Press "Enter" to skip to content

মূসা মুবারকা (আ.)’র সংক্ষিপ্ত জীবনি

এস, এ, এ

(موسی مُبَرْقَعْ) হযরত মূসা মুবারকা (আ.) ইমাম মুহাম্মাদ তাক্বি (আ.)র সন্তান ছিলেন। তাঁর দাদা ছিলেন ইমাম রেযা (আ.) এবং এই সূত্রে তিনি রাযাভি ছিলেন।

হযরত মূসা মুবারকা (আ.) রাযাভি বংশধারার প্রথম ব্যাক্তি যিনি ২৫৬ হিজরীতে কুম শহরকে বসবাসের নির্বাচন করেন। হযরত মূসা মুবারকা (আ.)র আগমণের পরে ইমাম জাওয়াদ (আ.)র  কন্যাগণ যথাক্রমে যায়নাব, উম্মে মুহাম্মাদ, মাইমুনা এবং পরবর্তিতে ইমাম মূসা কাযিম (আ.)র কন্যা বারিহা কুম নগরিতে আসেন। তিনি এখানেই মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁকে হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.আ.) কবরের পাশে দাফন করা হয়।

হযরত মূসা মুবারকা (আ.) থেকে লক্ষ লক্ষ সৈয়দ রাজাভি, রেজায়ী, মুর্তাজাভি, তাকওয়া, বার্কায়ী, মুবারকা বা ইবনে আল রেজা নামে পরিচিত, যারা এই মহান ব্যাক্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। এই পবিত্র ব্যাক্তিত্বের বংশ থেকে হাজার হাজার আলেম, আলেম, মুজতাহিদ, লেখক, পণ্ডিত, শাসক এবং বিশিষ্ট ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছে এবং যদি সেগুলি খতিয়ে দেখা হয় তবে বই লেখা যেতে পারে।

শেখ মুফিদ (রহ.) তার আল ইরশাদ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ইমাম জাওয়াদ (আ.)র সন্তানগণ ছিলেন যথাক্রমে: আলী নাক্বি (আ.), হযরত মূসা মুবারকা (আ.), ফাতিমা এবং আমামা। তবে ইবনে শাহর আশুব মেয়েদের ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেছেন: ইমাম মুহাম্মাদ তাক্বি (আ.)র কন্যাগণ ছিলেন যথাক্রমে: হাকিমা, উম্মে কুলসুম, খাদিজা।

মরহুম মুহাদ্দিসে কুম্মী তাঁর মুনতাহিউল আমাল নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম জাওয়াদ (আ.)র চার ছেলে ও চার কন্যা ছিল।

১. আবুল হাসান ইমাম আলী নাক্বি (আ.)।

২. আবু আহমাদ মূসা মুবারকা (আ.)।

৩. আবু আহমাদ হুসাইন।

৪. আবু মূসা ইমরান।

৫. ফাতিমা।

৬. খাদিজা।

৭. উম্মে কুলসুম।

৮. হাকিমা।

‘শাজারাতুল মুবারকা’ নামক গ্রন্থের লেখক উল্লেখ করেছেন ইমাম মুহাম্মাদ তাক্বি (আ.)র আটজন সন্তান ছিল তিনজন ছেলে এবং পাঁচজন কন্যা ছিল যথাক্রমে: ১. আবুল হাসান ইমাম আলী নাক্বি (আ.) ২. আবু আহমাদ মূসা মুবারকা (আ.) ৩. ইয়াহিয়া ৪. ফাতিমা ৫. হাকিমা ৬. বাহজাত ৭. খাদিজা ৮. বারিহা।

অনেক ঐতিহাসিকগণ ইমাম মুহাম্মাদ তাক্বি (আ.)র সন্তানদের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ প্রকাশ করেছেন কিন্তু মূসা মুবারকা সম্পর্কে কোন দ্বিমত পোষণ করেন নি। তবে তাঁর জন্ম তারিখ এবং হিজরতের সঠিক তারিখ কোথাও উল্লেখিত হয়নি।

মূসা মুবারকা (আ.)র মাতা ছিলেন সামানে মাগ্বরিবিয়া এবং এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাঁর জন্ম তারিখ সঠিকভাবে কোথাও উল্লেখিত হয়নি তবে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম আলী নাক্বি (আ.)র জন্মের দুই বছর পরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং এই বিষয়ে কোন ঐতিহাসিক এবং হাদীসবেত্তাগণ কোন দ্বিমত পোষণ করেন নি যে, ইমাম আলী নাক্বি (আ.) ২১২ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেহেতু আমরা বলতে পারি যে, হযরত মূসা মুবারকা ২১৪ হিজরী মদীনায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ৩০ বছর মদীনায় জীবন যাপন করেন অবশেষে আব্বাসী খলিফা মোতাওয়াক্কিল’র নির্দেশে তিনি বাগদাদে হিজরত করেন। ২৪৭ হিজরীতে মোতাওয়াক্কিলকে হত্যা করা হলে তিনি কুফায় চলে আসেন। মুহাদ্দিসে নূরী লিখেছেন হযরত মূসা মুবারকা ২৫৬ হিজরীতে কুফা থেকে কুম নগরীতে চলে আসেন এবং ৮২ বছর বয়সে ২৯৬ হিজরী ২২শে রবিউস সানী তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

কেন মূসাকে মুবারকা বলা হয়?

আবু আহমাদ বিন মূসা ওরফে মুবারকা নামকরণের কারণ হচ্ছে তিনি হাসান (আ.)র সন্তান কাসিম, হুসাইন (আ.)র সন্তান আলী আকবর এবং আব্দুল্লাহিল বাহির এর ন্যায় এতই সুন্দর, প্রভাশালী, আকর্ষণীয়, স্বর্গীয়, কমনীয়, মুক্ত ও সুন্দর চেহারার অধিকারী ছিলেন যে, যখন তিনি পথ চলতেন তখন লোকজন নিজেদের কাজ বাদ দিয়ে তাঁর প্রতি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতো। তিনি নিজেকে পুরুষ ও মহিলার চোখ থেকে বাঁচাতে নিজের (برقع) বোরকা দ্বারা চেহারাকে আচ্ছাদিত করে রাখতেন। এইজন্য তাকে মুবারকা বলা হয়।

একদা কুমের আরব নেতাদের উপস্থিতিতে যখন মূসা মুবারকা (আ.) নিজের মুখকে বোরকা দ্বারা আচ্ছাদিত করে রেখেছিলেন তখন তারা মূসাকে বলে: আমরা এটা পছন্দ করি না যে আমাদের মাঝে অপরিচিত কেউ অবস্থান করুক। তিনি নিজের আচ্ছাদিত চেহারা থেকে রোরকা নামালে সকলেই তাঁর জ্যেতিময় চেহারাকে দেখে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তাঁর হাতে চুমু দেয়।

কুফা থেকে কুমের পথে:

মরহুম মুহাদ্দিসে কুম্মী (রহ.) তাঁর ‘মুনতাহিউল আমাল’ নামক উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ছিলেন রাযাভি সৈয়দ বংশের প্রথম ব্যাক্তি যিনি ২৫৬ হিজরীতে কুম নগরীতে আসেন। যেহেতু তিনি নিজের চেহারাকে আচ্ছাদিত করে রাখতেন এবং এমতাবস্থায় তিনি কুম নগরীতে প্রবেশ করেন। কুম নিবাসী আরবীয় ব্যাক্তিত্ববর্গ তাঁকে শহরে প্রবেশ করতে বাধা দিলে তিনি কাশান নামক এলাকায় চলে যান। যখন তিনি কাশানে পৌছান তখন আহমাদ বিন আব্দুল আযিয বিন দুলাফ ইজলী তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করেন এবং দামী, সুন্দর পোষাক উপহার দেন এবং নির্ধারণ করে যে, প্রত্যেক বছর তাঁকে এক হাজার মিসকাল সোনা এবং একটি ঘোড়া প্রদান করবেন। কুমের আরবীয় ব্যাক্তিবর্গ নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং মুসা মুবারকার সমীপে উপস্থিত হয় ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং অতি সম্মানের সাথে তাঁকে কুম নগরীতে অভ্যর্থনা জানায়। কুমে তিনি স্বস্তিময় জীবন যাপন কালে নিজের সম্পদ দ্বারা একটি এলাকা ও চাষাবাদের জমি ক্রয় করেন। অতঃপর তাঁর বোন জয়নাব, উম্মে মুহাম্মাদ, মাইমুনা এবং ইমাম মূসা কাযিম (আ.)র কন্যা বারিহা কুম নগরীতে আসেন সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁকে হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.আ.)র পাশেই দাফন করা হয়।

হযরত মূসা মুবারকা (আ.)র জ্ঞান, ধর্ম, রাজনীতি, বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার কারণে ইমাম জাওয়াদ (আ.) নিজের ওয়ালি হিসেবে দান দক্ষিণা একত্রিতকরণের জন্য নিযুক্ত করেন। কিন্তু যখন তিনি কুম নগরীতে আসেন তখন নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিবর্গ ধারণা করে যে, তাঁর উপস্থিতির কারণে তাদের অবস্থান দূর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু পরে বুঝতে পারে যে, তারা ভুল বুঝেছিল।

পন্ডিত, রেজালশাস্ত্রবীদ এবং হাদীসবেত্তাদের দৃষ্টিতে মূসা মুবারকা:

একদল শিয়া আলেম হযরত মূসা (আ.)’র ন্যায়বিচার, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং ধর্মপ্রাণতা স্বীকার করেছেন এবং তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। উক্ত বিষয় থেকে স্পষ্ট হয় যে, মূসা মুবারকা তাদের কাছে কতটুকু বিশ্বস্ত ছিলেন।

শেখ মুফিদ (রহ.) তার ‘ইখতেসাস’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মূসা মুবারকা যখন ইমাম আলী নাক্বি (আ.)র সমীপে উপস্থিত হন এবং প্রশ্ন করার পূর্বেই ইমাম (আ.) আমার জীবন তোমার জন্য উৎসর্গিত হোক। ইমামমের এই কথা দ্বারা যে বিষয়গুলো স্পষ্ট তা হচ্ছে:

১. মূসা মুবারকা যুগের ইমামকে সম্মান করতেন এবং ইমামতের প্রতি তাঁর দৃঢ় ঈমান ছিল।

২. এই রেওয়ায়েত দ্বারা মূসা মুবারকা (আ.) এর বিশ্বস্ততা প্রমাণিত হয়। কেননা তিনি যদি ইবাদতকারী ও বিশ্বস্ত না হতেন তাহলে হাদীস বর্ণনাকারীগণ তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করতেন না।

মূসা মুবারকা (আ.) ওফাত:

ইমাম মুহাম্মাদ তাক্বি (আ.)র সন্তান ছিলেন তিনি ২৯৬ হিজরী বুধবার রাতে কুম নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন। (তারিখে কুম, পৃষ্ঠা ২১৬)

অন্য এক বর্ণনা অনুযায়ি হযরত মূসা মুবাররাকা ৮ই রবিউস সানী তারিখে মৃত্যুবরণ করেন। (বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৫৭, পৃষ্ঠা ২২০)

আরেকটি বর্ণনা মতে তিনি ১৪ই রবিউস সানী তারিখে ওফাত পান। বর্তমানে তাঁর কবর ইরানের কুম নগরীর চেহেল আখতারান নামক স্থানে রয়েছে। (কালায়েদুন নুহুর, খন্ড রবিউস সানী, পৃষ্ঠা ২২৬)

যখন মূসা মুবারকা (আ.) ইহলোক ত্যাগ করেন তখন কুমের শাষক আব্বাস বিন আমরু গ্বানাভি তাঁর জানাযার নামাজ পড়ান এবং বর্তমান চেহেল আখতারান নামক স্থানে তাকে দাফন করা হয়েছিল। পূর্বে সেখানে মুহাম্মাদ বিন হাসান বিন আবি খালিদ আশআরীর বাড়ি ছিল। (বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৫০, ‍পৃষ্ঠা ১৬০)

মাজার:

হযরত মূসা মুবারকা তাঁর গৃহে মৃত্যুবরণ করেন এবং বর্তমান চেহেল আখতারান নামক স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছিল। হযরত মূসা মুবারকা (আ.) কবরের পাশে তাঁর সন্তান শাহজাদা আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন মূসাকে দাফন করা হয়। তিনি একজন ইবাদতকারী, ঔদার্য এবং দানী ব্যাক্তি ছিলেন। তাঁর সমাধিস্থলের শিল্পকর্মে পরিপূর্ণ ভেস্টিবুল এবং করিডোরটি নবম শতাব্দী হিজরী থেকে আজও অবশিষ্ট রয়েছে।

মুসা মুবারকা (আ.)র প্রথম মাজার তৈরী হয় ৯৫২ হিজরীতে। শাহ তাহমাসব সাফাভি’র নির্দেশে এই মাজারটি তৈরী করা হয়। মূসা মুবারকা (আ.)’র মাজার প্রাঙ্গনে কিছু সৈয়দ এবং ইমামজাদাদের কবর রয়েছে। তন্মধ্যে তাঁর সন্তানদের কবরও রয়েছে। এই মাজারে ৪০ জন নারী, ৪০জন পুরুষ এবং ২৫জন বাচ্চাদের মোট ১০৫ জনের কবর রয়েছে। তন্মধ্যে তারিখে কুম নামক গ্রন্থে ১৪জনের নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে।  (তারিখে কুম, পৃষ্ঠা ২২২)

এই মাজারে আরো একজন ইমামজাদা যার নাম যায়দ। যিনি ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) এর নাতি ছিলেন। ফেইয কুম্মী বলেছেন: যায়দ’র নবম পূর্বপুরুষ ছিলেন ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)। (গান্জিনে আসারে কুম, পৃষ্ঠা ৫৫২)