Press "Enter" to skip to content

হযরত নূহ (আ.)কে কেন দ্বিতীয় আদম বলা হয়?

‘আমিতো নূহকে তার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করেছিলাম। সে তাদের মধ্যে অবস্থান করেছিল পঞ্চাশ কম হাজার বছর। অতঃপর প্লাবন তাদেরকে গ্রাস করে; কারণ, ওরা ছিল সীমা লঙ্ঘনকারী। অতঃপর আমি তাকে এবং যারা তরণীতে আরোহণ করেছিল তাদেরকে রক্ষা করলাম এবং বিশ্বজগতের জন্য একে করলাম একটি নির্দশন।’ (সূরা আনকাবুত : ১৪-১৫)

লক্ষ লক্ষ বছর আগে আবদুল গাফফার নামে এক মহৎ ব্যক্তি বাস করতেন। একদিন তিনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ কোথা থেকে অতি কুৎসিত কদাকার এক কুকুর তাঁর সামনে এসে হাজির হলো। বিশ্রী কুকুরটিকে দেখে তিনি বিরক্ত হলেন। বিড়বিড় করে বললেন : ‘কী কুৎসিত একটি কুকুর!’

মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় কুকুরটি মানুষের মতো কথা বলে উঠল : ‘হে আবদুল গাফফার! আপনি কাকে উপহাস করছেন? আমাকে যিনি বানিয়েছেন সেই স্রষ্টাকে, না আমাকে? আমার এই কুৎসিত চেহরার পিছনে তো আমার কোন হাত ছিল না।’

কুকুরের কথা শুনে আবদুল গাফফার চমকে উঠলেন। তাইতো! এই কুকুরটাও তো মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সৃষ্টি। মহান স্রষ্টার সৃষ্টির ঘৃণা করার অধিকার তো তাঁর নেই। কুকুরটার প্রতি খারাপ মনোভাবের জন্য তিনি খুবই দুঃখিত হলেন। তিনি কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন, হে প্রভু! আমাকে মাফ করে দাও। না বুঝে তোমার সৃষ্টিকে নিয়ে ঠাট্টা করেছি।

সেই অপরাধের অনুশোচনা করে আবদুল গাফফার দীর্ঘ দশ বছর আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করেছেন। তিনি এত বেশি কাঁদতেন যে, চোখের পানি পড়ে পড়ে তাঁর চিবুকের নিচে দাগ পড়ে গিয়েছিল। লোকজন এই অবস্থা দেখে তাঁকে নূহ ডাকতে শুরু করে। আরবি ভাষায় ‘নূহ’ অর্থ যে ক্রন্দন করে।

হযরত নূহ (আ.) ছিলেন আল্লাহর নবী। তাঁর সময়ের লোকজন ছিল অত্যন্ত দুর্নীতিবাজ এবং মূর্তিপূজক। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলাকে বাদ দিয়ে বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করত। এসব মূর্তির নাম ছিল ওয়াফ, সুয়া, ইযাগুথ, ইয়াউক এবং নাসরা।

আল্লাহ তাআলা হযরত নূহ (আ.)-কে ক্ষমা করলেন এবং ক্রন্দন করতে নিষেধ করলেন। তিনি হযরত নূহকে সমাজের লোকজনকে হেদায়েত করার  আদেশ দিলেন যাতে লোকজন মূর্তিপূজা বাদ দিয়ে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তার  ইবাদত করে।

এ ব্যাপারে পাক কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি তো নূহকে তার সম্প্রদায়ের নিকট পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, ‘আমি তোমাদের জন্য প্রকাশ্য সর্তককারী, যাতে তোমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর ইবাদত না কর; আমি তোমাদের এক মর্মন্তুদ দিনের শাস্তির আশঙ্কা করি’।” (সূরা হূদ : ২৫-২৬)

এভাবে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার আদেশ পেয়ে হযরত নূহ (আ.) তাঁর দেশের লোকজনকে মূর্তিপূজা ছেড়ে সৎপথে আসার আহ্বান জানালেন। মিথ্যা দেব-দেবীকে ছেড়ে প্রকৃত প্রভু আল্লাহ তাআলার ইবাদত করতে বললেন। হযরত নূহ (আ.) কতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে জনগণের কাছে আল্লাহ তাআলার বাণী প্রচার করতে লাগলেন। কিন্তু দুষ্ট লোকেরা তাঁর কথা শুনল না। যেমন পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তার সম্প্রদায়ের প্রধানেরা, যারা ছিল কাফির, তারা বলল, ‘আমরা তোমাকে তো আমাদের মতোই মানুষ দেখছি; আমরা তো দেখছি, কিছু না বুঝে তোমার অনুসরণ করছে তারাই যারা আমাদের মাঝে অধম এবং আমরা আমাদের ওপর তোমাদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব দেখছি না; বরং আমরা তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী মনে করি’।” (সূরা হূদ: ২৭)

অনেকদিন হেদায়াত করার পরও জনগণ হযরত নূহ (আ.)-এর কথা শুনল না। মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া সবাই তাঁর বিরোধিতা করতে লাগল। অনন্যোপায় হয়ে হযরত নূহ (আ.) আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা জানালেন যেন এসব অবাধ্য, দুষ্ট প্রকৃতির লোককে শাস্তি দেয়া হয়।

আল্লাহ তাআলা এই দুষ্ট লোকগুলোকে শাস্তি দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি হযরত নূহ (আ.)-কে আদেশ দিলেন একটি নৌকা তৈরি করতে। আল্লাহ ঠিক করেছেন একটি মহাপ্লাবন দিয়ে অবাধ্য কাফিরদের ধ্বংস করে দেবেন। যেমন আল কুরআনে বলা হয়েছে : ‘তুমি আমার তত্ত্বাবধানে ও আমার প্রত্যাদেশ অনুযায়ী নৌকা নির্মাণ কর এবং যারা সীমা লঙ্ঘন করেছে তাদের সম্পর্কে তুমি আমাকে কিছু বল না; তারা তো নিমজ্জিত হবে।’ (সূরা হূদ : ৩৭)

আল্লাহ তাআলার নির্দেশ অনুযায়ী হযরত নূহ (আ.) একটি বিশাল আকৃতির নৌকা তৈরি করতে লাগলেন। হযরত নূহ (আ.)-এর কাজ দেখে দুষ্ট লোকেরা হাসাহাসি করতে লাগল। তাঁকে উদ্দেশ্য করে ওরা বলল : ‘হে নূহ! কি ব্যাপার? নবী থেকে এখন কাঠমিস্ত্রী বনে গেলে নাকি? তোমার প্রভুর খবর কি? এ মরুভূমিতে তোমার নৌকা চালাবে কোথায়? মাথাটা বিগড়ে গেল নাকি? হাঃ হাঃ হাঃ’

আল্লাহ তাআলা এক সময় তাঁকে জানালেন, যখন চুলা থেকে পানি বেরিয়ে আসবে তখন থেকেই প্লাবন শুরু হবে।

হযরত নূহ (আ.) প্রতিদিন সকালে খোঁজ নিতে লাগলেন কখন মাটি ফেটে পানি বেরিয়ে আসে। কিছুদিন পরে একদিন সত্যিই দেখতে পেলেন চুলার নিচ থেকে মাটি ফেটে তীব্র বেগে পানি বেরিয়ে আসছে। অর্থাৎ মহাপ্লাবন শুরু হয়ে গেছে।

হযরত নূহ (আ.) আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ঘন কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে দশ দিগন্ত। দেখতে দেখতেই অঝোর ধারায় শুরু হলো বৃষ্টিপাত। এভাবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রইল।

হযরত নূহ (আ.) তাড়াতাড়ি তাঁর পরিবার-পরিজন ও মুষ্টিমেয় কিছু অনুসারীকে নিয়ে নৌকায় উঠে পড়লেন। তারপর নৌকায় বিভিন্ন স্তরের দরজাগুলো খুলে দিলেন। তারপর প্রত্যেক পশু-পাখির এবং প্রত্যেক বস্তুর জোড়া জোড়া নৌকায় উঠিয়ে নিলেন। যেমন কুরআন মজীদে বলা হয়েছে : ‘অবশেষে যখন আমার আদেশ আসল এবং উনুন উথলে উঠল; আমি বললাম, এতে উঠিয়ে নাও প্রত্যেক শ্রেণির যুগল, যাদের বিরুদ্ধে পূর্ব-সিদ্ধান্ত হয়েছে তারা ব্যতীত তোমার পরিবার-পরিজনকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে তার সংগে ঈমান এনেছিল অল্প কয়েকজন।’ (সূরা হূদ : ৪০)

এভাবে আল্লাহ তাআলার নির্দেশে হযরত নূহ (আ.) সব জিনিসের জোড়া নৌকায় উঠিয়ে নিলেন। ওদিকে রাত দিন অবিরাম বর্ষণের ফলে চারদিকে পানি বেড়ে গেল। শুরু হলো মহাপ্লাবন। হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকা এবং এর আরোহীবৃন্দ ছাড়া সবকিছুই পানির নিচে ডুবতে লাগল। দেখতে দেখতে মরুভূমি, পাহাড়-পর্বত সবকিছুই দ্রুত পানির নিচে তলিয়ে গেল। প্রচণ্ড বৃষ্টির তোড় তবুও থামছে না। আল্লাহর হুকুমে যেন আকাশ ভেঙে নেমে আসছে পানির ধারা। এখন চারদিকে পানি ছাড়া যেন আর কিছু নেই। দশ দিগন্ত শুধু পানিতে একাকার। শুধু ভেসে আছে হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকা। পর্বত প্রমাণ ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে এগিয়ে চলেছে নৌকা। নৌকার আরোহীরা সবাই আল্লাহর গুণগান করছে। কারণ, শুধু তাদেরকেই আল্লাহ তাআলা এই মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা করেছেন।

কয়েক সপ্তাহ বা কয়েকমাস পর আল্লাহ তাআলার নির্দেশে বৃষ্টি থেমে গেল। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। যেমন পাক কুরআনে বলা হয়েছে : ‘এরপর বলা হলো : হে পৃথিবী! তুমি তোমার পানি গ্রাস করে নাও এবং হে আকাশ! ক্ষান্ত হও।’ এরপর বন্যা প্রশমিত হলো এবং কার্য সমাপ্ত হলো। নৌকা জুদী পবর্তের ওপর স্থির হলো এবং বলা হলো : ‘জালিম সম্প্রদায় ধ্বংস হোক।’ (সূরা হূদ : ৪৪)

জুদী পর্বতে নৌকা থামার পর হযরত নূহ (আ.) এবং তাঁর সাথিরা পৃথিবীতে নামার জন্য প্রস্তুত হলেন। আশেপাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আসার জন্য হযরত নূহ (আ.) একটি কাককে পাঠালেন। কাকটা উড়ে গিয়ে আর ফিরে এলো না। তিনি তখন একটি কবুতরকে পাঠালেন অবস্থা দেখে আসার জন্য। কবুতরটা উড়ে গেল এবং কিছুক্ষণ পর একটি জলপাইয়ের ডাল ঠোঁটে নিয়ে ফিরে এলো। হযরত নূহ (আ.) এবং নৌকার অন্যান্য আরোহী বুঝতে পারলেন পৃথিবী এখন বসবাসের উপযোগী। হযরত নূহ (আ.) আল্লাহর নামে নৌকার দরজাগুলো খুলে দিয়ে সকল জীব-জানোয়ার ও পশু-পাখিকে ছড়িয়ে দিলেন। তারপর তিনি এবং তাঁর ঈমানদার সাথিরা মিলে পৃথিবীতে আবার বসবাস শুরু করলেন এবং মহান ¯্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইবাদত করতে লাগলেন।

আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল করীমে বলেছেন : ‘বলা হলো : হে নূহ! অবতরণ কর আমার দেয়া শান্তিসহ এবং তোমার প্রতি ও যে সমস্ত সম্প্রদায় তোমার সাথে আছে তাদের প্রতি কল্যাণ সহ…’ (সূরা হূদ : ৪৮)

হাদীস শরীফ বর্ণিত আছে হযরত নূহ (আ.)-এর তিন ছেলে প্লাবন থেকে রক্ষা পায়। তারা পিতার নৌকাতেই ছিলেন। প্লাবনের পর নৌকা থেকে নেমে নতুনভাবে মানুষের বসবাস শুধু হয়। নূহ (আ.)-এর নির্দেশে তাঁর তিনপুত্র তিনদিকে চলে যায়। তারা তিনটি ভিন্ন এলাকায় গিয়ে বসতবাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করেন। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় মানবজাতির বংশবিস্তার পুনরায় শুরু হয়। সেই জন্য ইতিহাসে হযরত নূহ (আ.)-কে ‘আদমে ছানী’ বা দ্বিতীয় আদম বলা হয়।

সূত্র: ইন্টারনেট