এস, এ, এ
ইমাম রেযা (আ.)’এর মায়ের নাম ছিল তুকতাম এবং তিনি ছিলেন নাওবা নামক এলাকার অধিবাসি। যখন তিনি ইমাম কাযিম (আ.)’এর গৃহে প্রবেশ করেন তখন তার নাম রাখা হয় নাজমা খাতুন।
ইমাম রেযা (আ.)ও হজরত ফাতেমা মাসুমা (সা.আ.)’এর মায়ের নাম ছিল নাজমা খাতুন। (ইসবাতুল হুদা, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৩৩)
ইতিহাস ও বিভিন্ন রেওয়ায়েতে ইমাম রেযা (আ.)’এর মায়ের বিভিন্ন নাম বর্ণিত হয়েছে। শেইখ মুফিদ (রহ.) ইমাম রেযা (আ.)’এর মায়ের নাম মোকাররামা বলে উল্লেখ করেছেন। (আল ইরশাদ, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ২৪৭)
আবার অনেক স্থানে তাঁর মায়ের নাম সুকান, খায়যারান, সাকরা অথবা সুকরা, আরওয়া, উম্মুল বানিন আর ইমাম রেয়া (আ.)’এর জন্মের পরে ইমাম কাযিম (আ.) তাঁর নাম রাখেন তাহেরা। (আলামুল ওয়ারা বিআলামুল হুদা, পৃষ্ঠা ৩১৩)
ইতিহাসে তার জন্মস্থান নাওবা’তে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নাওবা বলতে কোন এলাকাকে বুঝানো হয়েছে? ইতিহাসে নাওবা বলতে বিভিন্ন এলাকাকে বুঝানো হয়েছে যেমন:
১- তিউনিসিয়ার একটি ছোট শহরকে নাওবা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
২- মদিনা থেকে তিন দিনের দূরত্বে অবস্থিত একটি এলাকাকে বুঝানো হয়েছে।
৩- লোহিত সাগর কাছাকাছি সাগর একটি অঞ্চলকে বুঝানো হয়েছে।
৪- মিশরের দক্ষিনাঞ্চলের একটি এলাকাকে নাওবা বলা হয়েছে।
তবে ঐতিহাসিকদের মতে নাজমা খাতুন ছিলেন মিশরের দক্ষিনাঞ্চল নাওবা’র অধিবাসি। কেননা দ্বিতিয় শতাব্দির মধ্যেবর্তি সময়ে বন্দি হয়ে মদিনাতে আসেন। আর ইসলামি ইতিহাসের গ্রন্থ সমূহে মুসলমানদের মাধ্যেমে আফ্রিকার বিভিন্ন এলাকার বিজয়ের কথা উল্লেখিত হয়েছে। আর নাজমা খাতুন হচ্ছেন মিশরের দক্ষিণাঞ্চলের অধিবাসি। বর্তমানে উক্ত স্থানটি মিশর এবং সুদানের দক্ষিণে অবস্থিত।
যখন উক্ত মহিয়সি নারি মদিনাতে প্রবেশ করেন তখন ইমাম কাযিম (আ.) নাজমা খাতুনকে তাঁর মায়ের কাছে প্রেরণ করেন। তখন ইমাম কাযিম (আ.)’এর মা হামিদা বানু তাকে ধর্মিয় শিক্ষা দান করেন। পরে যখন ইমাম কাযম (আ.) তাঁকে বিবাহ করেন তখন তিনি পর্যায়ক্রমে ইমাম রেযা ও ফাতেমা মাসুমা (সা.আ.)কে গর্ভে ধারণ করেন। সুতরাং ইমাম রেযা (আ.) ও হজরত ফাতেমা মাসুমা (সা.আ.) হচ্ছে সহোদর। (বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৪৯, পৃষ্ঠা ৭)
শেইখ সাদুক এবং মরহুম কুলাইনি (রহ.) ইমাম কাযিম (আ.) ও নাজমা খাতুনের বিবাহের সম্পর্কে এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, হজরত হামিদা খাতুনের স্বপ্নে হজরত মোহাম্মাদ (সা.) আসেন এবং তাঁকে তিনি নির্দেশ দেন যে, তুমি তোমার সন্তানের সাথে নাজমা খাতুনের বিবাহ দিয়ে দাও। আর তিনিও উক্ত স্বপ্ন মোতাবেক ইমাম কাযিম (আ.)’এর সাথে নাজমা খাতুনের বিবাহ দিয়ে দেন।
মরহুম কুলাইনি (রহ.)’এর বর্ণনমতে ইমাম নিজে হেশাম বিন আহমার’কে বলেন তুমি কি জান যে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে কেউ মদিনাতে এসেছে? তখন হেশাম বিন আহমার ইমাম (আ.)’এর সাথে এক দাশ বিক্রেতার কাছে আসে। তখন সে ব্যাক্তি তাঁদের সমিপে ৭ জন দাসিকে উপস্থাপন করে। তখন ইমাম (আ.) তাকে বলেন আমরা যে ধরণের দাসি চাচ্ছি তাকে নিয়ে আস। কিন্তু দাস বিক্রেতা রাজি হয় না। সে বলে যে উক্ত দাসিটি হচ্ছে দূর্বল এবং অসুস্থ। পরের দিন ইমাম (আ.)আবার হেশামকে প্রেরণ করেন এবং বলেন উক্ত দাশ বিক্রেতার কাছে যাও এবং সে যে শর্তই রাখুক না কেন তুমি তা মেনে দাশিটিকে ক্রয় করে নিবে। অবশেষে উক্ত দাশ বিক্রেতা হেশঅমের কাছে দাশিটিকে বিক্রয় করে দেয়। তখন হেশাম উক্ত দাশ বিক্রেতার কাছে তার অসম্মতির কারণ জানতে চায়। তখন উক্ত দাশ বিক্রেতা তাকে বলে যে, আমকে একজন আহলে কিতাবের সম্মানিত নারি আমাকে বলেছিলেন যে, তোমার মতো লোকের কাছে উক্ত সম্মানিত দাশিটির অবস্থান শোভনিয় না। কেননা তার মালিকের মাধ্যেমে যে সন্তানটি জন্মলাভ করবে তিনি হবেন পূর্ব থেকে পশ্চিম এলাকার মধ্যে এমন এক ব্যাক্তি, যার কোন সমকক্ষ থাকবে না। যখন উক্ত দাসি অর্থাৎ নাজমা খাতুনকে ইমাম কাযিম (আ.)’এর কাছে আনা হয় তারপরে ইমাম রেযা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। (উসুলে কাফি, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৪৮৬, আল ইরশাদ, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ২৫৪)
ইমাম কাযিম (আ.)’এর ত্বত্তাবধানে নাজমা খাতুন:
হেশাম ইমাম কাযিম (আ.)’এর নির্দেশ অনুযায়ি উক্ত দাসিটিকে ক্রয় করে ইমাম (আ.)’এর বাড়িতে নিয়ে আসে। তখন সেখানে ইমাম কাযিম (আ.)’এর কিছু সাহাবি উপস্থিত ছিলেন। তারা ইমাম (আ.)কে হেশামের কাছ থেকে উক্ত ঘটনাটি শোনার পরে ইমাম (আ.)কে জিজ্ঞাসা করে: হে ইমাম (আ.)! আপনি কেন উক্ত দূর্বল এবং অসুস্থ দাসিটিকে ক্রয় করেছেন?
ইমাম কাযিম (আ.) তাদের জবাবে বলেন যে আমি উক্ত দাসিটিকে ঐশি ইলহামের কারণে ক্রয় করেছি!
তারা জিজ্ঞাসা করে কেমন ইলহাম?
আমি গতকাল রাতে রাসুল (সা.) এবং আমার পূর্বপুরুষ ইমাম বাকের ও জাফর সাদিক (আ.)কে স্বপ্নে দেখি। তাঁরা আমার কাছে আসেন এবং সিল্ক কাপড়ে বাধা একটি পোটলার বাধনকে খোলেন। উক্ত পোটলাতে একটি জামা রাখা ছিল এবং উক্ত জামাতে দাশিটির ছবি ছিল।
ইমাম (আ.)’এর নির্দেশনায় জিবন পরিচালনা:
হজরত নাজমা খাতুন ইমাম কাযিম (আ.)’এর পরিকল্পনা ও নির্দেশ অনুযায়ি নিজের জিবনকে পরিচলনা করেন। আর এভাবেই তিনি আখলাকের চরম উৎকর্ষে পৌছে যান।
ইমাম কাযিম (আ.)’এর কাছে তিনি শুধুমাত্র সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষাই অর্জন করেননি বরং ইমাম (আ.)’এর কাছ থেকে তিনি মারেফতের জ্ঞানও অর্জন করেন। তিনি প্রত্যেকদিন ইমাম কাযিম (আ.)’এর মা ‘হজরত হামিদা খাতুন’এর কাছে যেতেন এবং তাঁর কাছেও ধর্মিয় আহকাম সহ বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করতেন। (যানানে মারদ অফারিনে তারিখ, পৃষ্ঠা ১৭৪, উসুলে কাফি, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৪৭৬, মুনতাহিউল আমাল, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৩৫)
হজরত হামিদা খাতুনও তাঁকে আগ্রহের সহিত ধর্মিয় জ্ঞান দান করতেন। ধিরে ধিরে হজরত নাজমা খাতুন ধর্মিয় জ্ঞানে শিক্ষিত এবং বিভিন্ন জ্ঞান গরিমার চরম উৎকর্ষে পৌছে যান।
একদা ইমাম কাযিম (আ.) নাজমা খাতুন সম্পর্কে তাঁর সন্তান ইমাম রেযা (আ.)কে বলেন যে, আমি তোমার মায়ের মতো খুব কম মহিলাকেই চিনি যারা এত অল্প সময়ের মধ্যেই এত উন্নতি সাধন করেছে। (যানানে মারদ অফারিনে তারিখ, পৃষ্ঠা ১৭৪)
আর হয়তো এ কারণেই ইমাম (আ.) এবং তাঁর পরিবারের লোকজন তার নাম রাখেন নাজমা।
সম্মানিত সন্তানদ্বয় জন্মদানের সৌভাগ্যে অর্জন:
ইমাম কাযিম (আ.)’এর সাথে বিবাহের কিছু দিন পরেই হজরত নাজমা খাতুন গর্ভবতির চিহ্নাবলি অনুভব করেন। তিনি বলেন: আমি আমার গর্ভের সন্তানের ভারত্বের উপলব্ধি করি কিন্তু তার ভারত্বের কষ্টকে অনুভব করি না। (বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৪৯, পৃষ্ঠা ৯, মুনতাহিউল আমাল, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৪৫৯)
কিন্তু হজরত নাজমা খাতুন বলেন যে, আমি আমার গর্ভের সন্তানের বিভিন্ন যিকিরের শব্দকে শুনতে পেতাম। (বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৪৯, পৃষ্ঠা ৯, মুনতাহিউল আমাল, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৪৫৯)
হজরত নাজমা খাতুন তাঁর প্রথম সন্তান ইমাম রেযা (আ.) ১৪৮ হিজরি জিলকদ মাসে রোজ বৃহঃস্পতিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর দ্বিতিয় সন্তান হজরত ফাতেমা মাসুমা (সা.আ.)কে ১৭৩ হিজরি ১লা জিলকদে জন্মদান করেন। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ৪৫ বছর আগেই হজরত ফাতেমা মাসুমা (সা.আ.)’এর জন্মের খবর দিয়েছিলেন। (বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৪৮, পৃষ্ঠা ৩১৭, মুনতাহিউল আমাল, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৪৩২)
নাজমা খাতুনের ইবাদত:
নাজমা খাতুন অত্যাধিক ইবাদত করতেন এবং ইবাদতের মাঝে তাঁর সন্তানদের লালন পালন করতেন। রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম রেযা পর্যাপ্ত পরিমাণে মায়ের দুধ খেতেন আর এ কারণে তিনি অতিদ্রুত বেড়ে উঠেন। (বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৪৯, পৃষ্ঠা ৫)
হজরত নাজমা খাতুন বলেন যে, আমার জন্য একজন ধাত্রির ব্যাবস্থা কর যেন আমি আল্লাহর বেশি বেশি ইবাদত ও যিকরে নিজেকে নিমগ্ন রাখতে পারি। (রিয়াহিনুশ শারিয়াহ, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২২)
হজরত নাজমা খাতুন’এর ওফাত:
হজরত ফাতেমা মাসুমা (সা.আ.)’এর জন্মগ্রহণের কয়েক বছর পরে মদিনাতে হজরত নাজমা খাতুন মারা যান। তাঁর ওফাত, কবরস্থান এবং তাঁর মাজার সম্পর্কে ইতিহাসে তেমন কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তবে মনে করা হয় যে, হামিদা খাতুনের পাশে ‘মাশরাবা’ নামক স্থানে যা পূর্ব হাররা নামক স্থানের কাছে অবস্থিত ছিল সেখানে তাঁকে দাফন করা হয়। তবে উক্ত স্থানটিকে ওহাবিরা ভেঙ্গে ফেলেছে এবং বর্তমানে তার আর কোন চিহ্নাবলি অবশিষ্ট নেই। তবে প্রত্যেক বছর উক্ত এলাকাতে হজরত নাজমা খাতুনের যিয়ারতেরে উদ্দেশ্যে হাজিদের সমাগম ঘটে। (আসারে ইসলামি মাক্কে ওয়া মাদিনে, পৃষ্ঠা ২১২)