Press "Enter" to skip to content

মৃত্তিকা কিম্বা মৃত্তিকাজাত বস্তুর উপর সেজদা

পবিত্র ইসলামের দৃষ্টিতে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে সেজদা করা সর্বাপেক্ষা গুরুত্ববহ ইবাদত কিম্বা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সমূহের অন্তর্ভূক্ত রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে,মানুষ অন্য যে কোন অবস্থা অপেক্ষা সেজদাবনত অবস্থাতে আল্লাহর তায়ালার নিকটতম। মহামানবগণ বিশেষত: রাসূলুল্লাহ (সা.) ও আহলে বাইতের পবিত্র ইমামগণ (আ.) দীর্ঘায়িত সেজদাবনত হতেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহর উদ্দেশ্যে দীর্ঘায়িত সেজদা  মানুষের মন ও আত্মাকে প্রশান্ত করে। সেজদা  প্রতিপালকের দরবারে  বন্দেগী ও উপাসনার সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত। আর এ কারণেই হয়তো প্রতি এক রাকাত নামাযে দু’টি সেজদা  আদায়ের আদেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সূরাতে ওয়াজীব ও মুস্তাহাব সেজদা  সমূহ এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত বহণ করে।

সেজদা র ন্যায় মানুষের কোন কাজই শয়তানকে অধিক ব্যথিত করে না। অপর একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে,রাসূলুল্লাহ (সা.) তার এক ঘনিষ্ঠ সাহাবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

و إذا أردت أن یحشرک الله معی یوم القیامة فأطل السجود بین یدی الله الواحد القهّار

“যদি চাও কিয়ামতের দিবসে আমার সাথে একত্রে অবস্থান করবে, তাহলে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য দীর্ঘায়িত সেজদা করবে।”

আমরা সুদৃঢ় আকিদা পোষণ করি যে, সেজদা শুধুমাত্র আল্লাহর এক ও অদ্বিতীয় স্বত্তা ব্যতিত অন্য কারও জন্য মোটেও জায়েয নয়। কেননা সেজদা  বন্দেগী ও উপাসনার চুড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। আর উপাসনা বা ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য নির্ধারিত।

পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,

“আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে সেজদাবনত হয়।”

আরবী ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী এ আয়াতে “আল্লাহ” শব্দটি বাক্যর শুরুতে বর্ণিত হওয়াতে তা হাস্র বা শুধুমাত্র অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ সেজদা  শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত।

এছাড়া সূরা আরাফের ২০৬ নং আয়াতে বর্ণিত( و له یسجدون  )শব্দটি অনুরূপ অর্থের প্রতি ইঙ্গিত বহণ করে।

বস্তুতঃ সেজদা -বিনয়ের চুড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ;যা শুধুমাত্র বিশ্বস্রষ্টার জন্য নির্ধারিত। যদি অন্য কোন ব্যক্তি বা বস্তুর জন্য সেজদা  করা হয়.তাহলে তাকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা হবে;যা আদৌ সঠিক নয় এবং শিরক হিসেবে পরিগণিত।

তওহীদ বা একত্ববাদের  অন্যতম অর্থ হচ্ছে ইবাদতের ক্ষেত্রে একত্ববাদের বিশ্বাস। অর্থাৎ ইবাদত কেবলমাত্র এক ও অদ্বিতীয় প্রতিপালকের জন্য প্রযোজ্য। আর এ বিশ্বাস ছাড়া একত্ববাদের অর্থ পরিপূর্ণতা লাভ করবে না। অন্যভাবে বলা যায়:আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারও উপাসনা শিরকের পরিচয়। আর সেজদা  হচ্ছে সর্বত্তোম উপাসনা। সতরাং সেজদা  একমাত্র আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারও জন্য আদৌ জায়েয নয়।

কিন্তু হযরত আদমের (আ.) জন্য ফেরেস্তারা যে সেজদা  (যা পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত হয়েছে) করেছেন তা খ্যাতনামা মুফাসসীরগণের বর্ণনানুসারে সম্মানসূচক সেজদা ই হিসেবে পরিগণিত। অর্থাৎ এ সেজদা  হযরত আদমের (আ.) প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য করা হয়েছে,না তাকে উপাসনার উদ্দেশ্যে। যেহেতু এ সেজদা ’র আদেশদাতা ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা,সেহেতু তার নিদের্শ পালন কিম্বা আনুগত্য প্রকাশের নিমিত্তে ফেরেস্তাবর্গ সেজদা  করেছেন। এ ধরণের সেজদা কে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা পোষণের সেজদাহ ও বলা যেতে পারে।

অনুরূপভাবে হযরত ইউসূফের (আ.)উদ্দেশ্যে হযরত ইয়াকুব (আ.),তার সন্তান ও স্ত্রীবর্গের সেজদা  ও একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,

“তারা সবাই তার (ইউসূফের) সামনে সেজদাবনত হলেন।”

অর্থাৎ এ ধরণের সেজদা ও সম্মান প্রদর্শনের নিমিত্তে কিম্বা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে শিয়া মাযহাবে অন্যতম প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ “ওসায়েলুশ শিয়া”-তে নামাযের সেজদা  অধ্যায়ে ‘আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারও জন্য সেজদা  জায়েয নয়’শীর্ষক একটি শিরোনাম রয়েছে। সেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মাসুম ইমামগণ (আ.) হতে সাতটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

সুবিজ্ঞ পাঠক সমাজের প্রতি বিশেষ অনুরোধ এ বিষয়টি ভালভাবে স্মরণ রাখবেন,কারণ আগামী আলোচনাতে আমরা এগুলোর উপর আলোকপাত করব।

কিসের উপর সেজদা  করা জায়েয?

রাসূলের (সা.) পবিত্র আহলে বাইতের (আ.) অনুসারীরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে আকিদা পোষণ করে যে,সেজদা অবশ্যই মৃত্তিকাজাত বস্তুর উপর হতে হবে। তবে শর্ত হচ্ছে আহার্য ও পরিধেয় কো বস্তু যেন না হয়;যেমন:গাছের পাতা,কাষ্ঠ,উদ্ভিজ্জ বস্তু দিয়ে তৈরী মাদুর কিম্বা এ ধরণের কোন মৃত্তিকাজাত বস্তুর উপর সেজদা  করা জায়েয।

পক্ষান্তরে সুন্নী মাযহবের ফিকাহবিদরা আকিদা পোষণ করেন যে,সব ধরণের বস্তুর উপর সেজদা  করা জায়েয অবশ্য তাদের মধ্যে কেউ কেউ জামার অস্তিন কিম্বা পাগড়ির কোন অংশ বিশেষের উপর সেজদা  করা কে জায়েয মনে করেন না।

যাই হোক,আহলে বাইতের (আ.) অনুসারীরা এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মাসুম ইমামগণ (আ.) হতে প্রসিদ্ধ হাদীস বর্ণিত হওয়াতে এবং বিশিষ্ট সাহাবীবর্গের আমলের কারণে উক্ত আকিদার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করে থাকেন। এজন্য হজ্বের মৌসুমে তারা মসজিদুল হারাম  মসজিদে নববীর যে সব স্থানে কার্পেট বিছানো থাকে,সে সব স্থানে সেজদা  করা হতে বিরত থাকে। বরং তারা কার্পেট বিহীন স্থানগুলোতে নামাজ আদায় করে এবং পাথরের উপর সেজদা করে। কেউ কেউ অবার সাথে ছোট মাদুর রাখে এবং তার উপর সেজদা  করে।

ইরান,ইরাক এবং শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চল সমূহের যে সব মসজিদে কার্পেট বিছানো থাকে,সেখানে মাটির তৈরি সেজদা গাহ’র (সেজদা র স্থান) রাখা হয় এবং তার উপর কপাল রেখে সেজদা  করা হয়। আর ‘এভাবে মানুষের শরীরের সবচেয়ে সম্মানজনক অঙ্গ তথা কপালকে মাটির উপর রেখে সর্ব শক্তিমান আল্লাহর দরবারে চুড়ান্ত বিনয়ী ও আনুগত্য প্রকাশ করা হয়। কখনও কখনও এ সেজদা গাহ কে আল্লাহর পথে প্রাণ বিসর্জনকারী শহীদদের শাহাদত স্থলের মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়। যাতে আল্লাহর পথে তাদের আত্মত্যাগ ও উৎসর্গের কথা স্মরণে আসে এবং গভীর একাগ্রতার সাথে নামায আদায় করা সম্ভব হয়। অবশ্য এক্ষেত্রে কারবালার মহান শহীদগণের শাহাদত স্থলের তুরবাত (পবিত্র মাটি) দিয়ে উক্ত সেজদা গাহ তৈরীর উপর তুলনামূলক বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু তাই বলে শুধুমাত্র তুরবাত কিম্বা সাধারণ মাটি দিয়ে তৈরী সেজদা ড়াহর উপরেই সেজদা  করা হয় এমনটি নয় বরং যেভাবে পূর্বে উল্লেখ করেছি যে,মসজিদের পাথর কিম্বা ছোট কাঠের টুকরার উপরও সেজদা  করা হয়। (অনুধাবনযোগ্য)

আহলে বাইতের (আ.) অনুসারীদের নিকট মৃত্তিকা ও মৃত্তিকাজাত বস্তুর উপর সেজদা  ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত অকাট্য দলিল ও প্রমাণাদি রয়েছে। যেমন:রাসূলুল্লাহ (সা.) হতে বর্ণিত সহীহ হাদীস সমূহ,সাহাবীবর্গের অনুসৃত পন্থা এবং মাসুম ইমামগণের (আ.) রেওয়ায়েত সমূহ। শিঘ্রই আমরা এগুলোর উপর বিস্তারিত আলোচনা ও পর্যালোচনা করব।

এতদসত্বেও অবাক মনে হয় যে,কেন সুন্নী মাযহাবের কিছু ভাই আমাদের এ আকিদাকে নিয়ে অহেতুক সমালোচনা ও বিতর্কের ঝড় তুলে থাকেন। তারা কখনও এটাকে বিদআত আবার কখনও শিরক ও মাটি পূজার সাথেও তুলনা করেন।

এমতাবস্থায় যদি আমরা তাদের মাযহাবের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলী হতে প্রমাণ করি যে,স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্তিকা কিম্বা মৃত্তিকাজাত বস্তুর উপর সেজদা  করতেন;তদুপরি কি তারা আমাদের এ কাজকে বিদআত বলে প্রচার করবেন?!

আমরা যদি প্রমাণ করি যে,রাসূলের (সা.) অনেক একনিষ্ঠ সাহাবী যেমন:হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী (রা.) প্রচন্ড রোদ্রের তাপে যখন নুড়ি পাথরগুলো উত্তপ্ত হয়ে যেত,তখন সেগুলোকে এক হাত হতে অপর হাতে নিয়ে ঠান্ডা করতেন। যাতে এগুলোর উপর কপাল রেখে সেজদা  করতে পারেন।

এমতাবস্থায় তারা কী হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারীর (রা.) এ কাজকে বিদআত কিম্বা নুড়ি-পাথর পূজার সাথে তুলনা করবেন?

যদি কেউ মাদুরের উপর সেজদা  করে কিম্বা মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীর মেঝের উপর নামাজ আদায় করে সেখানে সেজদা  করে,তাহলে কী এটা বলা যাবে যে,সে মাদুর কিম্বা মেঝের পাথর পূজা করেছে?!

নিঃসন্দেহে তারা যদি আমাদের হাজার হাজার ফিকাহ শাস্ত্রের গ্রন্থাবলির মধ্যে যে কোন একটি পুস্তক হাতে নিয়ে তাতে উল্লেখিত ‘সেজদা যে সব বস্তুর উপরে জায়েয’তা নিয়ে একটু বিশ্লেষণ করতেন,তাহলে সহজেই বুঝতে পারতেন যে,তারা এ সম্পর্কে আমাদের বিরুদ্ধে যে সব অপবাদ আরোপ করে তা মোটেও সঠিক নয়।

অন্যায়ভাবে কারও উপর বিদআত,শিরক কিম্বা মূর্তি পূজার অপবাদ আরোপকারীরা কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে কি জবাব দিবেন?

শিয়া মাহাবের অনুসারীরা মৃত্তিকা ও মৃত্তিকাজাত বস্তুর উপর কেন সেজদা করে-এ প্রশ্নের জবাব সুস্পষ্ট করার নিমিত্তে ইমাম জাফর সাদীকের (আ.) একটি হাদীস এখানে তুলে ধরা যথোপযুক্ত মনে করছি। হাদীসটি শিয়া মাযহাবের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ উসূলে কাফীতে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম জাফর সাদীকের (আ.) ঘনিষ্ঠ শিষ্য ও খ্যাতনামা মুসলিম মনীষী হিশাম ইবনে হাকাম তার নিকট প্রশ্ন করেনযে,কিসের উপর সেজদা করা জায়েয এবং কিসের  উপর জায়েয নয়? জবাবে ইমাম (আ. ) বলেন:

السجود لا یجوز ألّا علی الأرض أو ما أنبتت الأرض ألّا ما أکل أو لبس

“সেজদা মাটি কিম্বা মাটি হতে উৎপন্ন বস্তু ব্যতিত অন্য কিছুর উপর জায়েয নয়। আহার্য ও পরিধেয়  কোন বস্তুর উপর সেজদা করা যাবে না।

হিশাম ইবনে হাকাম আবার প্রশ্ন করেন: আপনার প্রতি আমার প্রাণ উৎসর্গ হোক; এটির হিকমত বা দর্শন কি?

ইমাম (আ.) বলেন,

لأنّ السّجود هو الخضوع لله عزّ و جلّ فلا ینبغی أن یکون علی ما یؤکل و یلبس لأنّ أبناء الدّنیا عبید ما یأکلون و یلبسون و الساجّد فی سجوده فی عبادة الله فلا ینبغی أن یًع جبهته فی سجوده علی معبود أبناء الدّنیا الّذین اغترّوا بغرورها

“কেননা সেজদা হচ্ছে মহান আল্লাাহর প্রতি বিনয় প্রকাশের মাধ্যম। কাজেই আহার্য ও পরিধেয় বস্তুর উপর সেজদা  করা মোটেও সমীচীন নয়। কারণ দুনিয়া পুজারীরা যা কিছু ভক্ষন করে এবং পরিধান করে সেগুলো ভৃত্যে পরিণত হয়। আর সেজদা কারীরা সেজদা বনত অবস্থায় কপাল এমন কিছুর উপর রাখা জায়েয নয়,যেগুলো দুনিয়ার চাকচিক্যে মোহাচ্ছন্ন ব্যক্তিদের উপাস্য হিসেবে ব্যহৃত।

অতঃপর ইমাম (আ.) বলেন,

و السجود علی الأرض أفضل لأنّه أبلغ للتّواضع و الخضوع لله عزّ و جلّ

“আর মাটির উপর সেজদা করা সর্বাপেক্ষা উত্তম। কারণ এর মাধ্যমে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থায় মহান আল্লাহর প্রতি বিনয় প্রকাশ করা সম্ভব হয়।”

এ পর্যায়ে আমরা অত্র বিষয়ের (মৃত্তিকা ও মৃত্তিকাজাত বস্তুর উপর সেজদা  প্রসঙ্গে) অকাট্য সনদ ও দলিলাদি নিয়ে পর্যালোচনা করব, প্রথমেই রাসূলুল্লাহ (সা.) সুস্পষ্ট বাণী হতে শুরু করব:

ক-মৃত্তিকা বা মাটির উপর সেজদা র ক্ষেত্রে রাসূলের (সা.) প্রসিদ্ধ হাদীস

এ হাদীসটি শিয়া ও সুন্নী উভয় সূত্রে রাসূলুল্লাহর (সা.) হতে বর্ণিত হয়েছে।তিনি বলেছেন,

جعلت لی الارض مسجداً و ترابها طهورا

“মাটিকে আমার জন্য সেজদা ও পবিত্রতার (তায়াম্মুমের ) মাধ্যম হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।”

কেউ কেউ এমন ধারণা করেছেন যে,এ হাদীসের অর্থ হচ্ছে এ পৃথিবীর সর্বত্র আল্লাহর ইবাতের স্থান এবং ইবাদতের জন্য নিদৃষ্টি কোন স্থান নির্ধারণ করা হয়নি। যেমন ভাবে ইহুদী ও খৃষ্টানরা আকিদা পোষণ করে যে,ইবাদত অব্যশই গির্জা কিম্বা উপাসনালয়ে আঞ্জাম দিতে হবে। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে,এরূপ ব্যাখ্যার সাথে উক্ত হাদীসের মূল ভাবার্থের সাথে কোনরূপ সামঞ্জস্যতা নেই। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন যে,মাটি আমার জন্য পবিত্রতা দানকারী এবং মসজিদ (সেজদা র স্থান)। আমরা জানি যে,যা কিছু পবিত্রতা দানকারী তা দিয়ে তায়াম্মুম করা যায়;আর সেটা হচ্ছে মাটি ও পাথর। সুতরাং সেজদার স্থানও মাটি কিম্বা পাথরের হতে হবে।

পক্ষান্তরে মহানবী (সা.) যদি ইচ্ছা করতেন উক্ত হাদীসের মাধ্যমে সে অর্থকে বুঝবেন যা সুন্নী মাযহাবের এক শ্রেণীর ফিকাহবিদরা ব্যাখ্যা করেছেন;তাহলে হয়তো তিনি বলতেন,

جعلت لی الارض مسجداً و ترابها طهورا

“সমস্ত জমিন হচ্ছে আমার জন্য মসজিদ এবং এর মাটি পবিত্রতা ও তায়াম্মুমের মাধ্যম।”কিন্তু  তিনি আদৌ এমনটি বলেননি।

সুতরাং এ বিষয়টি সহজেই বলা যায় যে,উক্ত হাদীসে মসজিদ বলতে সেজদার স্থানকে বুঝানো হয়েছে। আর সেজদার স্থান এমন হওয়া বাঞ্চনীয় যার উপর তায়াম্মুম করা সম্ভব।

কাজেই শিয়া মাযহাবের অনুসারীরা যে আকিদা পোষণ করে-মৃত্তিকা বা মৃত্তিকাজাত বস্তুর উপর সেজদা করা অবশ্যক এবং কার্পেট বা এ জাতীয় বস্তুর উপর সেজদা করা জায়েয না;তা মোটেও অশুদ্ধ ও ভিত্তিহীন নয়। বরং রাসূলুল্লাহর (সা.) সুস্পষ্ট আদেশানুযায়ী তারা এমন আকিদা পোষণ করে।

ঘ-রাসূলের (সা.) অনুসৃত পন্থা

অনেক নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে প্রমাণীত হয় যে,মহানবী (সা.) মাটির উপর সেজদা করতেন,না পোষাক,কাপড় বা এ জাতীয় অন্য কিছুর উপর।

আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে,

سجد رسول الله فی یوم مطیر حتّی أنّی لانظ إلی ذلک فی جبهته وانبته

“একদা রাসূল (সা.) দেখলাম বৃষ্টি ভেজা দিনে মাটির উপর সেজদা করছেন। তার কপাল ও নাকেও সে সেজদা র আলামত (কাদা মাটির চিহ্ন) পরিদৃষ্ট ছিল।”

যদি কাপড়ের বা এ জাতীয় কোনকিছুর উপর সেজদা করা জায়েয হতো,তাহলে বৃষ্টির দিন ভেজা মাটির উপর সেজদা র কোন প্রশ্নই আসে না।

হযরত আয়েশা হতে বর্ণিত,

ما رأیت رسول الله متقیا وجهه بشیء

“আমি কখনও রাসূলকে (সা.) নামাযের সময় সেজদা আদায়কালে স্বীয় কপাল অন্য কিছু দিয়ে ঢাকতে দেখিনি।”

ইবনে হাজার এ হাদীসের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন:এ হাদীসের মূল ভাবার্থ হচ্ছে নামাযে সেজদার সময় শর্ত হচ্ছে কপাল মাটিতে স্পর্শ করা। কিন্তু যদি সম্ভব না হয় তাহলে বাধ্যতামূলক নয়।

হযরত মাইসুনেহ (মহানবীর (সা.) জনৈক স্ত্রী) হতে বর্ণিত অপর একটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে:

و رسول الله یصلی علی الخمرة فیسجد

“রাসূল (সা.) একটি মাদুরের উপর নামায আদায় করতেন এবং এটির উপর সেজদা দিতেন।”

নামায আদায়কালে মাদুরের জায়নামায ব্যবহা করতেন।

সুন্নী মাযহবের হাদীস গ্রন্থাবলীতে উল্লেখিত আরও অনেক রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে,মহানবী (সা.) “খুমরাহ”এর উপর নামায আদায়া করতেন। (খুমরাহ হচ্ছে খেজুরের পাতা দিয়ে তৈরীকৃত ছোট্র মাদুর,যা জায়নামায হিসেবে ব্যবহৃত হত। )

আশ্চর্যকর বিষয় হচ্ছে শিয়া মুসলমানরা যখন এভাবে নামায আদায় করে এবং নামাযের সময় মাদুর বিশিষ্ট জায়নামায ব্যবহার করে,তখন এক শ্রেণীর গোড়ামী মানসিকতার ব্যক্তিরা এটাকে বাকা চোখে দেখে এবং বিদআত হিসেবে আখ্যায়িত করে। অথচ সহীহ হাদীসের বর্ণনানুযায়ী এ কাজটি রাসূলের (সা.) সুন্নাত সমূহের অন্তর্ভূক্ত।

এটা কতই না ন্যক্কারজনক বিষয় যে,তারা রাসূলের (সা.) সুন্নাতকে বিদআত হিসেবে অখ্যায়িত করে!!

আমি কখনও ভুলতে পারব না যে,একবার হজ্বের সফরে মদীনার মসজিদে নববীতে নামায আদায়ের নিমিত্তে সাথে থাকা ছোট্র একটা মাদুর বিছানোর সাথেই জনৈক ধর্মান্ধ ওয়াহাবী পন্থি আলেম ক্রোধান্বিত হয়ে আমার দিকে তেড়ে আসে এবং মাদুরটি নিয়ে দূরে নিক্ষেপ করে। নিশ্চয় সে সুন্নাতকে বিদআত গণ্য করে এহেন আচরণ করেছে!

গ-সাহাবী ও তাবেঈনদের অনুসৃত পন্থা

ইতিহাস পর্যালাচনা করলে দেখা যাবে যে,রাসূলুল্লাহর (সা.) বিশিষ্ট সাহাবীবর্গ এবং তাদের পর তাবেঈনরা মৃত্তিকা কিম্বা মৃত্তিকাজাত বস্তুর উপর সেজদা করতেন;এক্ষেত্রে আমরা কয়েকটি নমুনা তুলে ধরা যথোপযুক্ত মনে করছি:

১-হযরত জাবের ইবনে  আব্দুলাহ আনসারী (রা.) বলেছেন,

کنت اصلّی مع النبی (ص) الظهر فآخذ قبضة من الحصی فاجعلها فی کفّی ثمّ لحولها إلی الکف الأخری حتّی تبرد ثمّ اضعها لجبینی حتّی اسجد علیها من شدّة الحرّ

“আমি মহানবীর (সা.) সাথে যোহরের নামায আদায়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। এমন সময় কিছু নুড়ি পাথর নিয়ে এক হাত থেকে অপর হাতে নিচ্ছিলাম,যাতে তা ক্রমশ: ঠান্ডা হয় এবং তার উপর সেজদা করা সম্ভব হয়। আর প্রচন্ড রোদ্রে উত্তপ্ত হওয়ার কারণে সে নুড়ি পাথরগুলো এভাবে ঠান্ডা করছিলাম। ”

এ হাদীসের মাধ্যমে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে,রাসূলের (সা.) সাহাবীবর্গ মাটির উপর সেজদা করাকে বাধ্যতামূলক মনে করতেন। এমনটি প্রচন্ড রোদ্রের উত্তপের সময়ও তারা বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে হলেও তা সম্পন্ন করতেন। যদি মাটির উপর সেজদা ওয়াজিব না হত, তাহলে জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারীর এমন পরিশ্রমের কোন প্রয়োজন ছিল না।

২-আনাস বিন মালেক উল্লেখ করেছেন,

کنّا مع رسول الله (ص) فی شدّة الحرّ فیأخذ أحدنا الحصباء فی یده فأذا برد وضعه و سجد علیه

আমরা কোন এক গরমের দিন রাসূলের (সা.) সাথে ছিলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ নুড়ি পাথর হতে নিয়ে ঠান্ডা করছিল, যাতে তার উপর সেজদা করা যায়।”

এ বিষয়টি প্রমাণিত করে যে, সাহাবীদের মাঝে জমিনের উপর সেজদা করার প্রচলন বহাল ছিল।

৩-হযরত আবু উবাইদাহ হতে বর্ণিত,

أنّ ابن مسعود لا یسجد-أو قال لا یصلّی ألا علی الأرض

“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) জমিন ব্যতিত অন্য কিছুর উপর সেজদা অথবা নামায আদায় করতেন না।”

যদি এখানে জমিন বলতে কার্পেট,কাপড় কিম্বা এ জাতীয় অন্য কিছুকে বুঝানো হত,তাহলে আমাদেও এ আলোচনার আদৌ প্রয়োজন ছিল না। কাজেই জমিন বলতে এখানে মাটি,পাথর,নুড়ি-পাথর  কিম্বা মাটি হতে উৎপন্ন বস্তু সমূহকে বুঝানো হয়েছে।

৪-মাসরুক বিন আযদা’য়ার (হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের সহযোগী) জীবনীতে বর্ণিত হয়েছে যে,

کان لا یرخص فی السجود علی غیر الأرض حتّی فی السفینة و کان یحمل فی السفینة شیئا یسجد علیه

“তিনি কখনও মাটি (জমিন) ব্যতিত অন্য কিছুর উপর সেজদা করতেন না। এমনকি যখন জাহাজে আরোহণ করতেন, তখন সাথে মাটিজাত কিছু বহণ করতেন এবং তার উপর সেজদা করতেন।”

৫-আলি ইবনে অব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাজজিনের নিকট প্রেরিত এক পত্রে লিখেন,

ابعث ألیّ بلوح من أحجار المروة علیه اسجد علیه

“মারওয়ে পাথরের একটি খন্ড আমার নিকটে পাঠাবে, যাতে আমি সেটির উপর সেজদা করতে পারি।”

৬-ফাতহুল বারী গ্রন্থে উল্লেখিত একটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে,

کان عمر بن عبد العزیز لا یکتفی بالخمرة بل یضع علیها التراب و یسجد علیه

“উমর ইবনে আব্দুল আজিজ মাদুরের উপর সেজদা করাকে যথেষ্ট মনে করতেন না। বরং মাদুরের উপর সামান্য মাটি রাখতেন, অতঃপর তার উপর সেজদা করতেন।”

উপরোক্ত রেওয়ায়েত সমূহের মাধ্যমে আমরা এ বিষয়টি আমাদের নিকট সূর্যালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে,রাসূলের (সা.) সাহাবীবর্গ এবং তাদের পর তাবেঈনরা ইসলামের প্রথম শতাব্দীগুলোতে জমিন তথা মাটি,পাথর এবং এ জাতীয় বস্তুর উপর সেজদা করতেন।

এমতাবস্থায় এখন যদি কেউ আমাদের যুগে তাদের উক্ত সুন্নতের ধারাবাহিকতায় মাটি কিম্বা মাটি হতে উৎপন্ন কোন কিছুর উপর সেজদা করে,তবে কী সেটা বিদআত হিসেবে পরিগণিত হবে?!

সুতরাং আমরা আশা করব সব ধরণের গোড়ামী মানসিকতা পরিহার করে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তার সাহাবীগণের অনুসৃত এ পন্থাকে পুনরায় জীবিত করবেন;যা সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি চুড়ান্ত বিনয় প্রকাশের মাধ্যম এবং সেজদা র প্রকৃত স্বরূপের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।