Press "Enter" to skip to content

আহলে সুন্নাতের ইমামদের দৃষ্টিতে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)

এস, এ, এ

ইমাম সাদিক (আ.)-এর মাহাত্ম্যের কথা শুধু শিয়ারাই নয় বরং আহলে সুন্নাহ ও জামাতের বহু সংখ্যক আলেম ও বুজুর্গরাও বলেছেন। ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.)এর নৈতিকতা, মর্যাদা ও মহত্ত্ব সম্পর্কে সুন্নি সম্প্রদায়ের নেতারা, বিখ্যাত ইসলামী পণ্ডিত এবং মহান বিশেষজ্ঞরা অনেক কথা বলেছেন। এখন আমরা সংক্ষেপে তাদের এই মন্তব্য এবং স্বীকারোক্তিসমূহ কিছু প্রকাশ করবো:

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ও ইমাম জাফর সাদিক (আ.):

“নুমান বিন সাবিত বিন যুতি” (৮০-১৫০ হিজরি) নামে পরিচিত, হানাফী মাযহাবের নেতা, যিনি ইমাম সাদিক (আ.)-এর সমসাময়িক ছিলেন, তিনি ইমাম সাদিক (আ.)-এর মহত্ত্ব সম্পর্কে ভাল বক্তব্য এবং স্বীকারোক্তি দিয়েছেন৷ অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি ইমাম জাফর সাদিক (আ.) সম্পর্কে বলেছেন:

ما رایت افقه من جعفربن محمد و انه اعلم الامه

আমি জাফর ইবনে মুহাম্মাদের চেয়ে অধিক জ্ঞানী কোন ফক্বিহ্ দেখিনি। তিনি উম্মতের সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী ব্যাক্তি। (সীরাহ আলামুন নোবালা, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৫৭, তারিখে কাবীর, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৯৮, ১৯৯, হাদীস নং ২১৪৩)

ইমাম সাদিক (আ.)-এর যুগে আব্বাসীয় রাজনৈতিক খলিফা ছিল মনসুর দেওয়ানকি। তিনি সর্বদা বনি আলী এবং বনি ফাতিমার নাম যশ, বিশেষ করে ইমাম সাদিক (আ.)-এর ক্ষেত্রে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতেন এবং তা থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে, মনসুর দেওয়ানকি মাঝে মাঝে আবু হানিফাকে উত্তেজিত করতেন এবং তাকে ইমাম সাদিক (আ.)-এর মুখোমুখি দাঁড় করাতেন। মনসুর আব্বাসি আবু হানিফা (রহ.)কে যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পণ্ডিত হিসেবে সম্মানিত করতেন যেন তিনি ইমাম জাফর বিন মুহাম্মদ (আ.)-এর মহানুভবতাকে ক্ষুন্ন করতে সক্ষম হন। এ প্রসঙ্গে আবু হানিফা নিজেই বর্ণনা করেন:

একদিন মনসুর দাভানকি আমার কাছে একজনকে পাঠালেন এবং বললেন: হে আবু হানিফা! লোকেরা জাফর বিন মুহাম্মদের প্রতি মুগ্ধ এবং আকৃষ্ট, তিনি মানুষের মধ্যে একটি বিশাল সামাজিক ভিত্তি স্থাপন করেছেন। আপনি যদি জাফর বিন মুহাম্মদের প্রসিদ্ধতার ভিত্তি এবং তার মহানুভবতাকে  জনগণের মাঝে ক্ষুন্ন করতে চান। তাহলে বিশেষ করে, তার মহত্ত্ব বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকুন, কিছু জটিল ও রহস্যময় প্রশ্ন তৈরি করুন এবং তাকে সঠিক সময়ে জিজ্ঞাসা করুন, যাতে জাফর বিন মুহাম্মদ উত্তর দিতে অক্ষম হন এবং আপনি তাকে অপমান করতে পারেন এবং লোকেরা যেন আর তার প্রতি আকৃষ্ট না হয় এবং তার থেকে দূরে সরে যায়।

এই উদ্দেশ্যে আমি ৪০টি জটিল মাসআলা তৈরি করেছিলাম এবং একদিন যখন মনসুর হীরাতে অবস্থান করছিলেন তখন তিনি আমাকে ডাকলেন, আমি তার সমীপে উপস্থিত হলাম, আমি প্রবেশ করার সাথে সাথে জাফর বিন মুহাম্মদকে তার ডান পাশে বসে থাকতে দেখলাম। আমি ইমাম জাফর সাদিক (আ.)এর দিকে তাকালাম। এমতাবস্থায় আমি তার মহিমা দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে আমি তা বর্ণনা করতে অক্ষম। অথচ আব্বাসীয় খলিফা মনসুরকে দেখে আমি এতটা মুগ্ধ হইনি। আমি সালাম বিনিময়ের পরে তাদের পাশে বসার অনুমতি চাইলাম, খলিফা ইশারায় অনুমতি দিলেন এবং আমি তাদের পাশে বসলাম। তারপর মনসুর আব্বাসি জাফর বিন মুহাম্মদের দিকে তাকিয়ে বললেন: হে আবু আব্দুল্লাহ! ইনি হচ্ছেন আবু হানিফা।

তিনি বললেন: হ্যাঁ, আমি তাকে চিনি। তখন মনসুর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন: আবু হানিফা! আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে আবু আবদুল্লাহ, জাফর বিন মুহাম্মদকে জিজ্ঞাসা করুন এবং তার কাছে উপস্থাপন করুন। আমি মনে মনে ভাবলাম: খুব ভালো। আমি সেই সুযোগটা নিয়ে আগে থেকে যে চল্লিশটি বিষয় প্রস্তুত করে রেখেছিলাম, তার সঙ্গে একের পর এক আলোচনা করলাম। প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে ইমাম সাদিক (আ.) একরে পর এক উত্তর দিচ্ছিলেন। এই বিষয়ে আপনার মতামত অমুক, এই বিষয়ে মদীনার আলেমদের অভিমত এই রকম, আমাদের অভিমতও এই রকম।

কোন কোন বিষয়ে তিনি আমাদের মতের সাথে একমত হয়েছেন এবং কোন কোন বিষয়ে মদীনার আলেমদের মতামতের সাথে একমত হয়েছেন এবং কখনো কখনো উভয় মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন এবং তিনি নিজেই তৃতীয় মত বেছে নিয়ে তা প্রকাশ করেছেন।

আমি তার কাছে একের পর এক বেছে নেওয়া চল্লিশটি কঠিন প্রশ্ন উপস্থাপন করলাম এবং যেভাবে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, জাফর বিন মুহাম্মাদ সম্পূর্ণ শান্তভাবে এবং দক্ষতার সাথে সে প্রশ্নসমূহের উত্তর দিয়েছিলেন। এরপর আবু হানিফা (রহ.) বলেছিলেন:

ان اعلم الناس اعلمهم باختلاف الناس

“প্রকৃতপক্ষে, সবচেয়ে জ্ঞানী লোক তারাই যারা বিভিন্ন বিষয়ে পণ্ডিতদের বিভিন্ন মতামত এবং তত্ত্ব দ্বারা বেষ্টিত এবং আয়ত্ত করে”। (সীরাহ আলামুন নোবালা, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ৫১৯, বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৪৭, পৃষ্ঠা ২১৭)

তিনি ইমাম সাদিক (আ.)-এর মহানুভবতার কথা এভাবে বর্ণনা করেছেন:

لولا جعفربن محمد ما علم الناس مناسک حجهم.

জাফর বিন মুহাম্মদ না থাকলে মানুষ তাদের হজের নিয়ম-কানুন জানত না। (মান লা ইয়াহ যারুহুল ফাক্বিহ্, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৫১৯)

মালিক বিন আনাস (রহ.) ও ইমাম জাফর সাদিক (আ.):

মালিক বিন আনাস হলেন আহলে সুন্নাহ ও জামায়াতের চার নেতার একজন এবং মালিকি মাযহাবের প্রধান, যিনি কিছু সময়ের জন্য ইমাম সাদিক (আ.)-এর শিষ্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। (সীরাহ আলামুন নোবালা, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৫৬)

তিনি ইমাম সাদিক (আ.)-এর মহত্ত্ব, জ্ঞান ও নৈতিকতা সম্পর্কে বলেছেন:

ولقد کنت آتی جعفربن محمد و کان کثیرالمزاح و التبسم، و ما راءیته قط یحدث عن رسول الله(ص) الا علی الطهاره و لا یتکلم فی مالا یعنیه و کان من العلماءالزهاد الذین یخشون الله و ماراءیته قط الا یخرج الوساده من تحته و یجعلهاتحتی.

আমি কিছুদিন যাবত জাফর বিন মুহাম্মদের সান্নিধ্যে অর্জন করেছিলাম। তিনি একজন প্রাণোচ্ছল ব্যাক্তি ছিলেন। তার ঠোঁটে সব সময় মৃদু হাসি পরিলক্ষিত হতো। তাঁর উপস্থিতিতে যখন ইসলামের প্রিয় রসূল (সা.)-এর বরকতময় নাম উচ্চারণ করা হতো, তখন জাফর বিন মুহাম্মদের মুখের রং সবুজ ও পরে হলুদ হয়ে যায়। যখনই আমি তার বাড়িতে যেতাম, তখন তাকে এই তিনটি অবস্থার একটি ব্যাতিত তাকে আর দেখিনি হয় নামায পড়তে, রোযা রাখতে বা কুরআন তিলাওয়াত করতে। (তাওয়াসসুল ওয়া ওয়াসিলা, পৃষ্ঠা ৫২, হায়াতে ফিকরি ওয়া সিয়াসী ইমামানে শিয়া, পৃষ্ঠা ৩২৭)

আমি কখনও দেখিনি যে জাফর বিন মুহাম্মাদ অযু ও পবিত্রতা অর্জন না করে রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে একটি হাদীসও বর্ণনা করেছেন। আমি তাকে অর্থহীন ও বেহিসাব কিছু বলতে দেখিনি। তিনি ছিলেন তপস্বী পণ্ডিতদের একজন যারা আল্লাহকে ভয় করতেন। তিনি আল্লাহর ভয়ে পরিপূর্ণ ছিলেন।

কখনোই এমন হয়নি যে আমি তাঁর সান্নিধ্যে উপস্থিত হয়েছি, আর তিনি যে মাদুরে বসতেন তা আমার জন্য বিছিয়ে দেন নি।

মালিক বিন আনাস ইমাম সাদিক (আ.)-এর তপস্বীতা, ইবাদত এবং আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে যা বলেছেন:

একদা আমি ইমাম সাদিক (আ.) এর সাথে মক্কার উদ্দেশ্যে এবং হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য মদীনা ত্যাগ করি। যখন আমরা শাজারা মসজিদে (যেটি মদিনাবাসীদের জন্য মিকাতের স্থান) পৌঁছালাম, ইহরামের পোশাক পরিধান করলাম, ইহরামের পোশাক পরার সময় তালবিয়্যাহ (বলা আবশ্যক) পাঠ করছিলাম তখন অন্যরাও আমাদের সাথে যথারীতি তালবিয়্যাহ পাঠ করছিল।

মালিক বলেছেন: আমি ইমাম সাদিক (আ.) কে লক্ষ্য করেছি। ইমাম সাদিক (আ.) “তালবিয়্যাহ” বলতে চান, কিন্তু তার মুখের রং বদলে যায়। একটি আবেগ ইমামকে স্পর্শ করে এবং তার গলার কণ্ঠস্বর ভেঙ্গে যায় এবং সে তিনি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ এমনভাবে হারিয়ে ফেলেন মনে হচ্ছিল তিনি বাহন থেকে পড়ে যাবেন। মালিক বলেন: আমি এগিয়ে এসে বললাম: হে নবীর সন্তান! এ তালবিয়্যাহ উচ্চারণ করা ছাড়া উপায় নেই। যে কোনো উপায়ে, তা উচ্চারণ করতে হবে। ইমাম বললেন:

হে আবি আমের পুত্র! আমি কিভাবে সাহস করি এবং নিজেকে “লাবিক”  বলার অনুমতি দিই? “লাবিক” বলার অর্থ এই যে, হে আল্লাহ, আপনি আমাকে ডাকছেন আমি তার পূর্ণ গতিতে সাড়া দিয়েছি এবং আমি তা করতে সর্বদা প্রস্তুত আছি। কি আত্মবিশ্বাসের সাথে আমি আমার ঈশ্বরের প্রতি এত ঔদ্ধত্য হতে পারি এবং নিজেকে সেবা করার জন্য প্রস্তুত একজন দাস হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি?! যদি আমার প্রতিউত্তর বলা হয়: ” لالبیک و لاسعدیک ” তাহলে আমি কি করব? (এমালি, শেখ সাদুক্ব, পৃষ্ঠা ১৪৩, হাদীস নং ৩)

অন্য একটি স্থানে ইমাম সাদিক (আ.)-এর ফজিলত ও মহত্ত্ব সম্পর্কে বলেছেন:

ما راءت عین و لا سمعت اذن و لا خطر علی قلب بشر افضل من جعفربن محمد

কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শোনেনি এবং কোন মানুষের অন্তরে জাফর ইবনে মুহাম্মাদ (আ.)-এর চেয়ে বেশি গুণী কোন মানুষ প্রবেশ করেনি।(সীরাহ দার সীরেহ-এ আয়েম্মে আতহার (আ.) পৃষ্ঠা ১৪৯)

هیچ چشمی ندیده است و هیچ گوشی نشنیده است و به قلب هیچ بشری خطور نکرده است، مردی که با فضیلت تر از جعفربن محمد باشد.

মালিক ইবনে আনাস সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে:

و کان مالک بن انس یستمع من جعفربن محمد و کثیرا مایذکر من سماعه عنه و ربما قال حدثنی الثقه یعنیه.

মালিক ইবনে আনাস ইমাম জাফর ইবনে মুহাম্মাদ (আ.) থেকে হাদীস শুনতেন, এবং তিনি তার কাছ থেকে যা শুনতেন তার অনেক কিছু বলতেন এবং তিনি সম্ভবত বলতেন: এই হাদীসটি আমার কাছে একজন সেক্বা ব্যাক্তি বর্ণনা করেছেন, যার অর্থ জাফর ইবনে মুহাম্মদ। (শারহুল আখবার ফি ফাযায়েলে আয়েম্মাতিল আতহার, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৯৯, হাদীস নং ১২০৩)

হোসাইন বিন ইয়াজিদ নওফেলি বলেন:

سمعت مالک بن انس الفقیه یقول والله ما راءت عینی افضل من جعفربن محمد(ع) زهدا و فضلا و عباده و ورعا. و کنت اقصده فیکرمنی و یقبل علی فقلت له یوما یاابن رسول الله ما ثواب من صام یوما من رجب ایمانا و احتسابا فقال (و کان والله اذا قال صدق) حدثنی ابیه عن جده قال قال رسول الله(ص) من صام یوما من رجب ایمانا و احتسابا غفرله فقلت له یا ابن رسول الله فی ثواب من صام یوما من شعبان فقال حدثنی ابی عن ابیه عن جده قال قال رسول الله(ص) من صام یوما من شعبان ایمانا و احتساباغفرله.

আমি ‘ফকীহ’ মালিক ইবনু আনাস থেকে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন: আল্লাহর কসম! তপস্বী, জ্ঞান, পুণ্য, ইবাদত ও তাকওয়ার দিক থেকে জাফর বিন মুহাম্মদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কাউকে আমি দেখেনি। আমি তার কাছে যেতাম। তিনি আন্তরিকভাবে সাদরে গ্রহণ এবং সম্মান করতেন। একদিন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, হে নবীর সন্তান, রজব মাসে রোজা রাখার সওয়াব কী? জবাবে তিনি নবীর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, তিনি যখনই কারো কাছ থেকে কিছু বর্ণনা করেন, তিনি তা সঠিকভাবে বর্ণনা করেন। তিনি উত্তরে বললেন: আমার পিতা তার পিতা থেকে, তার দাদা থেকে এবং তিনি নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রজব মাসে রোযা রাখার সওয়াব হলো তার গুনাহসমূহকে ক্ষমা করা হয়। অতঃপর আমি শা’বান মাসে রোজা রাখার বিষয়ে এই প্রশ্নটি করেছিলাম এবং ইমাম (আ.) একই উত্তর দেন।

ইবনে শবরমাহ ও ইমাম জাফর সাদিক (আ.):

আবদুল্লাহ বিন শবরমা বিন তুফাইল ধব্বি, যিনি “ইবনে শবরমা” (৭২-১৪৪ হিঃ) নামে পরিচিত, কুফার একজন বিখ্যাত বিচারক ও ফক্বিহ্ তিনি ইমাম সাদিক (আ.) সম্পর্কে বলেছেন।

ماذکرت حدیثا سمعته من جعفربن محمد(ع) الا کادان یتصرع له قلبی سمعته یقول حدثنی ابی عن جدی عن رسول الله.

আমার মনে হয় না আমি জাফর বিন মুহাম্মদের কাছ থেকে এমন একটি হাদীস শুনি নি যা আমার আত্মাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেনি। আমি তার কাছ থেকে শুনেছি যে, হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, আমি এই বর্ণনাটি আমার পিতা থেকে, আমার দাদা থেকে এবং রসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করছি। (এমালি সাদুক্ব, পৃষ্ঠা ৩৪৩, হাদীস নং ১৬)

তিনি বলেছেন:

واقسم بالله ما کذب علی ابیه و لا کذب ابوه علی جده و لا کذب جده علی رسول الله.

আল্লাহর শপথ! জাফর বিন মুহাম্মাদ হাদীস বর্ণনায় তার পিতা সম্পর্কে মিথ্যা বলেননি, তার পিতা তার পিতামহ সম্পর্কে মিথ্যা বলেননি এবং তিনি নবী (সা.) সম্পর্কে মিথ্যা বলেননি। (অর্থাৎ জাফর ইবনে মুহাম্মদের রেওয়ায়েতের ধারাবাহিকতায় যা আছে তা সম্পূর্ণ সত্য)। (এমালি সাদুক্ব, পৃষ্ঠা ৩৪৩, হাদীস নং ১৬)

ইবনে আবি লাইলী ও ইমাম সাদিক (আ.):

শেখ সাদুক একটি রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন যে মুহাম্মদ ইবনে আবদ আল-রহমান ওরফে “ইবনে আবি লাইলী” (৭৪-১৪৮ হিঃ) নামে পরিচিত, একজন ফক্বিহ্, মুহাদ্দিস, মুফতি এবং কুফা নামক বিচারক, ইমাম সাদিক (আঃ)-এর কাছে যায় এবং তাঁকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে এবং যথাপোযুক্ত উত্তর শ্রবণ করে। অতঃপর ইমামকে উদ্দেশ্য করে বলে:

اشهد انکم حجج الله علی خلقه.

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনারা আল্লাহর বান্দাদের উপর হুজ্জাত (দলিল) স্বরূপ। (মান লা ইয়াহ যারুহুল ফাক্বিহ্, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১৮৮, হাদীস নং ৫৬৯)

আমরু বিন ওবায়েদ মু’তাযিলী ও ইমাম সাদিক (আ.):

আমরু বিন উবায়েদ মুতাযিলি “ইমাম জাফর বিন মুহাম্মাদ (সা.)-এর কাছে যান এবং তিনি এই আয়াতটি পাঠ করেন।

الذین یجتنبون کبائرالاثم و الفواحش

অর্থ: যারা বড় বড় গোনাহ ও অশ্লীলকার্য থেকে বেঁচে থাকে। (সুরা নাজম, আয়াত নং ৩২)

তারপর নিরবতা অবলম্বন করেন। ইমাম সাদিক (আ.) বললেন: তুমি থামলে কেন? তিনি বললেন: আমি চেয়েছিলাম আপনি আমাকে কুরআন থেকে একের পর এক কবীরা গুনাহের কথা বর্ণনা করবেন। হযরত শুরু করলেন এবং একের পর এক সবচেয়ে বড় গুনাহের কথা উল্লেখ করলেন। ইমাম আমরূ বিন ওবায়েদের প্রশ্নের এমন উত্তম ও উপযুক্ত উত্তর দিলেন যে অবশেষে আমরূব বিন ওবায়েদ অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁদলেন এবং চিৎকার করলেন:

هلک من قال براءیه و نازعکم فی الفضل و العلوم

যে তার মত অনুযায়ী কথা বলে এবং অনুগ্রহ ও জ্ঞানে আপনার সাথে বিতর্ক করে সে ধ্বংস হবে। (কাফি, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ২৮৫, ২৮৭)

জাহেয এবং ইমাম জাফর সাদিক (আ.):

আবু বাহর জাহিজ বসরী (১৬০- ২৫৫হি) তিনি তৃতীয় শতাব্দীর অন্যতম বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন, তিনি ইমাম জাফর সাদিক (আ.) সম্পর্কে একটি বিবৃতি দিয়েছেন।

جعفربن محمدالذی ملاالدنیا علمه و فقهه و یقال ان اباحنیفه من تلامذته و کذلک سفیان الثوری و حسبک بهما فی هذاالباب.

জাফর বিন মুহাম্মাদ এমন একজন ব্যাক্তি ছিলেন যার জ্ঞান এবং ফিক্বাহ্শাস্ত্র সারা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছিল এবং বলা হয় যে আবু হানিফা এবং সুফিয়ান সুরি তার ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন। তাঁর জ্ঞানের বিশালত্বের জন্য এটাই যথেষ্ট।

উমর বিন মুকদাম ও ইমাম জাফর সাদিক (আ.):

ইমাম সাদিক (আ.)-এর সমসাময়িক আলেমদের মধ্যে ওমর ইবনে মুকাদাম ছিলেন একজন। তিনি ইমাম জাফর সাদিক (আ.) সম্পর্কে বলেন:

کنت اذا نظرت الی جعفربن محمد علمت انه من سلاله النبیین و قدراءیته واقفا عندالجمره یقول سلونی، سلونی.

জাফর বিন মুহাম্মাদকে দেখে বুঝলাম তিনি নবীদের বংশধর। আমি নিজে দেখেছি যে তিনি জামারাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং চাচ্ছিলেন যে, লোকেরা যেন তাকে জিজ্ঞাসা করুক এবং তার সমৃদ্ধ জ্ঞান থেকে উপকৃত হোক। (সীরাহ আলামুন নোবালা, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৫৭)

শাহরিস্তান ও ইমাম জাফর সাদিক (আ.):

আবুল-ফাত মুহাম্মদ ইবনে আবি আল-কাসিম আশআরী, যিনি “শাহরেস্তানি” নামে পরিচিত (৪৭৯-৫৪৭ হি:) তার মূল্যবান গ্রন্থ “ইলম ওয়া আল-নাহল”-এ ইমাম সাদিক (আ.)-এর মহত্ত্ব সম্পর্কে লিখেছেন:

و هو ذوعلم عزیز فی الدین و ادب کامل فی الحکمه و زهر بالغ فی الدنیا و ورع تام عن الشهوات.

ইমাম সাদিক (আ.) ধর্মীয় সহ বিভিন্ন বিষয়ে সীমাহীন জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, নিখুঁত সাহিত্য এবং পার্থিব বিষয়ের ক্ষেত্রে তিনি একজন শক্তিশালী তপস্বী ছিলেন এবং জাগতিক কামনা বাসনা এবং লালসাকে পরিহার করতেন। (আল মেলাল ওয়ান নাহল, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১৪৭, হায়াতে ফিকরি ওয়া সিয়াসী ইমামানে শিয়া, পৃষ্ঠা ৩৩০)

ইবনে খালকান ও ইমাম জাফর সাদিক (আ.):

ইবনে খালকান ইমাম সাদিক (আ.) সম্পর্কে লিখেছেন:

احدالائمه الاثنی عشر علی مذهب الامامیه و کان من سادات اهل البیت و لقب بالصادق لصدق مقالته و فضله اشهر من ان یذکر.

তিনি ছিলেন ইমামিয়ার বারোজন ইমামের একজন এবং আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর আহলে বাইতের বুজুর্গদের একজন। তাঁর বক্তব্যের সত্যতার কারণে, তিনি সাদিক নামে পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর অনুগ্রহের জন্য তিনি এতটাই খ্যোত ছিলেন যে তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন।

ইবনে খালকান আরও লিখেছেন: ইমাম সাদিক (আ.)-এর রসায়ন শস্ত্রে বিশেষ দক্ষতার অধিকারী ছিলেন, আবু মুসা জাবের বিন হাইয়ান তারতুসী তাঁর ছাত্র ছিলেন। জাবের এক হাজার পৃষ্ঠা সম্বলিত একটি বই লিখেছিলেন, যাতে জাফর বিন সাদিকের শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং পাঁচশটি গ্রন্থ ছিল। (ওয়াফিয়াতুল আয়ান, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৩২৭, সীরাহ পিশওয়া, পৃষ্ঠা ৩৫৩, হায়াতে ফিকরি ওয়া সীয়াসী ইমামানে শিয়া, পৃষ্ঠা ৩৩০)

ইবনে হাজার আসকালানী ও ইমাম সাদিক (আ.):

শাহাবুদ্দিন আবুল ফজল আহমেদ বিন আলী মিসরী শাফিঈ, যিনি “ইবনে হাজার আসকালানী” নামে পরিচিত (৭৭৩-৮৫২ হিঃ) তিনি ইমাম জাফর সাদিক (আ.) সম্পর্কে বলেছেন:

جعفربن محمد بن علی بن حسین بن علی بن ابی طالب فقیهی است بسیار راست گفتار.

ইবনে হাজার তার তাহযিবুত তাহযিব নামক গ্রন্থে আবি হাতেম থেকে এবং তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি ইমাম সাদিক (আ.) সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন:

و لجعفراحادیث و نسخ و هو من ثقات الناس… و ذکره ابن حبان فی الثقات و قال کان من سادات اهل البیت فقها و علما و فضلا… وقال النسایی فی الجرح و التعدیل ثقه.

জাফর ইবনে মুহাম্মদের জন্য অনেক হাদিস ও অনুলিপি রয়েছে। তিনি একজন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। ইবনে হিব্বান তাকে সেক্বা শ্রেণীতে রেখেছেন এবং বলেছেন: জাফর বিন মুহাম্মাদ আল্লাহর রসূল (সা.)-এর আহলে বাইতের বুজুর্গদের একজন এবং ফিক্বহ্, জ্ঞান ও সম্মানের দিক থেকে তার উচ্চ অবস্থান রয়েছে। “নাসাঈ” ইমাম সাদিক (আ.)-কে “বিশ্বস্ত” ব্যক্তিদের একজন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।

আব্দুল্লাহ শামসুদ্দিন যাহাবী এবং ইমাম জাফর সাদিক (আ.): 

আব্দুল্লাহ শামসুদ্দিন যাহাবী এবং ইমাম জাফর সাদিক (আ.) সম্পর্কে বলেছেন:

জাফর বিন মুহাম্মাদ বিন আলী বিন হুসাইন, যিনি হুসাইন বিন আলী এবং খোদার রাসূল (সা.)-এর সুরভিত সন্তানদের মধ্যে একজন, যাঁর মাতা হলেন কাসিম বিন মুহাম্মদ বিন আবি বকরের কন্যা উম্মে ফারাহ, এবং উম্মে ফারওয়ার মা হলেন আসমা, আব্দুর রহমান বিন আবি বকরের কন্যা। এই কারণে তিনি বলতেনঃ আমি আবু বকরের সাথে দুইভাবে সম্পর্কযুক্ত। তিনি বনি হাশেমের বড়। অনেক লোক তাঁর জ্ঞান থেকে অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন যেমন: তাঁর পুত্র “মুসা কাজেম”, “ইয়াহিয়া বিন সাঈদ আনসারী”, “ইয়াজিদ বিন আবদুল্লাহ”, “আবু হানিফা”, “ইবান বিন তাঘলিব”, “ইবনে জারিহ”, “মুয়াবিয়া বিন আম্মার”, “ইবনে ইসহাক”, “সুফিয়ান”, “শাবাহ”, “মালিক”, “ইসমাইল বিন জাফর”, “ওয়াহব বিন খালিদ”, “হাতাম বিন ইসমাইল”, “সুলেমান বিন বিলাল”, “সুফিয়ান বিন আইনীহ”, “হাসান বিন সালিহ, হাসান বিন আয়াশ, জুহাইর বিন মুহাম্মদ, হাফস বিন গিয়াথ, যায়েদ বিন হাসান, আনমাতি, সাঈদ বিন সুফিয়ান আসলামী, আবদুল্লাহ বিন মায়মন, আব্দুল আজিজ বিন ইমরান জোহরি, আব্দুল আজিজ দরোয়ারি।”, “আব্দুল ওয়াহাব সাকফি “, “ওসমান বিন ফারকাদ”, “মোহাম্মদ বিন থাবিত বনানী”, “মোহাম্মদ বিন মাইমন জাফরানী”, “মুসলিম জাঞ্জি”, “ইয়াহিয়া কাত্তান”, “আবু আসাম নাবিল” প্রমূখ। (সীরাহ আলামুন নোবালা, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৫৫, ২৫৬)

তিনি তাঁর ‘মিযানুল এতেদাল’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন:                                                                                                                                                                                জাফর বিন মুহাম্মাদ হলেন ইমামদের একজন যার একটি উচ্চ অবস্থান রয়েছে এবং তিনি সৎ অনুগ্রহকারী। (লোগাত নামে দেহখোদা, খন্ড ৯, পৃষ্ঠা ১৩০, ৩২৩)

ইবনে হাজার হেইতামী এবং ইমাম সাদিক (আ.):

শাহাবুদ্দিন আবুল আব্বাস, আহমদ বিন বদরুদ্দিন শাফিয়ী, যিনি “ইবন হাজার হেইতামী” নামে পরিচিত (৯৭৪-৯০৯ হি) তিনি ইমাম সাদিক (আ.) সম্পর্কে লিখেছেন:

মানুষ তার কাছ থেকে অনেক জ্ঞান অর্জন করেছে। এই জ্ঞান ভ্রমণকারীদের দ্বারা সর্বত্র পৌছে যায় এবং অবশেষে জাফর বিন মুহাম্মদের সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। “ইয়াহইয়া বিন সাঈদ”, “ইবনে জারিজ”, “মালিক”, “সুফিয়ান সাওরী”, “সুফিয়ান বিন আইনীহ”, “আবু হানিফাহ”, “শাবা” এবং “আইয়ুব সাজেস্তানী” প্রমুখ মহান আলেমগণ হাদীসটি থেকে উদ্ধৃত করেছেন। (সাওয়ায়েকুল মোহরেকা, পৃষ্ঠা ২০১)

মীর আলী হিন্দী ও ইমাম জাফর সাদিক (আ.):

মীর আলি হিন্দি, যিনি বিখ্যাত সুন্নি পণ্ডিতদের একজন এবং যিনি এই সমসাময়িক সময়ে বসবাস করেছিলেন, তিনি ইমাম সাদিক (আ.)-এর অসীম জ্ঞান ও নৈতিকতা এবং  মহত্ত্ব সম্পর্কে বলেছেন:

ধর্মীয় মতামত এবং ফতোয়া শুধুমাত্র সাদাত (সৈয়দ) এবং ফাতেমীয় ব্যক্তিত্বের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। তৎকালীন জ্ঞানের প্রসার বিতর্ক ও অনুসন্ধানের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করেছিল এবং দার্শনিক বিতর্ক ও আলোচনা সমস্ত সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল। উল্লেখ্য যে, এই বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের নেতৃত্বে জ্ঞানের ক্ষেত্র মদিনায় বিকাশ লাভ করেছিল। আলী বিন আবি তালিব (আ.) এর নাতি ইবনে হাওজা তথা ইমাম জাফরের নাম দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার ডাকনাম ছিলেন “সাদিক”। তিনি একজন সক্রিয় গবেষক এবং একজন মহান চিন্তাবিদ ছিলেন এবং তিনি সেই যুগের জ্ঞানের সাথে ভালভাবে পরিচিত ছিলেন এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামের প্রধান দার্শনিক বিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

তাঁর ক্লাসসমূহে, শুধুমাত্র তারাই নয় যারা পরে মাযহাবে ফিকাহ্ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বরং তাঁর ক্লাসে দূরবর্তী অঞ্চলের দার্শনিক এবং দর্শনের ছাত্ররাও অংশগ্রহণ করেছিলেন।

বসরার দার্শনিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ‘হাসান বসরী’ এবং মুতাজিলা ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ‘ওয়াসিল বিন আতা’ তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন যারা তাঁর জ্ঞানের ঝর্ণার স্বচ্ছতা থেকে উপকৃত হয়েছেন। (মুখতাসার তারিখে আরব, পৃষ্ঠা ১৯৩, সীরাহ্ পিশওয়াইয়ান, পৃষ্ঠা ৩৫২)