আজ মাহে রমজানের প্রথম রোজা চলছে। এই মাস প্রতিটা মুসলমানের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন –
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ كُتِبَ عَلَيْكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
অর্থ:- “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারো।” ¹
ㅤএই রমজান মাস এলেই সকলের মাঝেই একটা কমন জিনিস চোখে পড়ে। সেটা হলো মাগরিবের আযান দেওয়ার সাথে সাথে ইফতার ত্বরান্বিত করা। অন্যদিকে “জাফরী ফিকহ” এর অনুসারীগণ প্রচলিত মাগরিবের আজানের প্রায় ১৫/২০ মিনিট পর ইফতার করে থাকেন, যে কারণে আমাদের দেশের আলেম-সমাজ তাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেন এবং নানান রকম মন্তব্য পেশ করেন। দেশের প্রায় অধিকাংশ মুসলিমই সন্ধায় ইফতার করতে সাচ্ছন্দবোধ করেন। এমনকি দেশের আলেম সমাজও সন্ধায় ইফতার করার ফতোয়া দিয়ে থাকেন। এই ইফতারের সঠিক সময়সূচি নিয়েই আজকের আলোচনা।
মূলত সন্ধায় ইফতারের বৈধতার জন্য আলেম সমাজ যে দলিলসমুহ আমাদেরকে দেখিয়ে থাকেন তার মধ্যে বহুল প্রচলিত দুটি হাদীস হলো :
ㅤ❏ হাদীস ০১ :–
ㅤحدثنا عبد الله بن يوسف أخبرنا مالك عن أبي حازم عن سهل بن سعد أن رسول اللہ ﷺ قال لا يزال الناس بخير ما عجلوا الفطر.
অর্থ:- “আবদুল্লাহ ইবন ইউসুফ (র)… সাহল ইবন সা’দ (রা) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন লোকেরা যতদিন যাবত ওয়াক্ত হওয়ামাত্র ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে।” ²
ㅤ❏ হাদীস ০২ :–
ㅤحدثنا أحمد بن يونس حدثنا أبو بكر عن سليمان عن ابن أبي أوفى رضي الله عنه قال كنت مع النبی ﷺ في سفر قصام حتى أمسى ثم قال لرجل انزل فاجدح لي قال لو انتظرت حتى تمسى قال انزل فاجدح لي إذا رأيت الليل قد أقيل من هاهنا فقد أفطر الصائم
অর্থ:- “আহমদ ইবন ইউনুস (র)… ইবন আবূ আওফা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক সফরে আমি নবী (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত সাওম পালন করেন। এরপর এক ব্যক্তিকে বললেন : সওয়ারী হতে নেমে ছাতু গুলিয়ে আন। লোকটি বলল, আপনি যদি (পূর্ণ সন্ধ্যা হওয়া পর্যন্ত) অপেক্ষা করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) পুনরায় বললেন : নেমে আমার জন্য ছাতু গুলিয়ে আন। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : যখন তুমি এদিক (পূর্বদিক) হতে রাত্রির আগমন দেখতে পাবে তখন রোযাদার ইফতার করবে।” ³
ㅤㅤ◼️পর্যালোচনা :–
ㅤহাদীস – ০১ এর ক্ষেত্রে ইফতার ত্বরান্বিত করতে বলা হয়েছে। অথচ হাদীসটিকে কুরআনের পরিপন্থী বলেই মনে হয়। কেননা আল্লাহ পাক কুরআনে বলেছেন –
ㅤوَيَدْعُ ٱلْإِنسَٰنُ بِٱلشَّرِّ دُعَآءَهُۥ بِٱلْخَيْرِ وَكَانَ ٱلْإِنسَٰنُ عَجُولًا
অর্থ:- “মানুষ যেভাবে কল্যাণ কামনা করে, সেভাবেই অকল্যাণ কামনা করে। মানুষ তো খুবই দ্রুততা প্রিয়।” ⁴
ㅤএছাড়া এখানে ইফতারের সঠিক সময়ের কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু এর পরবর্তী হাদিসেই (হাদীস ০২) বর্ণিত হয়েছে যে রাসূল (সা.) কোনো এক সফরে গিয়ে সন্ধার সময় এক সাহাবাকে ছাতু গুলে নিয়ে আসতে বললেন। আর এই দুটি হাদীসকে একত্র করেই আমাদের আলেম সমাজ আমাদেরকে সুন্দরভাবে বোকা বানিয়ে যাচ্ছে। কেননা হাদীস ০২ এ স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সা.) সফররত অবস্থায় ছিলেন। আর আল্লাহ পাক মুসাফিরদের জন্য সফরে রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন।
ㅤ❏ আল কুরআনে আসছে –
ㅤفَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا۟ ٱلْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا۟ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
ㅤঅর্থ:- “………..কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তা’আলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।” ⁵
ㅤএরই পরিপ্রেক্ষিতে রাসূল (সা.) সফররত অবস্থায় রোজা ভঙ্গ করে ফেলেন, যা কুরআন এবং হাদীসের রেফারেন্স দ্বারা খুবই ভালোভাবে প্রমাণ করা যায়। এ বিষয়ে অন্যান্য হাদীসসমূহ নিম্নে দেওয়া হলো –
ㅤ❏ বুখারী থেকে –
حدثنا أدم حدثنا شعبة حدثنا محمد بن عبد الرحمن الأنصاري قال سمعت محمد بن عمرو ابن الحسن بن علي عن جابر بن عبد الله رضي الله عنهم قال كان رسول اللہ ﷺ في سفر فرأى زحاما ورجلاً قد ظلل عليه فقال ماهذا فقالوا صائم فقال ليس من البر الصوم في السفر
অর্থ:- “আদম (র)… জাবির ইবন ‘আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এক সফরে ছিলেন, হঠাৎ তিনি লোকের জটলা এবং ছায়ার নিচে এক ব্যক্তিকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন : এর কী হয়েছে? লোকেরা বলল, সে সায়িম। রাসূলুল্লাহ (সা.)বললেন : সফরে সাওম পালনে কোন নেকী নেই।” ⁶
ㅤ❏ মুসলিম থেকে –
حدثنی م محمد بن المثنى حدثنا عبد الوهاب يعني ابن عبد المجيد حدثنا جعفر عن أبيه عن جابر بن عبد الله أن رسول اللہ ﷺ خرج عام الفتح إلى مكة في رمضان فصام حتى بلغ كراع الغميم فصام الناس ثم دعا بقدح من ماء فرفعه حتى نظر الناس إليه ثم شرب فقيل له بعد ذلك ان بعض الناس قد صام فقال أولئك العصاة أولئك العصاة.
অর্থ:- “জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা:) থেকে বর্ণিত, “মক্কা বিজয়ের বছর রমজান মাসে রোজারত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কার উদ্দেশ্যে বের হলেন। এরপর যখন তিনি কুরাউল গামিম নামক স্থানে পৌঁছালেন, তখন লোকেরাও রোজারত ছিলো। এরপর তিনি একটি পানির পাত্র চাইলেন। এমনকি লোকেরা তার দিকে তাকাতে লাগলো। এরপর তিনি পানি পান করলেন। তখন তাকে বলা হলো কতিপয় লোক রোজারত আছে। তিনি বললেন, “তারা অবাধ্য, তারা অবাধ্য”। ⁷
ㅤ❏ মুসলিম থেকে আরো একটি হাদীস –
حدثني يحيى بن يحيى ومحمد بن بن رمح قالا أخبرنا الليث ح وحدثنا قتيبة بن سعيد حدثنا ليث عن ابن شهاب عن عبيد الله بن عبد الله بن عتبة عن ابن عباس أنه أخبره أن رسول اللہ ﷺ خرج عام الفتح في رمضان فصام حتى بلغ الكديد ثم أفطر قال وكان صحابة رسول اللہ ﷺ يتبعون الأحدث قالا حدث من أمره.
অর্থ:- “ইয়াহইয়া ইবন ইয়াহ্ইয়া, মুহাম্মদ ইব্ন রুমহ্ ও কুতায়বা ইব্ন সাঈদ (র)…… ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, (মক্কা) বিজয়ের বছর রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সওমরত অবস্থায় সফরে বের হলেন। অতঃপর কাদীদ নামক স্থানে পৌঁছাবার পর তিনি সওম ভেংগে ফেললেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এর সাহাবীগণ পর্যায়ক্রমে তাঁর সর্বাপেক্ষা নতুন নির্দেশ অনুসরণ করতেন।”…..⁸
ㅤএই তিনটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসূল (সা.) সফরে গিয়ে নিজের রোজা ভঙ্গ করেন কেননা সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াত অনুযায়ী আল্লাহ পাক মুসাফিরকে রোজা থেকে মুক্ত করেছেন। আর উপরিক্ত হাদীস ০২ এও একই কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করা যায়।
ㅤএছাড়া উক্ত হাদীসটি (হাদীস ০২) বুখারী শরীফের ❛ সফরে সাওম পালন করা ও না করা ❜ নামক পরিচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে যা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে এই হাদীসটির মাধ্যমে সন্ধ্যায় ইফতার করা নয় বরং সফরে রোজা না থাকার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।…⁹ কিন্তু আমাদের আলেম-সমাজ হাদীস দুইটির সমন্বয়ে সন্ধ্যায় ইফতার করার ফতোয়া দিয়ে থাকে যা কুরআন বিরোধী। অথচ হাদীস ০১ এবং হাদীস ০২ এর প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। অর্থাৎ হাদীস ০১ এর সাথে হাদীস ০২ এর কোনো সম্পর্কই নেই।
ㅤআল্লাহ পাক বলেছেন –
ㅤ وَلَا تَلْبِسُوا۟ ٱلْحَقَّ بِٱلْبَٰطِلِ وَتَكْتُمُوا۟ ٱلْحَقَّ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ
ㅤঅর্থ:- “তোমরা সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণ করো না এবং জেনেশুনে সত্যকে তোমরা গোপন করো না।” ¹⁰
ㅤদুনিয়ায় এতো মুসলমান…যার মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই সন্ধ্যায় ইফতার করে। তাহলে কি তারা ভুল করে?? এই প্রশ্নের উত্তরে কুরআন মজিদের একটি আয়াতই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি। আল্লাহ পাক বলছেন –
ㅤوَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِى ٱلْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا ٱلظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ
ㅤঅর্থ:- “আপনি যদি দুনিয়াবাসীদের অধিকাংশ লোকের কথার অনুসরণ করেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ হতে বিভ্রান্ত করে ফেলবে, তারা তো নিছক ধারণা ও অনুমানেরই অনুসরণ করে, আর তারা ধারণা ও অনুমান ছাড়া কিছুই করছে না।” ¹¹
মহান আল্লাহ পাক মানবজাতিকে বোধশক্তি দিয়ে তৈরি করেছেন। প্রথম পর্যায়ে ইয়াকিন (বিশ্বাস)। দ্বিতীয় পর্যায়ে আক্বল, তৃতীয় পর্যায়ে চিন্তা-ভাবনা। চতুর্থ পর্যায়ে ইলম্ (জ্ঞান)। এই পর্যায়গুলির ধারণা কমবেশী পরিলক্ষিত হয় সমাজে মানবের কর্মকান্ডে। কিন্তু মানুষ যখন নিজের বিবেক কাজে না লাগিয়ে এসকল অন্ধ জাহেলমার্কা হুজুরদের অনুসরণ করে তখন আর কিছুই করার থাকে না।
যাইহোক…মূল আলোচনায় আসি। এখন তাহলে একটি প্রশ্নই থেকে যায়। সেটি হলো – আমরা তাহলে কখন ইফতার করিবো ? বা ইফতারের সঠিক সময়ই বা কোনটি ? বা কখন ইফতার করলে রোজা সঠিক হবে ?
আমরা এটা খুব ভালোভাবেই জানি যে আমাদের আলেমগণ আমাদেরকে সন্ধায় ইফতার করার জন্য উৎসাহিত করে থাকেন। যেখানে আল্লাহ পাক স্বয়ং বলছেন –
ثُمَّ أَتِمُّ الْصِياَمَ إلَيْلِ
ㅤ অর্থ:– “অতঃপর রোজা পূর্ণ করিবে রাত্রি পর্যন্ত।” ¹²
ㅤঅর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে রাত অবধি রোজা পূর্ণ করার হুকুম রয়েছে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হতে পারে যে, সন্ধ্যা আর রাত কি আলাদা❓প্রশ্নের মতো উত্তরটাও অনেক সহজ। উত্তর হলো : হ্যাঁ, অবশ্যই আলাদা। কেননা যারা সামান্য হলেও জ্ঞান রাখেন তারা জানেন যে সূর্য অদৃশ্য হওয়ার পর পশ্চিম আকাশে যে লালিমা দেখা যায় সেটাকে বলা হয় গোধূলি লগ্ন। গোধূলি লগ্ন বলতে সন্ধ্যাকালও বোঝায় (সন্ধ্যাকালীন একটি মুহূর্ত)। অর্থাৎ দিনের শেষে এবং রাতের আগে যখন মাঠ থেকে রাখাল গরুর পাল নিয়ে গোয়ালে ফেরে, তখন গরুর পায়ের খুড়ের আঘাতে, পথের ধুলো উড়তে থাকে। তাই এ সময়কে “গোধূলি” বলা হয়। যেটাকে আরবীতে বলা হয় শাফাক্ব (সন্ধ্যা)। তখনও পরিবেশে যথেষ্ট পরিমাণ আলো বিদ্যমান থাকে।
আল্লাহ পাক বলেন –
فَلَآ أُقْسِمُ بِٱلشَّفَقِ
অর্থ-: “আমি শপথ করি সন্ধ্যাকালীন লাল আভার।” ¹³
ㅤএর প্রায় ১৫-২০ মিনিট পরেই যখন চারিদিক অন্ধকারে একাকার হয়ে যায় তখনই হলো রাত, যেটাকে আরবীতে বলা হয় “লাইল”।
وَٱلَّيْلِ وَمَا وَسَقَ
অর্থ:- “এবং রাত্রির, এবং তাতে যার সমাবেশ ঘটে।” ¹⁴
ㅤ❏ আরবীতে – দিনকে আরবীতে বলে – “নাহার”
ㅤㅤㅤ ㅤ ভোরকে আরবীতে বলে – “সুবেহ”
ㅤㅤㅤ ㅤ সকালকে আরবীতে বলে – “ফজর”
ㅤㅤㅤ ㅤ মধ্যান্হকে আরবীতে বলে – “জোহর”
ㅤㅤㅤ ㅤ বিকালকে আরবীতে বলে – “আসর”
ㅤㅤㅤ ㅤ সন্ধ্যাকে আরবীতে বলে – “শাফাক”
ㅤㅤㅤ ㅤ রাতকে আরবীতে বলে – “লাইল”
ㅤআল কুরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন –
ㅤ وَٱلنَّهَارِ إِذَا جَلَّىٰهَا وَٱلَّيْلِ إِذَا يَغْشَىٰهَا
ㅤঅর্থ:– “শপথ দিবসের যখন সে সূর্যকে প্রখরভাবে প্রকাশ করে। শপথ রাত্রির যখন সে সূর্যকে আচ্ছাদিত করে।” ¹⁵
ㅤআল্লাহ পাক আরো বলেছেন –
ㅤ وَءَايَةٌ لَّهُمُ ٱلَّيْلُ نَسْلَخُ مِنْهُ ٱلنَّهَارَ فَإِذَا هُم مُّظْلِمُونَ
ㅤঅর্থ:– “তাদের জন্যে এক নিদর্শন রাত্রি, আমি তা থেকে দিনকে অপসারিত করি, তখনই তারা অন্ধকারে থেকে যায়।” ….¹⁶
ㅤوَ جَعَلۡنَا الَّیۡلَ وَ النَّہَارَ اٰیَتَیۡنِ فَمَحَوۡنَاۤ اٰیَۃَ الَّیۡلِ وَ جَعَلۡنَاۤ اٰیَۃَ النَّہَارِ مُبۡصِرَۃً لِّتَبۡتَغُوۡا فَضۡلًا مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ لِتَعۡلَمُوۡا عَدَدَ السِّنِیۡنَ وَ الۡحِسَابَ ؕ وَ کُلَّ شَیۡءٍ فَصَّلۡنٰہُ تَفۡصِیۡلًا ﴿۱۲﴾
ㅤঅর্থ:– “আমি রাত ও দিনকে করেছি দু’টি নিদর্শন; রাতকে করেছি নিরালোক এবং দিনকে করেছি আলোকময়, যাতে তোমরা তোমাদের রবের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা বর্ষ সংখ্যা ও হিসাব স্থির করতে পার; এবং আমি সব কিছু বিশদভাবে বর্ণনা করেছি।” ¹⁷
আল্লাহ পাকের বক্তব্য (উপরিউক্ত ১৬ এবং ১৭ নং টিকা) অনুসারে –
❏ দিন – আলোকময়
❏ রাত – অন্ধকার
ㅤকিন্তু রমজান মাসে যখন মাগরিবের আযান দেওয়া হয় তখন চারিদিকে যথেষ্ট পরিমাণ আলো বিদ্যমান থাকে যা আরো ১৫/২০ মিনিটের জন্য স্থায়ী হয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাকি ১১ মাসে মাগরিবের আযান দেয়া হয় সূর্যাস্তের ৮/১০ মিনিট পরে কিন্তু রমযান মাসে আযান দেওয়া হয় সূর্যাস্তের মাত্র ২/৩ মিনিট পরে। প্রায় ১৪ ঘন্টার বেশি রোযা রেখে সামান্য ১৫/২০ মিনিটের জন্য তাড়াহুড়া করে সম্পূর্ণ রোযাটিকে নষ্ট করার কোন অর্থ থাকতে পারে না।
ㅤহাদিসে আসছে –
ㅤوكلوا واشربوا حتى يتبين لكم الخيط الأبيض من الخيط الأسود من الفجر ثم أتموا الصيام إلى اليل فيه البراء عن النبي
ㅤঅর্থ:- “আর তোমরা খাও ও পান কর যতক্ষণ না ফজরের কালো রেখা দূর হয়ে সাদা রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠে। আর রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ করো।” বারাআ (রা) এ সম্পর্কিত হাদীস নবী (সঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। ¹⁸
ㅤআরো বর্ণিত হয়েছে –
ㅤعن عدي بن حاتم قال لما نزلت حتى يتبين لكم الخيط الأبيض من الخيط الأسود عمدت الى عقال أشـود والى عقال أبيض فجعلتهما تحت وسادتي فجعلت أنظر في الليل فلا يستبين لي فغدوت على رسول الله ﷺ فذكرت ذلك له فقال ائما ذلك سواد الليل وبياض النّهار
ㅤঅর্থ:- “আদী ইবনে হাতেম (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, যে সময় “খাও ও পান কর যতক্ষণ না ফজরের কালো রেখা দূর হয়ে সাদা রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠে” নাযিল হল তখন আমি একটি কালো ও একটি সাদা রংয়ের সুতা নিয়ে আমার বালিশের নীচে রেখে দিলাম। রাতের বেলা আমি (রশি দু’টি বার বার) দেখতে থাকলাম। কিন্তু তা স্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম না। সকালে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে গিয়ে সব বর্ণনা করলাম। তিনি বললেন, এর অর্থ হল রাতের অন্ধকার ও দিনের আলো।” ¹⁹
ㅤরাত পেরিয়ে দিন না হওয়া অবধি সাদা ও কালো সুতো আলাদা করা যায় না। ঠিক তেমনি দিন পেরিয়ে ঠিক যে মুহূর্তে গিয়ে সাদা সুতো ও কালো সুতো চিহ্নিত করার মতো অবস্থা থাকে না, অর্থাৎ আর আলাদা করা যায় না সেটাই হলো রাতের শুরু। কিন্তু আজকাল যে সময়ে মাগরিবের আযান দেওয়া হয় তখন কালো ও সাদা সুতো চিহ্নিত করা তো দূরের কথা, খোলা আসমানের নিচে ৩০ হাত দুর থেকে কেও চলাচল করলেও স্পষ্ট দেখা যায়। তাহলে কেনো আমরা নিজেদের রোজা নষ্ট করছি ?
ㅤআহলে সুন্নাতের বিশিষ্ট মুজতাহিদ ইমাম মালেক (রহ.) তার মুয়াত্তা গ্রন্থে লিখেছেন –
ㅤ۸- وحدثني عن مالك ، عن ابن شهاب ، عن حميد بن عبد الرحمن ؛ أن عمر بن الخطاب وعثمان بن عفان كانا يصليان المغرب ، حين ينظران إلى الليل الأسود، قبل أن يفطرا. ثم يفطران بعدا الصلاة ، وذلك في رمضان
ㅤঅর্থ:– “হুমায়দ ইবন আবদুর রহমান (র) হইতে বর্ণিত উমর ইবন খাত্তাব (রা) এবং উসমান ইবন আফ্ফান (রা) উভয়ে মাগরিবের নামায পড়িতেন, এমন সময় তখন তাঁহারা রাত্রির অন্ধকার দেখিে পাইতেন। (আর ইহা হইত) ইফতার করার পূর্বে। অতঃপর তাঁহারা (উভয়ে) ইফতার করিতেন। আর ইহা হইত রমযান মাসে।” ²⁰
ㅤㅤঅর্থাৎ, আহলে সুন্নাতের খলিফাগণও রাতের অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত ইফতার করতেন না। তাহলে তাদের নিকট আমার একটি প্রশ্ন হলো, “হাদীস ০১” এর দৃষ্টিতে উক্ত খলিফাগণ কল্যাণের বাহিরে ছিলেন। এমনকি কিছু কিছু হাদীস অনুযায়ী যারা ইফতার করতে দেরি করেন তাদেরকে ইহুদি নাসারা ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে। তাহলে আপনাদের খলিফাগণও কি সেই ইহুদি নাসারা ট্যাগ পাবেন??? নাকি এই ট্যাগ কেবল মাত্র “জাফরী ফিকহ” এর অনুসারীদের জন্যই প্রযোজ্য।
ㅤদুঃখের বিষয় হলো বর্তমান মুসলিম-সমাজ আল্লাহর কালাম আল কুরআন তো নয়ই, বরং তাদের খলিফাগণের অনুসরণও করে না। ইজমা এবং কিয়াসের মাধ্যমে আল্লাহর আয়াতকে বিকৃত করে মুসলিম উম্মাহকে গোমরাহ করছে মুসলমানদের উচ্চ পদস্থ পন্ডিতগণ। তাদের ইজমা কিয়াসের ভিড়ে কুরআনের আয়াত-ই আমাদের কাছে মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বলেছেন –
ㅤوَٱلَّذِينَ سَعَوْ فِىٓ ءَايَٰتِنَا مُعَٰجِزِينَ أُو۟لَٰٓئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مِّن رِّجْزٍ أَلِيمٌ
ㅤঅর্থ:- “আর যারা আমার আয়াত সমূহকে ব্যর্থ করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়, তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি।” ²¹
ㅤপরিশেষে বলতে চাই – জীবন আপনার, সিদ্ধান্তও আপনার। আপনি আপনার রোজা নষ্ট করবেন না কী করবেন সেটা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত বিষয়। আপনাকে সঠিক জিনিসটা জানানোর মাধ্যমে আমার দায়িত্ব এখানেই শেষ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন –
وَمَن يُضْلِلْ فَلَن تَجِدَ لَهُۥ وَلِيًّا مُّرْشِدًا
অর্থ:- “..এবং তিনি (আল্লাহ) যাকে পথভ্রষ্ট করেন, আপনি কখনও তার জন্যে পথপ্রদর্শনকারী ও সাহায্যকারী পাবেন না।” ²²
তথ্যসূত্র :–
(1) সূরা বাকারা, আয়াত নং ২৮৩
(2)সহীহ বুখারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৬৮, পরিচ্ছেদ ১২২৭, হাদীস নং ১৮৩৩, ৪র্থ সংস্করণ – মার্চ ২০০৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
(3) সহীহ বুখারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৬৮, পরিচ্ছেদ ১২২৭, হাদীস নং ১৮৩৪, ৪র্থ সংস্করণ – মার্চ ২০০৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। (হাদীসটি সিহাহ সিত্তাহের প্রায় প্রতিটা গ্রন্থেই পাওয়া যায়)।
(4) সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত নং ১১।
(5) সূরা বাকারা, আয়াত নং ১৮৫।
(6) সহীহ বুখারী শরীফ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৬২, হাদীস নং ১৮২২, ৫ম সংস্করণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
(7) সহীহ মুসলিম, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৪৬, হাদীস নং ২৪৮১, ৪র্থ সংস্করণ, জুন ২০১০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
(সহীহ মুসলিম, ৩য় মখন্ড, পৃষ্ঠা ৪৫, হাদীস নং ২৪৭৫, ৪র্থ সংস্করণ, জুন ২০১০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
(9) সহীহ বুখারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৬০, পরিচ্ছেদ ১২১৬, হাদীস নং ১৮১৭, ৪র্থ সংস্করণ – মার্চ ২০০৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
(10) সূরা বাকারা, আয়াত নং ৪২।
(11) সূরা আন-আম, আয়াত নং ১১৬।
(12) সূরা বাকারা , আয়াত ১৮৭।
(13) সূরা আল-ইনশিকা , আয়াত ১৬।
(14) সূরা আল-ইনশিকা , আয়াত ১৭।
(15) সূরা আশ-শামস , আয়াত ৩-৪।
(16) সূরা ইয়া সিন , আয়াত ৩৭।
(17) সূরা বনী ইসরাইল , আয়াত ১২।
(18) সহীহ বুখারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৩৯, অনুচ্ছেদ নং ১৭, ১২শ প্রকাশ – সেপ্টেম্বর ২০১৪, আধুনিক প্রকাশনী।
(19) সহীহ বুখারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৪০, হাদীস নং ১৭৮১, ১২শ প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০১৪, আধুনিক প্রকাশনী।
(20) মুয়াত্তা ইমাম মালিক (রহ.), ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৫৮, রেওয়ায়েত নং ০৮, ৪র্থ সংস্করণ – ফেব্রুয়ারি ২০০২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
(21) সূরা সাবা, আয়াত নং ০৫।
(22) সূরা কাহফ, আয়াত নং ১৭।