Press "Enter" to skip to content

ইমাম খোমেনি (রহ.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী-৩

অনুবাদ: ড. আবু উসামা মুহাররম

পরবর্তি অংশ…

৭- শিক্ষাদান
ইমাম খোমেনি ২৭ বছরের পূর্বেই দার্শনিক বই পড়া শুরু করেন। তিনি তাঁর ছাত্রদের অধ্যয়নের জন্য বই বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক ছিলেন। এছাড়াও, দর্শনের শিক্ষা দেওয়ার সাথে সাথে তিনি যোগ্য এবং বিশ্বস্ত ছাত্রদেরকে ব্যক্তিগতভাবে আত্মশুদ্ধিমূলক পাঠ গ্রহণের পরামর্শ প্রদান করেন।[১]
ফলে ছাত্ররা দর্শনের কোর্সের পাশাপাশি নৈতিকতার শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। শুরুতে, এটি খুব সীমিতাকারে ছিল এবং তারা মানাজেলুস সায়িরিন বই থেকে পাঠ গ্রহণ করেন। তাঁর পাঠ গ্রহণের প্রতি ধীরে ধীরে আগ্রহীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, যাতে নীতিশাস্ত্রের পাঠ সপ্তাহে দুই দিন, যথা বৃহস্পতি ও শুক্রবারে পৌঁছে।[২] রেজা শাহের অধিনস্থ কর্মকর্তা এ নৈতিকতা পাঠের কর্মসূচি বাতিল করতে বাধ্য করে। ফলে তারা ফয়জিয়া স্কুল থেকে শহরের দূরবর্তী এলাকার হাজি মোল্লা সাদিক স্কুলে স্থানান্তরিত হয়।[৩]
তিনি ১৩২৫ হিজরিতে (১৩৬৪ হিজরি) আয়াতুল্লাহ বোরুজেরদি কুমে আসার সাথে সাথে ফিকহ ও উসুলে ফিকহ পড়া শুরু করেন। অবশ্যই, বিদেশী কোর্স শুরু করার আগে, তিনি বহু বছর ধরে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন এবং একদল পণ্ডিত ও ছাত্রের জন্য ফিকহ ও উসুলে ফিকহ পাঠদান করেন। ইমামের পাঠদনানের
বিশেষ পদ্ধতি এবং শৈলী তার ছাত্রদের গবেষণামুখী করে তোলে।[৪]

নির্বাসনের পর তারা ইমামকে নাজাফ আশরাফে পড়াতে বলেন। জবাবে, তিনি বলেছিলেন: "নাজাফের অঞ্চলে পাঠের প্রয়োজন নেই, তারা সুশিক্ষিত" জোরাজুরির পরে তিনি রাজি হলেন বটে, তবে শর্ত দিলেন তার পাঠে কোন আলেমরা পাঠে হস্তক্ষেপ করবে না। [৫] নাজাফের অনেক ছাত্র বিশ্বাস করত যে একজন ব্যক্তি যে নাজাফে পড়াশুনা করেনি সে একজন আলেম ও মুজতাহিদ হতে পারে না। তাই বেশ কিছু পেশাদার সমস্যা সৃষ্টিকারী ইমামের ক্লাশে এসেছিল কিন্তু তারা সমস্যা করতে পারেনি।[৬] ইমাম তার পাঠে নাজাফের চেয়ে ভিন্ন আঙ্গিক তৈরি করেন। যা সেখানে প্রচলিত ছিলনা। সময়মত ক্লাশ শুরু করতেন। পরীক্ষা নিতেন, যা নাজাফে প্রচলিত ছিল না। তার ক্লাশে যারা ভাল করতো তাদের তিনি পুরুষ্কৃত করতেন।[৭] ১৩৪৮ সালের বাহমান মাসে, ইমাম নাজাফের শেখ আনসারীর মসজিদে বেলায়েতে ফকিহ বা ধর্মীয় কর্তৃত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। [৮] একটি ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আলোচনা করেন। তবে এ সময় তিনি প্রিশ্নেন মুখোমুখি হন যে আপনি কবে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। আপনার এই বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত নয়। তিনি বলতেন এই বড় কাজের অনেক মাত্রা এবং প্রস্তুতি রয়েছে। আমরা বর্তমানে প্রোগ্রামটি সেট করছি এবং এটি একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অগ্রসর হবে। যখন ভবিষ্যত প্রজন্ম আসবে, তাদের যাতে আবার পরিকল্পনা সেট করার জন্য তাদের সময় নষ্ট করতে না হয়।[৯]
৮ -রচনা
ইমামের লেখালেখির কর্মজীবন যৌক্তিক বিষয় দিয়ে শুরু হয়েছিল এবং নীতিশাস্ত্র, ব্যবহারিক বিজ্ঞান, ফিকহ ও উসুলে ফিকহের ক্ষেত্রে অব্যাহত ছিল। ২৭ বছর বয়সে, তিনি

১. مصباح‌ الهدایه মিসবাহুল হিদায়াহ বইটি লিখেন। এ বইয়ের মুখোবন্দে সমসাময়িক অনেক পণ্ডিত মন্তব্য করেছেন।

২. ২৯ বছর বয়সে, তিনি রমজানের নামাযের উপর একটি ভাষ্য লেখেন।

৩. তার আরবাইন হাদিস বইটিতে ৭টি যৌক্তিক বিষয় সম্পর্কিত হাদিস রয়েছে এবং বাকিটি নৈতিকতার সাথে সম্পর্কিত। ইমামের অন্যান্য বই হল: [১০]

৪. হাশিয়া বার নুসুসুল হুকমি কায়সারি,

৫. হাশিয়া বার মাফাতিহুর গাইব;

৬. আসরারুস সালাত ইয়া মিরাজুস সালিকিন

৭. রিসালাহ ফিত্তিব ওয়াল ইরাদা

৮. হাশিয়া বার রিসালাতে শরহে হাদিসে রাসুল জালুত কাযি সাইদ ওয়া শরহে মুস্তাকিল্লি বার হুমান হাদিস

৯. কাশফে আসরার

১০. শরহে হাদিসে জুনুদ আকল ও জাহল

১১. আদাবুস সালাহ

১২. রাসায়িলঃ দারবারায়ে কায়েদায়ে লা যারার ওয়া লা যিরার, এস্তেসহাব, তাআদুল তারাজিহ, দুই খন্ডে

১৩. তাহরিরুল-ওয়াসিলা। ফিকহ কোর্সের সম্পূর্ণ পাঠ্য;

১৪. আল-বাই: দারস হায়ে ফিকহি নাজাফ ইমাম খোমেনি দার নাজাফে আশরাফ;

১৫. কিতাবুত তাহারা: বাহাসহায়ে ফিকহি;

১৬. তাহযিবুল উসুল: প্রফেসর জাফর সোবহানীর কুমের আইনশাস্ত্রের নীতির উপর বক্তৃতা তিনটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে;

১৭. নাইলুল-আওতার ফি বায়ানে কায়েদায়ে লা যারার ওয়া লা যিরার, তাকরিরে দারসে খারেজ;১৮. রিসালাহ ফিল ইজতিহাদ ও তাকলীদ দারসে খারেজ;

১৯. তাওযিহুল মাসাইল;

২০. যুবদাতুল আহকাম;

২১. হুকুমতে ইসলামি ইয়া বেলায়ত ফকীহ। ইসলামী সরকার সম্পর্কে ইমাম খোমেনির বক্তৃতা ও পাঠের সংকলন;

২২. মুবারেযে বা নফস ইয়া জিহাদ আকবর: নজফ আশরাফে নৈতিকতা সম্পর্কে ইমামের বক্তৃতার একটি সংগ্রহ;

২৩. মাকাসিবে মুহরিমা, দুই খণ্ড;

২৪. রিসালা মুশতামিল বার ফাওয়াদি দার বাযি মাসাইলে মুশকিলাহ

৯- রাজনৈতিক সংগ্রাম
আল্লাহর পথে সংগ্রাম ও জিহাদের চেতনার মূলে রয়েছে মহানবী (সা.)-এর জীবনকালের বিশ্বাস ও লালন- পালন, পারিবারিক পরিবেশ এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে তার সংগ্রাম শুরু হয় এবং এর বিবর্তন একদিকে তার আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিক মাত্রার বিবর্তন ও অন্যদিকে ইরান ও ইসলামী সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার সাথে সমান্তরালভাবে বিভিন্ন রূপে অব্যাহত থাকে।

৯.১ – যৌবন
সাইয়েদ রুহুল্লাহর শৈশব ও কৈশোরে ইরানের অস্থির রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি ইমাম খোমেনিকে দেশের সমস্যাগুলির প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তুলেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং সাংবিধানিক আন্দোলন এবং মির্জা কোচাখ খান জঙ্গলের আন্দোলন ছিল রুহুল্লাহর কিশোর বয়সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সেই বছরগুলিতে রুহুল্লাহকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত করেছিল তা ছিল বন আন্দোলন। জঙ্গল আন্দোলনের নেতার প্রতি রোহুল্লাহর আগ্রহের কারণ হল তিনি তার কাছ থেকে একটি স্বপ্ন বর্ণনা করেছিলেন এবং মির্জা কোচুক খান জঙ্গলের প্রশংসায় একটি কবিতা লিখেছিলেন। ইমাম তার ভাইকে তার স্বপ্ন এভাবে বর্ণনা করলেন: রাত হয়ে গেছে, কিন্তু সূর্য তখনও আকাশে। এই বাড়িটাও একটা জঙ্গল। বনকর্মীরা ঘোড়া নিয়ে এই বাড়িতে এসেছিল, আর মির্জাও তাদের মধ্যে ছিল। আমি তার জন্য চা নিয়ে এলাম, তিনি হাসলেন। কিছু না বলে বিদায় জানালেন। [১১]
যে সময় ইমাম কুমে গিয়েছিলেন, আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ হাসান মাদরাসি সংসদ সদস্য ছিলেন। খোমেইন অঞ্চলের সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য সম্ভবত ১৩০২ সালের শরত্কালে মাদ্রাজে তাঁর প্রথম সফর।[১২]
রেজা পাহলভির সিংহাসনে আরোহণের সময় আয়াতুল্লাহ মোদারেরসের বিরোধিতা এবং আগা নুরুল্লাহ এসফাহানির আন্দোলনের মতো প্রতিবাদী আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল, কিন্তু ইমাম এই সময়গুলিতে ব্যক্তিগত আন্দোলনে বিশ্বাস করেন। বরং বিশ্বাস করতেন সামগ্রিকভাবে আন্দোলোন করা উচিত। তারা আয়াতুল্লাহ হায়েরির পথ অনুসরণ করেছিল । তারা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বজায় রাখাকে অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিল। অবশ্য, কখনো কখনো তারা সূক্ষ্মতার সাথে তাদের বিরোধিতা দেখাতেন।[১৩]

তথ্যসূত্র:
১. রুহানি, সাইয়্যেদ হামিদ, নাহযতে ইমাম খোমেনি, খণ্ড ১, পৃ. ৫৫।
২.ইমাম খোমেনি, সহীফা ইমাম, খন্ড ৩, পৃ. ১৮৩।
৩. রুহানি, সাইয়্যেদ হামিদ, নাহযতে ইমাম খোমেনি, খণ্ড ১, পৃ. ৫৭।
৪. রুহানি, সাইয়্যেদ হামিদ, নাহযতে ইমাম খোমেনি, খণ্ড ১, পৃ. ৫৭।
৫. মুআসসে তানযিম ওয়া নাশরে আছারে ইমাম খোমেনি, খাতেরাতে সালহায়ে নাজাফ, আরোজ পাবলিকেশন,
খন্ড ১, পৃ. ৪৩।
৬. রুহানি, সাইয়্যেদ হামিদ, নাহযতে ইমাম খোমেনি , খণ্ড ২, পৃ. ২৫৬।
৭. মুআসসে তানযিম ওয়া নাশরে আছারে ইমাম খোমেনি, খাতেরাতে সালহায়ে নাজাফ, আরোজ পাবলিকেশন,
খন্ড ২, পৃ. ১৯৯।
৮. মুআসসে তানযিম ওয়া নাশরে আছারে ইমাম খোমেনি, খাতেরাতে সালহায়ে নাজাফ, আরোজ পাবলিকেশন,
খন্ড ২, পৃ. ৭১২।
৯. রাজাই, গোলাম আলী, বারদাশতহায়ে আয সিরিয়ে ইমাম খোমেনি, খণ্ড ৪, পৃ.২৭৪।
১০. রুহানি, সাইয়্যেদ হামিদ, নাহযতে ইমাম খোমেনি, খণ্ড ১, পৃ. ৭৩।
১১. কাদরি, সৈয়দ আলি, খোমেনি, রুহুল্লাহ, খণ্ড ১, পৃ. ২৩৪।
১২. রঞ্জির কেরমানি, আলি আকবর, রোযশুমারে যিন্দেগিয়ে ইমাম খোমেনি (আঃ),পৃ.৫।
১৩. শির আলি নিয়া, জাফর, দায়েরাতুল মাআরিফ মুসাওয়ারে তারিখে যিন্দেগিয়ে ইমাম খোমেনি, পৃ. ২৫।

চলবে…