Press "Enter" to skip to content

উমাইয়া খলিফাদের যুগে হযরত আলী(আ.)-এর ভূমিকা-৫

অনুবাদ: ড. আবু উসামা মুহাররম

তৃতীয় খলিফার সময়ে হযরত আলী(আ.)-এর ভূমিকা

২৩ হিজরিতে যখন ছয় জনের কাউন্সিল এর মধ্য থেকে একা উসমানের জামাতা আব্দুর রহমানএর অনুমোদনে উসমানকে খলিফা বানানোর প্রস্তাব দেয়া হয় এবং মুসলিমদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয়, তখন হযরত আলি (আ.) বললেন: হে লোক সকল! আমার আগে কেউ সত্য গ্রহণের জন্য তাড়াহুড়ো করেনি এবং যেহেতু আমার মত কেউ করুণা ও অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা করেনি, তাই আমার কথাগুলি শুনো এবং আমার যুক্তিগুলো অনুধাবনের চেষ্টা করো। সেই সময় খুব দূরে নয় যখন ভবিষ্যতে খিলাফত দখল করার জন্য তরবারি উন্মুক্ত করা হবে এবং চুক্তি ভঙ্গ হবে। যতক্ষণ না তোমাদের মধ্যে কেউ পথভ্রষ্টদের নেতা এবং অজ্ঞদের অনুসারী হবে। [১]

হযরত উসমানের যুগে ইমাম আলি (আ.)-এর অবস্থান

হযরত উসমান যখন খিলাফতে উপনীত হন, তখন তিনি মহানবি (সা.)-এর পথ এবং এমনকিতার পূর্বসূরী দুই খলিফার পথ ছেড়ে অন্য একটি পথ বেছে নেন, যার সংক্ষিপ্ত কারণগুলো নিম্নরূপ:

ক) নবির সুন্নাতের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিদ্বেষ: উদাহরণস্বরূপ, তিনি মিনায় পূর্ণ নামায পড়েন, যখন তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন: এটি আমার মতামত। অথবা যখন ওয়ালিদ বিন উকবা মাতাল অবস্থায় কুফার মসজিদে ফজরের সময় চার রাকাত নামাজ পড়েন এবং তাকে শাস্তি দেয়ার করার জন্য মদীনায় আনা হয়, তখন উসমান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি।

খ) উসমান কর্তৃক মুসলিম সাম্রাজ্যে উমাইয়াদের কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়, যারা তাদের হীনতা ও নিপীড়নের জন্য পরিচিত ছিল। উদাহরণ স্বরূপ, তিনি হাকাম বিনআসকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন, যে নবি কর্তৃক নির্বাসিত হয়েছিল। তাকে খুজাআ গোত্রের নেতৃত্ব প্রদান করা হয়। আবদুল্লাহ বিন সাদ আবি সারহকে নির্বাসনথেকে ফিরিয়ে আনেন এবং তাকে মিশরের শাসক করেন। তিনি ওয়ালিদ বিন উকবাকে যাকে স্বয়ং আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবে সাব্যস্ত করেন তাকে কুফায় পাঁচবছর কাটানোর অনুমতি দিয়েছিলেন।[২]

গ) উমাইয়াদের এবং তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের প্রতি তার অসীম উদারতা: উদাহরণ হিসাবে: তিনি মারওয়ানকে আফ্রিকার এক-পঞ্চমাংশ উপহার দেন। আবু সুফিয়ানকে ২০০ হাজার দিরহাম এবং তালহাকে ২০০ হাজার দিরহাম দিয়েছিলেন। উসমানের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ইমাম আলি (আ.)-এর অবস্থান দুটি ক্ষেত্রেপরীক্ষা করা উচিত:

ক) ধর্মীয় দিকনির্দেশনা

খ) রাজনৈতিকদিকনির্দেশনা

– ধর্মীয় নির্দেশনা:

হযরত আলি (আ.) হযরত উসমানের কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছিলেন এবং তার শাসনে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। হযরত উসমানও আলি (আ.)-এর প্রতি খুশি ছিলেন না। কারণ তিনি প্রকাশ্যে তার বিরোধিতা করেন। যদি উসমান হত্যা না হতো, তাহলে উসমানের অধপতন সত্বেও মুয়াবিয়া এবং উমাইয়া পরিবার তাদের নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্বের সুবিধা গ্রহণ করতো। এটি স্বাভাবিক ছিল যে হযরত আলি তার শাসনের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না এবং তার অপসারণ চাইতেন।

– রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা

হযরত উসমানকে হত্যার কারণে হযরত আলি (আ.) ভীষণভাবে পীড়িত ছিলেন। সেই অবস্থায় মুয়াবিয়া হযরত উসমানের মৃত্যুকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছিলেন। মুয়াবিয়া যিনি হযরত উসমানের মৃত্যুরপূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত উসমানের অনুরোধেসাড়া দেয়নি, তার মৃত্যুর পর তিনি শোক প্রকাশ করেন।আলি (আ.) বলেনঃ আমি প্রথম হিজরতকারীদের মধ্য থেকে একজন ছিলাম। আমিউসমানকে তার কাজকর্ম থেকে ফেরানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। তালহাও যুবাইর এই ফিতনায় ছুটে পতিত হয়েছিলেন। হযরত আয়েশা তাদের মধ্যে ছিলেনযারা তার উপর রাগান্বিত হয়েছিল। [৩]

হজরত আলি (আ.) হযরত উসমান কে সতর্ক করে বলতেন: লোকজন আপনার অবর্তমানে আপনার ব্যপারে আমার সাথে কথা বলছে। আপনি নিজে রাসূল (সা.) ও তার পরিবার-পরিজনের জীবন দেখেছেন। তাই তিনি তাকে বারবার সর্তক করেছেন যাতে তিনি মানুষের ক্রোধে ধ্বংস না হন। এজন্য তিনি যেন নবির জীবন চর্চা করেন। ইমাম (আ.) হযরত উসমানকে মারওয়ানের আনাগোনার বিপদ সম্পর্কে সতর্ককরার চেষ্টা করেছিলেন এবং মারওয়ানের সাথে পরামর্শ করতে নিষেধ করেছিলেন। অবশ্য আলি (আ.) তাকে দোষারোপ করেন এবং বলেন যে উসমান কিছু ভুল করেছেন এবং তাকে পাপের বাহক বলেছেন। এটাও বলেছেন যে উসমান তার পেটের জন্য কাকের মতো আগ্রহী হয়ে থাকে।

২. উসমানের বিরুদ্ধে জনপ্রতিবাদের ব্যপারে ইমাম (আ.)-এর অবস্থান

হযরত উসমানের খিলাফতের শাসনামলের শেষের দিকে তৎকালীন ইসলামের বিশাল ভূখণ্ডের জনগণ খলিফার সমর্থকদের বৈষম্য ও স্বেচ্চাচারীতে বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। এ কারণে চারদিক থেকে প্রতিবাদের আওয়াজ উঠে। হযরত উসমান ও তারস্বপক্ষের লোকজন এসব বিক্ষোভে কোনো কর্ণপাত করেনি। [৪]

মদিনার লোকেরা অন্যান্য শহরে তাদের মুসলিম ভাইদের কাছে চিঠি লিখে উসমানের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে এবং তাকে খেলাফত থেকে অপসারণ করতে বলে। প্রথম দল যারা এই আহ্বানে সাড়া দেয় তারা ছিল মিসরের লোকেজন। তারা মদীনায়এসে প্রকাশ্যে উসমানকে অনুতপ্ত হতে বলেছিল। অন্যথায় তারা তাদের তরবারি ব্যবহার করবে। প্রতিবাদকারীদের অনুরোধে খলিফা পদত্যাগ করার পর, তার বাড়ি ঘেরাও করা হয়। উসমানের অবরোধের সময় বিদ্রোহীরা তালহার আদেশে উসমান ও তার পরিবারের জন্য পানি বন্ধ করে দেয়।[৫]

ইমাম আলি (আ.) যিনি মদিনার বাইরে তাঁর নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি তালহাকে একটি বার্তা পাঠান এবং উসমানকে তাঁর নিজের কূপ রুমা থেকে পানি নিতে অনুমতি দিতে বলেন যাতে পিপাসায় মারা যান না। তবে তালহা তার হুকুম অমান্য করেন। কারণ অবরোধকারীরা তাদের অপতৎপরতা আরও তীব্র করে তোলে এতে উসমানের জন্য পরিস্থিতি কঠিন হয়ে পড়ে। মারওয়ান ইমাম (আ.)-এর কাছে বার্তা পাঠায় এবং পানি চেয়ে বসেন। ইমাম আলি তালহার সাথে আলোচনা করলেন এবং তিনি দেখলেন যে তিনি এড়িয়ে যাচ্ছেন। তিনি এমন রেগে গেলেন যে তালহা রাজি হওয়া ছাড়াআর কোন উপায় দেখতে পাননি। যখন তারা ইমাম আলি (আ.)-কে খবর দিল যে লোকজন উসমানকে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর, তখন তিনি উসমানকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে অবরোধকারীদের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ান। তিনি তার সন্তানদের নির্দেশ দেন: তোমাদের তরবারি নিয়ে উসমানের ঘরের দরজায় দাঁড়াও এবং কাউকে খলিফার কাছে যেতে দিও না। [৬]

হযরতের আলী (আ.)এর ছেলেরা তাদের পিতার আদেশ অনুসরণ করে হযরত উসমানের গৃহে পৌঁছে আক্রমণকারীদের সাথে লড়াই করে যতক্ষণ না ইমাম হাসান (আ.)-এর মাথা ও মুখরক্তে রঞ্জিত হয়ে যায় এবং ইমামের দাস কাম্বারের মাথা রক্তাক্ত হয়ে যায় গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হন।[৭]

হযরত উসমান ইমাম আলি (আ.) কে লোকদের সাথে কথা বলতে এবং তাদের তার উপর আক্রমণ করতে না দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ইমাম আলি (আ.) এই শর্তটি মেনে নিয়েছিলেন যে তিনি জনগণের কাছে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা তিনি পালন করবেন এবং জনগণকে শান্ত হওয়ার আমন্ত্রণ জানান। মিশরীয়রা উসমানের পক্ষে প্রতিশ্রুতি পত্র লিখেছিল এবং তাকে তাতে স্বাক্ষর করতে বলেছিল এবং এর শেষে তারা লিখেছিল যে উসমানের পক্ষ থেকে এই সমস্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের গ্যারান্টি হচ্ছেন আলি (আ.)। [৮]

নাহজুল বালাগার খুতবা ২৪০-এ বলা হয়েছে যে, সন ৩৫ হিজরিতে, যখন উসমানকে অবরোধ করা হয়েছিল, তখন তিনি ইবনে আব্বাসকে পাঠান যাতে আলি (আ.) মদীনায় না থাকেন এবং ইয়ানবুর বাগানে যান; যাতে লোকেরা তাঁর নামে শ্লোগান না দেয়। ইমাম চলে যান। যখন ভীষণভাবে তার সহযোগিতার দরকার হয় তখন তিনি একটি বার্তা পাঠান এবং ইমাম আলী (আ.) মদিনায় ফিরে আসেন এবং  ইবনে আব্বাস আবার আলি (আ.)-কে মদিনা ছেড়ে চলে যেতে বলেন। উসমানের অনুপযুক্ত অবস্থানের নিন্দায় ইমাম বলেন: হে ইবনে আব্বাস! ওসমান শুধু আমাকে ঘুরিয়ে রাখতে চায়, কখনো আমি চলে যাই কখনো ফিরে আসি। একবার তিনি আমাকে মদীনা ছেড়ে যাওয়ার বার্তা পাঠালেন, আবার তিনি আমাকে ফিরে আসতে বললেন, এখন তিনি আপনাকে পাঠিয়েছেন যাতে আমি শহর ছেড়ে যাই। খোদার কসম! আমি তাকে এতটাই রক্ষা করেছি যে আমি অপরাধী হওয়ার ভয় পেয়েছিলাম![৯]

হযরত উসমানের দাফনের কাহিনী তার হত্যার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষণীয়। মুসলমানদের খলিফা এমনভাবে জীবনযাপন করতেন যে মুসলমানরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাকে হত্যা করেছিল। তার জন্য দোয়া করাকে অপমানজনক মনে করেছিল এমনকি তাকে মুসলিম কবরস্থানে দাফন করা জায়েয মনে করেনি।[১০]

উসমানের মৃতদেহ তিন দিন ও রাত পর্যন্ত মাটিতে পড়ে ছিল এবং কেউ তাকে দাফন করতে রাজি ছিল না। তৃতীয় দিনে ইমাম আলি (আ.) হস্তক্ষেপ করেন এবং কিছু লোককে তাকে দাফন করার দায়িত্ব দেন। লোকেরা যখন জানল যে তারা উসমানকে কবর দিতে চায়, তখন তারা তাদের পোষাকে পাথরে ভরে হযরত উসমনের লাশ নিয়ে যাওয়ার পথে অবস্থান করছিল। যখন উসমানের মৃতদেহ আনা হয়, লোকেরা লাশের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। অবশেষে তাকে হিশশে কাওকবে দাফন করা হয়, যা ছিল ইহুদিদের কবরস্থান।[১১]

উপসংহার

যদিও ইমাম আলি (আ.) ইসলামের নবি (সা.) কর্তৃক খিলাফত প্রাপ্ত হয়েছিলেন, তবুও তিনি তাঁর মৃত্যুর পর পঁচিশ বছর খিলাফত থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। এটাই স্বাভাবিক যে এই যুগে ইমাম (আ.) সমাজের সমস্যাবলি থেকে উদাসীন ছিলেন না। এই নিবন্ধটির লক্ষ্য হল খিলাফত আমলে ইমাম (আ.)-এর কর্মক্ষমতা পরীক্ষা করা, বিশেষ করে খলিফার সাথে তাঁর মিথস্ক্রিয়া। এই গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল অনুসারে, খলিফার সাথে ইমামের সহযোগিতা দ্বিতীয় খলিফার খেলাফতের সময়কালের। ইমাম আলি (আ.) তিন খলিফার খিলাফতকালে সর্বদা সত্য কথা বলতেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কখনো তরবারি স্পর্শ করেননি। খলিফার সাথে ইমাম (আ.)-এর সর্বশ্রেষ্ঠ সহযোগিতা দ্বিতীয় খলিফার খিলাফতের সময়কালের। ইমামের সহযোগিতা ও পরামর্শ ছিল বৈজ্ঞানিক, বিচারিক, সাংস্কৃতিক এবং সামরিক বিষয়ে। খলিফার সাথে ইমামের বাইয়াত ব্যাতিত সহযোগিতা এবং ইমামের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও ইসলামের বৃহৎ স্বার্থে খলিফাকে সহযোগিতা করতেন।

তথ্যসূত্র:

[১]। নাহজুল বালাগা, খুতবা ১৩৯।

[২]। তারিখে তাবারি, খণ্ড ৩, পৃ. ৩৭০।

[৩]। আসকারি, মোর্তেজা, নকশে আয়েশা দার তারিখে ইসলাম,মুফিদ

পাবলিকেশন্স, তেহরান, ১৩৭৫, ভলিউম ১, পৃ. ২২৮।

[৪]। ইবনে কুতাইবা, আবু মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ইবনে মুসলিম, আল ইমামাতু ওয়াস

সিয়াসাতু, তাহকিক আলা শিরি, প্রথম সংস্করণ, কুম, আশ শরিফ ওয়ার রিযা

প্রকাশনা, ১৩৭১, খণ্ড ১, পৃ. ৩৮।

[৫]। তদেব

[৬]। সুয়ুতি, জালালুল উদ্দিন, তারিখুল খুলাফা, বে তাহকিকে মোহাম্মদ মহিউদ্দিন

আবদুল হামি, পৃ. ১৫৯।

[৭]।তদেব, পৃ.১ ৬০।

[৮] তদেব, পৃ. ১, পৃষ্ঠা ২২৯-২৩০।

[৯]। নাহজুল বালাগা, খুতবা ২৪০।

[১০]। ইবনে কুতাইবা, আবু মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ইবনে মুসলিম, আল-ইমামাহ ওয়া

আল-সিয়াসাহ, খণ্ড ১, পৃ. ৪৫-৪৬, ইয়াকুবি, আহমেদ বিন আবি ইয়াকুব, তারিখ ইয়াকুবি, কুম, ফারহাং আহলে

বাইত প্রকাশনা ইনস্টিটিউট, খণ্ড ২, পৃ. ১৭৬।