Press "Enter" to skip to content

কুরআনের পরিভাষায় আহলে বাইত (আ.)

অনুবাদ: ড. আবু উসামা মুহাররম

আয়াতে তাতহির ও আয়াতে ইবরাহিমের আলোকে আহলে বাইত কারা এ বিষয়ে সুন্নি ও শিয়াদের মধ্যে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। সুন্নিরা এটিকে সমস্ত আত্মীয়দের জন্য সাধারণ বলে মনে করে। আর শিয়ারা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সংখ্যক লোকের কথা উল্লেখ করে থাকেন। ইতিমধ্যে, শিয়ারা তাদের দাবির স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে কুরআনের আয়াত এবং আহলুস সুন্নাহদের বিভিন্ন রেওয়াত উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু সুন্নিরা, যেহেতু তারা এই বিষয়ে ওহীর উৎস থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। এমনকি আহলে বাইতের অর্থ করতে তারা নিজেদের মধ্যে মতৈক্যে পৌছাতে পারেনি।

১. শিয়া মাযহাবের দৃষ্টিতে আহলে বাইত (আ.): 

শিয়াদের মতের স্বপক্ষে জন্য বেশ কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করা যেতে পারে। যার কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হলো।

১.১ আহলে বাইতের আভিধানিক অর্থ

আরবি পরিভাষায় আহলে বাইতের আভিধানিক অর্থ, اهل الرجل   একজন ব্যক্তির নিকটাত্মীয়দের জন্য ব্যবহার করে। সুতরাং শুরুতে আহলে বাইত বলতে তার স্ত্রী, সন্তান এবং এমনকি তার আত্মীয়দের অন্তর্ভুক্ত করা হতো।

১.২ কুরআনিক পরিভাষায় আহলে বাইত

কুরআনের পরিভাষায় আহলে বাইত একটি বিশেষ পরিভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কুরআনে আমরা দেখি যে “আহল” শব্দটি নবীদের পরিবারের কিছু লোকের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। তাদের সকল আত্মীয়দের জন্য নয়। কারণ কুরআনে হযরত নূহ (আ.)-এর পুত্রকেও তার পরিবার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সেখানে স্ত্রী তো দূরের কথা (তাও আবার নূহ এবং লুতের স্ত্রী  মত) ।

قَالَ یَا نُوحُ انَّهُ لَیسَ مِن اهلِکَ انَّهُ عَمَلٌ غَیرُ صَالِحٍ

আল্লাহ বললেন, হে নূহ, সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়, তার আমল খুব খারাপ।

অতএব, প্রত্যেক রাসূলের আহলে বাইতের অর্থ বোঝার জন্য ওহীর উৎসের কাছে শক্তভাবে আত্মসমর্পন করা উচিত। ঐ উৎসের কাছে আহলে বাইতের অর্থ জিজ্ঞাসা করা উচিত। আল্লাহর রাসুলের আহলে বাইত সম্পর্কে শিয়া এবং আহলে সুন্নাতদের বর্ণনা এক্ষেত্রে বিশ্লেষণ করা উচিত।

২. আয়াতে তাতহির নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট

সূরা আহযাবের এই আয়াত নাযিলের ব্যাপারে আহলে সুন্নাতরা চাদরের হাদিস বর্ণনা করেছেনঃ

২.১ ইমাম মুসলিমের বর্ণনা

عن صَفِیَّةَ بِنْتِ شَیْبَةَ، قَالَتْ قَالَتْ عَائِشَةُ خَرَجَ النَّبِیُّ صلی الله علیه وسلم غَدَاةً وَعَلَیْهِ مِرْطٌ مُرَحَّلٌ مِنْ شَعْرٍ اَسْوَدَ فَجَاءَ الْحَسَنُ بْنُ عَلِیٍّ فَاَدْخَلَهُ ثُمَّ جَاءَ الْحُسَیْنُ فَدَخَلَ مَعَهُ ثُمَّ جَاءَتْ فَاطِمَةُ فَاَدْخَلَهَا ثُمَّ جَاءَ عَلِیٌّ فَاَدْخَلَهُ ثُمَّ قَالَ (اِنَّمَا یُرِیدُ اللَّهُ لِیُذْهِبَ عَنْکُمُ الرِّجْسَ اَهْلَ الْبَیْتِ وَیُطَهِّرَکُمْ تَطْهِیرًا

আয়েশা (রাঃ) বলেন যে, আল্লাহর রসূল একদা সকালে বের হলেন এবং তাঁর কাঁধে কালো পশমের তৈরি একটি আবায়া ছিল। ইত্যবসরে হাসান বিন আলীকে রাসুল (সা.) তার চাদরের ভিতরে নিয়ে নিলেন। এরপর হুসাইন আসলে তাকেও তিনি চাদরের ভেতরে নিয়ে এলেন। এরপর আলী আসলে তাকেও ভেতরে নিয়ে নিলেন। তারপরে ফাতেমা (সা.আ.) আসলে তিনি তাঁকেও চাদরের নিচে নিয়ে নিলেন। অতঃপর তিনি বললেনঃ

اِنَّمَا یُرِیدُ اللَّهُ لِیُذْهِبَ عَنْکُمُ الرِّجْسَ اَهْلَ الْبَیْتِ وَیُطَهِّرَکُمْ تَطْهِیرًا

আল্লাহ কেবল চান যে, হে আহলে বাইত তোমাদের হতে সর্ব প্রকারের কলুষতা দূরে রাখতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র রাখতে। (সুরা আহযাব, আয়াত নং ৩৩)

২.২ ইমাম নাসাইর বর্ণনা

«ودعا رسول الله صلی الله علیه وسلم الحسن والحسین وعلیا وفاطمة فمد علیهم ثوبا فقال اللهم هؤلاء اهل بیتی فاذهب عنهم الرجس وطهرهم تطهیرا

আল্লাহর রসূল হাসান, হুসাইন, আলি ও ফাতিমার জন্য প্রার্থনা করলেন এবং তিনি তাদের একটি কাপড় দ্বারা আচ্ছাদিত করে দিলেন এবং তিনি বললেন, এরা আমার আহলে বাইত, তাই এদের থেকে মন্দকে দূরে রাখুন এবং তাদের পবিত্র করুন।”

২.৩ ইমাম তিরমিযীর বর্ণনা

حدثنا محمود بن غیلان حدثنا ابو احمد الزبیری حدثنا سفیان عن زبید عن شهر بن حوشب عن‌ ام سلمة ان النبی صلی الله علیه وسلم جلل علی الحسن والحسین وعلی وفاطمة کساء ثم قال اللهم هؤلاء اهل بیتی وخاصتی اذهب عنهم الرجس وطهرهم تطهیرا فقالت‌ام سلمة وانا معهم یا رسول الله قال انک الی خیر قال هذا حدیث حسن وهو احسن شیء روی فی هذا وفی الباب عن عمر بن ابی‌سلمة وانس بن مالک وابی الحمراء ومعقل بن یسار وعائشة

রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর স্ত্রী উম্মে সালামা (রাঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান, হুসাইন, আলী ও ফাতিমাকে  একটি আবায়া দ্বারা আচ্ছাদিত করেন। অতঃপর তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, তারা আমার আহলে বাইত তাদের থেকে মন্দকে অপসারণ এবং তাদের পবিত্র করুন। উম্মে সালমা বলেন: আমি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করলাম আমি কি তাঁদের (আহলে বাইতের) সাথে আছি? তিনি বললেন, তুমি ভালর সাথে আছো। (তুমি আহলে বাইতের নও, তবে তুমি ভালো)।

তিনি বললেন: এটি একটি হাসান হাদীস এবং এটি ওমর ইবনে আবী সালামাহ, আনাস ইবনে মালিক, আবু আল-হামরা, মাকিল ইবনে ইয়াসার এবং হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত সর্বোত্তম বিষয়।

২.৩.১ আহলে বাইত (আ.) সম্পর্কিত হাদীসের সমালোচনা

তিরমিযী বলেছেন যে এটি একটি হাসান হাদীস এবং এটি এই ক্ষেত্রে সর্বোত্তম বর্ণনা… আল-আলবানী তার কিতাবে [৫] এই বর্ণনাটিকে সঠিক বলে মনে করেছেন। এছাড়াও, হাকিম নিশাবুরী এই বর্ণনাটি সঠিক মনে করেছেন এবং বলেছেন:

هذا حدیث صحیح علی شرط البخاری ولم یخرجاه

এটি আল-বুখারীর শর্তে একটি সহীহ হাদীস। তবে তিনি বর্ণনা করেন নি [৬] [৭] এই বর্ণনাটি বুখারী ও মুসলিমের মতে সঠিক, কিন্তু তারা তা উল্লেখ করেননি।

এছাড়াও একই বিষয়বস্তু সম্বলিত ইমাম  একটি বর্ণনা উল্লেখ করার পর তিনি বলেনঃ এটি মুসলিম এর শর্তের উপর একটি সহীহ হাদীস। [৮] মুসলিমের মতে এ বর্ণনাটি সঠিক, তবে তিনি তা বর্ণনা করেননি। এমনকি তাবারানী [9]-এধরনের দশটি বর্ণনা দিয়েছেন, যেখানে এটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে যে আল্লাহর রাসূলের আহলে বাইত শুধুমাত্র আলী, ফাতিমা, হাসান ও হোসাইন, এমনকি উম্মে সালমাও রাসূলের স্ত্রীদের মধ্যে একজন নন।  আহমাদ বিন হাম্বল ও তাবারানীও এই বর্ণনাটি বর্ণনা করেছেন যে,

فرفعت الکساء لادخل معهم فجذبه من یدی وقال: انّک علی خیر.

উম্মে সালমা তাদের সাথে প্রবেশ করতে এসেছিলেন, তখন তিনি আমার হাত ধরে বললেন: ”তুমি ভালর সাথে আছো’। [১০] [১১]

অতঃপর আমি তাদের সাথে প্রবেশের জন্য চাদরটি উপরে তুললাম, তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা আমার হাত থেকে নিয়ে বললেন, তুমি ভালো আছো।

আরও মজার ব্যাপার হল, ইবনে তাইমিয়া, যিনি ওহাবীদের তাত্ত্বিক নেতা, তিনিও তাদের সম্পর্কে নিম্নলিখিত বলেছেন:

والحسن والحسین من اعظم اهل بیته اختصاصا به کما ثبت فی الصحیح انه دار کساءه علی علی و فاطمة و حسن و حسین ثم قال اللهم هؤلاء اهل بیتی فاذهب عنهم الرجس وطهرهم تطهیرا

এবং আল-হাসান ও আল-হুসাইন আহলে বাইতদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, বিশেষ করে চাদরের সহীহ হাদিসে লিপিবদ্ধ থাকার কারণে, তিনি আলী, আলী, ফাতিমা, হাসান, এবং হুসাইন এর অনুগ্রহে তা পেয়েছেন। তারপর তিনি বললেন: হে আল্লাহ, এরাই আমার আহলে বাইত, তাদের থেকে কলুষতা দূর করুন এবং তাদেরকে পবিত্র করুন।[১২]

এই বাক্যটির অর্থ স্পষ্ট, হে আল্লাহ, তারা আমার আহলে বাইত, সুতরাং তাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করে তাদের পবিত্র করুন। এ বাক্যে আহলে বাইতের পবিত্রতার কোনো শর্তারোপ করা হয়নি বরং  তাদের তাকওয়া সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।

৩- নবীর স্ত্রীগণ কিন্তু আল্লাহর রাসূলের স্ত্রীদের সম্পর্কে আমরা কুরআনে দেখতে পাই যে তিনি বলেছেন:

یَا نِسَاءَ النبی لَستُنَّ کَاَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ ان اتَّقَیتُنَّ؛

“হে রসূলের স্ত্রীগণ, তোমরা অন্য নারীদের মত নও যদি তোমাদের মধ্যে তাকওয়া থাকে।

৩.১ – আহলে সুন্নাতের বর্ণনায় আহলে বাইত (আ.):

এছাড়াও, আহলে সুন্নাতের  কিছু সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, কিছু প্রবীণ সাহাবী যারা স্পষ্টভাবে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীদেরকে আহলে বাইতের সদস্য মনে করেন না।

পাদটীকা

  1. সূরাহুদ, আয়াত ৪৬।
  2. মুসলিম ইবনে আল-হাজ্জাজ, আবুল হাসান আল-কুশাইরি আননিসাবুরি, সহীহ মুসলিম, খণ্ড ৪, পৃ. ১৮৮৩, এইচ. ২৪২৪।
  3. নাসাঈ, আবু আবদ আল-রহমান আহমেদ বিন শোয়াইব, সুনান আল-নাসাঈ আল-কুবরা, খন্ড ৭, পৃ. ৪১৭।
  4. আল-তিরমিযী, মুহাম্মদ বিন ঈসা, সুনান আল-তিরমিযী, খন্ড ৬, পৃ. ১৮২।
  5. সহীহ সুনান আত-তিরমিযী, আল-আলবানী, খণ্ড ৭, পৃ. ২০৫, হাদীস ৩২০৫।
  6. আন নিসাবুরি, আবু আবদুল্লাহ আল-হাকিম মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ, আল-মুস্তাদরাক, খণ্ড ২, পৃ. ৪১৬।
  7. আন-নিসাবুরি, আবু আবদুল্লাহ আল-হাকিম মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ, আল-মুস্তাদরাক, খণ্ড ৩, পৃ. ১৪৬।
  8. আন-নিসাবুরি, আবু আবদুল্লাহ আল-হাকিম মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ, আল-মুস্তাদরাক, খণ্ড ২, পৃ. ৪১৬।
  9. তাবারানী, সুলাইমান বিন আহমাদ, আল-মুজাম আল-কবীর, খণ্ড, ৩, পৃ. ৫২, হাদিস ২৬৬২ থেকে ২৬৭৩ পর্যন্ত।
  10. শাইবানী, আবু আবদুল্লাহ আহমাদ বিন মুহাম্মদ বিন হাম্বল, মুসনাদে আহমাদ, খন্ড ৪৪, পৃ. ৩২৮।
  11. আল-মুজাম আল-কবীর, তাবারানী, খণ্ড ৩, পৃ. ৫৩।
  12. ইবনে তাইমিয়া, তাকী আদদীন আবু আল-আব্বাস আহমদ বিন আবদ আল-হালিম, মিনহাজ সুন্নাহ আল-নবাবিয়া, খণ্ড ৪, পৃ. ৫৬১।
  13. সূরা আহযাব, ৩৩, আয়াত ৩২।
  14. সহিহ মুসলিম, খণ্ড ৪, পৃ. ১৮৭৪, কিতাবু ফাজাইলিস সাহাবা, বাবু মিন ফাজাইলি আলি ইবনে তালিব।