এস, এ, এ
মুহাম্মাদ বিন উসমান বিন সাঈদ আমরী ইমাম মাহদী (আ.)’র দ্বিতীয় নায়েব ছিলেন। মুহাম্মাদ তার পিতার সহায়ক এবং ইমাম মাহদী (আ.)’র উকিল ছিলেন। উসমান বিন সাঈদের মৃত্যুর পরে মুহাম্মাদ বিন উসমান প্রায় ৪০ বছর (২৬৫- ৩০৫) ইমাম মাহদী (আ.)’র গায়বাতে সুগরার যুগে ওকালতির দায়িত্ব পালন করেন। ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র বর্ণিত রেওয়ায়েত এবং ইমাম মাহদী (আ.)’র চিঠিতে মুহাম্মাদ বিন উসমানের কথা বর্ণিত হয়েছে তারপরেও ইমামদের উকিল পরিষদের কিছু লোক তাঁর ওকালতি সম্পর্কে সন্দিহান ছিল আবার কিছুজন নিজেদেরকে ইমামের উকিল বলে দাবী করেছিল। মুহাম্মাদ বিন উসমানের উকিল পরিষদের কিছু ব্যাক্তি তার সহায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতো। ফিক্বহ সম্পর্কিত তাঁর কিছু লিখনী আছে তাতে ইমাম মাহদী (আ.) সম্পর্কিত তাঁর কিছু রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হয়েছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ দোয়া ও যিয়ারত মুহাম্মাদ বিন উসমান হতে বর্ণিত হয়েছে যেমন: দোয়া সামাত, দোয়া ইফতেতাহ, যিয়ারতে আলে ইয়াসীন ইত্যাদি।
জন্ম:
ইতিহাসে মুহাম্মাদ বিন উসমানের জন্ম তারিখ স্পষ্টভাবে কোথাও বর্ণিত হয়নি। তার নাম ছিল মুহাম্মাদ তার পিতার নাম ছিল উসমান। তার উপনাম ছিল আবু জাফর। তিনি বণি আসাদ গোত্রের লোক ছিলেন।
মুহাম্মাদের কয়েকটি উপাধি বর্ণিত হয়েছে যেমন: আমরী, আসাদী, কুফি, সাম্মান, আসকারী এবং খাল্লানী।
ইমাম জামানের প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব অর্জন:
ইমাম হাসান আসকারী (আ.) ইমাম মাহদী (আ.)’র জন্য মুহাম্মদ ইবনে উসমানের প্রতিনিধিত্বকে নির্দিষ্ট করেছিলেন। একদা ইয়েমেন থেকে একদল শিয়া সামেরা শহরে ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র কাছে, ইমাম আসকারী (আ.) উসমান বিন সাঈদকে ডাকে এবং মুহাম্মাদের উকিল হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং তাকে মৃত্যুর সংবাদ দেন। তিনি মুহাম্মাদকে ইমাম মাহদী (আ.)’র উকিল নির্বাচন করেন।
শেখ তুসী তার আল গ্বীবা নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে মুহাম্মাদ বিন উসমান এবং উসান বিন সাঈদ উভয়েই ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র বিশ্বস্ত এবং সেকা ছিলেন। ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র এই হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, মুহাম্মাদ ও তার পিতা উসমান তোমাদের কাছে যা পৌছায় তা আমার পক্ষ থেকে এবং যা কিছু বলে তা আমার কথা। তোমরা তাদের কথা শোন এবং তাদের অনুসরণ কর কেননা তারা হচ্ছে সেকা ও আমাদের বিশ্বস্ত।
শোকবার্তার কিছু অংশ:
তোমার পিতা সৌভাগ্যবান কেননা সে তোমার মতো সন্তান পেয়েছে। তুমি তার আদেশে খলিফা ও তাঁর উত্তরসূরী হবে এবং তাঁর উপর অনুগ্রহ করবে ও তার কাছ ক্ষমা চেয়ে নিবে। আল্লাহ তায়ালা যেন তোমাকে সাহায্যে এবং তোমাকে শক্তি দান করেন। তিনি যেন তোমাকে সাফল্য দান করেন এবং তোমাকে রক্ষা করেন।
শেখ তুসী’র রেওয়ায়েতের বর্ণনা অনুযায়ি যখন ইমাম মাহদী (আ.)’র প্রথম নায়েব মারা যান তখন তার সন্তান মুহাম্মাদ তাকে গোসল দেয়, কাফন পরান এবং দাফন করেন। ইমাম মাহদী (আ.) একটি শোকবার্তা মুহাম্মাদকে প্রেরণ করেন যাতে তিনি মুহাম্মাদকে উদ্দেশ্য করে সান্তনামূলক বাণি লিখা ছিল।
নায়েব দায়িত্বের সময়কাল:
শেখ তুসী তার “আল গ্বীবা” নামক গ্রন্থে লিখেছেন মুহাম্মাদ বিন উসমান ইমাম মাহদী (আ.)’র নায়েবের দায়িত্ব প্রায় ৫০ বছর পালন করেন। তবে সৈয়দ মুহাম্মাদ সাদর এই বিষয়ে সহমত পোষণ করেননি। কেননা মুহাম্মাদ বিন উসমান ৩০৫ হিজরীতে মারা যান ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র শাহাদতের সাথে প্রায় ৪৫ বছরের ব্যাবধান রয়েছে, সেই সময় (৫বছর) তার পিতা উসমান ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র নায়েবের দায়িত্ব পালন করছিলেন। সুতরাং দ্বিতীয় নায়েব ৪০ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন না ৫০ বছর।
ইমাম মাহদী (আ.)’র নায়েবের বিরোধকারীগণ:
যারা ইমাম মাহদী (আ.)’র দ্বিতীয় নায়েবের বিরোধিতা করেছিলেন এবং নিজেদেরকে ইমাম (আ.)’র নায়েব বলে দাবী করেছিলেন:
১. হাসান শারিয়ী।
২. মুহাম্মাদ বিন নাসির নুমাইরী।
৩. আহমাদ বিন হেলাল এবরাতায়ী।
৪. মুহাম্মাদ বিন আলী বিন বেলাল।
৫. মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন উসমান ওরফে আবু বকর বাগদাদী।
৬. ইসহাক্বে আহমার।
৭. হুসাইন বিন মানসুর হাল্লাজ।
নায়েবের দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের সমস্যাবলি:
মুহাম্মাদ বিন উসমান যখন ইমাম মাহদী (আ.)’র নায়েবের দায়িত্ব পালনকালে যে সকল সমস্যার সম্মুখিন হন তা নিন্মরূপ:
১. কারামাতা ফেরক্বার বিদ্রোহ।
২. ইসমাঈলী ফেরক্বার একটি শাখা দাবী করে।
৩. কারামাতার বিদ্রোহের কারণে আব্বাসী হুকুমত ইমামের অনুসারীদের বিরূদ্ধে কঠোরতা অবলম্বন করে।
৪. তাদের বিদ্রোহকে তারা ইমাম মাহদী (আ.)’র সাথে সম্পৃক্ত করার অপচেষ্টা চালায়।
৫. তারা নিজেদেরকে ইমাম মাহদী (আ.)’র আবির্ভাবের ক্ষেত্র তৈরীর সহায়ক বলে দাবী করে।
৬. মুহাম্মাদ বিন উসমানের প্রতি অভিসম্পাতকে তারা ইমাম মাহদী (আ.)’র সাথে সম্পৃক্ত করে।
৭. বাসরাতে ‘যানাজ’ নামক আন্দোলন।
মুহাম্মাদ বিন উসমান নায়েবের কর্ম পদ্ধতি:
মুহাম্মাদ বিন উসমান সেই গোলযোগপূর্ণ সময়ে নিজের কর্ম পদ্ধতিতে তাকিয়া অবলম্বন করতেন। তিনি এমনভাবে চলতেন যেন ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র কোন স্থলাভিষিক্ত ছিল না। তার নায়েবের দায়িত্বের কর্মগুলো তিনি তাকিয়ার মাধ্যমে সম্পাদন করতেন। তিনি কখনও ইমাম মাহদী (আ.)’র নাম জন সম্মুখে আনতেন না যেন আব্বাসী হুকুমত নিশ্চিত হয় যে ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র কোন উকিল ছিল না। মুহাম্মাদ বিন উসমানের এই কর্ম পদ্ধতির কারণ ছিল যেন তিনি হুকুমতের আক্রোশ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন এবং আব্বাসী শাষক মনে করে যে শিয়াদের কোন নেতা নেই এবং তারা আর কিয়াম করতে পারবে না।
১. ইমাম মাহদী (আ.)’র নাম এবং তাঁর অবস্থানকে গোপন করা।
২. বিভিন্ন এলাকার সহায়ক উকিলদের তদারকি করা।
৩. ইমাম (আ.)’র জন্য তহবিল সংগ্রহ।
৪. গোলাত ও মিথ্যাদাবীদারদের দমন।
৫. আকিদাগত ও ফিক্বহি প্রশ্নের উত্তর প্রদান।
মুহাম্মাদের এজেন্ট এবং সহায়কবৃন্দ:
মুহাম্মাদ বিন উসমানের দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন এলাকায় যারা তার এজেন্ট এবং সহায়ক ছিল তারা মুহাম্মাদ থেকে হাদীস বর্ণনা করতো। ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে যে, বাগদাদে প্রায় ১০জন মুহাম্মাদের সহায়ক ছিল যারা তার নেতৃত্বে কাজ করতো তন্মধ্যে একজন ছিলেন হুসাইন বিন রূহ। যিনি পরবর্তিতে ইমাম মাহদী (আ.)’র তৃতীয় নায়েব হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। মুহাম্মাদের অন্যান্য সহায়কবৃন্দ ছিলেন নিন্মেরূপ:
১. ইসহাক্ব বিন ইয়াকুব।
২. জাফার বিন উসমান মাদায়েনী।
৩. মুহাম্মাদ বিন হাম্মাম বাগদাদী।
৪. আব্দুল্লাহ বিন জাফর হুমাইরী।
৫. কাসিম বিন আলা
৬. মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহিম মাহযিয়ার।
৭. আলী বিন আহমাদ দালালে কুম্মী।
৮. গীয়াস বিন উসাইদ।
৯. আহমাদ বিন ইব্রাহিম নৌবাখতি।
মুহাম্মাদের লেখনি ও রেওয়ায়েত:
মুহাম্মাদ বিন উসমান থেকে ইমাম মাহদী (আ.) সম্পর্কে রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে যেমন: ইমাম মাহদী (আ.)’র জন্মগ্রহণ, ইমাম মাহদী (আ.)’র সাথে সাক্ষাতের ঘটনা, গায়বাতে সুগরার সময় তাঁর নাম উচ্চারণে বাধা সংক্রান্ত, দোয়ায়ে নামাত, দোয়া ইফতেতাহ, যিয়ারতে আল ইয়াসীন। মুহাম্মাদ কিছু রেওয়ায়েত তার পিতা হতে বর্ণনা করেছেন।
ফিক্বহ সংক্রান্ত বিষয়ে মুহাম্মাদ বিন উসমানের কিছু লেখনী রয়েছে যাতে ইমাম হাসান আসকারী (আ.) ও ইমাম মাহদী (আ.) হতে ফিক্বহ সংক্রান্ত বর্ণনা করেছেন। কিতাবুল আশরাবাহ নামক একটি গ্রন্থ ছিল যা আবু জাফরের কন্যা উম্মে কুলসুম মুহাম্মাদ বিন উসমানের ওসিয়ত অনুযায়ি ইমাম মাহদী (আ.)’র তৃতীয় নায়েব হুসাইন বিন রূহের কাছে হস্তান্তর করেন এবং পরবর্তিতে তিনি চতূর্থ নায়েব আবুল হাসান সামরী’র কাছে পৌছে দেন।
ওফাত:
রেওয়ায়েতের বর্ণনা অনুযায়ি মুহাম্মাদ বিন উসমান নিজের মৃত্যুর খবর দুই মাস পূর্বে দিয়েছিল। রাভি মুহাম্মাদ বিন উসমানকে জিজ্ঞাসা করে কেন আপনি নিজের জন্য কবর খনন করছেন? তিনি বলেন: আমাকে বলা হয়েছে যেন আমি আমার কাজগুলোকে সম্পন্ন করি কেননা দুই মাস পরে আমি মারা যাব।
আবুল হাসান আলী বিন আহমাদ দালাল কুম্মী রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন যে, একদা আমি আবু জাফর মুহাম্মাদ বিন উসমান’র কাছে যায়। দেখি তিনি একটি কাঠে কোরআনের আয়াত এবং ইমাম (আ.)গণের নামকে খনন করে নকশা করছেন। আমি মুহাম্মাদকে জিজ্ঞাসা করি যে এই ফলকটি কিসের? তিনি বলেন: এই ফলকটি আমার কবরের জন্য অচীরেই আমাকে এই কাঠের ওপরে রাখা হবে অথবা তিনি বলেছিলেন যে, আমি প্রত্যেকদিন কবরে এই ফলকটিতে হেলান দিয়ে এক পারা কোরআন পাঠ করি।
আবুল হাসান আলী বিন আহমাদ বলেন: একদা মুহাম্মাদ বিন উসমান আমার হাত ধরে আমাকে একটি কবরের দেখিয়ে বলেন: আমি অমুক দিন, অমুক, মাস এবং অমুক বছরে মারা যাব তখন এই ফলকটি আমার কবরে থাকবে। আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি এবং তার কথা অনুযায়ি দিন, মাস বছরের তারিখটি লিখে রাখি। কিছুদিন অতিবাহিত হতে না হতেই মুহাম্মাদ বিন উসমান অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং উল্লেখিত দিনে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন এবং ঐ কবরেই তাকে দাফন করা হয়।
মুহাম্মাদ বিন উসমান ৩০৫ হিজরী জামাদিউল মাসের শেষ তারিখে ইহলোক ত্যাগ করেন। তাকে তির পিতার কবরের পাশে দাফন করা হয়। মুহাম্মাদের মৃত্যুর পরে হুসাইন বিন রূহ তাঁর স্থানে ইমাম মাহদী (আ.)’র উকিল হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
তথ্যসূত্র:
১. বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৫১, পৃষ্ঠা ১৬, ৩৪৪, ৩৫১, খন্ড ৫১, পৃষ্ঠা ১৫২, খন্ড ৬৩, পৃষ্ঠা ১৯৭।
২. যিন্দেগানী নাওয়াবে খাস ইমামে যামান, পৃষ্ঠা ১৫৫, ১৭৯, ২২৭।
৩. রেজালে নাজ্জাশি, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০৮।
৪. তানক্বিহুল মেক্বাল, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৪৯।
৫. কামাল উদ্দিন, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৪, ২৮৩, ৫১০।
৬. আল কামেল, খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ১০৯।
৭. আল গ্বীবা, পৃষ্ঠা ২৪৩, ৩৫৬, ৩৬৪, ৩৬৬।
৮. রাহে তুসে আতাবাতে আলীয়াত, পৃষ্ঠা ৩৭৩, ৩৭৪, ৩৭৮।
৯. আলামুন নোবালা, পৃষ্ঠা ২২৩।
১০. তারিখে গ্বায়বাত, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৪০৪।
১১. সাযমানে ওয়েকালাত, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৬৯৪- ৭০৭।
১২. তারিখে সীয়াসি ইমামে দাওয়াযদাহুম, পৃষ্ঠা ১৭০, ১৭৫- ১৭৮।
১৩. মানাকেবে আলে আবি তালিব, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪২৯।
১৪. রেজালে তুসী, পৃষ্ঠা ৪৪৭।
১৫. খোলাসাতুল আকওয়াল, পৃষ্ঠা ২৫০।
১৬. তানক্বিহুল মেকাল, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৪৯।
১৭. মোজামে রেজালুল হাদীস, খন্ড ১৭, পৃষ্ঠা ২৯৪।
১৮. মেসবাহুল মোতাহাজ্জেদ, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৪১৭।
১৯. কাশফুল গুম্মা, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪২৮।
২০. তাবারী, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২০৯৯।
২১. ফেরাকুশ শিয়া, পৃষ্ঠা ৬৭- ৭৪।