Press "Enter" to skip to content

আযান ও একামতের ফযিলত ও সওয়াব

এস, এ, এ

আযান:  অর্থ, ঘোষণা ধ্বনি (الإعلام)। পারিভাষিক অর্থ, শরী‘আত নির্ধারিত আরবী বাক্য সমূহের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ে উচ্চকণ্ঠে সালাতের আহবান করাকে ‘আযান’ বলা হয়। ১ম হিজরী সনে আযানের প্রচলন হয়।ʾআযান শব্দের মূল অর্থ দাড়ায় أَذِنَ ডাকা,আহবান করা। যার মূল উদ্দেশ্য হল অবগত করানো। এই শব্দের আরেকটি ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ʾআজুন। (أُذُن), যার অর্থ হল “শোনা”। কুরআনে মোট পাঁচ স্থানে আজুন শব্দটি এসেছে।

মুয়াজ্জিন: নামাজের আজান দাতা, নামাজের সময় মসজিদের মিনার হতে যিনি উচ্চৈঃস্বরে আল্লাহর নাম ঘোষণা করেন।

মোয়াজ্জিনের সওয়াব:

ইমাম বাকির (আ.) বলেন: মোয়াজ্জিন যখন আযান দেয় এবং তার শব্দ আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে যায় তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন এবং যা পৃথিবীর যা কিছু তার আযানকে শ্রবণ করে এবং সত্যায়িত করে এবং তার আযানকে শুনে মসজিদে নামাজ পড়তে আসে নামাজিদের সমপরিমাণ সওয়াব তাকে দান করা হয় এবং যারাই তার আযানকে শ্রবণ করে নামাজ পড়বে তাকে উক্ত নামাজিদের সমপরিমাণ সওয়াব দান করা হবে। [মান লা ইয়াযারুহুল ফাক্বিহ্, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২৮৭]

শহীদদের সমপরিমাণ সওয়াব:

যে ব্যক্তি নামাযের জন্য আযান দেয়, তার সওয়াব সেই শহীদের সওয়াবের ন্যায়, যে আল্লাহর পথে নিজের রক্তে রঞ্জিত হয়। [সাওয়াবুল আমাল, পৃষ্ঠা ৫৮]

মুয়াজ্জিনের জন্য বেহেশত ওয়াজিব:

যে ব্যক্তি মুসলমানদের শহরে এক বছর নামাজের জন্য আযান দেয়, তার জন্য বেহেশত ওয়াজিব হয়ে যায়। [মাহাজ্জতুল বায়যা, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৩৭, ওসায়েলুশ শিয়া, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৬১৩]

নামাযের আযান ও ইকামাহ বলার প্রভাব:

ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) বলেন: যে ব্যক্তি আযান ও ইকামতের সাথে সালাত আদায় করবে, তার পিছনে দুই কাতার ফেরেশতা সালাত পড়বে এবং যে ব্যক্তি একাকী ইকামা দিয়ে সালাত আদায় করবে, তার পেছনে এক কাতার  ফেরেশতা সালাত আদায় করবে এবং সেই সারির আকার হবে পূর্ব ও পশ্চিম পর্যন্ত। [মাহাজ্জতুল বায়যা, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৩৮, সাওয়াবুল আমাল, পৃষ্ঠা ৫৯]

উচ্চ স্বরে আযান:

ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) বলেন: যখন নামাযের সময় আসত, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিলালকে বলতেন: দেয়ালের ওপরে (মসজিদের) উপরে যাও এবং উচ্চস্বরে নামাযের জন্য আযান দাও। [ওসায়েলুশ শিয়া, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৬২৪]

কেয়ামতে শহীদ ও নবীদের সাথে উত্থিত করা হবে:

রাসুল (সা.) বলেছেন: আমার উম্মতের মোয়াজ্জিনরা নবী, সত্যবাদী এবং শহীদদের সাথে [কেয়ামতে] উত্থিত হবে। [ওসায়েলুশ শিয়া, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ২৩]

সাত বছর আযান দেয়ার ফলাফল:

ইমাম বাকির (আ.) বলেন: কেউ যদি শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আযান দেয় তাহলে কেয়ামতের সময় সে বেগুনাহ অবস্থায় উত্থিত হবে। [সাওয়াবুল আমাল, পৃষ্ঠা ৮৩, মান লা ইয়াহযারুহুল ফাক্বিহ্, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২৮৮, ওসায়েলুশ শিয়া, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৬১৩]

মোয়াজ্জিনের আযানের মঞ্জুরির ফল:

মোয়াজ্জিনের আযানের মঞ্জুরির ফলাফল হচ্ছে তার গুনাহের কাফফারা। [মুসতাদরাকে ওসায়েল, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২২৭]

শয়তানের প্রস্থান:

রাসুল (সা.) বলেন: শয়তান যখন আযানের শব্দ শুনতে পায় তখন সে উক্ত স্থান থেকে প্রস্থান করে। [কানযুল উম্মাল, হাদীস নং ২০৯৫১]

আযান দেওয়ার জন্য লটারি:

রাসুল (সা.) বলেন: যদি লোকজন আযান দেয়া এবং প্রথম রাকাতে অংশগ্রহণের ফযিলত সম্পর্কে অবগত হতো তাহলে তারা এজন্য দেয়ার জন্য লটারি করতো। [বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৮৮, পৃষ্ঠা ২০০]

সর্বাবস্থায় আযান দেয়া:

ইমাম রেযা (আ.) বলেন: মোয়াজ্জিন যেন দন্ডায়মান বা বসা অবস্থায় [সর্বাবস্থায়] আযান দেয়। [মান লা ইয়াহযারুহুল ফাক্বিহ্, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২৮৫]

আযানের সময় দোয়া করা:

ইমাম আলী (আ.) বলেন: চারটি সময় দোয়া করাকে গনীমত মনে কর:

১. কোরআন তেলাওয়াত করার সময়।

২. আযান দেয়ার সময়।

৩. বৃষ্টি বর্ষণের সময়।

৪. মুমিনের সাথে কাফিরদের মুখোমুখি যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার সময়। [ওসায়েলুশ শিয়া, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ১১১৪]

শিশুর কানে আযান ও ইকামার সুপ্রভাব:

রাসুল (সা.) বলেন: যাদের সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে তাদের সন্তানের ডান কানে আযান এবং বাম কানে ইকামাহ্ পড়া উচিত, কারণ এই কাজটি শিশুকে শয়তানের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করে। [বহিারুল আনওয়ার, খন্ড ৮৪, পৃষ্ঠা ১৬২]

মোয়াজ্জিনের আযানের সুফল:

মোয়াজ্জিনের  আযানের সুফল হচ্ছে তার আযানের কারণে রুজি বৃদ্ধি পায়। [বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৮৪, পৃষ্ঠা ১৭৭]

মুয়াজ্জিনের আযানের পুনরাবৃত্তি:

রাসুল (সা.) যখন মোয়াজ্জিনের আযানের শব্দ শুনতেন তখন তিনি আযানের পুনরাবৃত্তি করতেন। [কাফি, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ৩১০, হাদীস নং ২৯]

রাসুল (সা.)-এর প্রতি বেলালের ভালবাসা:

ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) বলেন: প্রকৃতপক্ষে, বিলাল একজন সুযোগ্য বান্দা ছিলেন তিনি বলেছিলেন: আমি আল্লাহর রাসূলের পরে কারো নির্দেশে আযান দিব না। [মান লা ইয়াহযারুহুল ফাক্বিহ্, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২৮৬]

উচ্চ স্বরে আযান:

আবু আব্দুল্লাহ (আ.) বলেন: যখন তোমরা আযান দিবে তখন নিজেদের কন্ঠকে ছোট করো না কেননা তোমাদের উচ্চ স্বরে আযানের কারণে তোমাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে। [তাহযিব, অধ্যায় আযান, হাদীস নং ৪৫]

আযানের সময় সম্পর্কে অবগত হওয়া: আবু আব্দুল্লাহ (আ.) বলেন: শুধুমাত্র একজন মুসলিম ব্যক্তি যে আযানের সময় সম্পর্কে অবগত রয়েছে সে ব্যাতিত আযান বলা হয় না এবং বলা উচিতও না।

রাসুল (সা.) বলেছেন: প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা ভোরের নির্মল বাতাসকে নির্দেশ দেন সে যেন মোয়াজ্জিনের আযানের শব্দকে আকাশে নিয়ে যায়। যখন ফেরেশতারা দুনিয়াবাসীদের আযানের শব্দ শুনতে পায় তখন তারা বলে: এই শব্দটি মোহাম্মাদ (সা.)-এর উম্মতের যারা আল্লাহর একত্বাবাদের স্বীকারোক্তি দিচ্ছে এবং ঐ ফেরেশতারা নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই উম্মতের জন্য ইস্তেগফার করতে থাকে।

আযান ও আমাদের করণীয়:

ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) বলেন: তোমরা যখন আযানের শব্দ শুনবে তখন আযান উচ্চারণ কর।

ইমাম বাকির (আ.) বলেন: কেউ যদি সাত বছর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আযান দেয় তাহলে কেয়ামতের দিন তার আর কোন গুনাহ অবশিষ্ট থাকবে না।

ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) বলেন: মোয়াজ্জিনকে মদ্, আযানের সুরের চড়াই উতরাইয়ের কারণে ক্ষমা করা হবে এবং যারাই তার আযানকে শ্রবণ করবে তারা মোয়াজ্জিনের স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবে। [আত- তাহযিব, পৃষ্ঠা ১৪৮]

আযানের ফজিলত সম্পর্কে বিলাল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন: আমি আল্লাহর রাসূল থেকে শুনেছি যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং আল্লাহর সওয়াব ও সওয়াবের আশায় আল্লাহর পথে নামাযের আযান দেয়। এবং ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়া, ঈশ্বর তার অতীতের পাপগুলিকে ক্ষমা করুন।

সাওয়াবুল আমাল নামক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে: রাসুল (সা.) তাঁর একটি খুৎবাতে বলেছেন: যে ব্যক্তি কোন একটি মসজিদে নামাযের আযানের দায়িত্বে থাকবে এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে নামাযের আযান বলবে, আল্লাহ তাকে চল্লিশ হাজার নবী, চল্লিশ হাজার নেককার লোক, চল্লিশ হাজার শহীদ এবং চল্লিশ হাজার জাতি তাঁর সুপারিশের অধীনে দান করবেন। তিনি প্রকাশ করেন যে প্রতিটি শহরে চল্লিশ হাজার প্রাসাদ রয়েছে এবং প্রতিটি প্রাসাদে চল্লিশ হাজার উঠান রয়েছে, এবং প্রতিটি উঠানে চল্লিশ হাজার ঘর রয়েছে এবং প্রতিটি ঘরে চল্লিশ হাজার বিছানা রয়েছে এবং প্রতিটি বিছানায় একজন কালো চোখ বিশিষ্ট হুর রয়েছে, এবং প্রতিটি বাড়ির আয়তন পৃথিবীর আকারের চল্লিশ হাজার গুণ, এবং প্রত্যেকজনের  সেবা করার জন্য চল্লিশ হাজার চাকর এবং চল্লিশ হাজার দাসী রয়েছে। এবং প্রতিটি বাড়িতে চল্লিশ হাজার টেবিল এবং প্রতিটি টেবিলে চল্লিশ হাজারটি বড় বাটি রয়েছে। প্রত্যেকটি বাটিতে বিভিন্ন ধরণের খাবার রয়েছে। যদি মানুষ ও জ্বীন তাতে প্রবেশ করে তবে তা তাদের নিকটস্থ ঘরে প্রবেশ করবে এবং তারা যা চাইবে যেমন খাদ্য, পানীয়, সুগন্ধি, জামাকাপড়, ফলমূল, সকল প্রকার অলংকার ও জামাকাপড় সবই উপস্থিত থাকবে। তাই যখন মুয়াজ্জিন নামাজের জন্য আযান দেয় এবং বলে: আশহাদ আন লা ইলাহা ইলাল্লাহ, তখন চল্লিশ হাজার ফেরেশতা তাকে ঘিরে ফেলে। যখন তারা সবাই তার জন্য প্রার্থনা করে এবং তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, এবং সে আল্লাহর ছায়ায় থাকে যতক্ষণ না তার আযান শেষ হয়, এবং চল্লিশ হাজার ফেরেশতা তার জন্য সওয়াব লিখে এবং তারপর তা আল্লাহর কাছে উত্থাপন করে।

মাজালিসে সাদুক্ব এবং মাকারিমে আখলাক নামক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, কেউ যদি মোয়াজ্জিনের আযানের সাথে আযান উচ্চারণ করে তাহলে তার রুজি বৃদ্ধি পাবে।

মোহাম্মাদ বিন রাশেদ বলেন: হেশাম বিন ইব্রাহিম আমাকে বলেন: আমি অসুস্থ থাকতাম এবং সন্তানের বাবা হওয়ার জন্য ইমাম রেযা (আ.)-এর কাছে অভিযোগ করি। ইমাম রেযা (আ.) আমাকে বলেন: তুমি নিজের বাড়িতে উচ্চস্বরে আযান দিবে।

হেশাম বিন ইব্রাহিম বলেন: তারপর থেকে আমি এই কাজটি সম্পাদন করার পর আল্লাহ আমাকে সুস্থতা দান করেন এবং আমাকে একাধিক সন্তান দান করেন।

মোহাম্মাদ বিন রাশেদ বলেন: আমিও প্রায় সর্বদা অসুস্থ থাকতাম এবং যারা উক্ত ঘরে আমাদের সাথে বসবাস করতো তারাও অসুস্থ থাকতো। ঘটনাক্রমে একবার আমি ঘরে একা ছিলাম এবং আমার সেবা করার কেউ ছিল না। যখন আমি এই হাদীসটি হেশামের কাছ থেকে শুনলাম তখন ইমাম (আ.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী আমিও আযান দেওয়া শুরু করলাম। তারপর থেকে আল্লাহ আমাদের থেকে অসুখ বিসুখ থেকে দূরে রাখেন আলহামদুলিল্লাহ।

সুলাইমান জাফরী বলেন: ইমাম রেযা (আ.) আমাকে বলেছেন: তুমি নিজের ঘরে আযান দিবে কেননা উক্ত কাজ করলে শয়তান পলায়ণ করে।

একদা একজন ব্যাক্তি ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.)-এর কাছে তার দারিদ্রতা সম্পর্কে অভিযোগ করলে ইমাম সাদিক্ব (আ.) তাকে বলেন: তুমি যখন আযানের শব্দ শুনতে পারবে তখন আযান উচ্চারণ করবে।