ই মহরম রাতে [শামে গারিবা] হজরত রোবাব (সা.আ.) কারবালার উষ্ণ ময়দানে তার স্বামী, সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের দেহকে রক্তে রঞ্জিত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছেন, অন্যদিকে তিনি শিশু ও শোকার্ত নারীদের আর্তনাদ প্রত্যক্ষ করেছেন, যারা সকলেই তাদের প্রিয়জনদের হারানোর শোকে শোকাহত ছিল। হজরত রোবাব (সা.আ.) ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর অর্ধপোড়া তাঁবুর দিকে তাকাচ্ছিলেন, যেখানে তিনি জ্বরে আক্রান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে ছিলেন। সাকিনা তার বাবাকে খুঁজছিল; হজরত রোবাব (সা.আ.) অর্ধ-পোড়া তাঁবুতে আসগারের কথা ভেবে শোকে ঘুম পাড়ানির গান গাইছিলেন। এজিদের সৈন্যরা রোবাবের জন্য আলী আসগারের খালি দোলনাটিও অবশিষ্ট রাখেনি সেটাও লুন্ঠন করে নেয়।
শামে গারিবাতে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সন্তানরা সবাই একটি অর্ধপোড়া তাঁবুর ভিতরে জড়ো হয়েছিল। হযরত সকিনা তার ছোট্ট ভাইয়ের কথা স্মরণ করে ক্রন্দন করছিলেন। জয়নাব (সা.আ.) আলী আসগর (আ.)-এর মিষ্টি হাসির কথা স্মরণ করে বারবার কাঁদছিলেন। তার মনে পড়ছিল গতরাতে আলী আসগর (আ.) তৃষ্ণার্ত ঠোঁটে দোলনায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, এমতাবস্থায় হঠাৎ অর্ধপোড়া তাঁবুর আড়াল থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। জয়নব তাড়াহুড়ো করে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেলেন। দেখলেন রোবাব কাঁদছেন, জয়নাব (সা.আ.) রোবাব (সা.আ.) কে সম্বোধন করে বললেন: হে রোবাব! শিশুদের স্বার্থে আমাদের শান্ত থাকতে হবে। রোবাব (সা.আ.) বললেন: আজ সন্ধ্যায় তারা আমাদের পানি দিয়েছে। আমার বুক দুধে ভরে গেছে, কিন্তু এই দুধ পান করার পিপাসার্ত আলী আসগর কোথায়?
হযরত রোবাবের আযাদারী ও পদক্ষেপসমূহ:
হযরত রোবাব সূর্যের নিচে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পবিত্র দেহকে নিজের চোখে দেখার পর ছায়ায় না থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন; বর্ণিত হয়েছে যে, হজরত জয়নব (সা.আ.) যখন তাকে অন্য নারীদের সাথে ছাদের নিচে বা ছায়ায় এসে শোক পালন করতে বলতেন, তখন তিনি বিষয়টিকে প্রত্যাখ্যান করতেন এবং বলতেন: “যেহেতু আমি প্রখর সূর্যের নিচে আমার মাওলা হোসাইনের লাশকে পড়ে থাকতে দেখেছি, তাই আমি আমি নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।” আমি যতদিন বেঁচে থাকব ছায়ার নিচে অবস্থান করব না।
এক সূত্রের বর্ণনা অনুসারে, রোবাব এক বছর পর্যন্ত কারবালায় হুসাইন (আ.)-এর কবরের কাছে অবস্থান করেন এবং তারপর মদীনায় ফিরে আসেন। কিন্তু শহীদ কাজী তাবাতাবাই মনে করেন যে, হযরত রোবাব কারবালায় নয় বরং মদীনায় শোক পালন করেছিলেন এবং তিনি বলেছেন: ইমাম সাজ্জাদ (আ.) নিষেধ করার পরে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর স্ত্রী রোবাব কারবালার প্রান্তরে একা অবস্থান করেননি কারণ এক বছরের জন্য কারবালায় অবস্থানের বিষয়টি ছিল তাঁর ব্যাক্তিত্বের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি আরও বলেন: কেউ নিশ্চিতভাবে বলেনি যে, রোবাব ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পবিত্র কবরের কাছে এক বছর অবস্থান করেছিলেন। [হযরত সৈয়দুশ শোহাদা, পৃষ্ঠা ১৯৮- ২০০]
হযরত রোবাব মদীনায় ফিরে আসার পরে কুরাইশের অনেক স্বনামধন্য ব্যাক্তিত্বরা তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দেয় কিন্তু তিনি তাদের প্রস্তাবে রাজি হননি এবং তিনি বলেন: আমি রাসুল (সা.)-এর পরে আর কাউকে নিজের শশুর হিসেবে মেনে নিতে পারব না । [আল কামেল ফিত তারিখ, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৮৮]
মাসকালাতুত তাহান নামক একজন ব্যাক্তি ইমাম সাদিক (আ.) থেকে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন তিনি বলেন: আমি ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-কে বলতে শুনেছি: যখন হোসাইন (আ.) নিহত হন, তখন তাঁর স্ত্রী কালাবিয়্যাহ তার জন্য শোক প্রকাশ করেন এবং তিনি নিজেও ক্রন্দন করেন এবং অন্যান্য মহিলা ও দাসরাও তাঁর সাথে এতই ক্রন্দন করতেন যে তাদের চোখের অশ্রু শুষ্ক হয়ে যায়। এমতাবস্থায় তিনি তার এক দাসীকে কাঁদতে দেখেন এবং যার চোখ অশ্রুসজল ছিল, তিনি তাকে ডেকে বললেন: আমাদের মধ্যে শুধু তোমার চোখ কেন অশ্রুজল?! তিনি বললেন: আমি সুওয়াইক শরবত পান করি। তিনি তাদেরকে সুওয়াইক শরবত প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন এবং তারা সুওয়াইক শরবত পান করেন। অতঃপর তিনি বললেন: আমি এই কাজ দিয়ে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জন্য কান্না করার শক্তি অর্জন করতে চাই। [কাফি, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৪৬৬]
কিছু ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুসারে, শাম থেকে প্রত্যাবর্তনের পর হযরত রোবাব ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কবরে এক বছর একাকী অবস্থান করেন এবং শোক পালন করেন এবং তারপর মদীনায় ফিরে আসেন, তিনি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের কারণে খুবই বিচলিত ও ব্যথিত ছিলেন। [আল কামেল ফিত তারিখ, ইবনে আসীর, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৮৮]
কারবালায় এই মহীয়সী নারীর অবস্থানের বিষয়টি কোনভাবেই অস্বীকার করা সম্ভব না। কেননা সেই যুগে বিশেষ করে বিশ্বস্ত নারীদের মধ্যে এ ধরনের কাজ প্রচলিত ছিল, ঠিক যেমন ইমাম হাসান (আ.)-এর পুত্র হাসান মোসান্নার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ফাতিমা তার কবরের পাশে একটি তাঁবু স্থাপন করেছিলেন এবং একটি বছর সেখানে শোক প্রকাশ করেছিলেন।
শেখ কুলাইনি ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত রোবাব ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য এক বছর কারবালায় শোক পালন করেছিলেন, না তিনি এক বছর তিনি সেখানে অবস্থান করেছিলেন।
তবে কিছু কিছু লেখক এই বিষয়টিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত রোবাব শোকসভা অনুষ্ঠিত করেছিলেন, তবে সেটা মদীনায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সমাধি কারবালাতে নয়। ঐতিহাসিক সূত্রে বর্ণিত আছে যে, ইমাম সাজ্জাদ (আ.) রোবাবকে কারবালায় এক বছর একা থাকার অনুমতি দেননি এবং হযরত রোবাবও এমন নারী ছিলেন না যিনি ইমাম (আ.)-এর নির্দেশের বিরূদ্ধে কাজ করবেন।
হযরত রোবাব (আ.)-এর জীবনে পার্থিব ভোগ-বিলাস থেকে দূরে থাকার বিষয়টিও বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। একদিন হজরত রোবাবের কাছে সুগন্ধি বা মুরগির বিরিয়ানির একটি পাত্র আনা হয়েছিল যেন তিনি নিজেকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোক থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। যখন হযরত রোবাবের দৃষ্টি মুরগির বিরিয়ানির থালার উপর পডড়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেন এটা কি? তারা বলে: এটি কারো পাঠানো উপহার যেন আপনি নিজেকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোক পালন করা থেকে অব্যাহতি দেন। তিনি বললেন: আমরা আনন্দিত নই! এগুলো আমাদেরকে হুসাইন (আ.)কে হারানোর কষ্টকে নিবারণ করতে পারবে না। অতঃপর তিনি মহিলাদের ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন এবং তিনি তাদের রেখে যাওয়া কোন কিছুর নিজের ঘরে স্থান দেননি।
মদিনায় রোবাবের বাড়ি ধ্বংস:
মদীনায় ইয়াজিদের নিযুক্ত গভর্নর সাঈদ বিন আস যখন সে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের খবর শুনে, তখন সে হযরত আলী (আ.), আকিল ও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর স্ত্রী রোবাবের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
হযরত রোবাবের ওফাত:
হযরত রোবাব ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্যাদা ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে জানতেন বিধায় দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হবে জেনেও তিনি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সাথে কারবালায় আসেন। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর হজরত রোবাব (আ.) এক বছরের বেশি জিবীত ছিলেন না। হযরত রোবাব এই সময়টা সম্পূর্ণ অস্বস্তি ও দুঃখের মধ্যে কাটিয়েছেন এবং মূহুর্তের জন্য সূর্য উদয় থেকে নিয়ে অস্ত পর্যন্ত ছাদের নিচে বা ছায়ায় অবস্থান করেননি। এমতাবস্থায় তার শরীর জীর্ণ হয়ে যায় এবং অধিক শোক ও দুঃখের কারণে অবশেষে তিনি মদীনায় ইন্তেকাল করেন। [আল কামেল ফিত তারিখ, ইবনে আসীর, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ২২৯, তাযকেরাতুল খাওয়াস, ইবনে জুযি, পৃষ্ঠা ২৩৮, ক্বামক্বামে যাখখার, ফরহাদ মীর্যা, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৬৫৩, আয়ানুশ শিয়া, আমীন, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ৪৪৯, আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ইবনে কাসীর, খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ২২৯, নাফসুল মাহমুম, কুম্মী, পৃষ্ঠা ৩৪০, রিয়াহিনুশ শারিয়া, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ৩১৩]
উপসংহার:
রোবাব ছিলেন আমর আল-কাইস বিন আদির কন্যা, ইমাম হুসাইন (আ.) এর স্ত্রী এবং সাকিনা এবং আলী আসগার (আব্দুল্লাহ রাযী)-এর মা। এই মহীয়সী নারীর অনন্য ব্যক্তিত্বের কারণে তাঁর প্রতি হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ভালবাসা ছিল অসীম। যেহেতু রোবাব (আ.) ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মহত্ত্ব ও উচ্চ মর্যাদা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, তাই তিনি নিজেকে হুসাইন (আ.)-এর দাসী মনে করতেন। ইমাম হুসাইন (আ.)-এর স্ত্রীদের মধ্যে তিনিই একমাত্র মহিলা যিনি কারবালার ঘটনায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তিনি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর অনুসরণ করেন এবং তাঁর সাথে কারবালার যাত্রায় সমস্ত ধরণের দুঃখ ও কষ্ট সহ্য করেন। এই মহীয়সী নারী আহলে বাইত (আ.)-এর অন্যান্য নারীদের সাথে কারবালার দুর্ভোগ এবং সিরিয়ার বন্দিত্ব দশাকে সহ্য করেছিলেন। তিনি আহলে বাইত (আ.)-এর সাথে বন্দি অবস্থায় এজিদের দরবারে যান; তারপর তিনি মদীনায় ফিরে আসেন এবং ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জন্য শোক পালন করেন এবং তাঁর শোকগাথাও গাইতে থাকেন। কারবালা থেকে বন্দীদের কাফেলা প্রত্যাবর্তনের পর রোবাব (আ.) হযরত সাজ্জাদ (আ.)-এর অনুমতিক্রমে কয়েকজন দাসীর সাথে কারবালায় অবস্থান করেন এবং শোক পালন করেন এবং চতূর্থ ইমামের নির্দেশে এক বছর পর মদীনায় ফিরে আসেন। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর প্রতি ভালোবাসার কারণে তিনি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শোকে ক্রমাগত কাঁদতেন। অবশেষে হুসাইন (আ.)-এর শাহাদতেকে কেন্দ্র করে অত্যাধিক কান্নাকাটি ও শোকের কারণে এক বছর পর [৬২ হিজরিতে] তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।