মোঃ তুরাব রসুল
আয়েম্মায়ে মাসুমিনদের(আ) দৃষ্টি কোন থেকে পবিত্র রমজান মাসের রোজার শেষে প্রত্যেক বালেগ ও বুদ্ধিমান(অর্থাৎ যে পাগল না) যে নিজ ও তার পরিবারের সকালের জিবিকা নির্বাহের জন্য ব্যয় করতে সক্ষম তার ফিতরা বের করা ওয়াজিব। আহলে তাশাইয়ুর মতানুসারীদের দৃষ্টিতে সুন্নাতে নববী(সা)এর অনুসরণে প্রত্যেকের জন্য এক সা যা তিন কেজি গম, যব, কিসমিস, খেজুর ইত্যাদির মধ্যে যেটি মূল খাদ্য হিসাবে খাওয়া হয় তা বা তার বাজার মূল্য যাকাতে ফিতরা হিসাবে প্রদান করা অবশ্য কর্তব্য।
মহানবীর(সা) সুন্নতের অনুসরণে শীয়া মুসলিমরা এক সা পরিমাণ প্রধান খাদ্য বা তার বাজার মূল্য ফিতরা হিসাবে প্রদান করে থাকে। কিন্তু আহলে সুন্নাতের বৃহত্তর অংশ শীয়াদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে ও তারা মুয়াবিয়ার অনুসরণে অর্ধ সা ফিতরা আদায় করে থাকে।
এ সম্পর্কে ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে মুয়াবিয়া যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠ ছিল, হাজ্বের সময় লোকদের সাথে কথা বলে জানতে পারে সিরিয়ার এক মুদ গমের যে দাম হিজাজের দুই মুদ কিসমিস, খেজুর ইত্যাদি খাদ্যের একই মূল্য বা হিজাজে যখন গম আমদানি করা হল তখন দেখা গেল এক সা কিসমিস বা খেজুরের দাম অর্ধ সা গমের দামের সমান। তখন মুয়াবিয়া মূল্যের দিক দিয়ে সমান করে দুই মুদ বা অর্থ সা গম ফিতরা হিসাবে আদায় করার কথা বলে। কিন্তু সাহাবিরা(রা) মুয়াবিয়ার সাথে দ্বিমত পোষণ করে এর বিরুদ্ধতা করেন।
সকল হাদিস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে ফিতরার পরিমাণ এক সা যা নাবী(সা) ও খলিফা চতুষ্টয়ের সময় আদায় করা হত।
তিরমিযীর বর্ণনায় আছেঃ অর্থাৎ লোকেরা গমের অর্ধ সা এর সাথে অন্য বস্তুর এক সা এর সমান হিসাব করলেন। অতএব বুঝা গেল এক সা যব, কিসমিস , পনির, খেজুর ও অন্য খাদ্য দ্রব্যের যে দাম ছিল সে পরিমান দাম ছিল অর্ধ সা গমের। সে কারণে মুয়াবিয়া অর্ধ সা ফিতরা আদায়ের হুকুম দিলেন। কিন্তু সাহাবিদের মধ্যে অনেকেই তার প্রতিবাদ করেছেন।
যেমন হযরত আবু সাইদ খুদরি(রা) প্রতিবাদ করে বলেনঃ আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন সর্বদা ঐভাবেই ফিতরা আদায় করব যেভাবে আগে আদায় করতাম। (সহীহ মুসলিম)
আইয়াজ বিন আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত, আবু সাইদ খুদরির(রা) নিকট রামাজানের ফিতরা সম্পর্কে বর্ণনা করা হলে তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহর(সা) জামানায় যে পরিমাণ ফিতরা আদায় করতাম তা ব্যতীত অন্যভাবে আদায় করব না। এক সা খেজুর, গম, যব, পনির। কোন ব্যক্তি প্রশ্ন করল, গমের দুই মুদ দ্বারা কি আদায় হবে? তিনি বললেন, না। এটা মুয়াবিয়ার মনগড়া নির্ধারিত। আমি সেটা গ্রহণও করব না বাস্তবায়নও করব না।( ইবনু খুজাইমাহ ও ইমাম হাকিম সহীহ সূত্রে বর্ণিত, এবং ফাতহুল বারী)
ইমাম নববী(র) বলেন, যারা মুয়াবিয়ার কথা মত গমের দু মুদ আদায় করাকে গ্রহণ করেছে তাতে ভুল আছে। কেননা এ ব্যাপারে সাহাবী আবু সাইদ খুদরি(রা) ও অন্যান্য সাহাবাগণ বিরুদ্ধীতা করেছেন যারা দীর্ঘ সময় নাবী(সা) এর সঙ্গে ছিলেন ও তাঁরা নাবী(সা) এর অবস্থা সম্পর্কে অধিক অবগত ছিলেন। মুয়াবিয়া নিজের রায় দ্বারা মত প্রকাশ করেছে। সে নাবী(সা) হতে শুনে বলেননি। আবু সাইদ খুদরি(রা) এর হাদিসে ইত্তেবাহ ও সুন্নাহ গ্রহণের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ( ফাতহুল বারী, মুসলিম শরহে নাববী, শরহুল মুহাযযাব ইমাম নাববী)
ইমাম আহমাদ,ইমাম শাফেয়ী ও ইসহাক এক সা ফিতরা আদায় করার হাদিস পেশ করেছেন। কারণ নাবী(সা) সদাকাতুল ফিতর খাদ্যদ্রব্যের এক সা আদায় করা ফরজ করেছেন। আর গম হচ্ছে খাদ্যদ্রব্যের একটি। আর সেই জন্যে এক সা ব্যতীত ফিতরা আদায় হবে না। আবু সাইদ খুদরি(রা), আবুল আলিয়া, আবুশ শা’সআ,হাসান বাসরী, জাবির বিন জায়িদ, ইমাম শাফেয়ী, মালিক,আহমাদ বিন হাম্বল ও ইসহাক(র) প্রমুখ এ দলিল গ্রহণ করেছেন। নাইলুল আওতারে তা বর্ণিত হয়েছে। তাতে আরো বলা হয়েছে গম ও অন্য খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে পার্থক্য করা যাবে না। এবং যারা অর্ধ সা’ গমের কথা যে হাদিসগুলোর আলোকে বলে তা সম্পূর্ণ যঈফ(দুর্বল)।(তুহফাতুল আহওয়াযী)
সদাকাতুল ফিতরা আদায়ের ব্যপারে শীয়ারাই যে সুন্নাতে রাসুলুল্লাহর(সা) পরিপূর্ণ অনুসরণ করে তার প্রমাণ স্বরূপ আরো কিছু হাদিস তুলে ধরা হলো।
১। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর(রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ(সা) সদাকাতুল ফিতর হিসাবে এক সা পরিমাণ খেজুর বা এক সা’ পরিমাণ যব দিয়ে আদায় করতে নির্দেশ দেন। আব্দুল্লাহ(রা) বলেন, অতঃপর লোকেরা যবের সমপরিমাণ হিসাবে দু’ মুদ(অর্ধ সা) গম আদায় করতে থাকে।(বুখারী শরীফ ২য় খন্ড)
লোকেরা বলতে মুয়াবিয়া ও তার অনুসারীরা।
২। আবু সাইদ খুদরি(রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নাবী(সা) এর যুগে এক সা খাদ্যদ্রব্য বা এক সা খেজুর বা এক সা যব বা এক সা কিসমিস সদাকাতুল ফিতর আদায় করতাম। মুয়াবিয়ার যুগে যখন গম আমদানি হল তখন তিনি বলেন, এক মুদ গম(পূর্বোক্তগুলোর) দু মুদ- এর সমপরিমাণ বলে মনে হয়। (বুখারী শরীফ ২য় খন্ড)
৩। আবু সাইদ খুদরি (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ(সা) আমাদের মাঝে বর্তমান থাকা অবস্থায় আমরা সদাকাতুল ফিতর বাবদ এক সা খাদ্য(গম) বা এক সা খেজুর বা এক সা’ যব বা এক সা’ পনির অথবা এক সা’ কিসমিস দান করতাম। আমরা অব্যাহতভাবে এ নিয়মই পালন করে আসছিলাম। অবশেষে মুয়াবিয়া মাদীনাহয় আমাদের নিকট আসেন ও লোকদের সাথে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, আমি শাম দেশের উত্তম গমের দু মুদ পরিমাণকে এখানকার এক সা’ মনে করি। তখন থেকে লোকেরা এ কথাটিকে গ্রহণ করে নিলো। আবু সাইদ খুদরি(রা) বলেন, আমি কিন্তু সারা জীবন ঐ হিসাবেই সদাকাতুল ফিতর পরিশোধ করে যাবো, যে হিসাবে আমি রাসুলুল্লাহর(সা) যুগে তা পরিশোধ করতাম।( সুনানে ইবনে মাজা, বুখারী,মুসলিম, তিরমিজি, নাসায়ী, আবু দাউদ,আহমাদ,দারিমী। তাহকীক আলবানীঃ সহীহ।)
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে সাহাবীগণ মুয়াবিয়ার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। আর এখানে লোকেরা বলতে তার চাটুকার অনুসারীরা যেহেতু মুয়াবিয়া রাষ্টীয় ক্ষমতায় ছিল তার আনুকূল্য পাওয়ার জন্য মুয়াবিয়ার দ্বারা চালু করা বিদাত যা সুন্নাতের বিপরীত তা মেনে নেয়।
তাই আসুন শুধু নামে নয় রাসুলুল্লাহর(সা) আদেশকে নিঃশর্ত ভাবে মেনে নিয়ে আল্লাহর রাসুলের প্রকৃত অনুসারী হওয়ার চেষ্টা করি।
সালাম তাদের প্রতি যারা সত্যকে অনুসরণ করে।
মোঃ তুরাব রসুল।
০২/০৫/২০২০ইং।
০৮ই রামাজানুল মুবারক, ১৪৪১ হিজরি।