Press "Enter" to skip to content

মহান আল্লাহর অপরিবর্তনীয় ও অলঙ্ঘনীয় নিয়মকানুন

অনুবাদ: মোহাম্মাদ মুনীর হোসাইন খান
প্রশ্ন : শাফায়াত কি মহান আল্লাহর অপরিবর্তনীয় ও অলঙ্ঘনীয় নিয়ম-কানুনের (সুন্নাত) পরিপন্থী?
প্রশ্ন সংক্রান্ত বিশদ বিবরণ : সৃষ্টিজগৎ ও শরিয়তের ক্ষেত্রে এমন সব বিধান ও নিয়ম আছে যা ধ্রুব ও অপরিবর্তনীয়। কখনোই এ সব নিয়ম-কানুনের পরিবর্তন সাধিত হবে না এবং এ সব আইন-কানুন যেমন অতীতেও বলবৎ ছিল ঠিক তেমনি ভবিষ্যতেও বলবৎ থাকবে। পবিত্র কোরআনও এ সব নিয়ম- কানুনকে ‘মহান আল্লাহর সুন্নাত’ বলে অভিহিত করেছে। তাই পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন :
فَلَن تَجِدَ لِسُنَّتِ اللهِ تَبْدِيلًا وَ لَن تَجِدَ لِسُنَّتِ اللَّهِ تحويلا
‘অতঃপর আপনি কখনোই মহান আল্লাহর নিয়ম-নীতির ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন পাবেন না এবং আপনি কখনোই মহান আল্লাহর নিয়ম-নীতির (সুন্নাত) ক্ষেত্রে কোন ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করবেন না?”(ফাতির : ৪৩)
পাপীদেরকে শাস্তিদান হচ্ছে মহান আল্লাহর অপরিবর্তনীয় নীতি (সুন্নাত)। যেহেতু সদৃশ ও অনুরূপ পাপ ও অন্যায়সমূহের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ সব দিক থেকে সদৃশ ও অনুরূপ শাস্তিরই ব্যবস্থা করেছেন সেহেতু উপরোল্লিখিত এ বিষয়টি বিবেচনা করতঃ শাফায়াত আসলে কি মহান আল্লাহর অমোঘ নীতিমালার পরিপন্থী নয়?
উত্তর : মহান প্রভু আল্লাহ পাকের অপার দয়া এবং মহান নবী ও ওয়ালীদের শাফায়াতের পরিপ্রেক্ষিতে পাপীদের ক্ষমা আসলে সদা অনুগ্রহশীল মহান আল্লাহর অপরিবর্তনীয় ও অলঙ্ঘনীয় নীতিসমূহেরই (সুন্নাত) অন্তর্গত। উল্লেখ্য, নবী ও ওয়ালীদের শাফায়াত বিশেষ কতকগুলো শর্ত সাপেক্ষে পাপীদেরকে শামিল করে। সুতরাং যেহেতু শাফায়াত স্বয়ং মহান আল্লাহর নীতিসমূহের অন্তর্ভুক্ত সেহেতু তা কিভাবে আল্লাহ পাকের ঐশী নীতিসমূহের পরিপন্থী হবে না?
ব্যাখ্যা : এটা সত্য যে, মহান আল্লাহর নিয়ম-নীতি (সুন্নাত) অলঙ্ঘনীয় এবং এতে পরিবর্তন সাধন মোটেও সম্ভব নয়। তবে, অবশ্যই উপলব্ধি করা উচিত যে, মহান আল্লাহর নিয়ম-নীতি তাঁর মাত্র একটি গুণের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় এবং মহান আল্লাহর নিয়ম-নীতিও কেবল একটি নয়; বরং তাঁর অজস্র সুন্নাত রয়েছে যেগুলোর প্রতিটিই পূর্ণাঙ্গ ও সার্বিক এবং মহান আল্লাহর গুণাবলী থেকেই উৎসারিত। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হওয়ার জন্য আমরা সম্মানিত আলেমগণের অভিমতের দিকে দৃকপাত কর।
আল্লামা তাবাতাবাঈ আল-মীযানে এবং আয়াতুল্লাহ জাওয়াদী আমোলী পবিত্র কোরআনের বিষয়ভিত্তিক তাফসীর গ্রন্থে এ সব বিষয় এভাবে বর্ণনা করেছেন : নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহর সুন্নাত একক, অভিন্ন, একই ধাঁচের এবং এটাই হচ্ছে সরল সঠিক পথ (সিরাত-ই মুস্তাকীম); তবে একক, অভিন্ন ও একই ধাঁচের অপরিবর্তনীয় এ নিয়ম মহান আল্লাহর মাত্র একটি গুণ অর্থাৎ বিধি-প্রণয়নের গুণের (সিফাতে তাশরীয়ী) ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় যার ফলে যে কোন বিধান (হুকুম) ও প্রতিদানই নিজস্ব ক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হবে না। বরং ঐশী এ সুন্নাত মহান আল্লাহর যাবতীয় সুমহান গুণের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং প্রতিটি প্রপঞ্চই তার অস্তিত্ব ও বিকাশ লাভের সকল দিক হতে পরম সত্য সত্তা অর্থাৎ মহান আল্লাহর এক বা একাধিক সুমহান গুণের ওপর নির্ভরশীল; আর তা (অর্থাৎ প্রতিটি প্রপঞ্চের অস্তিত্ব ও বিকাশ) ঐশী গুণসমূহের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক ও ভিন্নতা এবং এ থেকে উদ্ভূত সমুদয় কারণ ও প্রয়োজনীয়তা অনুসারেই হয়ে থাকে। সংক্ষেপে বলা যায়, শাফায়াতের বাস্তবায়ন এবং এর ফলে শাস্তি বা দণ্ড মওকুফ হওয়া যেহেতু বিভিন্ন ধরনের কারণ, যেমন দয়া (রহমত), ক্ষমা (মাগফিরাত), চূড়ান্ত ফয়সালা, হকদারকে হক প্রদান, ন্যায়বিচার ইত্যাদির ফলস্বরূপ সেহেতু তা (শাফায়াত এবং এর ফলে পাপীর পাপমোচন ও ক্ষমা) মহান আল্লাহর চির বলবৎ নিয়ম-নীতির (সুন্নাতে জারীয়া) ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ও পার্থক্য আনয়ন করে না। ( আল মगान, খ. ১, পৃ. ১৬৩: কুরআনের বিষয়ভিত্তিক তাফসীর, খ. ৫ (কুরআনে মায়াদ বা কিয়ামত), পৃ. ১৫২-১৫৩)
প্রকৃতপ্রস্তাবে, আপত্তিকারী হয়তো ভেবেছে যে, শাস্তিদান হচ্ছে মহান। আল্লাহর আসল সুন্নাত (প্রকৃত নিয়ম)। তাই শাফায়াতের মাধ্যমে পাপীর পাগমোচন ও ক্ষমা (মাগফিরাত) হচ্ছে উক্ত সুন্নাত বা নিয়মের ব্যতিক্রম স্বরূপ। অথচ পাপীকে শাস্তিদান এবং শাফায়াতের কারণে পাপীর পাপমোচন ও ক্ষমার কোন একটি অপরটির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়; বরং প্রতিটি হচ্ছে মহান আল্লাহর অমোঘ অকাট্য নীতিমালার অন্তর্গত যা নিজ ক্ষেত্রে বলবৎ রয়েছে। তাই একটিকে মহান আল্লাহর নীতি এবং অন্যটিকে তাঁর এই ঐশ্বরিক নীতি ও পদ্ধতির পরিপন্থী বলে গণ্য করা একান্ত অনুচিত। মূলত ‘মহান আল্লাহর নিয়মনীতি ও পদ্ধতিসমূহ অপরিবর্তনীয় ও অলঙ্ঘনীয়- এ কথার অর্থ এটা নয় যে, সমগ্র অস্তিত্বজগৎ জুড়ে মহান আল্লাহর কেবল একটি সুন্নাত বিদ্যমান ও জাবী রয়েছে। অথচ তিনি এভাবে নিজ পরিচিতি তুলে ধরে বলেছেন
كُلٌّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ
প্রতিদিনই তাঁর বিশেষ বিশেষ কর্ম রয়েছে। ( সূরা আর রাহমান : ২৯)
সুতরাং মহান আল্লাহর প্রতিটি কর্ম এবং প্রতিটি মহত্বের প্রকাশমানতা তাঁর কোন না কোন একটি গুণের (সিফাত) সাথে একান্ত সংশ্লিষ্ট। ( জাফর সুবহানী, মানশুরে জভীদ, খ, ৮, পৃ ১১০)
পরিশেষে, শাফায়াত যদি বাস্তবায়িত হয় এবং এর ফলে যদি কোন ব্যক্তির শাস্তি বা দণ্ড মওকুফ হয় তাহলে তা মহান আল্লাহর অপরিবর্তনশীল নিয়মনীতি ও পদ্ধতির মোটেও পরিপন্থী বলে গণ্য হবে না; বরং শাফায়াত হচ্ছে কতিপয় নিয়ামক (প্রভাবক), যেমন রহমত (দয়া), ক্ষমা, বিচার, চূড়ান্ত ফয়সালা ও নিষ্পত্তি, প্রকৃত হকদারের হকের সুষ্ঠু সংরক্ষণ ইত্যাদির প্রত্যক্ষ ফল স্বরূপ। তাই মহান আল্লাহ যদি তাঁর এ অধিকার (শাফায়াত) মহানবী (সা.) অথবা ইমামদেরকে দিয়ে থাকেন তাহলে তা ঐশী নিয়মনীতি ও সুন্নাতের পরিপন্থী কাজ বলে গণ্য হবে না।
অধিক অধ্যয়ন ও অবগতির জন্য নিম্নোক্ত গ্রন্থাবলী দ্রষ্টব্য
১. আয়াতুল্লাহ আব্দুল্লাহ জাওয়াদী আমোলী প্রণীত পবিত্র কোরআনের বিষয়ভিত্তিক তাফসীর, ৫ম খণ্ড, পবিত্র কোরআনে পরকাল (মায়াদ), পৃ. ১৫৩।
২. আয়াতুল্লাহ জাফার সুবহানী প্রণীত বুদ্ধিবৃত্তি, পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে শাফায়াত, পৃ. ৯০।
৩. আয়াতুল্লাহ জাফার সুবহানী প্রণীত মানশূরে জভীদ, ৮ম খণ্ড, পৃ. ১১০ ।
তথ্যসূত্র:
– মোজতামায়ে আমুজেশে আলিয়ে ফেক্বহ্।