Press "Enter" to skip to content

শবে কদর ও মানুষের ইখতিয়ার

মূল: মোজতামায়ে আমুজেশে আলিয়ে ফেক্বহ্

অনুবাদ: মোহাম্মাদ মুনীর হোসাইন খান

প্রশ্ন : কুদর রজনীতেই যদি মানবভাগ্য নির্ধারণ করা হয় তাহলে মানুষের চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও ইখতিয়ারের তাৎপর্য কী?

এ বিষয়টি স্পষ্ট ও বোধগম্য হওয়ার জন্য দুটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়া বাঞ্ছনীয়: ১. কুদর রজনীতে মানবভাগ্য নির্ধারণ যে মানুষের ইখতিয়ারের পরিপন্থী এতদসংক্রান্ত সন্দেহের উৎপত্তি কোথা হতে হয়েছে?

২. কদর রজনীতে মহান আল্লাহ্ কর্তৃক ভাগ্য নির্ধারণের অর্থ কী?

প্রশ্ন সংক্রান্ত বিশদ বিবরণ: কুদর রজনীতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ যে মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও ইখতিয়ারের পরিপন্থী এতদসংক্রান্ত অহেতুক সন্দেহ এ কারণেই উত্থাপিত ও আলোচিত হয় যে, একদিকে রেওয়ায়াতসমূহ অনুসারে এ রাতে মানুষের এক বছরের ভাগ্য নির্ধারণ করে যুগের ওয়ালী অর্থাৎ যুগের ইমামের (আ.) ইখতিয়ারে রাখা হয়। অপর দিকে, এই নির্ধারণ ও নির্দিষ্টকরণের সাথে মহান আল্লাহর জ্ঞানও সংশ্লিষ্ট।

সুতরাং নির্ধারিত এ ভাগ্য ও মহান আল্লাহর জাত বিষয়ে পরিবর্তন সাধনের সামর্থ্য যদি মানুষের থেকে থাকে তাহলে মহান স্রষ্টার জ্ঞান যে অজ্ঞতায় পর্যবসিত হবে এবং ভাগ্য নির্ধারণ করার বিষয়টিও যে অর্থহীন হয়ে যাবে তা অবধারিত হয়ে যাবে। যাতে আমরা এ দুই বিষয়ের মুখোমুখী না হই সেজন্য মানুষ যে স্বীয় ভাগ্য পরিবর্তনে সক্ষম তা আমাদের অস্বীকার করতে হবে। আর এটাও জারের (অদৃষ্টবাদ) অর্থেই পর্যবসিত হবে।

জার ও ইখতিয়ার সংক্রান্ত বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি

এ প্রশ্নের উত্তর যাতে ভালোভাবে জানা যায় সে জন্য এ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়া বাঞ্ছনীয় যে, জাবর ও ইখতিয়ার প্রসঙ্গ হচ্ছে কালাম শাস্ত্রের অত্যন্ত প্রাচীন আলোচনাসমূহের অন্তর্ভুক্ত যা সকল ধর্ম ও তাত্ত্বিক মতবাদে বিদ্যমান। ইসলামে এতদসংক্রান্ত তিনটি প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান যেগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ: অদৃষ্টবাদ), যার প্রকাশ আশআরী চিন্তাধারা

ক. নিরঙ্কুশ জার

খ. নিরঙ্কুশ ইখতিয়ার । স্বাধীনতা (তাফভীয়), যার প্রবক্তা মোতালি

সম্প্রদায়।

গ. উক্ত দুই প্রান্তিক বিষয়ের মাঝামাঝি বিষয়, যার প্রবক্তা শিয়া সম্প্রদায়।

পবিত্র ইমামদের অনুসরণ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির আলোকে আহলে বাইতের মতাদর্শের অনুসারীরা প্রমাণ করেছে যে, মধ্য পন্থাই আসলে সঠিক পন্থা অ মানুষের কর্মসমূহ সম্পূর্ণরূপে তার নিজের সৃষ্টি নয় যার ফলে আল্লাহ পাক তারে হস্তক্ষেপ করতে অপারগ হবেন, আর না তা এমনভাবে মহান আল্লাহর সৃষ্টি যার ফলে সওয়াব (পুণ্য) ও শাস্তি বিধান অর্থহীন হয়ে যাবে।

তৃতীয় দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে, মুসলিম আলেমগণ জার অপনোদনের যে দুটি উত্তর দিয়েছেন সেগুলোর মাধ্যমেও ‘কদরের রাতে মানবভাগ্য নির্ধারণ করা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতার পরিপন্থী’ হওয়ার সন্দেহ অপনোদন করা সম্ভব।

প্রথম উত্তর : মহান আল্লাহ্ বিশ্বজগতকে একটি তন্ত্র বা ব্যবস্থার ভিত্তিতে সৃষ্টি করেছেন যার মধ্যে কার্যকারণের নিয়ম বলবৎ রয়েছে। প্রথম সৃষ্টি (e) (J, যে কোন ধরনের মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি মহান আল্লাহ্ কর্তৃক সৃজিত হয়েছে। সেই সৃষ্টি ব্যতীত অন্য সব সৃষ্টি ঐ সব কারণ থেকে উৎসারিত হয়েছে যেগুলো মহান আল্লাহ এ সব সৃষ্টির জন্য নির্ধারণ করেছেন। যেমন : প্রকৃতি জগতের ব্যবস্থা এমনভাবে বিন্যস্ত ও শৃঙ্খলায়িত করা হয়েছে যে, কোন বীজ বা শস্যদানা বিশেষ পরিস্থিতির আওতায় মাটিতে বপন করা হলে উদ্ভিদে পরিণত হবে। ঠিক একইভাবে শুক্রাণু যদি উপযুক্ত জরায়ুতে স্থাপিত হয় তাহলে আমরা চাই বা না চাই তা ভ্রুণে রূপান্তরিত হবেই। কিন্তু এসব কারণ এত সহজে ও অনায়াসে অস্তিত্ব লাভ করেনি। বেশ কিছু প্রপঞ্চের (phenomena) কারণসমূহ জটিল এবং এগুলোর ক্ষেত্রে এমন সব মৌল ও উপাদান জড়িত আছে যা সহজে শনাক্ত করা যায় না। মানুষের ঐচ্ছিক কাজকর্ম ঠিক এ ধরনের। মানুষের ক্ষেত্রে কার্যকারণ তন্ত্র এমনভাবে কাজ করে যে, এর ভিতরে মানুষের ইখতিয়ার ও ইচ্ছার ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং মানুষের ইখতিয়ার হচ্ছে এ তন্ত্র বা ব্যবস্থার অংশবিশেষ যা মহান আল্লাহ নির্ধারণ ও স্থাপন করেছেন।

প্রথম উত্তরের সমালোচনা : এ বিশ্লেষণ অনুসারে ভাগ্য নির্ধারণের অর্থ এই যে, মহান আল্লাহ্ মানুষের কাছে তার ভাগ্য সোপর্দ করেছেন। এ কথার অর্থ কেবল এটাই যে, মানুষের ভাগ্যের ক্ষেত্রে আল্লাহর কোন ভূমিকা নেই। এ অর্থটা যদিও তৃতীয় দৃষ্টিভঙ্গির কলেবরে উত্থাপিত হয়েছে তবুও তা হচ্ছে কার্যত সেই তাফভীয অর্থাৎ হস্তান্তরবাদ ও নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা সংক্রান্ত ভ্রান্ত মতবাদ যা মোতাযিলাদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়েছে। আর এ বিশেষণ অনুসারে আমাদের অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে, মানুষের ঐচ্ছিক কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত মহান আল্লাহর জ্ঞান কেবল এ বিশ্বব্যবস্থা সংক্রান্ত তাঁর জ্ঞানের পর্যায় এবং মানুষের কর্মসমূহের সকল খুঁটিনাটি দিক সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত নন। [শহীদ মুতাহহারী রচনাসমগ্র, খ. ১, পৃ. ৪৫৩]

এ অর্থটা কোন কোন প্রাচীন দার্শনিকের বক্তব্য থেকে বের হয়ে আসে। আর আল্লামা মাজলিসী পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে যে গভীর অনুধাবন ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন তার ভিত্তিতে এ অর্থকে ধর্মের জরুরি অর্থাৎ অপরিহার্য বিষয়াদির পরিপন্থী বলে গণ্য করেছেন। [বিহারুল আনওয়ার, খ. ৪, পৃ. ৮৭]

দ্বিতীয় উত্তর : মানবভাগ্য নির্ধারিতকরণের দ্বিতীয় বিশ্লেষণ হচ্ছে এই যে, যদিও মহান আল্লাহ বিশ্বব্যবস্থা সৃষ্টি করে তা কার্যকারণের নিয়মের ওপর স্থাপন করেছেন তবুও তা এমন নয় যে, এ বিশ্বব্যবস্থা ও কার্যকারণের নিয়মের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার সামর্থ্য তাঁর নেই। এ কারণেই বলা হয়েছে : মহান আল্লাহ যেমন কারণ সৃষ্টিকারী, তেমনি কারণ বিলুপ্তকারীও বটে। উদাহরণস্বরূপ : যেমনভাবে তিনি পোড়ানোর জন্য আগুন সৃষ্টি করেছেন তেমনি তিনি আগুনকে এর বিপরীতধর্মী জিনিস অর্থাৎ পুষ্পোদ্যানে রূপান্তরিত করতে পারেন। সূক্ষ্ম ভাষায় বলতে গেলে, এটা ঠিক যে, মহান আল্লাহ কার্যকারণের নিয়ম প্রবর্তন করেন নি, তবে তিনি বিশেষ বিশেষ কারণ সৃষ্টি ও প্রবর্তন করেছেন। মহান আল্লাহই আগুনকে পোড়ানোর কারণ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। অতএব, স্বয়ং তিনিই পারেন এই কারণকে এর কারণত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে এবং তিনি অন্য কোন কারণকে এর স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন।

এ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ভাগ্য নির্ধারণ হচ্ছে নির্দিষ্ট ফলাফল ও কার্য পরম্পরার গতি পথে কারণসমূহ সংস্থাপন করার নামান্তর। আরেকভাবে বলা যায়, মহান আল্লাহ্ সূক্ষ্মভাবে মানুষের ভাগ্য নির্দিষ্ট ও নির্ধারণ করেন। এই নির্ধারণ, এমনকি ক্বদরের রজনীর আগে ও প্রকৃত জগতেই সংঘটিত হয়ে থাকে; বরং এর চাইতেও ঊর্ধ্বে মহান আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞানে নির্ধারিত আছে যে, কারা সৌভাগ্যবান এবং কারা দুর্ভাগা। আরেফদের ভাষায়, প্রত্যেক ব্যক্তির স্থায়ী সত্তায় (be) এ বিষয় বিদিত আছে যে, সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের সাথে তার সম্পর্ক কেমন। তবে এতদসত্ত্বেও তা মানুষের ইখতিয়ারের পরিপন্থা নয়। কারণ, এই নির্ধারণ ও নির্দিষ্টকরণ আসলে মহান আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞান থেকে এবং এই চিরন্তন জ্ঞান মানুষের ইখতিয়ার ও ইচ্ছার অনুবর্তী। অন্যভাবে বল যায়, আল্লাহ্ জানেন যে, অমুক ব্যক্তি অমুক সময় এবং অমুক অবস্থায় কোন ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কোন ধরনের ইচ্ছা পোষণ করবে এবং তার সেই নিজস্ব ইখতিয়ারের ভিত্তিতে নিজ ভাগ্যও নির্ধারণ করবে।

হাদীস ও রেওয়ায়াতসমূহ অধ্যয়ন করে আমরা বুঝতে পারি যে, মान আল্লাহ্ কর্তৃক মানবভাগ্য নির্ধারণের অর্থ ও বাস্তব স্বরূপ সংক্রান্ত এ ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য। নিচে কতিপয় হাদীস উল্লেখ করা হলো :

১. ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন :

…. যেহেতু মহান আল্লাহ্ চিরন্তন কাল হতে জানতেন যে, অমুক কাজ তাদের থেকে সংঘটিত হবে (অর্থাৎ এ কাজের সাথে তাদের ইচ্ছা সুদৃঢ়ভাবে সংশ্লিষ্ট হবে) সেহেতু তিনি তাদের ইখতিয়ারে উক্ত কার্য সম্পাদন করার উপায়-উপকরণও অর্পণ করেছেন। তাই যখন তারা কাজটি সম্পাদন করে তখন তারা সামর্থ্যবান বলে গণ্য হয়। [বিহারুল আনওয়ার, খ. ৫, পৃ. ৪২]

এ রেওয়ায়াতে ইমাম সাদিক (আ.) ভাগ্য নির্ধারণ প্রসঙ্গকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, মহান আল্লাহ্ কাজ করার উপায়-উপকরণ মানুষের ইখতিয়ারে অর্পণ করেন এবং সেও এসব উপায়-উপকরণ ব্যবহার করে উক্ত কাজ সম্পাদন করে। তবে পাপাচার ও বিরুদ্ধাচরণের মত কোন সুনির্দিষ্ট কাজের উপায়- উপকরণ মানুষের ইখতিয়ারে প্রদান করা হয় এ কারণে যে, মহান আল্লাহ্ জানেন যে, সে অবশেষে নিজ ইখতিয়ারেই উক্ত কর্ম নির্বাচন করবে।

আবু বাসীর বর্ণনা করেছেন : একদা আমি ইমাম সাদিক (আ.)-এর নিকট বসেছিলাম; তখন এক ব্যক্তি ইমামের কাছে পাপীদের শান্তি প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ইমাম সাদিক (আ.) বললেন ম আল্লাহ্ এ হুকুমটা করেছেন। অতঃপর তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে এ হুকুম বোঝা ও সম্পাদন করার সামর্থ্য প্রদান করেছেন এবং পাপীদেরকে বিরুদ্ধাচরণ করার সামর্থ্যও প্রদান করেছেন; কারণ, তিনি পূর্ব হতে জানতেন যে, বিরুদ্ধাচারীদের থেকে পাপাচার সংঘটিত হবে। [হাশিম মারূফ আল-হাসানী প্রণীত হাদীস ও মুহাদ্দিস সংক্রান্ত পর্যালোচনা, পৃ. ২২৯]

মারূফ আল-হাসানী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন : অতএব, এ সব পাপী যে দুর্ভাগ্যের পথ স্বেচ্ছায় বেছে নেবে এতদসংক্রান্ত জ্ঞান থেকেই এদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ্ এ হুকুম উৎসারিত হয়েছে। [হাশিম মারূফ আল-হাসানী প্রণীত হাদীস ও মুহাদ্দিস সংক্রান্ত পর্যালোচনা, পৃ. ২২৯]

এই দুই রেওয়ায়াতের ভিত্তিতে সার্বিকভাবে বলা যায় যে, চিরন্তন কাল থেকেই মহান আল্লাহ্ কর্তৃক ভাগ্য নির্ধারণ প্রসঙ্গ তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের প্রেক্ষাপটে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, মানুষ স্বেচ্ছায় এবং নিজ ক্ষমতা ও ইখতিয়ারের ভিত্তিতে সম্পাদনের জন্য কোন ধরনের কার্য বেছে নেবে। অতএব, এ ক্ষেত্রে কোন ধরনের জা অর্থাৎ অদৃষ্টবাদ বিদ্যমান নেই। বিষয়টা ঠিক এমন যে, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির ওপর প্রভাব বিস্তারকারী সমুদয় কারণ ও নিয়ামক সংক্রান্ত জ্ঞান কারো আছে এবং নিশ্চিতভাবে যে প্রথম থেকেই জানে যে, মানুষ কোন্ সময় কোন্ কাজ আঞ্জাম দেবে। এটা সত্য যে, সে এক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির ভাগ্যের সকল খুঁটি-নাটি দিক ও বিষয় ধারবাহিকতাসহ বর্ণনা করতে ও জানতে সক্ষম; তবে এক্ষেত্রে জাব্র (বাধ্যবাধকতা) নেই। কারণ, মানুষের ওপর কোন কিছু চাপানো হয় নি।

শবে কদর প্রসঙ্গে বলা যায় যে, সকল মানুষের এক বছরের কার্যাবলী সংক্রান্ত আল্লাহ্ পাকের চিরন্তন জ্ঞান ও ফিরিস্তি যা তাঁর ঐশী জ্ঞানভাণ্ডারসমূহে সংরক্ষিত আছে তা ক্বদরের রজনীতে অবতীর্ণ হয়। অতএব, এক্ষেত্রে কোন জাই বিদ্যমান নেই ।

 

২. বিশেষ জবাব : এ উত্তরের ক্ষেত্রে জার ও ইখতিয়ার সংক্রান্ত মামূলী জবাবসমূহের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদেরকে একটি বস্তুনিষ্ঠ মূলনীতি মেনে নিতেই হবে। আর তা হলো যে, ক্বদরের রজনীতে মহান আল্লাহ্র চিরন্তন জ্ঞানের অবতীর্ণ হওয়ার বিষয়টি কেবল মুখ্য আলোচ্য বিষয়ই নয়; বরং ভাগ্যের এক ধরনের নির্ধারণ ও লিখনের বিষয়ও মানুষের ক্ষেত্রে আলোচিত হয়ে থাকে। তাই এ ধারণার ভিত্তিতে আমরা বলি : ক্বদরের রাতে যে ভাগ্য (তাকদীর) নির্ধারিত হয়ে থাকে তা অবশ্যম্ভাবী-অলঙ্ঘনীয় ভাগ্য নয়। সুতরাং রেওয়ায়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে যে, যদি কোন ব্যক্তি কদরের রাতে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে না থাকে তাহলে আরাফাত দিবসে (৯ জিলহজ্জ) ক্ষমা পাওয়ার জন্য সে চেষ্টা করবে।`[সাইয়্যেদ জাফর ইবনে তাউস রাযীউদ্দীন আলী ইবনে মূসা প্রণীত ইকবালুল আ’মাল, পৃ.২৮; মান লা ইয়াহদারুহুল ফকীহ, পৃ. ৯৯; উসূলে কাফী, খ. ৪, পৃ. ৬৬]

এ কথার অর্থ হচ্ছে এই যে, ক্বদরের রাতের ভাগ্য আরাফাত দিবস বা বছরের অবশিষ্ট দিনগুলোয় পরিবর্তনীয়। এস্থলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ক্বদরের রাতের জন্য মূলত অবশ্যম্ভাবী ভাগ্য নয় এবং কদরের রজনীতে যে জ্ঞান ইনসানে কামিল ও যুগের ওয়ালীর ওপর অবতীর্ণ হয় তা হচ্ছে সেই জ্ঞান যা রহিতযোগ্য এবং বাস্তবে

রূপায়ণের ফলক (a) থেকে অবতীর্ণ হয়। তবে ন্যূনপক্ষে এ বিশ্লেষণে সংরক্ষিত ফলকের জ্ঞান (byic (c) যা মহান আল্লাহ্র চিরন্তন জ্ঞানের অনুলিপিস্বরূপ তা যুগের আল্লাহ মনোনীত ইমাম ও ওয়ালীর ইখতিয়ারে অর্পণ করা হয় না। কারণ, এমতাবস্থায় তা আর পরিবর্তন করা যাবে না। তাই এ কারণে বন্দরের রজনীতে বিষয়াদির নির্ধারণ হচ্ছে একটি আইনের খসড়াসদৃশ যে ক্ষেত্রে মানুষ পরিবর্তনযোগ্য যে সব বিষয় বা ধারা তার জন্য ক্ষতিকর সেগুলোকে পরিবর্তন করে উক্ত আইনের চূড়ান্ত Text-এ তা নিজের অনুকূলে অনতে সক্ষম।

রেওয়ায়াতসমূহ পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে যায়ে যে, যে সব বিষয় লাইলাতুল কদরে ইমামদের ওপর অবতীর্ণ হয় সেগুলো অবশ্যম্ভাবী নয়; বরং সেগুলো হচ্ছে পরিবর্তনীয় বিষয়। যেমন : আইয়াশীর তাফসীর গ্রন্থে ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : কোন এক ব্যক্তি তাকে ক্বদরের রাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন : এ রাতে ফেরেশতা ও লেখকাণ পৃথিবীর আকাশে অবতীর্ণ হন এবং এক বছরের যে সব বিষয় সংঘটিত হওয়া ও বান্দাদের ভাগ্যে যা কিছু ঘটার কথা নির্ধারিত আছে তা লিপিবদ্ধ করেন। তবে বেশ কিছু বিষয় আছে যার বাস্তবায়ন মাশীয়াত অর্থাৎ ঐশী ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল; তাই আল্লাহ্ পাক সে সব বিষয়ের মধ্য হতে যা ইচ্ছা তা অগ্রবর্তী এবং যা ইচ্ছা তা বহাল রাখেন; আর তাঁর কাছেই আছে উম্মুল কিতাব। [নযূর বিন মাসউদ ইবনে আইয়াশ সামারকান্দী প্রণীত তাফসীর আল আইয়াশী, সাইয়্যেদ হাশেম রাসূল মাহাল্লাতী কর্তৃক গবেষণাকৃত, খ. ২, পৃ. ২১৫]

ইমামদের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তাঁরা এমন অকাট্য ও অপরিবর্তনীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন না যার ওপর মহান আল্লাহ্র মাশীয়াত্ (ইচ্ছা) কর্তৃত্বশীল (নয়) হবে না। যেমন : ইমাম সাদিক (আ.) নির্ভরযোগ্য একটি হাদীসে বলেছেন : ইমাম যয়নুল আবেদীন আলী ইবনুল হুসাইন (আ.) সর্বদা বলতেন : যদি পবিত্র কোরআনে একটি আয়াত না থাকত তাহলে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত যে সব ঘটনা ঘটবে তা তোমাদেরকে জানাতাম; তাঁকে বলা হলো : ‘সেটা কোন্ আয়াত?’ তিনি বললেন: তা হচ্ছে মহান আল্লাহ্র এ বাণী

يمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيَثْبِتُ وَعِنْدَهُ أُمُّ الْكِتَابِ

‘আল্লাহ যা ইচ্ছা তা বিলুপ্ত করেন এবং মিটিয়ে দেন এবং যা ইচ্ছা তিনি বহাল রাখেন এবং তাঁর কাছেই আছে উম্মুল কিতাব।” [উম্মুল কিতাব্-এর অর্থ কিতাবের মূল যা অপরিবর্তনীয়, সূরা রা’দ : ৩৯]

এতদপ্রসঙ্গে অনেক রেওয়ায়াতও বিদ্যমান।

ফলাফল

প্রথমত জার ও ইখতিয়ার সংক্রান্ত আপত্তির প্রচলিত জবাবসমূহের আলোকে কদরের রাতকে কেন্দ্র করে জার বা অদৃষ্টবাদ শীর্ষক আপত্তি সমাধান করা সম্ভব। এমতাবস্থায় ভাগ্য নির্ধারণের অর্থ মহান আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞানের (পৃথিবীতে অবতরণ ব্যতীত আর কিছুই হবে না যা মানুষের ইচ্ছা ও ইখতিয়ারের অনুগামী।

দ্বিতীয়ত যদি মেনেও নেই যে, ক্বদরের রাতে যা কিছু ঘটে ও সংঘটিত হয় তা আসলে জ্ঞানের অবতরণ নয়, বরং তা হচ্ছে নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত হওয়ার পর্যায়ে। কারণ, যা কিছু এ রাতে নির্ধারিত হয় তা অবশ্যম্ভাবী নয় এবং মানুষ তা পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে; সুতরাং এর ফলে জাব্র ও অদৃষ্টবাদ অপরিহার্য হয় না। অবশেষে একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আর তা হলো : ভাগ্যের উক্ত রূপরেখা বা ক্ষমতাও ক্বদরের রাতে বৃথা লেখা হয় না; বরং ব্যক্তির অতীত কর্মসমূহ, বর্তমান অবস্থা এবং হাজারো কারণ যা আমাদের কাছে অপ্রকাশিত ও অজ্ঞাত রয়েছে সেগুলোর আলোকে তা প্রণয়ন করা হয়। স্মর্তব্য যে, এসব কারণ আমরা নিজেরাই আমাদের জীবন জুড়ে আমাদের নিজস্ব ইচ্ছা ও ইখতিয়ারের মাধ্যমে নির্ধারণ করেছি অথচ আমরা সেগুলো সম্পূর্ণরূপে ভুলেও গেছি। তবে স্রষ্টার জ্ঞানে তা সংরক্ষিত আছে।

 

অধিক অবগতি ও অধ্যয়নের জন্য নিম্নোক্ত গ্রন্থ ও উৎসসমূহ দ্রষ্টব্য

১. এক দল লেখক কর্তৃক সংকলিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশ্নাবলী ও সেগুলোর উত্তর (রমযান মাসের বিশেষ সংখ্যা), পৃ. ৬৫।

২. তাফসীরে নমুনা, খ. ৩০, সূরা ক্বদর-এর ব্যাখ্যা।

সমাপনী হাদীস

ইমাম রেজা (আ.) বলেন :

‘আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) তিনরাত ঘুমাতেন না : ২৩ রমযানের রাত, ঈদুল ফিতরের রজনী এবং ১৫ শাবানের রাত। এ রাতগুলোয় জীবিকাসমূহ বণ্টন, আয়ুষ্কাল নির্ধারণ এবং উক্ত বছরে যা কিছু সংঘটিত হবে তা ব্যক্ত করা হয়। [বিহারুল আনওয়ার, খ. ৯৭, পৃ. ৮৮]