এস, এ, এ
সালিল ছিলেন ইমাম হাদী (আ.)’র স্ত্রী এবং ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র মাতা। তিনি একজন সতী, চরিত্রবান, আধ্যাত্মিক জ্ঞানী এবং পূণ্যবতি নারী ছিলেন। ইমাম হাদী (আ.) তাঁকে একজন সুযোগ্য নারী বলে মনে করতে এবং তাঁর পদমর্যাদা এবং মর্তবার প্রশংসা করেছেন। তিনি নিজের দেশে এক অভিজাত বংশের মেয়ে ছিলেন। [1] জনাবা সালিল, তিনজন মাসুম (আ)’র সান্নিধ্য অর্জন করেছেন এবং ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র মৃত্যুর পরে তিনি আহলে বাইতের অনুসারীদের জন্য প্রত্যাবর্তন এবং আশ্রয়স্থল ছিলেন; কারণ ইমাম তাঁকে সেই যুগে ইমামতের উত্তম বর্ণনাকারী, তাঁর পূর্ণতা এবং আভিজাত্য এমন পর্যায়ে ছিল যে, ইমাম তাঁকে ইমামতের রহস্য বর্ণনা করার ওসিয়ত করেন। [2]
নাম এবং ডাকনাম:
ঐতিহাসিকগণ ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র মাতার বিভিন্ন নাম বর্ণনা করেছেন; যেমন: সালিল, সুসান, হাদীসা, হারিবা এবং আসাফান। [3]
আল্লামা মাজলিসি (রহ.) বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র মাতার নাম ছিল উম্মে ওয়ালাদ। তাঁর নাম হাদীসা, সুসান এবং সালিল। এই নামগুলোর মধ্যে সঠিক হচ্ছে সালিল। ঐ সতী ও দয়ালু নারী কল্যান, ধর্মানুরাগ এবং সংযমশীলতার চরম উৎকর্ষে পৌঁছে ছিলেন। [4] উয়ুনুল মোজেযাত নামক গ্রন্থের লেখক বলেছেন: ইমাম হাসান আসকারীর মায়ের সঠিক নাম ছিল সালিল এবং এইভাবে (کانت من العارفات الصالحات) তার প্রশংসা করেছেন। [5] বাকির শারীফ কুরাইশী বলেছেন: রেওয়ায়েতের বর্ণনা অনুযায়ি তাঁর সালিল নামটি সহীহ। [6] তাঁর ডাকনাম ছিল উম্মুল হাসান; [7] কেননা তাঁর সন্তানের নাম ছিল হাসান।
ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র মাতা তাঁর যুগের সবচেয়ে সতী, পুত, চরিত্রবান এবং উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন নারী ছিলেন এবং রেওয়ায়েত বর্ণনাকারীগণ তাঁকে একজন আধ্যাত্মিক এবং পূণ্যবতি নারী হিসেবে গণ্য করতেন এমনকি এই কারণে তাঁকে মাতামহ ও বলা হতো; কেননা তিনি ইমাম মাহদী (আ.)’র মাতামহ ছিলেন। তিনি একজন উপযুক্ত এবং আধ্যাত্মিক নারী ছিলেন। তাঁর প্রিয়ভাজন এবং সম্মানিত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল তিনি ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র শাহাদতের পরে আহলে বাইতের অনুসারীদের আশ্রয়স্থল এবং প্রত্যাবর্তনের কেন্দ্র বিন্দু ছিলেন। [8]
সালিলের প্রশংসায় ইমাম হাদী (আ.):
ভাগ্য সালিলকে মদীনায় নিয়ে আসে। যখন নির্ধারিত হয় যে, ইমাম নাক্বি (আ.)’র সাথে সালিলের বিবাহ হবে, তখন ইমাম তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন তোমার নাম কি। তিনি বলেন: আমার নাম সালিল। ইমাম বলেন: অচীরেই আল্লাহর হুজ্জাতকে (নির্বাচিত ইমাম) তোমার গর্ভে দান করবেন। যেন তিনি অত্যাচারে পূর্ণ পৃথিবীকে ন্যায় দ্বারা পূর্ণ করবেন। [9]
জন্মগ্রহণ:
সালিল মদীনায় গর্ভবতি হন এবং সেখানেই তিনি হাসান আসকারী (আ.)কে জন্মদান করেন। [10] ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র জন্মের তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে, তবে প্রসিদ্ধ হচ্ছে তিনি ২৩২ হিজরী সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।[11] তাঁর জন্মগ্রহণের পরে (الله اکبر) এবং (لا اله الا الله) উচ্চারিত হচ্ছিল। পিতা সন্তানকে কোলে নেন তারপর তাঁর ডান কানে আযান এবং বাম কানে ইকামত পাঠ করেন।
হাসান আসকারী (আ.)’র মৃত্যু:
সালিল বলেন: (( একদা আমার সন্তান আবু মুহাম্মাদ, হাসান আসকারী আমাকে বলে: ২৬০ হিজরীতে আমাকে সমস্যায় ফেলা হবে ভয় করছি যে আমাকে কষ্ট এবং দুরবস্থার সম্মুখিন হতে হবে। আর আমি যদি এই বীপদ থেকে বেঁচে যায় তাহলে ২৭০ হিজরী পর্যন্ত কোন বীপদে পতিত হব না)) আমি এই খবরটি শোনার পরে ক্রন্দন করতে শুরু করি। আমার সন্তান আমাকে সান্তনা দেয় এবং বলে হে মা! বিচলিত হয়ো না আল্লাহ ভাগ্যে যা কেখেছেন তাই হবে। [12]
ইমাম হাসান আসকারী (আ.) ২৫৯ হিজরীতে তাঁর মাকে হজে পাঠান। যখন সেই ধর্মভীরু এবং মর্যাদাশীল নারী ওহীর দেশে পৌঁছায় তখন থেকেই তিনি দোয়া এবং ইবাদতে মশগুল হয়ে পড়েন এবং হজ সম্পাদন করেন। সালিল হজ সম্পাদনের পরে সামেরার উদ্দেশ্যে রওনা হন। তিনি যখন মদীনায় রাসুল (সা.)এর কবরের কাছে পৌছান তখন ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র শাহাদতের খবর শুনতে পান। [13] “বাসায়েরুদ দারাজাত” নামক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, মোতামেদ আব্বাসী যখন তার ভাই জাফরকে বন্দি করে তখন ইমাম হাসান আসকারীরর মা মদীনায় অবস্থান করছিলেন এবং বিচলিত অবস্থায় ছিলেন এবং আন্তরিক ভাবে শান্ত ছিলেন না কখনও তিনি মদীনার বাহিরে চলে যেতেন এবং ইরাক থেকে আসা মুসাফিরদের কাছ থেকে তাঁর পরিবারের খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন। ৮ই রবিউল আওয়া তারিখে ইমাম হাসান আসকারী (আ.) শাহাদত বরণ করলে তাঁর মা মদীনায় তার মৃত্যুর খবর পান। এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয় যে ইমাম হাসান আসকারী (আ.) তাঁর মাকে নিজের মৃত্যুর সময় সম্পর্কে অবগত করেছিলেন। [14]
শিয়াদের আশ্রয়স্থল:
আহমাদ বিন ইব্রাহিম বলেন: আমি ২৬২ হিজরীতে ইমাম মুহাম্মাদ বিন আলী (আ.)’র কন্যা এবং ইমাম হাসান আসকারীর ফুফু জনাবা হাকিমার কাছে যায় এবং পর্দার আড়াল থেকে তাঁর সাথে কথা বলি এবং তাঁর কাছে কিছূ বিষয়ে প্রশ্ন করি। আমি ইমাম হাসান আসকারীর পরে কাকে ইমাম হিসেবে মেনে নিব? হাকিমা সকল ইমামের নাম উচ্চারণ করেন যখন ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র সন্তান ইমামে যামানা (আ.)’র নাম উচ্চারণ করেন তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করে বলি আপনার প্রতি উৎসর্গিত হই আপনি কি তাকে দেখেছেন নাকি শুধু তাঁর জন্মের খবর শুনেছেন? তিনি বলেন: যখন ইমাম হাসান আসকারী (আ.) তাঁর মাকে চিঠি লিখছিলেন তখন আমি তার কাছ থেকে এই খবরটি শুনেছিলাম। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি সেই নবজাতকটি এখন কোথায় আছে? তিনি বলেন: লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়েছেন। তাঁর অন্তর্ধানে থাকা কালীন অবস্থায় শিয়ারা কার কাছে প্রত্যাবর্তন করবে? হাকিমা বলেন: তাঁর দাদী ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র মাতা। আমি বলি তাহলে কি আমি এমন একজনের অনুসরণ করবো যে একজন নারীকে তার ওয়াসী রূপে নিযুক্ত করেছেন? জানাবা হাকিমা বলেন: ইমাম হাসান আসকারী (আ.) এই বিষয়ে ইমাম হুসাইন (আ.)’র অনুসরণ করেছেন; কেননা তিনি প্রকাশ্যভাবে তাঁর বোন জয়নাবকে ওসীয়ত করেন এবং যা কিছু ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) হতে বর্ণিত হতো তা হযরত জয়নাব (সা.আ.)’র প্রতি সম্পর্কিত করা হতো; এইভাবে তাক্বিয়ার পথ অবলম্বনের মাধ্যমে মাসুম ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র জীবন রক্ষা পায়। [15]
ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র ওয়াসী:
ইমাম হাসান আসকারী (আ.) মৃত্যুর সময় তাঁর মাকে নিজের স্থলাভিষিক্তরূপে নিযুক্ত করেন। সালিল যখন মদীনায় ছিলেন তখন তার সন্তান শাহাদত বরণ করেন। তিনি সন্তানের শাহাদতের খবর পেয়ে বিলম্ব না করেই সামেরার উদ্দেশ্যে রওনা হন। সামেরা তাঁর এবং জাফর কাযযাবের সাথে মীরাস নিয়ে দ্বন্দ চরম পর্যায়ে পৌছায়। তারা উভয়ে কাজী আবু শারেব’র কাছে যায় এবং সালিল কাজীর কাছে প্রামাণিত করে যে, ইমাম হাসান আসকারী (আ.) তাকে নিজের ওয়াসী নিযুক্ত করেছেন। তারপর কাজী ইমাম হাসান আসকারী এবং জাফরের মাঝে মীরাসকে ভাগ করে দেন। [16]
সালিল এমন একজন ক্ষমামীল নারী ছিলেন যে, জাফরের দারিদ্রতায় তার এবং তার পরিবারের সকল সদস্যর খরচাদির দ্বায়িত্ব তিনি নিজে বহন করতেন। পরবর্তিতে জাফরের অবস্থা এতটায় খারাপ হয়ে যায় যে, তার খাবারের মতো খাদ্যও তার কাছে ছিল না। সালিল গম, আটা, গোশত এবং সকল খরচাদি এমনকি তার গবাদি পশুর খাদ্যর খরচও দিতেন। [17]
শেখ তুসী (রহ.) তার আল গ্বীবা নামক গ্রন্থে এই সম্পর্কে লিখেছেন যে, কেউ যদি বলে যে, কি করে সম্ভব যে ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র সন্তান (ইমাম মাহদী (আ.ফা.)থাকার পরেও তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিজের ওয়াসী নিযুক্ত করেন এবং তাকে ওয়াক্ফ্ এবং সাদক্বাগুলোর দ্বায়িত্ব দান করেন। আমরা এক্ষেত্রে বলতে পারি: তিনি নিজের মাতাকে নিজের ওযাসী নিযুক্ত করেন যেন তাঁর সন্তান ইমাম মাহদী (আ.)কে গোপন করে রাখতে পারেন। তিনি যদি তাঁর আদরের সন্তানের কথাকে উপস্থাপন করতেন তাহলে তাঁর গোপন থাকার বিষয়টি ফাঁস হয়ে যেত। ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) ও নিজের সন্তান মূসা ইবনে জাফরকে রক্ষা করার জন্য তাঁর স্ত্রী হামীদা বারবারিয়া’কে নিজের ওয়াসী নিযুক্ত করেন। [18]
পরলোক গমণ:
সালিলের মৃত্যুর তারিখ সঠিকভাবে কোথাও বর্ণিত হয়নি। তবে এটা স্পষ্ট যে, তিনি ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র শাহাদতের পরে মারা যান। তিনি জীবনের শেষ লগ্নে ওসীয়ত করেন যে, মৃত্যুর পরে তাঁকে যেন তাঁর স্বামী এবং সন্তান ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র মাজারের পাশে দাফন করা হয়। যখন তাকে দাফন করার জন্য নিদৃষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় তখন জাফর বাধা দিয়ে বলে: এটা আমার ঘর এবং আমি তাকে এখানে দাফন করতে দিব না। এমতাবস্থায় ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হয়ে বলেন: হে জাফর এটা তোমার ঘর নাকি আমার ঘর?! তিনি এই কথা বলেই পুণরায় লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। সালিলকে ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র পাশে দাফন করা হয়। [19]
অন্য বর্ণনা অনুযায়ি জাফর বিন উমর বলেন: ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র মৃত্যুর পরে আসকার নামক এলাকায় যায় তখন পর্যন্ত ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র মা জিবীত ছিলেন। [20]
তথ্যসূত্র:
[1]. যানানে মার্দে অফারিন, পৃষ্ঠা ১৮৫।
[2]. আনওয়ারুল বাহিয়া, পৃষ্ঠা ৪৭৩।
[3]. ফুসুলুল মাহমা, পৃষ্ঠা ২৮৪, আল ইরশাদ, পৃষ্ঠা ৬৫০, আলামুন নিসায়িল মু’মিনাত, পৃষ্ঠা ৪৫৩।
[4]. জালালুল উয়ুন, পৃষ্ঠা ৯৮৯।
[5]. উয়ুনুল মোজেযাত, পৃষ্ঠা ১৩৪।
[6]. হায়াতে ইমাম হাসান আসকারী (আ.) পৃষ্ঠা ১৩।
[7]. রিয়াহিনুশ শারীয়া, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৪।
[8]. আনওয়ারুল বাহিয়া, পৃষ্ঠা ৪৭৩।
[9]. আয়ানুশ শিয়া, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০, রিয়অহিনুশ শারীয়া, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৪।
[10]. ইসবাতুল ওয়াসিয়া, পৃষ্ঠা ৪৫৭।
[11]. আল ইরশাদ, পৃষ্ঠা ৬৫০, ফুসুলুল মাহমুম, পৃষ্ঠা ২৮৪।
[12]. বাসায়েরুদ দারাজাত, পৃষ্ঠা ২৮২, বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৫০, পৃষ্ঠা ৩২০।
[13]. উয়ুনুল মোজেযাত, পৃষ্ঠা ১৩৮, জালালুল উয়ুন, পৃষ্ঠা ৯৯৮, দুররুন নাযিম, পৃষ্ঠা ৩৭৩।
[14]. বাসায়েরুদ দারাজাত, পৃষ্ঠা ৪২৮।
[15]. কামাল উদ্দিন, পৃষ্ঠা ১৭৮, রিয়াহিনুশ শারীয়া, পৃষ্ঠা ২৫।
[16]. কামাল উদ্দিন, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১২৪, দালায়েলুল ইমামা, পৃষ্ঠা ৪২৫।
[17]. রিয়াহিনুশ শারীয়া, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৫।
[18]. কিতাবুল গ্বীবা, পৃষ্ঠা ৮৫।
[19]. খারায়েজুল জারায়েহ, পৃষ্ঠা ৬৬১, উসুলে কাফি, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৫৯।
[20]. কামাল উদ্দিন, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৭৫।