সংকলন সংযোজন সম্পাদনা: সৈয়দ হোসাইন উল হক
এম-ফিল,ইসলামিক স্টাডিজ এন্ড হিস্টোরি,অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।যথাযোগ্য প্রশংসা কেবল তারই, যিনি আপন কুদরতের দ্বারা সৃষ্টি জগতকে পরিচালিত করেন এবং যিনি জীবন ও মৃত্যুর মালিক। দরুদ ও সালাম রাসূল (সাঃ) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি, যাঁরা নিজেদের সকল কিছুকে উৎসর্গ করে মানুষের হেদায়েতের জন্য প্রচেষ্টা করেছেন। সালাম ও দরুদ ইমাম মাহদী (আঃ)-এর প্রতি, যিনি আজও মানুষের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যস্ত। আল্লাহ তাঁর আগমনকে দ্রুত ত্বরান্বিত করুন। আমিন।
একটি জাতির পরিচয়ের পূর্ণতা মিলে সেই জাতির ইতিহাসে। যে জাতির ইতিহাস যত স্বচ্ছ, সে জাতি পৃথিবীর বুকে তত বেশি মর্যাদাবান। কারণ ইতিহাস আগামীদিনের পরিকল্পনা তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রাখে। অতীতের ভুল জাতিকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয় আর সফলতা লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়পদ রাখে। সেজন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আল কোরআনে অসংখ্য স্থানে পুর্বের জাতিদের ইতিহাস টেনে এনেছেন, তাদের ভুল, অপরাধ, অবহেলা এবং সেগুলোর প্রভাব ও ফলাফল মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন এবং বলে দিয়েছেন। সেগুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায়। অর্থাৎ সর্বযুগেই ইতিহাস পর্যালোচনা করে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ণয়ের কোনো বিকল্প নেই।আমি এখানে ইতিহাসের কিছু সত্য ঘটনা নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পেয়েছি, যেগুলো ইসলামের ইতিহাসে পট পরিবর্তনের মাইলফলক। গত ২-৩ বছর পুর্বে ছোট আকারে কয়েকটি লাইনের এই পোষ্টি দিয়েছিলাম—“এই হল সেই মূয়াবীয়া, যে উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) কে অত্যন্ত নির্মম নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে লাশটি মাটির গভীর গর্তে পুতে ফেলেছিল।যার জন্য আজ পর্যন্ত হযরত আয়েশা (রা) কবরের কোন সন্ধান পাওয়া যায় নি!”-এতে অনেকেই ইসলামী ইতিহাসের সেই লুকায়িত চরম সত্যকে শিক্ষাসরুপ উন্মোচিত করেতে কমেন্ট করে এবং ম্যাসেজ দিয়ে অনুরোধ করেছেন।তাই শ্রদ্ধেয় জনাব ভাব পাগলা আব্দুল্লাহ ভাইয়ের লিখিত- “(রাঃ) নাকি (লাঃ)” বইটি থেকে প্রায় অনেকটা হুবহু তুলে ধরলাম। নিঃসন্দেহেই এটা বলতে পারি যে এই বইটি এতই সাবলীল ভাবে লিখা এবং এত যথেস্ট তথ্যসুত্র সহ উপস্থাপন করা হয়েছে, যা কিনা সত্যসন্ধ্যানী পাঠকের জন্য একটা দিকদর্শণ বল্লেও অত্যুক্তি হবে না। জারজ মোয়াবিয়া যাবতীয় কুকর্ম সম্পর্কে আরও জানতে যারা তৃষ্ণার্ত তারা বইটি সংগ্রহ করে নিতে পারেন।
যাই হোক মূল কথায় আসি—
মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (লা:) একদিন রাতের খাবারের জন্য হজরত আয়েশা (রা) কে নিমন্ত্রণ করেন যে ঘরে আয়োজন হচ্ছিল ঠিক সেইখানে একটা সরু আকৃতির খাদ বা গর্ত খনন করেন মুয়াবিয়া। আল্লামা ইবনে খালদুনের মতানুসারেঃ স্থানটুকু ধারালো চাকু ও তলোয়ার দ্বারা পূর্ণ এবং অগ্রভাগ উপরের দিকে ছিল। তার উপর দিয়ে চিকন শুকনা কাঠের বাকল বিছিয়ে একটা কার্পেট দ্বারা আবৃত করা হয়। হজরত আয়েশা (রা) কে বসার জন্য একটা কাঠের চেয়ার দেওয়া হয়। এবং এমনভাবে রাখা হয় যে, যখনই তিনি সেখানে বসলেন, তখনই চেয়ারটি নড়বড় করে ওঠে। তিনি তৎক্ষণাৎ সেই গর্তে পড়ে যান। তার মাথা, থুতনি ও অন্যান্য স্থান রক্তাক্ত হয়। অনেক হাডিড ভেঙে গিয়েছিল । ঘৃণ্য, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ থেকে রক্ষা পাবার জন্য মুয়াবিয়া সেই গর্ত সরু লম্বা আকৃতির পাতা জাতীয় গাছ দিয়ে পূর্ণ করে ফেলেন। এইরূপ নৃশংসভাবে আয়েশা (রা.) কে হত্যা করে মুয়াবিয়া (লা:)।হজরত আয়েশা (রা.)-এর বয়স ছিল চৌষট্টি বছর যখন তাকে হত্যা করা হয় এবং সময়কাল হিজরি সাতান্ন সালের শেষ দিকে। মুয়াবিয়ার এরূপ জঘন্য চক্রান্ত প্রমাণ করে দয়াময় নবি (সা.) তার শত্রু ছিলেন। মুয়াবিয়া শত্রুতার নিদর্শন রাখেন নবি (সা.)-এর সহধর্মিণীকে হত্যা করে! টিক এই কারণে হজরত আয়েশা (রা.)-এর কবরের নির্দিষ্ট স্থানটুকু মদিনার কোথায়, তা কেউ জানে না!! হজরত আয়েশা (রা.)-কে মুয়াবিয়া হত্যা করার পেছনে একমাত্র কারণ ছিল, আয়েশা (রা.) মুয়াবিয়াকে মসজিদে নববিতে নবিবংশ ও ইসলাম নিয়ে বিদ্রুপ করতে বারণ করেছিলেন!
গ্রন্থসূত্রঃ Tadhkira ul Khawass page 62 Information References: Musharriful Mahbubin by Hazrat Khuwaia Mehboob Qasim Chishti Mushrrafi Qadri, Pages 216-218,Kokab wa Rifi Fazal-e-Ali Karam Allah Wajhu, Page 484 By Syed Mohammed Subh-e-Kashaf Al Tirmidhi, Urdu translation by Syed Sharif Hussein Sherwani Sabzawari, Published by Aloom AlMuhammed, number B12 Shadbagh, Lahore, 1st January 1963. Habib Alseer Rabiyah AlAbrar, Volume 1, Alama Jarul Allah Zamik (530 Hijri), Hadoida Sanai, by Hakim Sanai (Died 525 Hijri, at Ghazni), Page 65-67, Namoos Islam, by Agha Hashim Sialkoti, Published Lahore, 1939, Pages 66-67, Tazkarah Tul-Aikram Tarikh-e-Khulafa Arab-Wa-Islam by Syed Shah Mohamed Kabir Abu Alalaiyi Dana Puri, Published Le Kishwar Press, Lakhnow, April 1924/ 1346.
অপর এক বর্ণনায় এসেছে যে, মূয়াবীয়ার নির্দেশে হযরত আয়েশার (রাঃ) লাশটি কোন এক পাহাড়ের গুহায় ফেলে দেয়া হয়। এইরূপ জঘন্য ভাবে হযরত আয়েশা (রা.)-কে হত্যা করেন কাতেবে ওহী জারজ মুয়াবীয়া (লা:)। প্রসঙ্গত এখানে আরও উল্লেখ্য যে, কাতেবে ওহী (রা.) আনহু প্রাপ্ত সাহাবী হযরত মূয়াবীয়া অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় হযরত আয়েশা (রা.)-কে হত্যা করেন এবং তারপূর্বে হযরত আয়েশার (রা.) ভাই মুহাম্মদ বিন আবু বকরকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। হযরত আয়েশা (রা.) এর ভাই হযরত মুহম্মদ বিন আবু বকরকে গাধার চামড়ার ভিতর পুরে দিয়ে আগুন ধরিয়ে হত্যা করা হয়। নবী (সা.)-এর অনেক সঙ্গীকেও মুয়াবীয়া হত্যা করেন । এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হজতর বিন আদি (রা.) ও হযরত আম্মার ইয়াসির (রা.)। বুখারী শরীফেও সুসপষ্ট হাদীস রয়েছে হযরত আম্মার বিন ইয়াসিরকে (রাঃ) যারা হত্যা করবে তার জাহান্নামে আহবানকারী দল। সেই জাহান্নামে আহবানকারী দলের নেতৃত্বে ছিলেন এই জারজ মুয়াবিয়া সেটা গোপন করেন কেন!?
গ্রন্থসূত্রঃ তারিখুল ইসলাম, লেখক নজীব আবদী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৪৪।,তাবারী ৪র্থ খন্ড ১৯০ পৃ:, আল ইস্থিয়ার ২য় খন্ড ১৩৫ পৃ:,ইবনুল আসির ৩য় খন্ড ২৩৪ পৃ:, আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া ৬ ষ্ঠ খন্ড ৩৩৬ পৃ:, ইবনে খলদুন ৩য় খন্ড ১৩ পৃ:, তারিখে ইসলাম ১৫১ পৃ:, সৈয়দ আমিমুল ইহসান মুজাদ্দেদী। বুখারি ৮ম খন্ড, পৃ ১৮৫-১৮৬/তিরমীজী, ৫ম খন্ড পৃ ৬৬৯/মুসনাদে হাম্বল, ২য় খন্ড পৃ ১৬১,১৬৪,২৬৪,৩য় খন্ড পৃ ২২-২৮।
হে উম্মতে মুয়াবিয়া (লা:) ! দেখুন কীভাবে আপনারা সাপের গালেও চুমু দিচ্ছেন আবার ব্যাঙের গালেও! আপনারা পারেনও। একবার বলেন আয়েশা ছিলেন রসুল (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় বিবি (!) আবার তাকে যারা হত্যা করে তারা হলাে মহাসম্মানিত সাহাবি। আপনাদের মগজ কি বিক্রি করে দিয়েছেন!? অনেকের মাথায়ই প্রশ্ন আসতে পারে, কেন মুয়াবিয়া আয়েশাকে হত্যা করবে? আভ্যন্তরীন কারণ যদিও অন্য, তবে বাহ্যিক কারণ হিসেবে এটা বলা যায় যে, বিবি আয়েশা তৃতীয় খলিফা উসমান ইবনে আফফানকে হত্যার ফতোয়া দিয়েছিলেন এই বলে “এই নাসাল কে হত্যা করো।” ইবনে কুতাইবা তার “আল ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ” এ লিখেছেনঃ—“উবাইদ তাকে (আয়শাকে) বললেনঃ “তুমিই প্রথম জন যে তার (উসমানের) বিরুদ্ধে লোকদেরকে উত্তেজিত করেছিলে, আর তুমি বলতে নাসালকে হত্যা করো কেননা সে ফাসিক হয়ে গিয়েছে।” আয়শা (আল্লাহ তার উপর রাজী হোক), উসমানের বিরুদ্ধে জনগণকে উত্তেজিত করতে সবরকম করেছিলেন, তিনি বলতেনঃ— “হে জনগণ এটা রাসুল সাঃ এ জামা এখনো পুরানো হয়নি, কিন্তু তার সুন্নাহ পুরানো হয়েগিয়েছে,নাসালকে হত্যা করো, আল্লাহ তাকে হত্যা করুক”। একথা ইমাম ফকরুদ্দিন আর রাজী তার মসহুলের খণ্ড ৪ পাতা ৩৪৩ এ উল্লেখ করেছেন।
আহলে সুন্নাহর স্বনাম ধন্য ঐতিহাসিক ও দার্শনিক আহমাদ বিন ইয়াকুব মাস্কুয়াহ (মৃত্যু: ৪২১ হিঃ) তাজারেব আল উমাম খণ্ড ১ পাতা ৪১৯ এ লিখেছেনঃ— “তিনি উসমানের বদনাম করত আর তার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করত, তিনি আল্লাহের নবির (সা.) গাধার পিঠে চড়ে একটা কাপড় নিয়ে বলতেনঃ“এটা আল্লাহর নবীর (সা.) এর জামা পুরানো হয় নি। কিন্তু তার দ্বীন পুরানো হয়ে গিয়েছে, নাসালকে হত্যা করো, আল্লাহ তাঁকে হত্যা করুন”। কিছু বুঝলেন কেন হত্যা করেছেন মুয়াবিয়া বিবি আয়েশাকে ? আমি জানি এই লেখা পড়ে অনেকের মাথায়ই বজ্রপাত হবে। তাদের কাছে অনুরোধ আপনারা খুঁজে দেখেন। ধর্ম আসলে চিন্তাশীলদের জন্য, পশুদের জন্য নয়।
কেউ আহলে বাইতের সাথে শত্রুতা করে, মানুষ হত্যা করে,চুক্তি ভঙ্গ করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রকৃত সাহাবী হতে পারে না। তেলাপোকা একটি পাখি মোয়াবিয়া একজন সাহাবা! সাহাবি মানে মোয়াবিয়া নয়। কিছু জ্ঞানপাপী আলেম শতশত বছর ধরে অবান্তর হাদিসের ভিত্তিতে দুশ্চরিত্র মুয়াবিয়াকে সাহাবী বানিয়ে রেখেছে৷ যদিও কুরআন কারা সাহাবী হিসেবে গণ্য হবে তা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে তারপরও তারা নির্লজ্জের মত ফোর্থ হ্যান্ড হাদীস দেখিয়ে দাঁত কেলাচ্ছে !I always mention it in all my articles-সাহাবী মানে অনুসরণীয় কিন্তু সাহাবী নামের সাথে সামঞ্জস্য নয় তথা সাহাবী আদর্শের সাথে মিলেনা এমন কর্মকান্ড কখনো অনুসরণীয় অনুকরণীয় গ্রহনীয় নয়! সাহাবী একটি বৈশিষ্ট্য, সাহাবী একটি চরিত্র, সাহাবী একটি আদর্শ, সাহাবী মানে বিশ্বস্ত, সাহাবী মানে উৎসর্গ, সাহাবী ঈমানের পথে সর্বদা অটল থাকা এবং সর্ব কুফরির বিরুদ্ধে চির আপোষহীন এক মহা অবস্থানের নাম। হারামকে হালাল বলা কুফরি। মুলুকিয়তকে খেলাফত বলা ব্যভিচারকে বিয়ে বলার চেয়েও নিকৃষ্ট কুফরি। এরপরেও একজন বিবেক সম্পন্ন মানুষ কিভাবে মহানবী (সাঃ) এর আপন চাচা হযরত হামজাহ (রাঃ) এর কলিজা ভক্ষনকারীনী পতিতা সর্দারনী হিন্দার জারজ পুত্র,রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর স্ত্রী হযরত আয়েশার (রা.) কে নির্মমভাবে হত্যাকারি মূয়াবীয়াকে কাতেবে ওহী মার্কা রাঃআনহু সনদযুক্ত সাহাবা হিসাবে অভিহিত করেন! কেউ কেউ আবার এই বিষয়ে আলোচনা করতে নারাজ।মুয়াবিয়ার জুলমাতি প্রকাশ-প্রচারনায়, তাকে লানত-তাবার্রায় কাউকে নিরোৎসাহিত করা বা নিজে নিরোৎসাহ বোধ করাটা আসলে রসুল (সঃ) এর হাদিস অনুযায়ি’ই জালিমের পক্ষে কৌশলী অবস্থান তথা একধরনের সূক্ষ নেফাকী। আর এরকম সুক্ষ নেফাকীগত কৌশলি ফাঁদ থেকে সরল উম্মাহর বড় একটা অংশ এখনো মুক্ত হতে পারেনি।মহান আল্লাহ পাক, তাঁর রাসূল ও তাঁর আহলে বাইতের প্রদত্ত শিক্ষাই হচ্ছে মিথ্যার মিম্বারে বসা এসব হারাম খেকো খতিবদের বিরুদ্ধাচারন করা ও এদের হাতে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বন্দী অসহায় সাধারন মানুষদের জন্য সহমর্মিতা প্রকাশ করা। এই ধরনের ধৃষ্টতাপূর্ণ অপকর্মের প্রতিবাদ হাজার বছরের অধিক সময় ধরে করা হয়েছে বলেই এরা মুয়াবিয়াকে ইমাম আলী (আঃ) এর স্থানে আর ইমাম আলী (আঃ) কে জারজ মুয়াবিয়ার স্থানে বসাতে পারেনি। নচেৎ সত্যবাদীদের নীরবতা আর মিথ্যুকদের সরব অবস্থান সত্যকে মিথ্যার আবর্জনা দিয়ে ঢেকে দিত।এখানে শীয়া বা সুন্নি বিবেচ্য নয়। নিরপেক্ষ চোখ দিয়ে ইতিহাসকে জানার চেষ্টা করুন।