নূর হোসেন মজিদী
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর যুগ থেকে শুরু করে এ ব্যাপারে যে সর্বসম্মত মত (ইজমা) চলে এসেছে তা হচ্ছে, কোরআন মজীদে আহলে বাইত বলতে হযরত ফাতেমাহ্, হযরত আলী, হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন (আ.)-কে বুঝানো হয়েছে তেমনি আলে মুহাম্মাদ (সা.) বলতেও তাঁদেরকে বুঝানো হয়েছে। এ বিষয়ের সমর্থনে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত প্রচুর হাদীছ রয়েছে।
বর্ণনাসূত্রের বিচারে এ বিষয়ক হাদীছগুলো মুতাওয়াতির কিনা সে বিষয়ে পর্যালোচনায় না গিয়েও আমরা বলতে পারি যে,
প্রথমতঃ এ সব হাদীছের বিষয়বস্তু ইসলামের চারটি অকাট্য জ্ঞানসূত্রের কোনোটির সাথেই সাংঘর্ষিক নয়।
দ্বিতীয়তঃ সংশ্লিষ্ট আয়াত নাযিলকালে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর পুত্রসন্তান না থাকা ও কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে তাঁর বিবিগণ মা‘ছূম না হওয়া তথা আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ক হাদীছগুলো গ্রহণ করা ছাড়া সংশ্লিষ্ট আয়াতাংশের প্রায়োগিকতা থাকে না। কারণ, সে ক্ষেত্রে আদৌ তাঁর কোনো আহলে বাইত থাকে না এবং সংশ্লিষ্ট আয়াতাংশ অর্থহীন হয়ে যায়, যে ধরনের উক্তি থেকে চির জ্ঞানময় সর্বজ্ঞাতা আল্লাহ্ তা‘আলা পরম প্রমুক্ত।
অধিকন্তু আয়াতে মুবাহিলা (সূরা আলে ইমরান: ৬১) অনুযায়ী হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) যে আমল করেন তদ্সংক্রান্ত যে তথ্যের ওপরে উম্মাহর মধ্যে ইজমা‘ রয়েছে তা থেকেও উক্ত চারজন মহান ব্যক্তিত্বের আহলে বাইত বা আলে মুহাম্মাদ (সা.) হওয়ার ব্যাপারে অকাট্য সমর্থন পাওয়া যায়।
নাজরানের খৃস্টান ধর্ম নেতাদের কাছে ইসলামের সত্য দ্বীন ও হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর সত্যিকারের পয়গাম্বর হওয়ার বিষয়টি অকাট্যভাবে সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তারা ইসলাম ও হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিরোধিতার ব্যাপারে, বিশেষ করে হযরত ‘ঈসা (আ.)-এর ব্যাপারে একগুঁয়েমি করতে থাকলে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে লা‘নতের চ্যালেঞ্জ দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা.)কে নির্দেশ দেন; এরশাদ করেন:
“(হে রাসূল!) আপনার কাছে প্রকৃত জ্ঞান এসে যাওয়ার পরেও যে আপনার সাথে এ ব্যাপারে (‘ঈসার ব্যাপারে) বিতর্ক করে তাকে বলুন: এসো আমরা ডেকে নেই আমাদের পুত্রদেরকে ও তোমাদের পুত্রদেরকে, আমাদের নারীদেরকে ও তোমাদের নারীদেরকে এবং আমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদের নিজেদেরকে, অতঃপর আমরা প্রার্থনা করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহ্র লা‘নত করি।” (সূরা আলে ইমরান ৬১)
ইসলামের সকল মাযহাব ও ফিক্বাহ সূত্রে বর্ণিত হাদীছ সমূহের ভিত্তিতে সমগ্র উম্মাহর কাছে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত তথ্য অনুযায়ী হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) হযরত ফাতেমা, হযরত আলী, হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন (আ.)-কে স্বীয় চাদর বা ‘আবা-র নীচে নিয়ে নাজরানের খৃস্টানদের সাথে মুবাহালা করতে যান এবং এ সময় আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে যে দো‘আ করেন তাতে তাঁদেরকে “এরাই আমার আহলে বাইত” বলে উল্লেখ করেন। এ সংক্রান্ত হাদীছগুলোরও বিষয়বস্তু এমন যা ইসলামের অকাট্য জ্ঞানসূত্র সমূহের কোনোটির সাথেই সাংঘর্ষিক নয় এবং এ ব্যাপারে এতদ্ব্যতীত অন্য কোনো বর্ণনা নেই। এমতাবস্থায় এটিকে গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নেই। নচেৎ ধরে নিতে হয় যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এ আয়াত অনুযায়ী আমল করেন নি যে ধারণা নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যানযোগ্য।
লক্ষণীয় যে, সংশ্লিষ্ট আয়াত অনুযায়ী হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর জন্য তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোকে নিয়ে মুবাহিলা করতে যাওয়া অপরিহার্য ছিলো। এ আয়াতে উভয় পক্ষে মুবাাহালায় অংশগ্রহণকারীকে তিন ধরনের লোকদেরকে নিয়ে এতে অংশগ্রহণ করতে বলা হয়, তা হচ্ছে: انفسنا (আমরা নিজেরা), ابنئنا (আমাদের পুত্রগণ/ বংশধর পুরুষগণ) ও نسائنا (আমাদের নারীগণ/ স্ত্রী-কন্যাগণ)। এ আয়াতে প্রদত্ত নির্দেশের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যাদেরকে নিয়ে মুবাহিলা করতে গেলেন সুস্পষ্ট যে, তাঁদের মধ্য থেকে হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন (আ.)কে ابنئنا (আমাদের পুত্রগণ/ পুরুষ বংশধরগণ) হিসেবে, হযরত ফাতেমা (সা.আ.)কে نسائنا (আমাদের নারীগণ অর্থাৎ প্রিয়তম নারীগণ) ও হযরত আলী (আ.)কে انفسنا (আমরা নিজেরা) হিসেবে সাথে নিয়ে যান। অর্থাৎ তিনি তাঁর পুরো আহলে বাইতকে সাথে নিয়ে যান।
এখানে আরো গভীরভাবে তলিয়ে চিন্তা করার বিষয় হচ্ছে এই যে, মুবাহালার আয়াতে যাদেরকে সাথে নিয়ে মুবাাহালাহ করার নির্দেশ দেয়া হয় তাঁদের সম্পর্কে আভিধানিক অর্থ গ্রহণ করা হলে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য কন্যাকে নয়, বরং তাঁর স্ত্রীগণকে সাথে নিতে হতো, অথবা কন্যার সাথে সাথে স্ত্রীগণকেও সাথে নিতে হতো। অবশ্য জীবিত পুত্রসন্তান না থাকা অবস্থায় নাতিদ্বয়কে নিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতা থাকলেও আভিধানিক তাৎপর্যের দৃষ্টিতে জামাতাকে সাথে নেয়ার বিষয়টি এর আওতায় আসে না। কিন্তু যেহেতু মুবাাহালা ক্ষেত্রে রক্ত বা বৈবাহিক সম্পর্কের নিকটতম ব্যক্তিদেরকে সাথে নেয়ার যৌক্তিকতা ছিলো না এবং প্রতিপক্ষও তা দাবী করতো না, বরং দু’টি আদর্শিক পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নেতার জন্য আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে যারা তাঁর নিকটতম ও পরবর্তী উত্তরাধিকারী তথা নেতার সাথে যারা ধ্বংস হয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট আদর্শের চিরবিলুপ্তি ঘটবে তাঁদেরকে সাথে নিয়েই মুবাহিলা করা অপরিহার্য ছিলো।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ইসলামের সকল মত-পথের সূত্রে বর্ণিত হাদীছ-ভিত্তিক সর্বসম্মত মত অনুযায়ী হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) হযরত আলী (আ.)-এর সাথে তাঁর সম্পর্ককে হযরত মূসা ও হযরত হারূন (আ.)-এর সম্পর্কের অনুরূপ বলে উল্লেখ করেছেন। এর মানে হচ্ছে, হযরত হারূন (আ.) যেরূপ হযরত মূসা (আ.)-এর আদর্শিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন, ঠিক সেভাবেই হযরত আলী (আ.) হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর আদর্শিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। এমতাবস্থায় তাঁকে সাথে নিয়ে না গেলে মুবাহিলা অসম্পূর্ণ থাকতো। সম্ভবতঃ প্রতিপক্ষও এ বিষয়টি অবগত ছিলো এবং এ কারণে তাঁকে সাথে নিয়ে না গেলে তা প্রতিপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতো না।
অনুরূপভাবে বুঝা যায়, হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) জানতেন যে, তিনি তাঁর স্ত্রীদেরকে “আমাদের নারীগণ” হিসেবে তথা আহলে বাইতের নারী সদস্য হিসেবে সাথে না নেয়ায় প্রতিপক্ষের কাছ থেকে প্রতিবাদের আশঙ্কা ছিলো না অর্থাৎ প্রতিপক্ষও জানতো যে, তাঁর স্ত্রীগণ আদর্শিক-পারিভাষিক দিক থেকে তাঁর আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।
এ থেকে আরো প্রমাণিত হয় যে, পারিভাষিক অর্থে কোনো নবী বা রাসূলের আহলে বাইত বা আলে রাসূলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য অভিধানিক অর্থে পরিবারের সদস্য বা বংশধর হওয়া অপরিহার্য নয়, বরং এর বাইরে থেকেও অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। অর্থাৎ পারিভাষিক অর্থে একজন নবী বা রাসূলের আহলে বাইত বা আলে রাসূলের অন্তর্ভুক্ত তাঁরাই যারা তাঁর আদর্শিক সত্তার অংশ এবং তাঁর আদর্শিক উত্তরাধিকারী। হযরত মূসা (আ.) ও হযরত হারূন (আ.) এবং হযরত মূসা ও হযরত ইউশা‘ বিন্ নূন্ (আ.)-এর মধ্যে যে সম্পর্ক ছিলো তা এ ধরনেরই এবং এ কারণেই হযরত ইউশা‘ বিন্ নূন্ (আ.) হযরত মূসা (আ.)-এর পুত্র না হওয়া সত্ত্বেও তাঁর আদর্শিক নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। একই কারণে হযরত আলী (আ.) হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর পুত্র না হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে আহলে বাইত (আ.)-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।