Press "Enter" to skip to content

ইমাম হুসাইন (আ.)’র চেহেলুমে কারাবালায় পদযাত্রার ইতিহাস

এস, এ, এ

আশুরার দিনে ইমাম হুসাইন (আ.) কারবালায় শাহাদত বরণ করার পরে থেকেই আহলে বাইত (আ.)এর অনুসারিগণ তাঁর কবর যিয়ারতের জন্য কারবালার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে আসছে। কেউ বাহনে, কেউ পায়ে হেটে আবার অনেকে তাবলিগের উদ্দেশ্যে খালি পায়ে হেঁটেও ইমাম হুসাইন (আ.)এর চেহেলুমের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য কারবালার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে থাকেন।

ইমাম হুসাইন (আ.)এর কবর মোবারক যিয়ারত করা সম্পর্কে বিভিন্ন ইমাম (আ.) হতে একাধিক রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে। কিছু কিছু রেওয়ায়েতে পায়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

আরবাইনে পায়ে হাটার প্রচলন:

যুগ যুগ থেকে বিভিন্ন আলেম এবং আউলিয়াগণ পায়ে হেটে ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারত করা সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন এবং নিজেরাও নাজাফ থেকে কারবালা পর্যন্ত হেঁটে যেতেন। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারি (রা.) ছিলেন কারবালার প্রথম যিয়ারতকারি, যিনি সন ৬১ হিজরিতে ইমাম হুসাইন (আ.)এর কবর যিয়ারতের জন্য স্বয়ং কারাবালায় উপস্থিত হন। যদিও উক্ত সময়টি ছিল বণি উমাইয়ার হুকুমতের সবচেয়ে স্পর্শকাতর সময়।

ইমাম হুসাইন (আ.)এর আরবাইনে পদযাত্রার সূচনা: 

ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম হুসাইন (আ.) এর চেহেলুম উপলক্ষ্যে শাইখ আনসারি (রহ.)এর যুগ থেকেই পদযাত্রার প্রথা শুরু হয়। কিন্তু পরে তা বিভিন্ন কারণে বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মির্যা হুসাইন নূরির মাধ্যমে পুণরায় পদযাত্রার রেওয়াজ প্রচলিত হয়। তিনি প্রথমবারের মতো ঈদুল আযহার দিন প্রায় ৩০জন ব্যাক্তিদেরকে সাথে নিয়ে নাজাফ থেকে কারবালার উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং তিনদিন তিনি পায়ে হেটে কারবালাতে পৌঁছান। তিনি এরপর থেকে সিদ্ধান্ত নেন যে প্রত্যেক বছর তিনি এভাবে পায়ে হেঁটে নাজাফ থেকে কারবালায় যাবেন। তিনি সন ১৩১৯ হিজরিতে শেষবারের মতো পায়ে হেটে কারবালাতে যান এবং ইমাম হুসাইন (আ.)এর মাজারের যিয়ারত করেন।

আয়াতুল্লাহ মালেকি তাবরিযি (রহ.)এর দৃষ্টিতে আরবাইনের পদযাত্রা:

মির্যা জাওয়াদ মালেকি তাবরিযি (রহ.) ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কারবালার পথে একাধিকবার পায়ে পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি আরবাইন সম্পর্কে নিজের অভিমত এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, প্রত্যেক ব্যাক্তির উচিৎ সে যেন ইমাম হুসাইন (আ.)এর চল্লিশার দিন নিজেকে ইমাম হুসাইন (আ.)এর দুঃখে দুঃখিত এবং মাতাম ও আহাজারিতে নিজেকে নিমগ্ন রাখে এবং যদি সম্ভব হয় তাহলে সে যেন কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারতের জন্য  যায়। এমনকি জিবনে একবার হলেও যেন কারবালার যিয়ারতের জন্য যায়। কেননা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, মুমিনের চিহ্ন হচ্ছে ৫টি যথা: প্রত্যেকদিন ৫১ রাকাত নামাজ পড়া, আরবাইনেরযিয়ারত পাঠ করা, ডান হাতে আংটি পরিধান করা, মাটিতে সিজদা করা এবং বিসমিল্লাহ উচ্চ স্বরে উচ্চারণ করা। (আল মুরাকেবাত, পৃষ্ঠা ৮৫)

আরবাইনের পদযাত্রা উদ্দেশ্যে আয়াতুল্লাহ মাকারিম শিরাজি (দা.বা.)

আয়াতুল্লাহ মাকরিম শিরাযি (দা.বা.) সন ১৩৬৯ থেকে ১৩৭০ পর্যন্ত নাজাফে বসবাস করতেন। তিনি মাত্র দুইবার খালিপায়ে তিনদিনে নাজাফ থেকে কারবালা পর্যন্ত ইমাম হুসাইন (আ.)এর কবর যিয়ারতের জন্য পদযাত্রার সৌভাগ্য অর্জন করেন এবং তিনি উক্ত সুযোগটিকে কোনমতেই হাত ছাড়া করতে চাননি।

আরবাইনের পদযাত্রা সম্পর্কিত রেওয়ায়েতসমূহ:

ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে যিয়ারত করা সম্পর্কে বলেছেন: যে ব্যাক্তি ইমাম হুসাইন (আ.)এর কবর যিয়ারতের জন্য পদযাত্রা করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে তার প্রত্যেক ধাপের বিনিময়ে সওয়াব প্রদান করবেন এবং তার গুনাহকে মুছে দিবেন এবং তার পদমর্যাদাকে বৃদ্ধি করে দিবেন। যখন সে যিয়ারতের জন্য যাবে তখন আল্লাহ দুজন ফেরেস্তাকে নির্ধারণ করবেন এবং তাদেরকে নির্দেশ দিবেন যেন, তার প্রত্যেকটি মুখনিসৃত ভাল বাণীকে যেন গণনা করা হয় কিন্তু তার মুখনিসৃত খারাপ বাণিকে যেন গণনা করা না হয় যতক্ষণ না সে ফিরে আসে। যখন সে যিয়ারত থেকে ফিরে আসবে তখন তাকে ফেরেস্তারা বলবে: হে ব্যাক্তি! তোমার সকল গুনাহ সমূহকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে এখন থেকে তুমি আল্লাহ, তাঁর রাসুল (সা.) এবং আহলে বাইত (আ.)এর দলের একজন সদস্য। মহান আল্লাহর শপথ তুমি কখনও জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে না এবং জাহান্নামের আগুনও তোমাকে কখনও স্পর্শ করবে না। (কামেলুয যিয়ারত, পৃষ্ঠা ১৩৪)

এছাড়াও আবু সাঈদ কাযি হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: একদা আমি ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.)এর সাথে সাক্ষাত করার উদ্দেশ্যে তাঁর সমিপে উপস্থিত হই। তিনি আমাকে বলেন: কেউ যদি ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারতের জন্য যাত্রা করে তাহলে হজরত ইসমাইল (আ.)এর সন্তানদের যারা দাশরূপে জিবন যাপন করতো তাদেরকে মুক্ত করার সমপরিমাণ সওয়াব অর্জন করবে।

জাবের মাকফুফ আবি সামেত হতে বর্ণনা করেছেন তিনি বলেছেন: আমি ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) হতে শুনেছি যে,  তিনি বলেছেন: কেউ যদি ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারতের জন্য যাত্রা করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাকে তার প্রত্যেক ধাপের জন্য হাজারটি সওয়াব দান করবেন এবং তার হাজারটি গুনাহকে ক্ষমা করে দিবেন, তার হাজারটি পদমর্যাদাকে বৃদ্ধি করে দিবেন।

আলী বিন মায়মুন সায়েগ্ব বলেন: ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) আমাকে বলেন: হে সায়েগ্ব! তুমি ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারতের সুযোগকে কখনও হাতছাড়া করো না। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারতের সওয়াব কি?

তিনি বলেন: কেউ যদি পায়ে হেটে ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারতের জন্য যায় তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাকে তার প্রত্যেকটি ধাপের জন্য সওয়াব প্রদান করবেন, তার গুনাহকে ক্ষমা করে দিবেন এবং তার পদমর্যাদাকে বৃদ্ধি করে দিবেন। আল্লাহ দুজন ফেরেস্তাকে তার জন্য নিয়োগ করবেন এবং তাদেরকে উক্ত বান্দার যিয়ারতকালিন সময়ে শুধুমাত্র সৎ আমলসমূহকে লিপবিদ্ধ করার নির্দেশ দিবেন এবং যতক্ষণ না সে তার ঘরে ফিরে আসে। যখন সে ঘরে ফিরে আসবে তখন ফেরেস্তারা তাকে বলবে: হে ব্যাক্তি! তোমার সকল গুনাহ সমূহকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে এখন থেকে তুমি আল্লাহ, রাসুল (সা.) এবং আহলে বাইত (আ.)এর দলের একজন সদস্য। মহান আল্লাহর শপথ তুমি কখনও জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে না এবং জাহান্নামের আগুন তোমাকে কখনও স্পর্শ করবে না।

ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন নবি (আ.)উৎসূক ছিলেন:

ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন: কেউ যদি এক লক্ষ চব্বিশ হাজার নবীর সাথে মুসাহেফা (করমর্দন) করতে চায় তাহলে সে যেন ১৫ই শাবান রাতে ইমাম হুসাইন (আ.)এর কবর যিয়ারতের জন্য যায়। শুধুমাত্র সাধারণ বান্দারাই না বরং ফেরেশতা এবং নবীদের রূহও ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারতের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে অনুমতি নেন।

কেয়ামতে ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারতকারিদের নূর:

“নূরুল আয়ন” নামক গ্রন্থে ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি কেয়ামতে ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারতের সওয়াব সম্পর্কে বলেছেন: যে ব্যাক্তি পূর্ণ আগ্রহ ও উদ্দীপনা সহকারে ইমাম হুসাইন (আ.) এর যিয়ারত করার জন্য কারবালার উদ্দেশ্যে যাত্র করবে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে নূর প্রদান করা হবে। কেয়ামতে তার উক্ত নূর দ্বারা পূর্ব থেকে পশ্চিম এলাকা আলোকিত হয়ে যাবে। আহবান জানানো হবে যে, হে ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারতকারি! কোথায় তোমরা যারা পূর্ণ আগ্রহ ও উদ্দীপনার সাথে ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারত করতে গেছিলে এমতাবস্থায় কেয়ামতে সকলেই ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারতকারি হওয়ার আশা পোষণ করবে।

সমস্যা সমাধানের কল্পে ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারত:

ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন: কেউ যদি বিভিন্ন বিপদ ও সমস্যায় জরজারিত থাকে এবং উক্ত অবস্থায় সে ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারত করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার সকল সমস্যাকে সমাধান করে দিবেন।

ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারতের ফলাফল:

ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন: ইমাম হুসাইন (আ.) আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার কারণে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে চারটি পুরস্কার দান করেছেন যথা: ইমামত তার সন্তানদের মধ্যে প্রদান করেছেন, কারবালার মাটিতে শেফা (আরোগ্য লাভ) দান করেছেন, তাঁর কবরের কাছে থেকে আল্লাহর কাছে দোয়া করলে সে দোয়া কবুল হয় এবং যখন কোন যিয়ারতকারি তাঁর যিয়ারতের জন্য যাবে তখন থেকে নিয়ে তার ঘরে ফিরে না আসা পর্যন্ত তার আয়ুর হিসাব নেয়া হবে না।

ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারতের ফলে ৫০ বছরের গুনাহ মার্জিত হয়:

“নূরুল আয়ন” নামক গ্রন্থে ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন: কেউ যদি ইমাম হুসাইন (আ.)এর কবরের যিয়ারত করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার মনোবাসনাকে পূর্ণ করবেন, দুনিয়ার বিভিন্ন নেয়ামত তাকে পর্যাপ্ত পরিমাণ দান করবেন, যিয়ারতের পথে তার ব্যায় করা অর্থের বিনিময় তাকে দ্বিগুণ দান করবেন এবং তার ৫০ বছরের গুনাহকে আমলনামা থেকে মুছে দিবেন।

যিয়ারত-এ আরবাইন পাঠের সওয়াব:

ইমাম হাসান আসকারি (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, ২০শে সফর ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারত-এ আরবাইন পাঠ করা মুস্তাহাব। তিনি উক্ত রেওয়ায়েতে বলেছেন: মুমিনের চিহ্ন হচ্ছে ৫টি যথা: প্রত্যেকদিন ৫১ রাকাত নামাজ পড়া, আরবাইনেরযিয়ারত পাঠ করা, ডান হাতে আংটি পরিধান করা, মাটিতে সিজদা করা এবং বিসমিল্লাহ উচ্চ স্বরে উচ্চারণ করা।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সকল মুমিন ভাই বোনদেরকে ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারত করার এবং আরবাইনের দিনে কারবালাতে উপস্থিত হয়ে যিয়ারত-এ আরবাইন পাঠের সৌভাগ্য দান করুন, আমীন।