ইমামের ৬ বছরের স্বল্পকালীন ইমামতকালটি তিনজন আব্বাসীয় খলিফার (মো’তায, মোহ্তাদী ও মো’তামেদ) শাসনামলে অতিবাহিত হয়।
আব্বাসীয় খলিফা মো’তায তার পূর্ব খলিফা তারই চাচাতো ভাই মোস্তাইন এর পর খেলাফতে অধিষ্ঠিত হয়। আর ইমাম হাদী (আ.) এই খলিফার শাসনামলেই শহীদ হন। বেশ কিছু সংখ্যক আলাভী বংশের লোকদেরকেও তারই শাসনামলে বিষ প্রয়োগে ও অন্যভাবে শহীদ করা হয়। খলিফা মো’তায একবার তার ভাই মুয়াইয়েদকে বন্দী করে এবং চল্লিশটি বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দেয়। ফলে মুয়াইয়েদ স্বেচ্ছায় যুবরাজের পদ থেকে ইস্তফা দান করে মুক্তি লাভ করে । কিন্তু পরে যখন জানতে পারলো যে তুর্কীদের কিছু অংশ মুয়াইয়েদের যুবরাজ পদের প্রতি বিশ্বস্ত। তখন তাকে হত্যার আদেশ দেয়। অতঃপর মুয়াইয়েদকে বিষ মাখানো কম্বল দিয়ে পেচিয়ে কাফনের কাপড়ের ন্যায় উভয় প্রান্ত বেঁধে রাখে । এভাবে তার মৃত্যু হলে দরবারী কিছু ফকীহ্ ও বিচারকদেরকে আমন্ত্রণ করে উক্ত মৃতদেহ পর্যবেক্ষণ করায় তাদের থেকে স্বীকারোক্তি নেয় যে, কোন প্রকার নির্যাতন ব্যতীতই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। (মোরুজুয যাহাব, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৯১-৯৫; তাতিম্মাতুল মুনতাহা, পৃ. ২৫৪)
মো’তাযের পর মোহ্তাদী খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হয়। সে মুনাফেকের মত ছদ্দবেশ ধারণ করে গোপনে অত্যাচার ও জুলুম করে কিন্তু প্রকাশ্যে সাধু মানুষের বেশে ইবাদত-বন্দেগীতে মগ্ন থেকে তার দরবার থেকে নর্তকীদের বিতাড়ন করে, পাপাচার নিষিদ্ধ করে, ন্যায়বিচারের ঘোষণা দেয় । অপরদিকে ইমাম আসকারী (আ.)-কে বন্দী করে। এমনকি ইমামকে হত্যার সিদ্ধান্তও নেয় কিন্তু মৃত্যু তাকে ফুরসত দিলো না। নিজেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। মোহ্তাদীর শাসনামলে বেশ কিছু আলাভী তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করেন। তারা এই অভ্যুত্থানে সফল হয় নি। তাদের কেউ কেউ বন্দী হয় এবং বন্দী দশাতেই মৃত্যু বরণ করে।
আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ বলেন : মোহ্তাদী যখন মাওয়ালীদের (অনারব মুসলমান) হত্যা করতে লাগলো, ইমাম আসকারী (আ.)-কে লিখলাম : “মহান আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি যিনি মোহ্তাদীর হাত থেকে আমাদের এখন পর্যন্ত রক্ষা করেছেন, আমার কাছে এই মর্মে খবর পৌঁছেছে যে, সে (মোহ্তাদী) আপনাকে হত্যার হুমকি প্রদান করে বলেছে -আল্লাহর কসম, আমি মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশধরকে দুনিয়ার মাটি থেকে সমূলে উৎপাটন করব।”
ইমাম সেই চিঠির জবাবে নিজ হাতে লিখেন : “কত সীমিত আয়ূ তার! মাত্র পাঁচ দিন পর অপমান ও লাঞ্ছনাসহ মৃত্যু বরণ করবে।”
ঠিক তাই ঘটলো যেমনটি ইমাম বলেছিলেন। (এরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ৩২)
এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভাল যে মোহ্তাদীও তুর্কী সৈন্যদের অভ্যুত্থানে নিহত হয়। মো’তামেদ তার স্থলাভিষিক্ত হয়। (তাতিম্মাতুল মুনতাহা, পৃ. ২৫৪-২৫৮)
মো’তামেদও তার পূর্ব পরুষদের ন্যায় ভোগবিলাসিতা ও জুলুম-নির্যাতন ব্যতীত কিছুই বুঝতো না। ভোগবিলাসিতায় এতই মগ্ন থাকতো যে, এই সুযোগে তার ভাই “মুয়াফ্ফাক” ধীরে ধীরে তার স্থলাভিষিক্তের পদ দখল করে দেশ শাসনের সার্বিক কাজ পরিচালনা করতে থাকে । মো’তামেদ পুতুলের ন্যায় নাম মাত্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে । মুয়াফ্ফাকের মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র মো’তাযেদ তার পিতার পদে অধিষ্ঠিত হয় । অবশেষে ২৭৯ হিজরীতে মো’তামেদের মৃত্যু হলে মো’তাযেদ নিয়মতান্ত্রিক ভাবে খেলাফতে অধিষ্ঠিত হয়। (তাতিম্মাতুল মুনতাহা, পৃ. ২৬৮; মুরুজুজ জাহাব, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৪০-১৪২)
মো’তামেদের শাসনামলেই ইমাম হাসান আসকারী (আ.) শহীদ হন। বেশ কিছু সংখ্যক আলাভীও তার হাতেই নিহত হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে নিকৃষ্টতম পন্থায় হত্যা করে। এমনকি হত্যার পর তাদের মৃতদেহ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে। (মুরুজুজ জাহাব, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২০)
কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, মো’তামেদের শাসনামলে যথেষ্ট যুদ্ধ বিগ্রহ হয় যাতে প্রায় ৫ লক্ষ লোক নিহত হয়। (এরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ৩২৪; মাহজুদ্দাওয়াত, সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, পৃ. ২৭৪, বিহারুল আনওয়ার, ৫০তম খণ্ড, পৃ. ৩৩০)
যা হোক, জনগণের দৃষ্টি সর্বদাই ইমামদের দিকে ছিল। তারা এও বুঝতে পারতো যে, জালিম খলিফাদের সাথে ইমামদের আপোষহীনতার ফলেই ইমামগণ তাদের রোষানল ও কঠোর নির্যাতনের শিকার হতেন । ইমাম আসকারী (আ.)ও তার পূর্ব পুরুষদের ন্যায় শাসকদের নির্যাতন ও নিয়ন্ত্রণের শিকার হন। ইমাম এশবার মোহ্তাদীর শাসনামলে সালেহ্ ইবনে ওয়াসিফের কারাগারে বন্দী হয়েছিলেন। খলিফা ইমামকে নির্যাতন করার জন্য দু’জন দুষ্কৃতকারী ব্যক্তিকে নিয়োজিত করে। কিন্তু ঐ দু’জন লোক ইমামের ইবাদতে আকৃষ্ট হয়ে নির্যাতন করা থেকে বিরত থাকে।
খলিফা আরও একবার ইমামকে নাহরীরের (মোহ্তাদীর জনৈক কর্মচারী) কারাগারে বন্দী করে । কারাগারের প্রহরী ইমামের প্রতি রূঢ় আচরণ করে। নাহরীরের স্ত্রী প্রহরীকে বললেন, “আল্লাহকে ভয় কর, তুমি জানো না, কতবড় মহান ব্যক্তি তোমার কারাগারে অবস্থান করছেন”অতঃপর ইমামের ইবাদত ও গুণাবলীর কথা বর্ণনা করে বললেন, “আমার ভয় হয় ইমামের প্রতি তুমি যে অত্যাচার করছো তোমাকেই তার ফল ভোগ করতে হবে।” (এরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ৩২৪-৩২৫)
মো’তামেদ নিজেও তার শাসনামলে ইমাম আসকারী (আ.) ও তার ভ্রাতা জাফর (জাফর কাজ্জাব)-কে আলী জারীনের কারাগারে বন্দী করে নিয়মিত ইমামের অবস্থার খবরা খবর রাখতো। সংবাদদাতাগণ তাকে জানাতো যে, ইমাম সারাদিন রোজা রাখে ও সারারাত নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকেন।
কয়েকদিন পর আবার যখন ইমামের সম্পর্কে জানতে চাইলো আলী জারীন তার কাছে পূর্বে দেয়া সংবাদেরই পুনারাবৃত্তি করেন। খলিফা একথা শুনে আলী জারীনকে আদেশ করলো : এখনই ইমামের কাছে গিয়ে আমার সালাম জানিয়ে তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে তার বাড়ীতে পৌঁছে দাও।
আলী জারীন বলল : কারাগারে গিয়ে দেখলাম … ইমাম পোশাক পরে রওয়ানা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন । তিনি আমাকে দেখা মাত্রই উঠে দাঁড়ালেন। তাকে খলিফার দেয়া নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত করলাম । ইমাম বাহনে আরোহণ করলেন কিন্তু রওয়ানা হলেন না; এর কারন জিজ্ঞেস করলাম।
বললেন : যতক্ষণ জাফর না আসবে, আমি যাব না।
বললাম : খলিফা শুধুমাত্র আপনাকেই মুক্ত করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। জাফরের ব্যাপারে কোন কথা বলেন নি।
বললেন : তোমার খলিফার কাছে গিয়ে বল, “আমরা দু’জন একই পরিবার থেকে এসেছি, যদি তাকে না নিয়ে একা ফিরে যাই তাহলে এ রহস্য তার কাছে লুকিয়ে থাকবে না।
আলী জারীন খলিফার কাছে গেল এবং ফিরে এসে বলল : খলিফা জাফরকে আপনার সম্মানে মুক্তি দিয়েছেন। তিনি জাফরকে তার ও আপনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং খেয়ানতের কারণেই বন্দী করেছিলেন।
অতঃপর জাফর মুক্তি পেল এবং ইমামের সাথেই বাড়ী ফিরলো। (মাহ্জুদ্দাওয়াত, সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, পৃ. ২৭৫)
এতক্ষণ খলিফাদের শাসনামলের অবস্থা ও ইমামের সাথে খলিফাদের আচরণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হলো। তাতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ইমাম আসকারী (আ.) এক শাসরুদ্ধকর ও কঠিন পরিবেশে জীবন-যাপন করতেন। খলিফাগণ ইমামের প্রতি সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতো, তাকে একাধিকবার বন্দীও করেছে। ইতিহাস এভাবে সাক্ষী দেয় : যখন ইমাম বন্দী দশা থেকে মুক্ত থাকতেন তখনও ইমামের গতিবিধি তাদের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। ইমামের অনুসারী, সমর্থক ও বন্ধুমহল সহজভাবে তার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারতেন না। কিছু শিয়াগণ আলাভীদের সহযোগিতায় ইমামের বাড়ীর সন্ধান নিতেন। “কাশফুল গুম্মাহ্” নামক গ্রন্থে পাওয়া যায় :
এক আলাভী জীবন ধারণের উদ্দেশ্যে সামাররা থেকে জাবাল (পশ্চিম ইরানের পাহাড়ী এলাকা থেকে হামাদান ও কাযভীন পর্যন্ত অঞ্চল) শহরে চলে যায়। হালওয়ান গোত্রের এক লোক তার সাক্ষাত লাভ করে জিজ্ঞেস করলো :
কোথা থেকে এসেছো?
বলল : সামররা।
জিজ্ঞেস করলো : অমুক এলাকার অমুক গলি কোথায় বলতে পারো ?
বলল : হ্যাঁ।
জিজ্ঞেস করলো : হাসান ইবনে আলী (আ.)-এর সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে?
বলল : না।
জিজ্ঞেস করলো : কি কারণে জাবালে এসেছো ?
বলল : জীবন ধারণের জন্য।
হালওয়ানী বলল : আমার কাছে ৫০ দিনার আছে তা তোমাকে দিচ্ছি, তার বিনিময়ে আমাকে সামররায় হাসান আসকারী (আ.)-এর বাড়ীতে পৌঁছে দাও।
আলাভী বংশের লোকটি প্রস্তাবটি মেনে নিয়ে তাকে ইমামের বাড়ীতে পৌঁছে দিলো। (কাশফুল গুম্মাহ্, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩০৭)
এ ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বন্দী দশার বাইরে ইমামের জীবন-যাপন কেমন ছিল এবং এই মহান ব্যক্তি কতটা সীমাবদ্ধতা ও সতর্ক দৃষ্টির মধ্যে অবস্থান করতেন। যে অবস্থায় ইমামের সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখা মোটেই সহজ ছিল না। অনেক চেষ্টা তদবীর করে ইমামের সাক্ষাত লাভ সম্ভব হতো। এমনকি আলাভীগণ এবং তাঁর নিকট আত্মীয়-স্বজনও তাঁর সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ রাখতে পারতেন না।