Press "Enter" to skip to content

হযরত যায়দ বিন আলী (আ.)’র আন্দোলন ও শাহাদত

এস, এ, এ

হযরত যায়দ বিন আলী ছিলেন ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)’র সন্তান। তিনি উমাইয়ার অবৈধ খলিফা হেশাম বিন আব্দুল মালিকের বিরূদ্ধে কিয়াম করেন। বণি উমাইয়া শাষন ক্ষমতা তার এই কিয়ামের কারণে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।

শেখ মুফিদ (রহ.) তার ‘আল ইরশাদ’ নামক গ্রন্থে যায়দ বিন আলী সম্পর্কে লিখেছেন যে, যায়দ বিন আলী বিন হুসাইন (আ.) ইমাম বাকির (আ.) এর পরে তাঁর ভাইদের মধ্যে মাননীয় এবং উত্তম ছিলেন। তিনি একজন ধার্মিক, পরহেজগার, ফক্বিহ্, দানশীল এবং সাহসী ব্যাক্তি ছিলেন। তিনি তরবারি হাতে তুলে নেন এবং মানুষকে সৎ কাজের উপদেশ অসৎ কাজে নিষেধ করতেন এবং ইমাম হুসাইন (আ.)’র হত্যাকারীদের কাছ থেকে কেসাস গ্রহণ করেন।

তাঁর ইবাদতপূর্ণ ব্যাক্তিত্ব সম্পর্কে যিয়াত বিন মুনযার ওরফে আবু জারুদ বলেন: আমি মদীনায় যায়দ বিন আলী সম্পর্কে যার কাছে জিজ্ঞাসা করেছি সেই তাঁকে ‘হালিফুল কোরআন’  বলে সম্বোধন করেছে। হেশাম বিন হেশাম বলেন: আমি খালিদ বিন সাফওয়ানকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কোথায় যায়দ বিন আলী’র সাথে সাক্ষাত করেছেন? তিনি বলেন: কুফায় (রাসাফে কুফা)।

জিজ্ঞাসা করলাম তিনি কেমন মানুষ? সে বলল: তুমি তার সমম্পর্কে যেমনটি শুনেছ সে আল্লাহর ভয়ে এতই ক্রন্দন করে যে তার অশ্রু নাকের পানির সাথে মিশে যায়।

তবে কারবালার ঘটনা ও ইমাম হুসাইন (আ.)’র শাহাদতের পরে বণি উমাইয়ার বিরূদ্ধে আহলে বাইতের প্রেমিকদের সাথে নিয়ে কারবালার শহীদদের কেসাস নেওয়ার উদ্দেশ্যে তার বিরোধিতা উমাইয়া খেলাফত পতনের সম্মুখিন ছিল যেমন: তাওয়াবিন ও মুখতার বিন আবি উবাইদা সাকফির গণজাগরণ ছিল অন্যতম। কিন্তু যায়দ বিন আলী’র বিপ্লবের পূর্বে আলাভীদের কোন প্রকারের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি এবং যায়দ বিন আলী’র বিপ্লব বণি উমাইয়াদের বিরূদ্ধে আলাভীদের মাঝে এক চরম আলোড়ন সৃষ্টি করে যা বণি আব্বাসীয়দের যুগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

উক্ত ঘটনা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয় যে, সেই যুগ পর্যন্ত রাসুল (সা.)’র বংশ এবং আলাভীদের কেউ তেমনভাবে সাহায্যে করতে চাইতো না এবং বণি উমাইয়াদের বিরোধিতা করার ধৃষ্টতা করতো না।  আলীর এই সন্তান তাঁর নিরলস চেষ্টা পূণরায় আহলে বাইতের প্রেমিক এবং আলী’র অনুসারীদের মাঝে এক আলোড়নের সৃষ্টি হয় এবং এভাবেই বিপ্লবের সূচনা হয়।

কিছু রেওয়ায়েতে পরিলক্ষিত হয়েছে যে, কুফাতে আহলে বাইতের প্রেমিকগণ যায়দ বিন আলী’র বিপ্লবী আন্দোলনকে সমর্থন করতো এবং কখনও গোপনে আবার কখনও প্রকাশ্যেভাবে বণি উমাইয়া খেলাফতের বিরোধিতা করতো। আলাভীরা তাকে মদীনা থেকে কুফায় আসার এবং কুফাবাসীদের নেতৃত্ব দেয়ার আহবান জানায়। যায়দ তার সম্মানিত ভাই ইমাম মুহাম্মাদ বাকির (আ.)’র সাথে এই বিষয়ে পরামর্শ করেন। ইমাম বাকির (আ.) তাকে এতো তাড়াতাড়ি বিপ্লব করতে নিষেধ করেন এবং তার কুফল সম্পর্কেও তাঁকে অবগত করেন।

এই কারণে যায়দ ইমাম মুহাম্মাদ বাকির (আ.)’র জীবদ্দশায় বিপ্লবী আন্দোলন করেননি। কিন্তু ইমামের শাহাদতের কয়েক বছর পরে মদীনায় খলিফা ও তার আমলাদের বৈষম্যমূলক আচরণ অসহ্যনীয় হয়ে উঠে। যায়দ শামে যেয়ে হেশাম বিন আব্দুল মালিকের কাছে অভিযোগ করে। কিন্তু খলিফা শুধু তার অভিযোগকে অবহেলা করেনি বরং তাকে শাম থেকে বহিস্কার করে দেয়।  আর বণি উমাইয়ার এই আচরণের কারণে যায়দ বিপ্লবের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন এবং কুফার উদ্দেশ্যে ফিরে যান যেন বিপ্লবীদের একত্রিত করে কলুষিত খেলাফতের বিরূদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন।

তিনি কুফা শহরে প্রবেশ করে স্থানীয় লোকজনদেরকে গোপনে বিপ্লবের জন্য আজবান জানায়। কিন্তু যায়দ বিপ্লবীদর সংখ্যা আন্দোলনের জন্য যথেষ্ট মনে করতেন না। এজন্য তিনি আরো চার মাস অবস্থান করার পরের কুফা থেকে মদীনায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বণি উমাইয়ার প্রতিপক্ষ এবং ইমাম আলী’র অনুসারীরা তার এই সিধান্ত সম্পর্কে অবগত হলে তাকে খোঁজ করে অবশেষে তার সাথে ক্বাদেসিয়া নামক স্থানে সাক্ষাত করে। তারা সকলে তাঁকে অনুরোধ করে যেন তিনি কুফায় ফিরে আসেন কারণ তখন তারা সত্যিই যায়দকে সাহায্যে করার সিদ্ধান্ত জানায় এবং তাঁকে যুদ্ধের সামগ্রিক সাহায্যে করবে বলে অঙ্গীকার করে।

যায়দ বিন আলী পুণরায় কুফায় ফিরে আসেন এবং সেখানে তিনি ৮ মাস অবস্থান করেন এবং দুই মাস তিনি বাসরায় সফর করেন এবং সেখানের লোকজনদেরকে তাঁকে সাহায্যে করার অহবান জানায়। যায়দ এতই গোপনভাবে সৈন্য সংগ্রহ করতে থাকে যে, কুফার গর্ভণর শত চেষ্টার পরেও এই সম্পর্কে কিছুই জানতে পারে না। কিন্তু হেশাম কুফার গর্ভণরকে সতর্কবাণী জানিয়ে চিঠি লিখে যে, অচীরেই যায়দ বিন আলী কোন ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছে।

ইউসুফ বিন উমর সংবেদনশীল হয়ে পড়ে এবং যায়দ বিন আলীকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে পড়ে। যায়দ বিন আলী ইমাম আলী (আ.)’র অনুসারীদেরকে একত্রিত করার জন্য বিভিন্ন শহর যেমন: মাদায়েন, বাসরা ওয়াসেত, মুসেল, খোরাসান, রেই এবং যাযিরাতুল আরবে সফর করছিলেন। শুধুমাত্র কুফার  ১৫ হাজার শিয়া তাঁর হাতে বাইয়াত করে এবং তারা অত্যাচারী বণি উমাইয়ার সাথে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি ঘোষণা করে। বাইয়াতকারীদের মধ্যে বিভিন্ন মতাদর্শের অনুসারী ছিল কিন্তু তার পরেও তারা সকলেই যায়দকে সাহায্যে করার অঙ্গিকার করে।

যায়দ বিন আলীকে বন্দি করার জন্য ইউসুফ বিন উমর যার পর নাই বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে এবং পরিবেশকে ঘোলাটে করে ফেলে আর এই কারণে যায়দ নির্ধারিত সময়ের পূর্বই আন্দোলন শুরু করে দেয়। এইজন্য অল্প সংখ্যক বাইয়াতকারীগণ তাঁর সাথে সংযুক্ত হতে পারে।

সন ১২০ হিজরী  (অন্য মত অনুযায়ি ১২১ বা ১২২) ১লা সফর যায়দ “ইয়া মানসুর আমেত” (এই শ্লোগাণটি রাসুল (সা.) বদরের যুদ্ধে ব্যাবহার করেছিলেন) শ্লোগাণ উচ্চারণের মাধ্যমে তার বিপ্লবী আন্দোলন ‍শুরু করে। এমতাবস্থায় যায়দের পক্ষে আন্দোলনকারীর সংখ্যা ২২০ থেকে ৫০০ জনের বেশী ছিল না। তারা ইউসুফ বিন উমরের সৈন্য এবং শাম থেকে আগত সৈন্যদলের সাথে যুদ্ধ শুরু করে দেয়।

দুই পক্ষের মাঝে যুদ্ধ দুইদিন অব্যাহত ছিল। শাম থেকে আগত অনেক সৈন্য যায়দের বিপ্লবীদের হাতে আহত  এবং মৃত্যুবরণ করে। উক্ত যুদ্ধে একটি তীর যায়দের কপালে বিদ্ধ হয় এবং তিনি আহত হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় রাতে তাঁর সঙ্গীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তাঁকে একজন শিয়ার বাড়িতে লুকিয়ে রাখে এবং চিকিৎসার জন্য একজন চিকিৎসককে ডেকে নিয়ে আসে। চিকিৎসক অনেক চেষ্টার পরে যায়দের কপাল থেকে তীরের অবশিষ্ট অংশটি বাহির করা ব্যাতিত আর কোন উপায় দেখতে পেল না। যায়দের মাথা থেকে তীরটি বাহির করার সাথে সাথে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ৪

যায়দ বিন আলী’র অবিশিষ্ট সঙ্গীরা যেমন: ইয়াহিয়া বিন যায়দ তাঁর লাশকে দাফন করার পরে বিভিন্ন দিকে চলে যায় আবার অনেকে কুফা থেকে পালিয়ে অন্য শহরে চলে যায়। যায়দ বিন আলী’র লাশের ঠিকানা পাওয়ার জন্য ইউসুফ বিন উমর পুরস্কার ঘোষণা করে।  যে ব্যাক্তি যায়দের দাফনের সময় উপস্থিত ছিল তার সহায়তায় যায়দের কবরটি তারা সনাক্ত করতে সক্ষম হয়।  তারা কবরটি খুঁড়ে যায়দের মাথাকে কেটে নেয় এবং তা হেশাম বিন আব্দুল মালিকের কাছে প্রেরণ করে এবং তাঁর শরীরকে কুফার আবর্জনা ফেলার স্থানে ঝুলিয়ে রাখে।

যায়দের লাশের সাথে তার সঙ্গীদের যেমন: নাসর বিন খুযাইমা, মাবিয়া বিন ইসহাক, যায়দ বিন আব্দুল্লাহ ফাহরী’র লাশকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এভাবেই যায়দ বিন আলী’র নেতৃত্বে বিপ্লবী আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

ইমাম বাকির ও ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.)’র ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ি যায়দ ও তাঁর আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। যায়দের মৃত্যুর চার বছর পরে তার সন্তান ইয়াহিয়া বিন যায়দ খোরাসানে আন্দোলন করে এবং সেও পিতার ন্যায় শাহাদত বরণ করে। তারও মাথাকে শরীর থেকে বিছিন্ন করে শামে ওয়ালিদ বিন ইয়যিদের কাছে প্রেরণ করা হয়। খলিফা ইয়াহিয়া বিন যায়দের লাশকে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়।

তথ্যসূত্র:

১- তারিখে তাবারী, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ৫০৩।

২- আল ফুতুহ, খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ১২২।

৩- তারিখে খোলাফা, পৃষ্ঠা ৬৫০।

৪- তারিখে দামেস্ক, খন্ড ১৯, পৃষ্ঠা ৪৫৬- ৪৭৬।

৫- আল ইরশাদ, পৃষ্ঠা ৫২০, কাশফুল গুম্মা, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৩৫।

৬- বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৪৬, পৃষ্ঠা ১৮৬।

৭- মুসনাদে যায়দ বিন আলী (আ.), পৃষ্ঠা ১৯০।