বাংলায়ন: ড. আবু উসামা মুহাররম
পিতা-মাতাকে সম্মান করা দ্বীনের অন্যতম প্রধান বিধান। তাদেরকে সন্তুষ্ট করা সর্বোচ্চ আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ। তাদের বিরুদ্ধাচারণ করা ও তাদের অসন্তুষ্ট করা বড় গুনাহ। মহান আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,
وَ اِنۡ جَاهَدٰکَ عَلٰۤی اَنۡ تُشۡرِکَ بِیۡ مَا لَیۡسَ لَکَ بِهٖ عِلۡمٌ ۙ فَلَا تُطِعۡهُمَا وَ صَاحِبۡهُمَا فِی الدُّنۡیَا مَعۡرُوۡفًا ۫ وَّ اتَّبِعۡ سَبِیۡلَ مَنۡ اَنَابَ اِلَیَّ ۚ ثُمَّ اِلَیَّ مَرۡجِعُکُمۡ فَاُنَبِّئُکُمۡ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ
তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার অংশী করতে পীড়াপীড়ি করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের কথা মান্য করো না, তবে পৃথিবীতে তাদের সঙ্গে সদভাবে বসবাস কর এবং যে ব্যক্তি আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অবলম্বন কর, অতঃপর আমারই নিকট তোমাদের প্রত্যাবর্তন এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে অবহিত করব। (সুরা লুকমান, আয়াত:১৫)।
অর্থাৎ যদি পিতা-মাতা আল্লাহর অংশী স্থাপনে বাধ্য করার চেষ্টা করেন, তখন আল্লাহর নির্দেশ হল তাদের কথা না মানা। এমতাবস্থায় মানুষ স্বভাবতঃ সীমার মধ্যে স্থির থাকে না। এ নির্দেশ পালন করতে গিয়ে সন্তানের পক্ষে পিতা-মাতার প্রতি কটু বাক্য প্রয়োগ ও অশোভন আচরণ করে তাদেরকে অপমানিত করার সম্ভাবনা ছিল। ইসলাম তো ন্যায়নীতির জ্বলন্ত প্রতীক — প্রত্যেক বস্তুরই একটি সীমা আছে। তাই অংশীদার স্থাপনের বেলায় পিতা-মাতার অনুসরণ না করার নির্দেশের সাথে সাথে এ হুকুমও প্ৰদান করেছে যে, দ্বীনের বিরুদ্ধে তো তাদের কথা মানবে না, কিন্তু পার্থিব কাজকর্ম যথা শারীরিক সেবা-যত্ন বা ধন-সম্পদ ব্যয় ও অন্যান্য ক্ষেত্ৰে যেন কার্পণ্য প্রদর্শিত না হয়। তাদের প্রতি বেআদবী ও অশালীনতা প্রদর্শন করো না। তাদের কথাবার্তার এমনভাবে উত্তর দিবে না, যাতে অহেতুক মনোবেদনার উদ্রেক করে। মোটকথা, শিরক-কুফরীর ক্ষেত্রে তাদের কথা না মানার কারণে যে মর্মপীড়ার উদ্রেক হবে, তা তো অপারগতা হেতু বরদাশত করবে, কিন্তু প্রয়োজনকে তার সীমার মধ্যেই রাখতে হবে। অন্যান্য ব্যাপারে যেন মনোকষ্টের কারণ না ঘটে সে সম্পর্কে সচেতন থাকবে। [কুরতুবি, তাবারি, সা’দি]
একটি সহিহ হাদিসে বর্ণিত আছে যে, হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. বলেন,
عن معاذ قال: أوصاني رسول الله صلى الله عليه وسلم بعشر كلمات قال: ” لا تشرك بالله شيئا وإن قتلت وحرقت، ولا تعقن والديك، وإن أمراك أن تخرج من أهلك ومالك، ولا تتركن صلاة مكتوبة متعمدا؛ فإن من ترك صلاة مكتوبة متعمدا فقد برئت منه ذمة الله، ولا تشربن خمرا؛ فإنه رأس كل فاحشة، وإياك والمعصية؛ فإن بالمعصية حل سخط الله عز وجل، وإياك والفرار من الزحف وإن هلك الناس، وإذا أصاب الناس موتان وأنت فيهم فاثبت، وأنفق على عيالك من طولك، ولا ترفع عنهم عصاك أدبا وأخفهم في الله “
এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে এসে বলল, “আমাকে অসিয়ত করুন। নবি সা. বললেন, “আমি তোমাকে অসিয়ত করব। তুমি আল্লাহর সাথে শরিক করো না, এমনকি তারা তোমাকে আগুনে পুড়িয়ে দিলেও। যদি না তুমি জিহ্বা দিয়ে কিছু বল এবং তোমার হৃদয় আমাদের জন্য অটল থাকে, এবং আমি তোমাকে তোমার পিতা-মাতার আনুগত্য করতে এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিচ্ছি, তারা যেই হোক না কেন। জীবিত বা মৃত, এমনকি যদি তারা তোমাকে তোমার স্ত্রী এবং সম্পত্তি ছেড়েও যেতে বলে। এটি ঈমানের একটি।
অন্য হাদিসে উল্লেখ আছে যে, কেউ তাকে জিজ্ঞেস করল তার সন্তানের উপর পিতামাতার অধিকার কী? তখন তিনি বললেন, তাদের সামনে তাদের নাম বলা উচিত নয়। তাদের সামনে বুকফুলে হাঁটা উচিত নয়। পিতা বসার আগে বসা উচিত নয়। এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে লোকেরা তার বাবাকে অপমান করে।
হযরত জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন, তোমাদের কী বাধা দেয়, যে তোমাদের পিতা-মাতা জীবিত হোক বা মৃত, তাদের জন্য দোয়া করবে, তাদের জন্য হজ করবে তাদের জন্য রোজা রাখবে, তাদের সাথে সদাচরণ করবে? এতে তোমরাও ছওয়াব পাবে, তারাও ছওয়াব পাবে।
হাসান হাদিসে ইমাম হাসান (আ.) বলেন,
حَدَّثَنَا أَبُو عَاصِمٍ، عَنْ بَهْزِ بْنِ حَكِيمٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، مَنْ أَبَرُّ؟ قَالَ: أُمَّكَ، قُلْتُ: مَنْ أَبَرُّ؟ قَالَ: أُمَّكَ، قُلْتُ: مَنْ أَبَرُّ؟ قَالَ: أُمَّكَ، قُلْتُ: مَنْ أَبَرُّ؟ قَالَ: أَبَاكَ، ثُمَّ الأَقْرَبَ فَالأَقْرَبَ
হাকিম ইবনে হিযাম (রা.) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! সদ্ব্যবহার পেতে কে অগ্রগণ্য? তিনি বলেনঃ তোমার মা। আমি বললাম, তারপর কে? তিনি বলেনঃ তোমার মা। আমি বললাম, তারপর কে? তিনি বলেনঃ তোমার মা। আমি বললাম, তারপর কে? তিনি বলেনঃ তোমার পিতা, তারপর ক্রমান্বয়ে আত্মীয়ের সম্পর্কের নৈকট্যের ভিত্তিতে (দারিমি, তিরমিযি, হাকিম)।
অন্য হাদিসে তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে এসে বলল, “হে আল্লাহর রাসুল, আমি জিহাদে যেতে খুব আগ্রহী।” প্রতিউত্তরে তিনি বললেন, যদি তুমি আদতেই জিহাদে যাও তাহলে তোমার প্রতিদান আল্লাহর কাছে রয়েছে। যদি তুমি জীবিত ফিরে আসো, তুমি তোমার গুনাহ থেকে মুক্তি পাবে সেদিনের মত নিষ্পাপ হয়ে যেদিন তুমি তোমার মায়ের কাছ থেকে জন্ম নিয়েছিলে। লোকটি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমার বৃদ্ধ পিতা-মাতা আছেন যারা আমাকে ভালবাসেন এবং চান না যে আমি তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হই। রাসুল সা. উত্তরে বললেন, সেই আল্লাহর শপথ, যাঁর ক্ষমতায় আমার জীবন, তারা তোমার সাথে এক রাত ও একদিন কাটানো আল্লাহর পথে এক বছর যুদ্ধ করার চেয়ে উত্তম।
অন্য হাদিসে তিনি বলেন, এমন সময় আসে যখন একজন সৎকর্মপরায়নশীল ব্যক্তি তার জীবনে তার পিতা-মাতার প্রতি সদয় আচরণ করে না। তাদের মৃত্যুর পর সে তাদের ঋণ পরিশোধ করে না এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে না, তাই আল্লাহ তাকে পিতা ও মাতা অবাধ্য সন্তান হিসেবে নাম লিখে নেন। আবার এমন অনেকে আছেন,যারা জীবনে বাবা এবং মাকে পায়নি। কিন্তু যখন তারা মারা যায়, তিনি তাদের ঋণ পরিশোধ করেন এবং তাদের জন্য ক্ষমা চান, আল্লাহ তাদের একজন ভাল ব্যক্তি হিসাবে নাম লিখেন।
অন্য হাদিসে তিনি বলেন, তিনটি জিনিস আছে কোনোভাবেই আল্লাহ থেকে মুক্তি দেবেন না।
প্রথমত, ঋণ যারই হোক না কেন, সে ভালো মানুষ হোক বা খারাপ হোক।
দ্বিতীয়ত, প্রতিশ্রুতি পালন করা, তা ভালো ব্যক্তির সাথে হোক বা খারাপ ব্যক্তির সাথে।
তৃতীয়ত, পিতা-মাতার প্রতি সদয় হওয়া, তারা ভালো হোক বা খারাপ।
তথ্যসূত্র:
আল্লামা বাকের মাজলিসি, হিলয়াতুল মুত্তাকিন, পৃ. ১১৩।