মোঃ তুরাব রসুল
প্রবিত্র রমজান মাস আসলেই সালাফি শাসিত সুন্নিদের পক্ষ হতে অভিযোগ শুরু হয়ে যায় যে শিয়াদের রোজা মাকরূহ হয়ে যায় বা তাদের রোজা হয় না। কারণ তারা দেরি করে রাতে ইফতার করে। রাতে ইফতার করা সঠিক না ভুল তা জানার আগে আমরা কোরানের আলোকে জেনে নেই রাতের সজ্ঞা। ১।” আমি রাত ও দিবসকে করে দিয়েছি দুইটি নিদর্শন,অতঃপর রাত্রির নিদর্শনকে নিস্প্রভ ও দিবসের নিদর্শনকে উজ্জ্বল করে দিয়েছি; যেন তোমরা তোমাদের রবের দেয়া জীবিকা অন্বেষণ করতে পার”( বনি ইসরাইল – ১১)
২। “দিনের শপথ যখন সে সূর্যকে প্রখরভাবে প্রকাশ করে।”(আস শামস-৩) ৩।”রাতের শপত যখন সে সূর্যকে আচ্ছাদিত করে”।(আস শামস-৪) ৪।”রাতের শপত যখন সে আচ্ছন্ন করে”( সুরা লাইল-১) ৫।”আর তাদের জন্য আরেকটি নিদর্শন হলো রাত আমি তার থেকে দিনকে অপসারণ করি,তখনই তো তারা অন্ধকারে পতিত হয়”। ( ইয়াসিন – ৩৭) ৬।” আমি শপথ করি সন্ধ্যাকালীন লাল আভার”।( সুরা ইনশিক্বাক্ব-১৬) ৭।”এবং রাত্রির এবং তাতে যার সমাবেশ ঘটে”।(সুরা ইনশিক্বাক্ব-১৭)
উপরোক্ত আয়াতগুলি যদি আমরা ভালোভাবে পড়ি তাহলে আমাদের কাছে রাতের সংজ্ঞা পরিস্কার হয়ে যায়। আর আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে এটা আল্লাহর দেয়া রাতের সংজ্ঞা, এবং সেই মহান আল্লাহ পাক তার পাক কালাম কোরআন শরীফে সুরা বাকারার ১৮৭ নং আয়াতে সাহরী ও রোজা পূর্ণ করা অর্থাৎ ইফতার করার সময় সম্পর্কে এরশাদ করেনঃ” আর পানাহার কর যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিস্কার দেখা যায়। অতঃপর রোজা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত।( সুরা বাকারার১৮৭ নং আয়াতের শেষাংশ)। কিন্তু যারা শিয়াদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায় যে শিয়াদের রোজা মাকরূহ বা হয় না, তাদের চিন্তা করা দরকার কোরান মোতাবেক শিয়ারা যে সময় ইফতার করে তাহাই সঠিক। কারণ কোরআন শরীফে রোজা পূর্ণ করার কথা রাত্রি পর্যন্ত আছে। যা সুরা বাকারার ১৮৭নং আয়াতে পরিস্কার ভাবে বলা হয়েছে। কোরআনে ১৬২জায়গায় রাত যাকে আরবিতে “লাইল”উল্লেখ করা হয়েছে যার কয়েকটি আয়াত আমি উল্লেখ করেছি। কিন্তু যারা বলে সূর্য অস্ত যাওয়া মানে রাত, তাদের মতকে সম্পূর্ণ বাতিল ঘোষণা করেছে সুরা ইনশিক্বাক্ব এর ১৬ ও ১৭ নং আয়াত যেখানে ১৬ নং আয়াতে সন্ধ্যাকালিন রক্তিম আভার কথা তারপরে ১৭ নং আয়াতে রাত্রির কথা যা আরবি তে ‘শাফাক্ব” ও “লাইল” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। নিশ্চয় রাতকে আরবিতে শাফাক্ব বলা হয় না,রাতের আরবি “লাইল ” শব্দই ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ সন্ধ্যাকালিন আভা আর রাত্রি এক জিনিষ না। আর কোরআনে রোজা পূর্ণ করার আদেশ “লাইল” অর্থাৎ রাতই আছে। রাত পর্যন্ত পৌছাতে হলে সন্ধ্যা সময়টি অতিক্রম করেতেই হবে। রাত তাকেই বলা হয় যা অন্ধকারে আচ্ছাদিত। যা সুরা নুরের ২৪,৩৬,৪৪ সুরা দোহার ২ সুরা বনী ইসরায়েলের ৭৮ সুরা নাযিয়াতের ২৯ সুরা ফোরকানের ৫,৪৭,৬২ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
এবার আমরা হাদিসে ইফতারের সময় যদি অনুসন্ধান করি তাহলেও ইফতারের সময় উল্লেখ করার বিষয়ে “লাইল” অর্থাৎ রাত্রি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সালাফিদের কাছে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য কিতাব সহীহ আল বুখারী থেকে দুটি হাদিস উল্লেখ করা হলো। ১। আব্দুল্লাহ বিন আউফ থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ(সা) বলেনঃ “যখন দেখবে যে, পূর্ব দিক থেকে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে তখন ইফতার করবে।”( সহীহ আল বুখারী দ্বিতীয় খন্ড)
২। নবী(সা) বলেনঃ সূর্যাস্তের পরে যখন পূর্ব দিক থেকে অন্ধকার হয়ে আসবে ও দিনের আলো পশ্চিম দিক থেকে চলে যাবে তখন রোজাদারদের জন্য ইফতারের সময় হয়।(সহীহ আল বুখারী দ্বিতীয় খন্ড)
হাদিস দুটিতে একটা বিষয় সুস্পষ্ট যে সূর্য অস্ত যাওয়ার পরেই কিন্তু ইফতার করার কথা বলা হয়নি তার সাথে পূর্ব দিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসার কথাও বলা হয়েছে। অর্থাৎ হাদিসদ্বয়ে আরবি “লাইল” শব্দ ব্যবহারিত হয়েছে যার অর্থ রাত। কিন্তু আমার প্রশ্ন সালাফিরা যে সময়ে ইফতার করে সে সময় কি কোরআন-হাদিসে বর্ণিত রাত বা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়? কেউ যদি মাঝহাবী গোড়ামি না করে এবং বিবেকের গলাকে চেপে না ধরে তাহলে তার উত্তর হবে না। কারণ সেই সময় কোন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয় না, দিনের আলো তখনও এতটাই পরিস্কার থাকে যে সবকিছু দৃষ্টিগোচর হয়।
কিন্তু সালাফিরা কোরআনের অনুসরণতো করেই না যে বুখারী, বুখারী করে মুখে ফেনা তুলে সেই বুখারীর হাদিস না মেনে বুখারীর আরেকটি হাদিস তুলে ধরে ” যত দিন লোকেরা সত্ত্বর ইফতার করবে ততদিন পর্যন্ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে না।” হাদিসতো ঠিক আছে কিন্তু এই হাদিসে কি ইফতারের সময় বলা হয়েছে? নিশ্চয় না বরং ইফতারের সময় হওয়ার পর সত্ত্বর ইফতার করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
সালাফি পরিচালিত সুন্নিরা তাদের ওয়াজ মাহফিলে চার খলিফাকে অনুসরণ করার কথা খুব জোরালো ভাবে বর্ণনা করে কিন্তু বাস্তবে সেটাও তারা অনুসরণ করে না।
যেমন হযরত ওমর ও হযরত ওসমান(রা)
রাতে মাগরিবের নামাজের পর ইফতার করতেন। যা ইমাম মালিক(র) বর্ণনা করেছেন।
হযরত ওমর ও হযরত ওসমান(রা) উভয়ে মাগরিবের নামাজ পড়তেন এমন সময় যখন তারা রাত্রির অন্ধকার দেখতে পেতেন।আর তা(মাগরিবের নামাজ) হতো ইফতার করার পূর্বে। অতঃপর তারা উভয়ে ইফতার করতেন, আর তা হতো রমজান মাসে।
( মুয়াত্তা,ইমাম মলিক ১ম খন্ড) যা শিয়াদের সাথে সম্পূর্ণ ভাবে মিলে যায়। এখন আমার শেষ প্রশ্ন সালাফিদের দ্বারা শাসিত ও পরিচালিত সুন্নি ভাইদের প্রতি রাত্রের আগমনের পর আপনাদের মহান খলিফাদ্বয় ইফতার করে কি তারা ভুল করেছেন? যদি উত্তর হয় না তাহলে আপনারা ভুলের মধ্যে আছেন। আর যদি উত্তর হয় হ্যাঁ তাহলে আপনাদের দ্বারাই প্রমাণিত হচ্ছে যে খলিফারা ভুল করেছেন।
সালাম তাদের প্রতি যারা সত্যকে গ্রহণ করে।
মোঃ তুরাব রসুল
২৫/০৪/২০২০ইং।
পহেলা রমজান ১৪৪১হিজরী।
ইমামে জামানা(আ ফ শ) ওয়ারিশ।