Press "Enter" to skip to content

আবু হামযা সোমালি কে ছিলেন?

এস, এ, এ

জন্ম:

সাবিত বিন আবি সাফিয়া ওরফে আবু হামযা সোমালি, আবি সাফিয়া’র (সাবিতের পিতা) নাম ছিল দিনার। সুতরাং সাবিত বিন দিনার ছিলেন আবু হামযা সোমালি।

সাবিত বিন দিনার ওরফে আবু হামযা সোমালি’র সঠিক জন্ম তারিখ ইতিহাসে বণিত হয় নি; তবে যাযানে কেন্দি’র বর্ণনা অনুযায়ি তিনি ৮২ হিজরীর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

আবু হামযা সোমালি কুফাবাসী ছিলেন। আলে মুহাল্লাব তাঁকে নিজেদের গোত্রের লোক বলে মনে করতেন। কিন্তু নাজ্জাসী তার এই দাবীকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং তাকে বানু সোয়াল বা সাআল গোত্রের লোক বলে মনে করতো। সোমালা গোত্রের এলাকায় বসবাসের কারণে তিনি আবু হামযা সোমালি উপাধির অধিকারী হন।

যায়দ বিন আলী’র সাথে আবু হামযা সোমালির সুসম্পর্ক ছিল। তিনি কুফাতে যায়দ বিন আলী’র দাওয়াত এবং শাহাদতের ঘটনাকে অবলোকন করেছিলেন।

আবু হামযা সোমালি’র তিনজন সন্তান যথাক্রমে: হামযা, নূহ এবং মানসুর, যায়দ বিন আলী’র বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে শাহাদতের সুধা পান করেন।

মাসুম ইমাম (আ.)র সান্নিধ্য অর্জন:

সাবিত বিন দিনার ওরফে আবু হামযা সোমালি চারজন ইমাম (আ.)’র (ইমাম সাজ্জাদ, বাকির, সাদিক্ব এবং কাযিম (আ.)) সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন এবং তিনি উক্ত ইমাম (আ.)গণ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি মাসুম ইমামগণের নিকটে বিশ্বস্ত এবং সেক্বা ছিলেন।

ইমাম (আ.)গণের দৃষ্টিতে আবু হামযা সোমালি:

আবু হামযা সোমালি’র ফযিলত সম্পর্কে ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) বলেছেন: আবু হামযা হচ্ছে এই যুগের সালমান ফার্সি।

ইমাম রেযা (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, সাবিত বিন দিনার ওরফে আবু হামযা সোমালি হচ্ছে এই যুগের লোকমান।

নাজ্জাসি বলেন: আবু হামযা ইমামগণের একজন বিশ্বস্ত সাহাবী ছিলেন যার বর্ণিত রেওয়ায়েত গ্রহণযোগ্য।

শেখ সাদুক্ব বলেছেন: আবু হামযা সোমালি একজন বিশ্বস্ত এবং আমানতদার ব্যাক্তিত্ব ছিলেন এবং তিনি চারজন ইমামের সান্নিধ্য অর্জন করেছিলেন।

আবু হামযা’র মর্যাদার কথা প্রকাশ করতে গিয়ে নাজ্জাসী তাঁর কারামতের কথা এভাবে উল্লেখ করেছিলেন যে, আবু হামযা ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র কাছ থেকে একটি দোয়া শিখেছিলেন। একবার তার সন্তানের হাত ভেঙ্গে গেলে সে উক্ত দোয়াটি পড়ে ফুঁ দিলে তার সন্তানের হাত ভাল হয়ে যায়। ইয়াহিয়া বিন আব্দুল্লাহ সেই যুগের হাড় জোড়া লাগাতো সেও বুঝতে পারছিল না আবু হামযা সোমালি’র সন্তানের কোন হাতটা ভেঙ্গে ছিল।

ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.)র ভবিষ্যতবাণী:

ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) আবু হামযাকে বলেন: আমি যখন তোমাকে দেখি তখন প্রশান্তি অনুভব করি।

আবু বাসির বলেন: ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) আমাকে জিজ্ঞাসা করেন: আবু হামযা কেমন আছে? আমি বলি: আমি যখন তার কাছ থেকে আসি তখন সে অসুস্থ ছিল। ইমাম (আ.) বলেন: আবার যখন তুমি তার কাছে যাবে তখন আমার সালাম তাকে পৌঁছে দিও এবং তাকে বলো যে, সে অমুক মাসে অমুক দিনে মারা যাবে।

আমি ইমাম (আ.)কে বলি: আল্লাহর শপথ সে আপনার একান্ত অনুসারী এবং আপনিও তাকে ভালবাসেন।

ইমাম (আ.) বলেন: তুমি সত্য কথা বলেছ, আমাদের কাছে যা রয়েছে তার জন্য মঙ্গলজনক।

আমি জিজ্ঞাসা করি: কি আপনার অনুসারীরা আপনার সাথে থাকবে?

ইমাম (আ.) বলেন: হ্যাঁ। তবে শর্ত হচ্ছে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে, রাসুল (সা.)’র প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, পার্থিব জীবন এবং স্বীয় আমলের প্রতি যেন সতর্ক থাকে, গুনাহ থেকে বিরত থাকে তাহলেই আমাদের অনুসারীরা আমাদের সাথে থাকবে।

কিছু দিন অতিবাহিত না হতেই আবু হামযা ইহলোক ত্যাগ করেন।

আহলে সুন্নাতের হাদীসবেত্তাগণের দৃষ্টিতে:

তিনি ঐ যুগে এতোটাই প্রসিদ্ধ ছিলেন যে, আহলে সুন্নাতের হাদীসবেত্তাগণ তাঁর থেকে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন। এছাড়া আবু হামযা এবং তাঁর পরিবার জ্ঞানী পন্ডিতগণের নিকট সেক্বা স্বরূপ ছিলেন।

যদিও খেলাফতের পৌষ্য দরবারী আলিমগন তাকে রাফেযি এবং গ্বালি (অতি রঞ্জিতকারী) বলে মনে করতো। তারপরেও ইবনে কাসীর, তিরমিযি, ইবনে মাজা খতিবে বাগ্বদাদী আবু হামযা হতে বর্ণিত রেওয়ায়েতকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করতেন। এছাড়া সাআলাবী, তাবারী, ইবনে কাসীর, কুরতুবি, সিয়্যুতি, আবু হাইয়ান, হাকেমে নিশাবুরি, আবুল ফারাজ ইস্ফাহানী এবং ইসহাক্ব আবু হামযা সোমালি হতে বর্ণিত রেওয়ায়েতকে সহীহ বলে মনে করেতেন এবং তাদের তাফসীর গ্রন্থসমূহে তা উল্লেখ করতেন।

আহলে সুন্নাতের তাফসীরবিদ এবং হাদীস বিশারদ হাকিমে নিশাবুরি তার মুস্তাদরাক নামক গ্রন্থে আবু হামযা হতে বর্ণিত হাদীসসমূহকে বুখারী ও মুসলিমের ন্যায় সহীহ বলে মনে করতেন।

আবু হামযা সোমালির বৈধতা:

যদিও আহলে সুন্নাত শিয়া রাভিদের থেকে হাদীস বর্ণনা করে না বললেই চলে, আর যদি কেউ এই মাযহাবের বিশেষ মনোযোগের কারণ হয় তাহলে আর কিছু বলার অবকাশ রাখে না, কিন্তু আবু হামযা সোমালি ছিলেন এমন এক ব্যাক্তিত্ব যার বর্ণিত রেওয়ায়েত আহলে সুন্নাতের অনেক হাদীস গ্রন্থে পরিলক্ষিত হয় যেমন: ইবনে আসাকের তার গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে আবু হামযা হতে বর্ণিত রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন, ইবনে কাসির তার বিভিন্ন রেওয়ায়েতে আবু হামযার হতে বর্ণিত সনদের ব্যাবহার করেছেন, আবুল ফারাজে ইস্ফাহানী তার ‘আল আগ্বানী’ নামক গ্রন্থে আবু হামযা হতে অনেক রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন। শিয়া রেজাল শাস্ত্রবীদদের কাছেও আবু হামযা সোমালি’র অনেক সুনাম রয়েছে এবং নাজ্জাশি তাকে বিশ্বস্ত মানুষ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

আবু হামযা সোমালির রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে:

১. তাফসীরে কোরআন।

২. কিতাবে নাওয়াদুর।

৩. কিতাবুয যাহিদ।

৪. রেসালে হুকুক্বে ইমাম সাজ্জাদ।

৫. দোয়া আবু হাযা সোমালি। শেখ তুসী তার মেসবাহুল মোতাহাজজেদ নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। আবু হাযা সোমালি এই দোয়াটি ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) থেকে শিখেছিলেন। দোয়াটি সেহেরীর সময় পড়া মুস্তাহাব।

৬. মুসনাদে আবু হামযা।

রেজাল শাস্ত্রবীদদের দৃষ্টিতে আবু হামযা সোমালি:

ইয়াকুবির দৃষ্টিতে আবু হামযা সোমালি কুফার একজন ফক্বিহ ছিলেন, কাশশি এবং নাজ্জাসী তাঁর থেকে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন। হাকিম নিশাবুর তার ‘মুসতাদরাকুল সাহীহাইন’ নামক গ্রন্থে আবু হামযা সোমালি থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তা সহীহ বলে দাবী করেছেন, এছাড়া ফাযল বিন সাযান তাঁর থেকে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছন। যদিও আহলে সুন্নাত তার বর্ণিত হাদীসগুলোকে দূর্বল বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে।

তার লিখা কোরআনের তাফসীর ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল তারপরে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

বিভিন্ন ব্যাক্তিত্বগণ তাঁর বর্ণিত হাদীস ও রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন যেমন:

১. নাজ্জাসী (পঞ্চম শতাব্দী)

২. আবু ইসহাক্ব, আহমাদ বিন মুহাম্মাদ সাআলাবী (পঞ্চম শতাব্দী)

৩. ইবনে নাদীম (পঞ্চম শতাব্দী)

৪. ফুরাতে কুফি (পঞ্চম শতাব্দী)

৫. সাআলাবী (পঞ্চম শতাব্দী)

৬. আবু জাফর, মুহাম্মাদ বিন আলী বিন শাহর আশুব (ষষ্ঠ হিজরী)

৭. শাহরিস্তানী তার “মাফাতিহুল আসরার এবং মাসবিহুল আবরার” নামক গ্রন্থে তাঁর থেকে হাদীস ও রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন। (ষষ্ঠ হিজরী)

৮. তাবারসী তার মাজমাউল বায়ান নামক গ্রন্থে।

৯. ইবনে শাহর আশুব তার মানাকিবে আলে আবি তালিব গ্রন্থে আবা হামযার তাফসীর থেকে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন।

মৃত্যু:

ইতিহাসের প্রসিদ্ধ বর্ণনা অনুযায়ি আবু হামযা সোমালি ১৫০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ইবনে সাআদ মনে করেন তিনি খলিফা মনসুরের খেলাফকালে মৃত্যুবরণ করেন। মানসুরের খেলাফতকাল ছিল ১৩৬- ১৫৮ হিজরী পর্যন্ত। শিয়া হাদীস অনুযায়ি হাসান বিন মাহাবুব আবু হামযা থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাসান বিন মাহবুব ২২৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন, মৃত্যুকালীন সময়ে তার বয়স ছিল ৭৫ বছর। অর্থাৎ আবু হামযার মৃত্যুর সময় (১৫০ হিজরী) হাসান বিন মাহবুবের বয়স দুই বছরের চেয়েও কম ছিল! সুতরাং ইবনে সাআদের বর্ণনাটি সঠিক; কেননা আমরা যদি আবু হামযা সোমালি’র মৃত্যুর সাল ১৫৮ হিজরী ধরে নেই তাহলে ইবনে মাহবুব’র বয়স তখন ছিল প্রায় ৮ বছর।

সূত্রসমূহ:

১. রেজালে নাজ্জাসী, পৃষ্ঠা ১১৫, ১১৬, ২০৩, ৪০৬।

২. ইখতিয়ার মাআরেফাতুর রেজাল, পৃষ্ঠা ১২৪।

৩. মউসুআতে তাবাকাতিল ফোকাহা, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৩০৪।

৪. আল ফেহরেসত, পৃষ্ঠা ১০৫।

৫. আয যারিআতি ইলা তাসানিফিশ শিয়া, খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ১৮৬।

৬. আল আবওয়াব, পৃষ্ঠা ১১০।

৭. তাবাকাতুল কুবরা, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ৩৪৫।

৮. আয়ানুশ শিয়া, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৯- ১০।

৯. ফাহরিসতে আসমায়ে মুসান্নিফুশ শিয়া, পৃষ্ঠা ১১৮।

১০. বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৯২, পৃষ্ঠা ২৩০।