নূর হোসেন মাজিদি
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন :
أَفَلا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا
“তারা কি কোরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহ তালাবদ্ধ?” (সূরা মুহাম্মাদ: ২৪)
আল্লাহ্ তা‘আলা অন্যত্র এরশাদ করেন :
أَفَلا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلافًا كَثِيرًا
“তারা কি কোরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না? এটা যদি আল্লাহর নিকট থেকে ব্যতীত অন্য কারো কাছ থেকে হতো তাহলে অবশ্যই তারা এতে বহু স্ববিরোধিতা পেতো। ” (সূরা আন্-নিসা’ : ৮২)
খুবই দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বেশীর ভাগ মুসলমানই কেবল ছাওয়াবের উদ্দেশ্যে কোরআন পাঠ (তেলাওয়াত্) করে এবং যেভাবে তা পাঠ করা উচিত (حَقَّ تِلاوَتِهِ) সূরা আল্-বাক্বারাহ্ : ১২১) সেভাবে পাঠ (অধ্যয়ন) করে না অর্থাৎ এ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না। আর সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক এই যে, আলেম হিসেবে পরিচিত লোকদের সিংহ ভাগের অবস্থাই এ পর্যায়ের; তাঁরা হাদীছের চিন্তাগবেষণাবিহীন অন্ধ ভক্ত হাজার হাজার হাদীছ মুখস্ত করেন, কিন্তু কোরআন মজীদের মানদণ্ডে সে সব হাদীছের যথার্থতা পরীক্ষা করার যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করেন না। তাই উপরের শিরোনামের পোস্ট প্রকাশিত হবার পরেও কেউ কেউ সংকলকগণ কর্তৃক “ছ¡হীহ্” হিসেবে দাবীকৃত জাল হাদীছের সাহায্যে হযরত রাসূলে আকরাম (ছাঃ)-এর পিতা-মাতাকে মুশরিক্ প্রমাণের চেষ্টা করেন (না‘ঊযূ বিল্লাহি মিন্ যালিক্) এবং কেউ কেউ এ দাবীর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে দাবী করেন যে, হযরত ইবরাহীমের (‘আঃ) জন্মদাতা পিতা মুশরিক্ ছিলেন (না‘ঊযূ বিল্লাহি মিন্ যালিক্), অথচ পোস্টের শেষে এ ভ্রান্ত ধারণাও খন্ড করা হয়েছে, কিন্তু তা তাঁদের চৈন্তিক স্থবিরতার নিরসন করতে পারে নি। তাই এখানে বিষয়টির ওপর বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোকপাত করছি।
(১) আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজীদে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, নবী-রাসূলগণ (‘আঃ) পরস্পরের বংশধর (ذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِنْ بَعْضٍ ) সূরা আালে ‘ইমরান্ : ৩৪)।
মু’মিন-মুশরিক্ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষই তো হযরত আদম (‘আঃ)-এর বংশধর এবং তিনি নবী ছিলেন, তাহলে বিশেষভাবে নবী-রাসূলগণকে (‘আঃ) পরস্পরের বংশধর বলার উদ্দেশ্য কী? এ কথার একটাই উদ্দেশ্য হতে পারে, তা হচ্ছে, নবী-রাসূলগণ (‘আঃ) বানী আদমের মধ্যকার কোনো নাফরমানের বংশধর নন। অর্থাৎ তাঁরা নবী-রাসূলগণের (‘আঃ) ও তাঁদের ধারাবাহিকতার নিষ্পাপ লোকদের বংশধর। কোরআন নাযিল কালীন মুশরিক্ ও ইয়াহূদীরাও এ থেকে এরূপ অর্থই বুঝেছিলো, নইলে নাফরমান ও মুশরিক সন্তানের পক্ষে নবী-রাসূল হওয়া সম্ভব গণ্য করা হলে (যা এ কালের আলেম নামধারী অনেক লোকই সম্ভব মনে করেন) মুশরিক ও ইয়াহূদীরা কোরআন মজীদের উক্ত আয়াতকে (সূরাহ্ আালে ‘ইমরান্ : ৩৪) একটি অর্থহীন বেদরকারী কথা বলে অভিহিত করতো যা তারা করে নি।
(২) আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন যে, তিনি মু’মিনদের নিজেদের মধ্য থেকে রাসূলুল্লাহকে (ছাঃ) উত্থিত করেছেন (لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولا مِنْ أَنْفُسِهِمْ Ñ সূরাহ্ আালে ‘ইমরান্ : ১৬৪)। এমতাবস্থায় প্রকৃত ব্যাপার যদি এমনই হতো যে, রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) জন্মের সময় মক্কায় কোনোই মু’মিন্ ছিলো না, তাহলে কোরআন মজীদের এ উক্তি মিথ্যা হয়ে যায় (না‘ঊযু বিল্লাহি মিন্ যালিক্)। কিন্তু কোরআন নাযিল কালীন মুশরিকরা ও ইয়াহূদীরাও কোরআন মজীদের এ আয়াতের উক্তিকে মিথ্যা বলে দাবী করে নি। এমতাবস্থায় এটাই কি স্বাভাবিক নয় যে, রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) পিতা-মাতা, দাদা ও তাঁর ললনপালনকারী চাচা হযরত আবূ ত্বালিব্ (‘আঃ) মু’মিন্ ছিলেন?
এখানে উল্লেখ্য যে, অনেক লোকে মনে করে, “মু‘মিন্” বলতে কেবল রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) প্রতি ঈমানদারকে বুঝানো হয়। কিন্তু কোরআন মজীদে “মু‘মিন্” শব্দটি এ অর্থে ব্যবহার ছাড়াও ব্যাপকতর অর্থে কেবল তাওহীদ ও আখেরাতে ঈমানদারদের জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের সম্পর্কে এরশাদ করেন :
وَلَوْ آمَنَ أَهْلُ الْكِتَابِ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ مِنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ وَأَكْثَرُهُمُ الْفَاسِقُونَ
“আর আহলে কিতাব যদি (এই নবীর প্রতি) ঈমান আনতো তাহলে তা তাদের জন্যই উত্তম হতো; (অবশ্য) তাদের মধ্যে মু’মিন্ লোকেরাও আছে, তবে তাদের বেশীর ভাগই ফাসেক্ব।” (সূরাহ্ আালে ‘ইমরান: ১১০)
কেউ কেউ হয়তো বলে বসবে যে, এখানে “মু’মিন্” বলতে আহলে কিতাবের মধ্যকার যারা রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) প্রতি ঈমান এনেছিলেন তাঁদের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এরূপ বুঝানো কি সম্ভব? কিছু পৌত্তলিক হিন্দু যদি রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) প্রতি ঈমান আনে তো এরপরও তাদেরকে পৌত্তলিক হিন্দুদের মধ্যে গণ্য করে বলা কি সঙ্গত যে, “পৌত্তলিক হিন্দুদের মধ্যে কিছু মু’মিন্ আছে”? আবার কেউ বলে বসতে পারে যে, উক্ত আয়াতে রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) নবুওয়াত-পূর্ববর্তী আহলে কিতাবের কথা বলা হয়েছে, অথচ এ আয়াতটি স্বয়ং রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) প্রতি নাযিল হয়, আর তা’তে বর্তমান কাল ব্যবহার করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, আহলে কিতাবের লোকেরা তাঁর প্রতি ঈমান আনলে তা তাদের জন্য ভালো হতো। তাহলে এখানে “মু’মিন্” বলতে কী করে রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) নবুওয়াত্-পূর্ববর্তীদের কথা বুঝানো হতে পারে? আর তাদের ধারণাকৃত সে অর্থেও তো রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) নবুওয়াতের দায়িত্ব লাভের পূর্বে মক্কায় একদল মু’মিন্ লোক ছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) ছিলেন তাঁদেরই একজন। এমতাবস্থায় (মক্কায় একদল মু’মিন্ থাকা অবস্থায়) রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) পিতা-মাতা, দাদা ও তাঁর লালনপালনকারী চাচা মু’মিন্ ছিলেন না এটা কি কল্পনা করা যায়?
(৩) কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে হযরত ইবরাহীম (‘আঃ)-এর জন্মদাতা পিতা যদি মুশরিক হতেন তাহলে “নবী-রাসূলগণ (‘আঃ) পরস্পরের বংশধর (ذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِنْ بَعْضٍ ) সূরা আলে ‘ইমরান: ৩৪)” এ আয়াতের বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণিত হতো এবং এ থেকে কোরআন মজীদে স্ববিরোধিতা প্রমাণিত হতো। কোরআন মজীদে স্ববিরোধিতা নেই বলে যখন চ্যালেঞ্জ দেয়া হয় (সূরাহ্ আন্-নিসা’ : ৮২) তারপর নিঃসন্দেহে ইয়াহূদীরা কোরআনে স্ববিরোধিতা বের করার জন্য চিন্তা-গবেষণা (তাদাব্বুর্) করে থাকবে। এমতাবস্থায় তারা যদি কোরআনে পেতো যে, হযরত ইবরাহীম (‘আঃ)-এর জন্মদাতা পিতা মুশরিক ছিলেন তাহলে অবশ্যই তারা উক্ত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে দেখাতো যে, এটা “নবী-রাসূলগণ (‘আঃ) পরস্পরের বংশধর (ذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِنْ بَعْضٍ ) সূরা আালে ‘ইমরান: ৩৪)” কোরআন মজীদের এ দাবীর সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু তারা এমন কিছু বলে নি।
সূরাহ্ আল্-আন্‘আামের ৭৪ নং আয়াতে আাযার্-কে হযরত ইবরাহীম (‘আঃ)-এর পিতৃস্থানীয় ব্যক্তি (ابيه) বলা হয়েছে। অন্যদিকে তাওরাতে হযরত ইবরাহীম (‘আঃ)-এর জন্মদাতা পিতার নাম বলা হয়েছে “তারেহ্” বা “তেরহ্”। কিন্তু তা সত্তে¡ও ইয়াহূদী পণ্ডিতরা দাবী করে নি যে, কোরআনে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে। কারণ, তারা কোরআন নিয়ে তাদাব্বুর্ করে দেখতে পায় যে, এখানে ব্যাপক অর্থবোধক ابيه দ্বারা তাঁর জন্মদাতা পিতাকে (والد) বুঝানো হয় নি। তার প্রমাণ:
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন :
وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لأبِيهِ إِلا عَنْ مَوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ
“ইবরাহীম্ কর্তৃক তার পিতৃস্থানীয় ব্যক্তির (ابيه) জন্য ইস্তিগ¦ফার্ করণ কেবল তার সাথে কৃত তার (ইবরাহীমের) প্রতিশ্রুতির কারণে বৈ ছিলো না। অতঃপর যখন তার (ইবরাহীমের) কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেলো যে, সে আল্লাহর দুশমন তখন সে (ইবরাহীম্) তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলো। ” (সূরাহ্ আত্-তাওবাহ্ : ১১৪)
আাযারের সাথে হযরত ইবরাহীমের (‘আঃ) এই সম্পর্ক ছিন্নকরণ কোন্ সময়ের ঘটনা? নিঃসন্দেহে ইরাক থেকে তাঁর ফিলিস্তিনে হিজরতের প্রাক্কালের ঘটনা। কিন্তু হযরত ইবরাহীম (‘আঃ) বার্ধক্যে Ñ যখন তাঁর বয়স মোটামুটি একশ’ বছর Ñ স্বীয় পুত্র ইসমা‘ঈল্ (‘আঃ) সহ কা‘বাহ্ গৃহ পুনঃনির্মাণ করার পর তাঁর জন্মদাতা পিতা-মাতার (والدين) জন্য ইস্তিগ¦ফার্ করেন। তিনি বলেন :
رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ
“হে আমাদের রব্! হিসাব প্রতিষ্ঠার দিনে আমাকে, আমার জন্মদাতা পিতা-মাতাকে ও মু’মিনদেরকে ক্ষমা কর। ” (সূরাহ্ ইবরাহীম্ : ৪১)
সুতরাং অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, কোরআন মজীদে আাযার্-কে হযরত ইবরাহীম (‘আঃ)-এর জন্মদাতা পিতা (والد) বলা হয় নি।
বস্তুতঃ কোরআন মজীদের এ এক বিশেষ বাকরীতি যে, তার এক অংশ অন্য অংশকে ব্যাখ্যা করে। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন নবী-রাসূল (‘আঃ) তাঁদের নিজ নিজ ক্বাওমকে আল্লাহর পথে আহবানের দায়িত্ব পালন করেন, কিন্তু হযরত লূত্ব (‘আঃ)কে যে ক্বাওমের হেদায়াতের জন্য পাঠানো হয় তিনি সে ক্বাওমের লোক ছিলেন না। তাই তাদেরকে যেমন “ক্বাওমে লূত্ব” (সূরাহ্ হূদ : ৭০, ….) বলা হয়েছে তেমনি “ইখ্ওয়ানু লূত্ব” (লূত্বের ভ্রাতৃগোষ্ঠী) (সূরাহ্ ক্বাফ্ : ১৩) বলা হয়েছে। ফলে কারো পক্ষে মনে করা সম্ভব নয় যে, কোরআন মজীদে হযরত লূত্ব (‘আঃ)কে ক্বাওমে লূত্বে জন্মগ্রহণকারী বলে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে।
আফসোস্! কোরআন নাযিলের যুগের ইয়াহূদী পণ্ডিতরা কোরআন মজীদে স্ববিরোধিতা খুঁজে না পেলেও আমাদের আলেম নামধারী অনেক লোক কোরআন নিয়ে তাদাব্বুর্ না করার কারণে রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) ইন্তকালের দুই শতাধিক বছর পরে গায়রে মা‘ছূমদের সংকলিত প্রকৃত ছ¡হীহ্ ও ছ¡হীহ্ হিসেবে দাবীকৃত জাল হাদীছের সংমিশ্রিত সংকলনসমূহের ওপর অন্ধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা পোষণের কারণে হযরত ইবরাহীম্ (‘আঃ)-এর জন্মদাতা পিতাকে ও রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) পিতা-মাতাকে মুশরিক্ হিসেবে অভিহিত করে কার্যতঃ কোরআন মজীদের প্রতি স্ববিরোধিতা আরোপ করছেন। এদের অন্তরসমূহ কি তালাবদ্ধ?