অনুবাদ: ড. আবু উসামা মুহাররম
পরিচিতি
আবুল কাসিম আলি বিন মুসা বিন জাফর বিন মুহাম্মদ বিন তাওউস, ডাকনাম রাজিউদ্দিন। তিনি তাওউস পরিবারের একজন যোগ্য উত্তরসূরী; তাই তিনি সাইয়্যিদ ইবনে তাউস নামে পরিচিত।(১)
ইবনে তাউস ৫৮৯ সনের ১৫ মুহাররম বৃহ:বার ইরাকের হিল্লা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। (২) তাকে যুল হাসনাইন বলা হয়। কারণ তার প্রপিতামহ হলেন দাউদ বিন হাসান আলমুসান্না যিনি ইমাম হাসান (আ.)-এর সন্তানের নাতি এবং ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর মেয়ের নাতি ছিলেন। তিনি হাসানি হুসাইনির একজন হিসেবে বিবেচিত।(৩)
তার পিতা মুসা বিন জাফর একজন হাদীস বর্ণনাকারী যিনি তার বর্ণনাগুলি পত্রের মধ্যে লিখতেন। তার পরে তার পুত্র সেই পত্রগুলি সংগ্রহ করেন। যা তিনি فرقة الناظر و بهجة الخاطر مما رواه والدی موسی بن جعفر ফিরকাতুন নাজির ওয়া বাহজাতুল খাতের মিম্মা রাওয়াহু ওয়ালিদি মুসা বিন জাফর নামে প্রকাশ করেন। তাঁর মা ছিলেন ভারাম বিন আবি ফারাসের কন্যা, যিনি ইমামিয়া পণ্ডিতদের একজন ছিলেন।(৪)
এছাড়াও, তাঁর পিতার মা ছিলেন শেখ তুসির উত্তরসূরী। তাউস ইবনে আবি ফিরাস এবং শেখ তুসি (রহ.)এর নাম উল্লেখ করার সময়, তাদেরকে নিজের দাদা বলে ডাকতেন। সাইয়্যিদ বিন তাউসের ভাই আহমাদ বিন তাউস সমকালীন একজন বড় আলেম ছিলেন। সাইয়্যেদ বিন তাউসের মৃত্যুর পর তিনি শিয়া সম্প্রদায়ের হাল ধরেন। (৬)
ইবনে তাউস হিল্লায় তার পড়াশোনা শুরু করেন এবং কিছু সময় পর তিনি হিল্লা থেকে কাযেমাইনে হিজরত করেন।(৭) এরপর তিনি মন্ত্রী নাসির বিন মাহদির কন্যাকে বিয়ে করেন। এই বিয়ের কারণে তিনি দীর্ঘকাল বাগদাদে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। (৮) একটি বর্ণনা অনুসারে, তিনি বাগদাদে ১৫ বছর অবস্থান করেন। সেখানে তার ছেলে জন্মগ্রহণ করেন। ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে কারবালায় فرج المهموم ফারাজ আল-মাহমুম বই সমাপ্ত করেন। (১৫) ইবনে তাউস ৬৫২ হিজরিতে আবার বাগদাদে ফিরে আসেন। ৬৬১ হিজরিতে, তিনি হুলাকো খান মুগলের কাছ থেকে আলাউইটদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
হিল্লার একটি কবর সাইয়্যেদ ইবনে তাওউস [১৯] এর বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু ইবনে ফুতি (৭২৩ হি) হাওয়াদিসে জামেয়ে নামক গ্রন্থে বলেন যে, ইবনে তাওউসের মৃতদেহ তার মৃত্যুর পর নাজাফে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল এবং তাকে ইমাম আলী (আ.)।[মাজারের পাশে দাফন করা হয়েছিল। (২০) সাইয়্যেদ ইবনে তাউস তার ফালাহুস সায়েল নামক গ্রন্থে লিখেন যে, তিনি ইমাম আলী (আ.)-এর মাজারের পাশে নিজের জন্য একটি কবর প্রস্তুত করেছিলেন এবং এর প্রস্তুতির তদারকি করেছিলেন। (২১)
কেউ কেউ অভিমত ব্যক্ত করেন যে হিল্লায় সাইয়্যেদ বিন তাউসের নাম সহ রাজিউদ্দিন আলী বিন আলী বিন মুসার পুত্রের অন্তর্গত, যিনি তার পিতার সাথে নাম, ডাকনাম এবং উপাধি ভাগ ধারণ করেছিলেন।(২২)
শিক্ষা
ইবনে তাউস হিল্লা শহরে তার পড়াশোনা শুরু করেন এবং তার পিতা ও পিতামহ ওয়ারাম বিন আবি ফিরাসের কাছ থেকে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। তার আত্মজীবনীতে তিনি লিখেন যে, তার ছাত্রবন্ধুরা তার কয়েক বছর আগে ফিক্বাহশাস্ত্রের যা অধ্যয়ন করেছিল তা তিনি এক বছরে শিখেন। আলি আড়াই বছর ফিক্বহ অধ্যায়নের পরে অনুভব করে যে তার আর উস্তাদের প্রয়োজন নাই। (২৪) তারপরে তিনি বাগদাদের বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেন এবং জ্ঞান অর্জন করেন।(২৫)
উস্তাদবৃন্দ
ইবনে তাউস তার কাশফ আল-মাহজাহ গ্রন্থে নাজিবুদ্দিন মুহাম্মদ বিন নামা হালীকে ফিক্বাহশাস্ত্রের তার শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (২৬) মুহাদ্দিস নূরি مستدرک الوسائل মুস্তাদরাক আল-ওয়াসাইলের উপসংহারে, (২৭) বিশ্বস্ত সূত্রে বর্ণনা করেন যে, সাইয়্যিদ ইবনে তাওউস যাদের থেকে হাদিস বর্ণনা করেন তাদের সংখ্যা দশজন।
এই দশ জন হল: হুসাইন বিন আহমদ সৌরাভি আলী বিন ইয়াহিয়া বিন আলী খাইয়্যাত, আসাদ বিন আব্দুল কাহির শাফরোহ, নাজিবুদ্দিন বিন নামা, সাইয়্যেদ ফখর বিন মাদ মুসাভি, মুহাম্মদ বিন মাদ, হাসান বিন দারবি, সালেম বিন মাহফুজ, মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ ইবনে জাহরা, ইয়াহিয়া প্রমুখ।
ছাত্রবৃন্দ
সাইয়্যেদ ইবনে তাউসের কয়েকজন ছাত্র হলেন: সুদিদ আল-দ্বীন হালি (আল্লামেহ হালীর পিতা), আল্লামা হালি, হাসান বিন দাউদ হালি, আব্দুল করিম বিন আহমদ বিন তাউস, আলি বিন ঈসা এরবালি।(২৮)
সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন
কিছু গবেষক বিশ্বাস করেন যে, অনেক ধর্মীয় লোকের ধারণা সাইয়েদ ইবনে তাউস ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক তপস্বী, একজন রহস্যবাদী এবং একজন ফিক্বাহশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ, যিনি রাজনৈতিক জীবন থেকে দূরে ছিলেন। গবেষণা দেখায় যে, সাইয়্যেদ বিন তাউস একজন নিখুঁত মানুষ ছিলেন যিনি রাজনীতি ও রাজনৈতিক জীবন নিয়েও চিন্তা করতেন; এমনকি তিনি তার সন্তানদের রাজনৈতিক শিক্ষার জন্য الاصطفاء فی تاریخ الملوک و الخلفاء “আল ইস্তাফা ফি তারিখ আল-মুলুক ওয়া খিলাফাহ” নামে একটি বিশেষ বই লিখেছিলেন। এই বইটিতে, তিনি তার সন্তানদের আদেশ দিয়েছিলেন যে, তারা নিজেরা এবং তাদের পিতার সম্পর্কে তার ভাল বিশ্বাস নিশ্চিত না করা পর্যন্ত এটি কারও কাছে প্রকাশ করবে না। তিনি এও বলেছেন যে, এই বইটি একটি আমানত যাতে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, তার সন্তান এবং ভবিষ্যত প্রজন্ম এ বই থেকে উপকৃত হবে।
আব্বাসীয় খিলাফতকালে সৈয়দ ইবনে তাউস
বাগদাদে অবস্থানকালে, রাযিউদ্দিন ইবনে তাউসের সাথে বিখ্যাত আব্বাসীয় উজির ইবনে আলকামির সাথে বন্ধুত্ব ছিল, যিনি একজন শিয়া ছিলেন। তিনি আব্বাসীয় খলিফা আল-মুস্তানসিরের দ্বারাও সম্মানিত হয়েছেন। খলিফা তাকে বাগদাদে একটি বাড়ি উপহর হিসেবে দিয়েছিলেন। এই সময়কালে, আব্বাসীয় খলিফা তাকে সরকারী বিভিন্ন দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু ইবনে তাউস সেগুলি প্রত্যাখ্যান করেন। তার মতে, এই সময়ের মধ্যে, তাকে ফতোয়া, নেতৃত্বদান, এমনকি খলিফার মন্ত্রিত্ব ও রাজসভার বিদুষক পদের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি গ্রহণ করেননি। (৩২)
গ্রন্থসূচি:
১. কুমি, আলকুনা ওয়া আলআলকাব, ১৩৮৯ হি, খণ্ড ১, পৃ. ৩৪১।
২. হুসাইনি কামুনেহ, মাওয়ারিদুল ইত্তেহাফ, ১৩৮৮ হি, খণ্ড ১, পৃ. ১০৭-১০৮।
৩. সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, তরফুম মিনা আম্বিয়া ওয়াল মানাকিব, ১৪২০ হিজরি, পৃ. ৪১
৪. খানসারি, রাওযাতুল জান্নাত, ১৩৯০ হিজরি, খণ্ড ৪, পৃ. ৩২৫।
৫. শাহিদি গোলপাইগানি, রাহনুমায়ে সাআদাত, ২০১৩, পৃ. ১৪।
৬. আজাভি, মাওসুআতু তারিখিল ইরাক বাইনা ইহতিলালাইনি, ১৪২৫ হি, খণ্ড ১, পৃ. ৩১৬।
৭. আবদুল হামিদ, মু‘জামু মুরিখুশ শিয়া, ১৪২৪ হি, খণ্ড ১, পৃ. ৬৩৯।
৮. সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, কাশফুল মুহাজ্জা, ১৪১৭ হিজরি, পৃ. ১৬৬।
৯. খানসারি, রাওযাতুল জান্নাত, ১৩৯০ হিজরি, খণ্ড ৪, পৃ. ৩৩৮
১০. আবদুল হামিদ, মু‘জামু মুরিখুশ শিয়া, ১৪২৪ হি, খণ্ড ১, পৃ. ৬৩৯।
১১. কোলবার্গ, কিতাবখানায়ে ইবনে তাউস, ১৩৭১, পৃ. ২৭।
১২. কোলবার্গ, কিতাবখানায়ে ইবনে তাউস, ১৩৭১, পৃ. ২৮।
১৩. কোলবার্গ, কিতাবখানায়ে ইবনে তাউস, ১৩৭১, পৃ. ২৮।
১৪. সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, কাশফুল মুহাজ্জা, ১৪১৭ হিজরি, পৃ. ৪৪।
১৫. সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, ফারাজুল মাহমুম, দারুয যাখাইর, পৃ. ২৬০।
১৬. কোলবার্গ, কিতাবখানায়ে ইবনে তাউস, ১৩৭১, পৃ. ২৯।
১৭. শুমারি আয মুহাক্কিকান, মুকাদ্দামা, দুররুল আমান মিন আখতারিল আসফার ওয়া আল-আযমান, ১৩৬৮, পৃ.৫।
১৮. সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, কাশফুল মুহাজ্জা, ১৪১৭ হিজরি, পৃ. ৩০
১৯.মাওকিউল আমানাতি আম্মাতি লিলমাযারাতিশ শিয়াতিত তাবিয়ি লিদিওয়ানিল ওয়াকফিশ শিয়া, মাওকিউল আমানাতি আম্মাতি
২০.লি মাজারিস সাইয়্যিদ ইবনে তাউস আলাল ফেসবুক।
২১. ইবনে ফুতি, আল-হাওয়াদিসুল জামিআহ, দারুল কুতুবুল ইলমিয়্যাহ, পৃ. ২৫৫
২২. দেখুন: সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, ফালাহুস সাহিল, ১৪০৬ হি, পৃ. ৭৩-৭৪।
২৩. দেখুন: বে ফকিহ বাহর আল-উলূম, যিয়ারতগাহে ইরাক,সাযমানে হজ্জ ওয়া যিয়ারত,পৃ. ৬৪।
২৪. সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, কাশফুল মুহাজ্জা, ১৪১৭ হিজরি, পৃ. ১৮৫।
২৫. সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, কাশফুল মুহাজ্জা, ১৪১৭ হিজরি, পৃ. ১৮৫।
২৬. কোলবার্গ, কিতাবখানায়ে ইবনে তাউস, ১৩৭১, পৃষ্ঠা ২৩-২৪।
২৭. সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, কাশফুল মুহাজ্জা, ১৪১৭ হিজরি, পৃ. ১৮৮।
২৮. নুরি, খাতেমাতু মোস্তাদরাক আল-ওয়াসাইল, ১৪০৮ হি, খণ্ড ২, পৃ. ৪৬৬-৪৬৬।
২৯. আগা বোজুর্গ, তাবাকাত আলামুশ শিয়া (সপ্তম শতাব্দী), ১৯৭২, পৃ. ১১৭।
৩০. মুবাহেসে সিয়াসি দার কাশফুল মুহাজ্জাহ সাইয়্যেদ ইবনে তাউস (গবেষণা নিবন্ধ)
৩১. ডোমেন) http://ensani.ir/fa/article/৬৩৯৫৩/
৩২. উলুমে সিয়াসি দাফতারে তাবলিগাতে ইসলামি হুযায়ে ইলমিয়্যাহ, কুম, খণ্ড, ২৫, পৃ.১৩।
৩৩. লি মুহাজ্জাহ, ১৪১৭ হি, পৃ. ১৫৭-১৫৮।
চলবে…..