এস, এ, এ
إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَن يَشَاء وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
আপনি যাকে পছন্দ করেন, তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না, তবে আল্লাহ তা’আলাই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন। কে সৎপথে আসবে, সে সম্পর্কে তিনিই ভাল জানেন। [ সুরা কাসাস ২৮:৫৬ ]
আবু তালিবকে কাফির প্রমাণিত করার ঘটনার পিছনে আলী (আ.)-এর সাথে চরম শত্রুতার সাক্ষ্য বহন করে। বণি উমাইয়ারা চাইতো যেকোন ভাবে হযতে আলী (আ.)-এর ফযিলতকে হ্রাস করতে এবং তারা আলী (আ.)-এর পিতাকে যিনি একজন উৎসর্গকারী ছিলেন তাকেও কাফের প্রমাণ করতে যথেষ্ট অপচেষ্টা চালিয়েছে। নিঃসন্দেহে এই কাজটি ছিল বণি উমাইয়াদের এবং তারা নিজেদের খেলাফতকালে আবু তালিবকে কাফের প্রমাণিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে এবং ভিত্তি হীন প্রমাণ উপস্থাপনের অপচেষ্টা চালিয়েছে যেমন:
১. [إِنَّكَ لا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ …] উক্ত আয়াতটি কোনভাবেই আবু তালিবের সাথে সম্পৃক্ত না। কেননা পূর্ববর্তি আয়াতটি
وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ وَقَالُوا لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَا نَبْتَغِي الْجَاهِلِينَ
তারা যখন অবাঞ্চিত বাজে কথাবার্তা শ্রবণ করে, তখন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, আমাদের জন্যে আমাদের কাজ এবং তোমাদের জন্যে তোমাদের কাজ। তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা অজ্ঞদের সাথে জড়িত হতে চাই না। [ সুরা কাসাস ২৮:৫৫ ]
আহলে কিতাবের কিছু মুমিনদের সাথে মক্কার মুশরিকদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।
মজার বিষয় হচ্ছে, আবু তালিব সম্পর্কে আয়াত নাযিল হওয়ার বিষয়ে ফখর আল-রাজি নিজেই তথাকথিত মুসলিম sensকমত্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে আয়াতের উপস্থিতি আবু তালিবের কুফরীর সামান্যতম ইঙ্গিত নয়। (তাফসীরে ফাখরে রাযি, খন্ড ২৫, পৃষ্ঠা ৩)
তবে কেন তারা এটিকে আবু তালিবের শিরকতার সাথে যুক্ত করার জন্য জোর দিয়েছিল তা সত্যই ভীতিজনক।
২. আবু তালিবের ঈমান সম্পর্কিত মুসলমানদের ইজমা হচ্ছে যে, আবু তালিব কাফির অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। যদিও এই জাতীয় মিথ্যা দাবী সম্পর্কে বিখ্যাত সুন্নি ভাষ্যকার আলুসি রুহ আল-মা’আনি বলেছেন, এটি কথাটি ঠিক না। কেননা অনেক মুফাসসির এবং শিয়া আলেমগণের মত অনুযায়ি আবু তালিব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া আহলে বাইত (আ.)-এর ইমামগণের ইজমা এটা প্রমাণ করে যে তিনি ঈমানদার ছিলেন। কারণ তাঁর কবিতা তাঁর ঈমানের সাক্ষ্য বহণ করে। (রুহুল মাআনি, খন্ড ২০, পৃষ্ঠা ৮৪)
৩. যে রেওয়ায়েতগুলোতে আবু তালিবের ঈমান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ভুল কেননা লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এই দাবিটি যার কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই, এবং এই বর্ণনাগুলির নথিতে এমন ব্যক্তিগণ রয়েছে যারা সন্দেহজনক বা মিথ্যাবাদী বলে প্রমাণিত।
ইবনে মারদাভিয়া নিজ সনদে উল্লেখ করেছেন: ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন [إِنَّكَ لا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ] রাসুল (সা.) আবু তালিবকে বারবার বলতে থাকে যে, হে চাচা ঈমানি নিয়ে আনুন। কিন্তু তিনি ঈমান আনেন নি। (দুররে মানসুর, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৩৩)
উল্লেখিত রেওয়ায়েতটি আবু সাহল সেররী বর্ণনা করেছেন। ইলমে রেজালের বিজ্ঞ আলেমগণ তাকে একজন মিথ্যাবাদি, জাল হাদীস বর্ণনাকারী এবং চোর বলে আখ্যায়িত করেছেন।
অনুরূপভাবে আব্দুল কুদ্দুস আবি সাঈদ দামেশকি ছিল এই রেওয়ায়েত বর্ণনাকারী সেও একজন মিথ্যাবাদি ছিল। (গ্বাদীর, হাদীস, খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ২০)
উল্লেখিত হাদীস থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, ইবনে আব্বাস এই হাদীসটি কোন মাধ্যম ব্যাতিতই এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যেন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং বিষয়টি স্বচক্ষে অবলোকন করেছেন। যদিও ইবনে আব্বাস হিজরতের তিন বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর আবু তালিব মৃত্যুবরণ করেন হিজরতের ৩ বছর পূর্বে [নবুওয়াত ঘোষণার ১০ম বর্ষে, ৭ই রমজান] সুতরাং আবু তালিবের মৃত্যুর সময় তিনি তাঁর মায়ের বুকের দুধ খেতেন! এটা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে হাদীস বর্ণনাকারী এই ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ ছিলেন।
অপর হাদীসটি আবু হুরাইরা বর্ণনা করেছন: হে চাচা বলুন (لا اله الا اللَّه) কেয়ামতের দিন আমি আল্লাহর নিকট আপনার পক্ষে সাক্ষি দিব। কিন্তু আবু তালিব বলেন: আমি কুরাইশের ভয়ে আমার ঈমানের বহিঃপ্রকাশ করিনি, তানাহলে তোমাকে অপমানিত হতে হতো না। তখন এই আয়াতটি নাযিল হয়। (দুররে মানসুর, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৩৩)
আবু হুরাইরার বর্ণিত এই হাদীস থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে , আবু হুরাইরা আবু তালিবের এই বিষয়টিকে স্বচক্ষে দেখেছেন। যদিও আমরা জানি যে, তিনি খায়বার বিজয়ের পরে ঈমান নিয়ে আসেন অর্থাৎ হিজরতের সাত বছর পরে। অথচ আবু তালিব হিজরতের পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সুতরাং প্রমাণিত হয় যে, এই হাদীসটিও মিথ্যা ও জাল।
আর যদি কথা উঠে যে ইবনে আব্বাস এবং আবু হুরায়রা নিজে দেখেননি বরং অপরের কাছ থেকে শুনেছেন। তাহলেও প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাহলে তারা কার কাছ থেকে শুনেছেন। কেন তারা তাদের নামকে উল্লেখ করেননি।
ধিরে ধিরে তারা নিজেদের গ্রন্থসমূহে হাদীসটি বর্ণনা করে নিজেদের মধ্যে ইজমা তৈরি করেছে। এটা কেমন ইজমা, হাদীসটি কি বিশ্বাসযোগ্য?
৪. আবু তালিবের ঈমান ছিল আসহাবে কাহফের ন্যায় অর্থাৎ অন্তরে ঈমান ছিল কিন্তু তিনি কখনও মুখে প্রকাশ করেননি। (তাফসীরে নমুনা, খন্ড ১৬, পৃষ্ঠা ১২৫)
৫. তাফসীর নমুনা-এর ৫ম খন্ডে পৃষ্ঠা ১৯৪ তে সুরা আনআমের ২৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় এই সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
৬. আবু তালিব যে বছরে ইন্তেকাল করেন সেই বছরকে রাসুল (সা.) “আমুল হুযন” বলে আখ্যায়িত করেন। রাসুল (সা.)এর নামকরণ থেকে স্পষ্ট হয় যে, তিনি কতটা আবু তালিবকে ভালবাসতেন। আর একজন নবী কখনও এজন কাফেরকে ভালবাসতে পারে না।
আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের সকলকে সঠিকভাবে দ্বীনকে জানার তৌফিক দান করেন। আমীন।