যেহেতু আহলে বাইতের অনুসারীগণ সুন্নত ও সীরাত অবলম্বনে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সেজদাকে শুধুমাত্র মাটি ও তা থেকে উৎপন্ন দ্রব্যের (খাদ্যদ্রব্য ও পরিধেয় বস্ত্র ব্যতীত) উপর জায়েয মনে করে থাকেন, সেহেতু আল্লাহর পবিত্র দরবারে অধিকতর খুজু’ বা ভয় প্রকাশের লক্ষ্যে মাটির উপর সেজদা প্রদানকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কেননা, মাটির উপর সেজদা মহাপ্রভুর সমক্ষে একজন মানুষের অবনত মস্তকে আরাধনারই বহিঃপ্রকাশ। ফলে তা একজন ব্যক্তিকে আল্লাহর দাসত্বের পথে অধিকতর দৃঢ়তা প্রদান করে এবং সৃষ্টির সুউচ্চ লক্ষ্যে নিকটবর্তী হতে সাহায্য করে।
একদল লোক মনে করে থাকেন, মৃত্তিকার উপর সেজদার অর্থ মাটিকে পূজা করা বুঝায় এবং তা এক ধরনের শেরক্ হিসেবে চিহ্নিত। তাঁরা প্রতিবাদের অবস্থান থেকে বলেন: শিয়ারা কেন মাটির উপর সেজদা করে থাকে? এ প্রশ্নের উত্তরে অবশ্যই স্মরণীয় যে, “السجود لله السَّجُودُ عَلَى الْأَرْضِ বাক্য দু’টির মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য বিদ্যমান। উপরোক্ত সমালোচনাটি এ দু’টি বাক্যের অর্থের মধ্যে পার্থক্য না করার কারণে উত্থাপিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে “السجود لله” এর অর্থ হল আল্লাহর উদ্দেশ্যে সেজদা করা আর السجود على الأرض -এর অর্থ ভূপৃষ্ঠের উপর অর্থাৎ মাটির উপর সেজদা করা বুঝায়। অন্য কথায়, আমরা মাটির উপর সেজদার মাধ্যমে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সেজদা করে থাকি।
নীতিসঙ্গত ভাবে বিশ্বের সকল মুসলমান নিশ্চয়ই যে কোন একটা বস্তুর উপর সেজদা করে থাকেন। যদিও বা সেটা আল্লাহর উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে। আল্লাহর ঘর তথা কা’বা শরীফের যিয়ারতকারীগণ ‘মজিদুল হারামের’ পাথরগুলোর উপর সেজদা করে থাকেন। আর এর পরও তাদের সেজদার উদ্দেশ্য আল্লাহকেই সেজদা করা।
এভাবে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, মৃত্তিকা অথবা উদ্ভিদের উপর সেজদা করার অর্থ ওগুলোর পুজা করা বুঝায় না। বরং বিনয়ী ভাবের মাধ্যমে আল্লাহর উদ্দেশ্যে মাটির সমপর্যায়ে পৌছে গিয়ে সেজদা ও উপাসনা করা হয়ে
থাকে। শিয়াদের ক্রমবর্ধমান ধারণা আরো অধিক স্পষ্ট হবার উদ্দেশ্যে শিয়া বিশ্বের মহান ইমাম হযরত জা’ফর সাদেক (আঃ) এর বক্তব্যের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা যুক্তিযুক্ত মনে করছি।
“হিশাম বিন আল্ হাকাম বলেন: ইমাম সাদেক (আঃ) কে সেজদা শুদ্ধ হয় এমন সব জিনিষ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন:
“সেজদা শুধুমাত্র যমীন ও তা থেকে উৎপন্ন বস্তুসমূহের (খাবার দ্রব্য ও পরিধেয় বস্ত্র ব্যতীত) উপর সম্পাদন করতে হবে।” আমি বল্লাম: “আমার জীবন আপনার জন্যে উৎসর্গ হোক, এর কারণ কি?” তিনি বল্লেন:- ” কারণ সেজদা দ্বারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে অবনত হওয়া ও তাঁরই আদেশ পালন করা বুঝায়। খাদ্য দ্রব্য ও পরিধেয় বস্ত্রের উপর সেজদা করা যথোপযুক্ত নয়। কেননা দুনিয়া পূজারীরা খাদ্য ও পরিধেয় বস্তুর দাস। অন্যদিকে সেজদার মুহুর্তে একজন মানুষ আল্লাহর উপাসনা করে থাকে। অতএব, স্বীয় ললাট এমন কিছুর উপর স্থাপন করা মোটেই ঠিক নয় যার প্রতি দুনিয়া পুজারীদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। মাটির উপর সেজদা করাই সর্বোত্তম কাজ। কেননা, বিনয়াবনতা ও নম্রতার সাথে মহাপ্রভুর সামনে সেজদা করা অধিক সামঞ্জস্যপূর্ন।”
উক্ত হাদীসটি স্পষ্ট সাক্ষ্য প্রদান করে যে, মৃত্তিকার উপর সেজদা শুধুমাত্র এ জন্যে সম্পাদন করতে হবে যে খুজু বা বিনয়াবনতার সাথে অদ্বিতীয় প্রভুর মুখোমুখী একাজটা অধিক সঙ্গতিপূর্ণ। শিয়া মহাপন্ডিত আল্লামা আমিনি (রহঃ) তাঁর স্বীয় গ্রন্থ “সীরাতুনা ওয়াসুন্নাতুনা” তে উক্ত প্রকৃত সত্যের প্রতিই ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, ” সেজদা যেহেতু খোদায়ী মহত্ত্বের সমক্ষে অতিশয় খুজু’ বা বিনয়াবনতা ও মিনতি ব্যতীত অন্য কিছু নয়, সুতরাং মাটিকে সেজদাগাহ হিসেবে বিবেচনা করাই যথোচিত কাজ। একজন নামাজীর স্বীয় মুখমন্ডল মৃত্তিকার উপর সমর্পন করা এজন্যে যথোপযুক্ত হবে যে, সে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে কি ধরনের নীচু প্রকৃতির বস্তু দিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়েছে, যা থেকে সে সৃষ্টি হয়েছে, যার দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। আর যা থেকে হবে পুনঃরুত্থান- এভাবে সে খোদার স্মরনে মশগুল থাকে এবং কার্যকরী উপদেশাবলী অর্জনে সক্ষম হবে। সে যেন তার প্রকৃত হীনতা ও তুচ্ছতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে পারে, যাতে করে তার ভিতর বিনয়াবনতা, খোদার দাসত্ব ও স্বার্থপরতা ত্যাগের মনোভাব অর্জিত হয়। মৃত্তিকার উপর সেজদার মাধ্যমে সে যেন পরিস্কারভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, সৃষ্টিজীব মাটির সাথেই সম্পর্কযুক্ত এবং মাটির-ই উপযুক্ত। যেন আরো উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, এ বিশ্ব ভ্রহ্মান্ডের স্রষ্টার মোকাবেলায় তাকে বিনয়াবনতা ও মুখাপেক্ষিতা সহকারেই সৃষ্টি করা হয়েছে, এর বেশী কিছু নয়।”
মৃত্তিকা ও তৃণের উপর সেজদার প্রমাণ
এখানে আরেকটি প্রশ্ন আমাদের সামনে উপস্থিত হতে পারে: কেন শিয়াগন মাটি অথবা কোন কোন উদ্ভিদের উপর সেজদা করতে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে থাকেন? আর কেনই বা সবকিছুর উপর সেজদা করেন না? এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, যেমনি ভাবে একটি ইবাদতের মূল বর্ণনা তার পবিত্র আইনদাতার (আল্লাহ) কাছ থেকে আসা দরকার তেমনিভাবে, তার হুকুম-আহকাম ও শর্তসমূহও শরীয়ত বা ধর্মীয় আইন কানুনের বর্ণনাকারী তথা হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর কাজ কর্মের মাধ্যমেই স্পষ্ট হতে হবে। কেননা কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) সকল মুক্তিকামী মানুষের নেতা এবং তাদের জন্যে এক উজ্জ্বল আদর্শ হিসেবে পরিগনিত। দ্বীনি হুকুম আহকাম তাঁর কাছ থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করা সমস্ত মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। সুতরাং মহানবী (সঃ)-এর নিকট থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহ ও তাঁর বাস্তব কর্ম-পদ্ধতির কিছু অংশ এবং তাঁর সাহাবাদের বাস্তব অনুশীলন ও বক্তব্যাবলী থেকে কিছু দৃষ্টান্ত আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। যার অধিকাংশই আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের হাদীসের গ্রন্থাদি থেকে সংগৃহীত হয়েছে। এ সকল হাদীসের সবক’টিই মাটি ও উদ্ভিদের উপর সেজদা সম্পর্কীত। আর সে সমস্ত হাদীসগুলো হযরত মোহাম্মদ (সঃ), তাঁর সাহাবা ও তাবেয়ীনদের চাটাইয়ের উপর সেজদার সাক্ষ্যবহন করে। এটা ঠিক সে পদ্ধতি যার উপর শিয়া মুসলমানগণ বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। এখন শিয়া মতামতের উজ্জ্বল প্রমাণাদি যা খাটি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিরই বিবরন দেয় তা আপনাদের সমক্ষে তুলে ধরার প্রয়াস পাবো।
মহানবী (সঃ)-এর সুন্নত থেকে সেজদার বৈশিষ্ট্য নির্ণয়
বিশ্ব-মুসলিমের দৃষ্টিতে রাসুল (সঃ)-এর বক্তব্যাবলী ইসলামী আইন প্রবর্তনের নির্মল ও বিশুদ্ধ উৎস হিসেবে বিবেচিত এবং শরীয়তের অনুসারীগণ এরই ভিত্তিতে স্বীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করাকে অবশ্য কর্তব্য হিসেবে গন্য করে থাকেন। শিয়াগনও মহানবী (সঃ)-এর হাদীস সমূহকে “আহকামে এলাহী” তথা ” ঐশী নির্দেশাবলীর” ভিত্তিমূল বলে মনে করে থাকেন। তাঁরা সর্বক্ষেত্রে বিশেষতঃ সেজদার হুকুম আহকামের ক্ষেত্রে তাঁর সুন্নতের অনুসরন করে থাকেন। ইসলামী পন্ডিতগণ উক্ত বিষয়ে নবীপাক (সঃ)-এর নিকট থেকে অসংখ্য হাদীস বর্ণনা করেছেন-যা মাটি ও উদ্ভিদের উপরে সেজদারই সাক্ষ্য বহন করে এবং তা হুবহু শিয়া মুসলমান ভাইদের সেজদার পদ্ধতিরই উৎকৃষ্ট বিবরন। এখানে নমুনাস্বরূপ বর্ণিত হাদীস সমূহের কয়েকটি আপনাদের সম্মুখে পেশ করছি। একদল হাদীস বর্ণনাকারী রাসূল (সঃ)-এর কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেনঃ
جعلت لِي الْأَرْضِ مَسْجِدًا وَطُهُورًا
অর্থাৎ “মাটিকে আমার জন্যে সেজদাগাহ ও পবিত্রতার উৎস হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে।”
শাব্দিক তারতম্যভেদে প্রচুর হাদীস গ্রন্থাদিতে উক্ত হাদীসটির বর্ণনা এসেছে। যার সামান্য অংশ এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করছি।
মুসলিম বিন হাজ্জাজ তার নিজ সহীহাতে এরূপ বর্ণনা করেছেন:
جَعَلَتْ لَنَا الْأَرْضِ كُلَهَا مَسْجِدًا وَطَهُورًا
অর্থাৎ “সবধরনের মাটি আমাদের জন্যে সেজদাগাহ ও পবিত্রতার উৎস হিসেবে তৈরী করা হয়েছে।”
আর ‘সীরাতুনা ওয়া সুন্নাতুনা’ গ্রন্থে উক্ত হাদীসটি জনাব নেসাঈ ও আবু দাউদ-এর উদ্ধৃতি দিয়ে লিপিবদ্ধ আছে।
বায়হাকী স্বীয় সুনানে, মহানবী (সঃ)-এর নিকট থেকে এভাবে বিবরণ দিচ্ছেন যে,
جَعَلَتْ لِي الأرْضِ طَيِّبَة وَطَهُورًا وَمَسْجِدًا
অর্থাৎ “ভূমি আমার জন্যে পবিত্র আর পবিত্রতার উৎস হিসেবে পরিগণিত। সেটাকে আমার জন্যে সেজদাগাহ হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে।”
বিহারুল আন্ওয়ার গ্রন্থে এরূপ একটি হাদীসে কুদসীর উল্লেখ আছেঃ
جعَلَتْ لَكَ وَلا مَتِكَ الْأَرْضِ كُلِهَا مَسْجِدًا وَطَهُورًا
অর্থাৎ “যমীন তোমার জন্যে এবং তোমার উম্মতের জন্যে সেজদাগাহ ও পবিত্রতার উৎস হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে।”
“মিস্বাহুল মাসাদ”-এর রচয়িতা মহানবী (সঃ)-এর নিকট থেকে এরূপ বর্ণনা দিচ্ছেনঃ
جَعَلَتِ الأَرْضُ كُلهَا لِي وَلِأُمَّتِي مَسْجِدًا وَطَهُورًا
অর্থাৎ ” সকল যমীন আমার জন্যে এবং আমার উম্মতের জন্যে সেজদাগাহ ও পবিত্রতার উৎস করে সৃষ্টি করা হয়েছে।
মিস্বাহুল মাসনাদ, শেখ কাত্তাওয়ামুদ্দিন।
উপরোল্লিখিত মোতাওয়াতের হাদীসগুলো মুসলমানদের সকল বিদ্বান ব্যক্তির নিকট গ্রহণযোগ্য হাদীস হিসেবে সুপরিচিত। এরই উপর ভিত্তি করে পরিস্কার ভাবে বলা যায় যে, যমীনের উপরিভাগ তা মাটিই হোক আর পাথর, বালুকা ও তৃণলতাই হোক, সেজদার জন্যে ওগুলো হলো প্রথম ও প্রধান শর্ত। আর কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতীত এ আইনের লংঘন করা এক অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হবে।
মোতাওয়াতের হাদীস হচ্ছে, এমন সব হাদীস যা অসংখ্য বর্ণনাকারীর মাধ্যমে বর্ণিত হবার ফলে আমাদের অন্তরে পরিপূর্ণ বিশ্বাস জন্মে এবং এর নির্ভুলতার ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
এখানে’ শব্দের অর্থ শরীয়তের আইন প্রবর্তন করা বুঝায়। তদ্বারা উত্তমরূপে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এ বিষয়টি ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি নির্দেশ বা হুকমে এলাহী। আর এভাবে ভূমি ও এর অন্যান্য উপাদানের উপর সেজদার বৈধতার প্রমাণ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
মাটির উপর সেজদা করা নবীর (সঃ) নির্দেশ
নবী করীম (সঃ) যে মুসলমানদেরকে মাটির উপর সেজদা করতে নির্দেশ প্রদান করতেন সে সম্পর্কে বর্ণিত হাদীস সমুহের কয়েকটি নমুনা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি।
এক: নবী (সঃ)-এর পত্নী উম্মে সালমা বলেন যে, রাসুল (সঃ) বলেছেন : “ترب وجهك لله
অর্থাৎ ” স্বীয় মুখমন্ডলকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে মাটির উপর স্থাপন কর”
দুই: আব্দুর রাজ্জাক” আল্ মুসান্নেফ” নামক গ্রন্থে খালেদ জাহ্মীর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন :
رأى النبي (ص) صُهَيْبًاً يَسْجُدُ كَأْنَهُ يتقى التراب فَقَالَ لَهُ النبي تَرَب وَجَهَكَ يَا صهيب
অর্থাৎ “প্রিয় নবী (সঃ) অবলোকন করলেন যে সোহাইব সেজদা করার সময় মাটি থেকে বিরত থাকে। সুতরাং তাকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ হে সোহাইব, তোমার মুখমন্ডলকে মাটির উপর স্থাপন কর।”
তিন: ‘ইরশাদুস্ সারী’ গ্রন্থে এভাবে লিপিবদ্ধ আছে:
قال (ص) لمعاذ : عَفْر وَجَهَكَ فِي التراب
অর্থাৎ ” মহানবী (সঃ) মায়াজকে বলেন: স্বীয় মুখমন্ডলকে মাটির উপর স্থাপন কর।”
চার: ‘কানযুল উম্মাল, ‘আল এছাবা’ ও ‘উসুদুল গাবাহ’ গ্রন্থে এরূপ বর্ণিত আছে: হযরত মোহাম্মদ (সঃ) রেবাহকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ
يا رباح ترب
অর্থাৎ” হে রেবাহ! ললাটকে মাটির উপর স্থাপন কর ”
এ ধরনের বর্ণনা শিয়া সুন্নী নির্বিশেষে প্রচুর হাদীস গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। নবী পাক (সঃ)-এর বক্তব্যে উল্লেখিত ‘ترب শব্দটি থেকে দু’টি বিষয় সুস্পস্ট হয়ে যায়।
একটি হলো: সেজদা প্রদানের সময় ললাট মাটির উপর স্থাপন করা একজন মানুষের অবশ্য কর্তব্য। অন্যটি হচ্ছে: এ ব্যাপারে তা অবশ্য পালনীয় একটি আদেশ হিসেবে গন্য। কারণ, ‘ترب” শব্দটি تراب তুরাবের সমপরিবারের ধাতু থেকে গৃহীত হয়েছে যার অর্থ হচ্ছে মাটি। আর তা আদেশসুচক প্রণালীতে বর্ণনা করা হয়েছে।
এটা পরিষ্কার যে, মৃত্তিকার উপর সেজদার প্রাধান্যতার দর্শন হচ্ছে : এ কাজটি বিশ্ববিধাতার সমক্ষে নমনীয়তার নিদর্শন এবং একজন মানুষকে তার অনবরত ঔদ্ধত্য, আত্মতুষ্টি ও স্বার্থপরতার শৃংখল থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসে। একারণে মহানবী (সঃ) বলেছেনঃ
” যখন তোমাদের কেহ নামাজে দাঁড়ায়, সে যেন সেজদার সময় অবশ্যই তার ললাট ও নাসিকা মাটির উপর স্থাপন করে। কেননা এভাবে তার বিনয়ী ভাবেরই স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।”
কপাল থেকে পাগড়ী তুলে নিতে নবীর (সঃ) নির্দেশ
মৃত্তিকার উপর সেজদার প্রয়োজনীয়তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, সেজদার সময় ললাট থেকে পাগড়ীর কোনা সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে রাসুল (সঃ)-এর নির্দেশ।
হাদীস বিশারদগণ উপরোক্ত ব্যাপারে প্রচুর হাদীস উল্লেখ করেছেন। যেমন: সেজদার সময় পাগড়ীর একাংশ ললাট ও মাটির উপরিভাগের মাঝখানে স্থাপনকারী ব্যক্তিদেরকে একাজ করতে তিনি নিষেধ করেছেন। এখানে এ জাতীয় হাদীসের কয়েকটি নিদর্শন আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
এক: সালেহ সাবাবী বলেন: “নবী করিম (সঃ) জনৈক ব্যক্তিকে তাঁর পার্শ্বেই কপালে পাগড়ী বাধা অবস্থায় নামাজরত দেখতে পেলেন, তিনি ঐ ব্যক্তির কপাল থেকে পাগড়ী সরিয়ে দিলেন।”
দুই: আয়াজ বিন আবদুল্লাহ জ্বারশী বলেন: ” নবী (সঃ) জনৈক ব্যক্তিকে নামাজরত দেখতে পেলেন যে, সে পাগড়ীর এক কোনার উপর সেজদা করছিল। সে ব্যক্তিকে তার কপালের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, পাগড়ী যেন সরিয়ে ফেলা হয়।”
তিন: ‘কানযুল উম্মাল’ ও সুনানে বায়হাকী’ গ্রন্থদ্বয়ে আমীরুল মো’মেনীন হযরত আলী (আঃ)-এর নিকট থেকে একটি হাদীস নিম্নরূপে বর্ণিত হয়েছে:
” যখনই তোমাদের কেহ নামাজ পড়তে ইচ্ছে করবে তখন সে যেন তার মুখমন্ডল থেকে পাগড়ী সরিয়ে নেয়।”
চার: ‘ বিহারুল আনওয়ার’ গ্রন্থে দাআইমুল ইসলাম থেকে উল্লেখ করা হয়েছে:
” নবী (সঃ)-এর নিকট থেকে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি একজন নামাজীকে কাপড়, জামার আস্তিন এবং হাত ও পাগড়ীর কোনাচের উপর সেজদা করতে নিষেধ করেছেন।”
উপরোল্লিখিত বর্ণনাসমূহ থেকে পরিস্কার উপলব্ধি করা যায় যে, মাটির উপর সেজদার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি নবী করীম (সঃ) এর যুগে একটি নিশ্চিত বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতো। আর তা এমন পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছিল যে, যখনই কোন মুসলমান মাটির উপর সেজদা না করে ললাট পাগড়ীর কোনার উপর স্থাপন করতো তখনই তিনি বাধা প্রদান করতেন। আর যদি সকল প্রকার বস্তুর উপর সেজদা করা বৈধ হতো, এমনকি পরিধেয় বস্তু, যেমন: পাগড়ীর উপর পর্যন্ত, তা’হলে নবী (সঃ) কখনও এ কাজে বাধা প্রদান করতেন না।
মূল: সৈয়দ রেযা হুসাইনী নাসাব
অনুবাদক: মোঃ নূর আলম
তথ্যসূত্র:
বিহারুল আন্ওয়ার, খন্ডঃ ৮২, পৃঃ ১৪৭
সীরাতুনা ওয়া সুন্নাতুনা, পৃঃ ১২৫
সহীহ বুখারী, খন্ড-১ কিতাবুস্ সালাত, পৃঃ ৯১
সহীহ মুসলিম, খন্ড-১, পৃঃ ৩৭১
সুনানে তিরমিযি, খন্ড-২, পৃঃ ১৩১, ১৩৩
সুনানে বায়হাকী, খন্ড-১, পৃঃ ২১২
সহীহ মুসলিম, খন্ড- ১. পৃঃ-৩৭১
সুনানে বায়হাকী, খন্ড- ৬, পৃঃ ২৯১
বিহারুল আন্ওয়ার, খন্ড- ৮৩, পৃঃ ২৭৭
কানযুল উম্মাল, খন্ড: ৭, পৃঃ ৪৬৫, কিতাবুস্ সালাত।
আল্-মুসান্নেক, খন্ডঃ ১, পৃঃ ৩৯২
ইরশাদুস্ সারী, খন্ড-১, পৃঃ ৪০৫
আল্ এছাবা, খন্ডঃ ১, পৃঃ ৫০২, নং- ২৫৬২
উসুদুল গাবাহ, খন্ড: ২, পৃঃ ১৬১
আন্-নেহারা। ইবনে আসির), খন্ড-২, রাগাম ধাতু
সুনানে বায়হাকী, খন্ড-২, পৃঃ ১০৫
সুনানে বায়হাকী, খন্ড: ২. পৃঃ ১০৫
কানযুল উম্মাল, খন্ড: ৪, পৃঃ ২১২
সুনানে বায়হাকী, খন্ডঃ ২, পৃঃ ১৪৫
কানযুল উম্মাল, খন্ড: ৪, পৃঃ ৯৯, ২১২ এবং অন্য সংস্করনে খন্ডঃ ৭, পৃঃ ৩২৪।
বিহারুল আন্ওয়ার, খন্ড-৮৫, পৃঃ ১৫৬