Press "Enter" to skip to content

আধুনিক বিজ্ঞানে মে’রাজ – ১

অনুবাদ: মোহাম্মাদ মুনীর হোসাইন খান
মে’রাজ অর্থ
আভিধানিক অর্থ : মে’রাজ (معراج) শব্দটি উরূজ (عروج) ধাতু থেকে উৎসারিত। আর এ উরূজ শব্দের অর্থ হচ্ছে ঊর্ধ্বগমন। যে রাতে দু’আ (প্রার্থনা) ঊর্ধ্বলোকে গমন করে সেই রাতকে ‘লাইলাতুল মে’রাজ’ (لیلة المعراج  ) অর্থাৎ মে’রাজের রজনী বা শবে মে’রাজ বলা হয়।( হুসাইন রাগেব ইসফাহানী, আলমুফরাদাত) সুতরাং মে’রাজ শব্দের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে পৃথিবী ও ঊর্ধ্ব জগৎ পরিভ্রমণ।
পারিভাষিক অর্থ : মে’রাজের পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে আসমানসমূহে মহানবী (সা.)-এর অলৌকিক ভ্রমণ। রেওয়ায়াতসমূহের ভিত্তিতে মহানবী (সা.)-এর মে’রাজ দুধাপে সংঘটিত হয়েছে :
ক. মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত মহানবীর সফর এবং সেখান থেকে মসজিদুল হারামে প্রত্যাবর্তন যা সূরা ইসরার প্রথম আয়াতে এভাবে বর্ণিত হয়েছে :
سبحان الذي أسرى بعبده ليلا من المسجد الحرام إلى المسجد الأقصى
এ অংশটিকে ইতিহাসের গ্রন্থসমূহে পারিভাষিক ভাবে ‘ইসরা’ (اسراء) অর্থাৎ নৈশ ভ্রমণ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
খ. দ্বিতীয় ধাপ : মসজিদুল আকসা থেকে আসমানসমূহের দিকে যাত্রা। রেওয়ায়াতসমূহ অনুসারে এই যাত্রা পথে তিনি নবীদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন ও কথা বলেছিলেন এবং জান্নাত-জাহান্নাম ও মহান আল্লাহর সুমহান নিদর্শনাদিও দর্শন করেছিলেন। এই অংশটিকে পারিভাষিক অর্থে মে’রাজ বলা হয়। (নাসের মাকারেম শিরাজী, তাফসীরে নামুনেহ, খ. ২, পৃ. ৫০৪-৫০৫)
মে’রাজের বিবরণ
মহানবী (সা.)-এর মে’রাজ পবিত্র কোরআনের দুটি সূরায় সংক্ষেপে উল্লিখিত হয়েছে। সূরাদ্বয় হচ্ছে সূরা ইসরা এবং সূরা নাজম। পবিত্র কোরআনের আয়াত এবং হাদীসসমূহের ভিত্তিতে সংক্ষেপে মে’রাজের বিবরণ নিচে প্রদান করা হলো:
মশহুর অর্থাৎ প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে এই যে, এই ভ্রমণ রাতের বেলায় এবং মহানবী (সা.)-এর পবিত্র মক্কায় বসবাসকালের শেষ বছরগুলোয় সংঘটিত হয়েছিল। ( সাইয়েদ হাশেম রাসূল মাহারাতি, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর জীবনী, পৃ. ১৯৬)
তবে এ ভ্রমণ কোন রজনীতে হয়েছিল- এতদসংক্রান্ত মুতাওয়াতির (অকাট্য সূত্রে উল্লিখিত) বর্ণনা বিদ্যমান নেই। আল্লামা মাজলিস বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থে তিনটি অভিমত উল্লেখ করে বলেছেন: ১৭ রবিউল আওয়ালের রাত, ২৭ রজবের রাত এবং একটি বর্ণনায় ১৭ রমযানের রাত উল্লিখিত হয়েছে।” (বিহারুল আনওয়ার, খ. ১৮, পৃ. ৩০২)
এটাই প্রসিদ্ধ যে, মহানবী (সা.) ঐ রাতে আবু তালিবের মেয়ে উম্মে হানীর  গৃহে ছিলেন এবং সেখান থেকেই মে’রাজ গমন করেন। তাঁর মসজিদুল আক্‌সা ও আসমানসমূহে গমন এবং ফিরে আসা এক রাতের বেশি ছিল না। মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : “আমি উম্মে হানীর ঘরে যখন নিদ্রা ও জাগরণের মাঝামাঝি এক অবস্থায় ছিলাম তখনই হযরত জিব্রাঈল এসে বললেন: ‘হে মুহাম্মাদ! উঠুন।’ আমি উঠে দাঁড়ালাম। জিব্রাঈল আমার হাত ধরে আমাকে যমযমের দিকে নিয়ে গেলেন। এক ফেরেশতাকে তিনি বললেন : ‘যাও কিছু যম ও কাওসার নহরের পানি নিয়ে এসো যাতে মুহাম্মাদ করে ওজু করেন। উক্ত ফেরেশতা পানি আনলে আমি তা দিয়ে ওজু করলাম। অতঃপর জিব্রাঈলের নির্দেশে আমি মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলাম। এরপর জিব্রাঈল হাত ধরে আমাকে মসজিদের বাহিরে আনলেন। যখন আমি বাইরে আসলাম তখন মসজিদের দরজার সামনে বুরাক দেখতে পেলাম। জিব্রাঈল আমাকে বললেন: ‘বুরাকের ওপর উঠুন। এটা হচ্ছে সেই বাহন যাতে চড়ে ইবরাহীম (আ.) কাবা যিয়ারত করতে আসতেন। আমি বুরাকের ওপর সাওয়ার হলাম এবং তা আমাকে মসজিদুল আকসায় এবং সেখান থেকে আসমানসমূহে নিয়ে যায় এবং সেখানে অনেক আশ্চর্যজনক বিষয় প্রত্যক্ষ করি এবং সৃষ্টির রহস্যাবলীর সাথে পরিচিত হই। অতঃপর বুরাক আমাকে পবিত্র মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে। (আল মীযান ফি তাফসীরিল কুরআন, খ. ১৩, পৃ. ৩২; মাহমূদ ইবনে মুহাম্মাদ হাসানী আবুল মাকারিম, দাকায়িকৃত তাভীল ওয়া হাকায়িকৃত তানযীল, পৃ. ৩৭৯-৩৯৩)
রেওয়ায়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে যে, বুরাক কয়েকটি স্থানে থামে এবং মহানবী (সা.) সে সব জায়গায় নামায পড়েন। যেমন কুফার মসজিদ, সিনাই পর্বত, বাইতুল লাহুম (হযরত ঈসার জন্মস্থান)। অতঃপর মহানবী (সা.) মসজিদুল আক্সায় প্রবেশ করে সেখানে নামায পড়লেন এবং সেখান থেকে আসমানসমূহে গমন করেন। (বিহারুল আনওয়ার, খ. ১৮, পৃ. ২৫২-২৬১)
ইবনে হিশাম নিজ সীরাহ্ গ্রন্থে মে’রাজের হাদীস এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, উম্মে হানী বলেন:
“রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ঐ রাতে আমার গৃহেই ছিলেন; তিনি ইশার নামায পড়লেন এবং ঘুমালেন। আমরাও তাঁর সাথে ঘুমালাম। ফজরের সময় হলে তিনি আমাদের ঘুম থেকে জাগালেন এবং ফজরের নামায পড়লেন এবং আমরাও তাঁর সাথে নামায আদায় করলাম। তখন তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন : ‘হে উম্মে হানী! আমি আজ রাতে যেমন তোমরা দেখেই তোমাদের সাথে ইশার নামায এখানেই পড়ি; অতঃপর আমি বাইতুল মুকাদ্দাস গমন করে সেখানে কয়েকবার নামায আদায় করি। যেমন তোমরা দেখতে পাচ্ছ, তেমনি আমি পুনরায় এখানে এসে ফজরের নামায পড়ি।’ এ কথা বলে তিনি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। আমি হাত দিয়ে তাঁর পোশাকের প্রান্ত এমনভাবে টেনে ধরলাম যে, তাঁর জামা পেছনে সরে আসল। আমি তখন তাঁকে বললাম : ‘হে রাসূল (সা.)! আমাকে যে এ কথা বললেন তা অন্যদেরকে বলেন না। কারণ, তারা আপনার কথা প্রত্যাখ্যান করবে এবং আপনাকে কষ্ট দেবে। কিন্তু তিনি বললেন : হে আল্লাহ! আমি তাদের সবাইকে বলব।’ উম্মে হানী বলেন : ‘আমার হাবশী দাসীকে বললাম : ‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পিছে পিছে গিয়ে দেখ যে লোকজন তাঁর সাথে কেমন আচরণ করছে এবং তাদের কথাবার্তাও আমাকে বলবে।’ দাসী চলে। গেল। সে ফিরে এসে আমাকে বলল : ‘মহানবী (সা.) যখন তাঁর কাহিনী লোকদেরকে বললেন তখন তারা আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল : ‘আপনার কথা যে সত্য তার প্রমাণ কী এবং আমরা কিভাবে বুঝব যে, আপনি সত্য বলছেন?’ মহানবী (সা.) বললেন : ‘এর প্রমাণ হচ্ছে অমুক কাফেলা। শাম যাওয়ার সময় তাদেরকে অমুক জায়গায় দেখি এবং তাদের উটগুলো বুরাকের চলার শব্দে ভীত হয়ে যায় এবং একটি উট সেখান থেকে পালিয়ে যায়। আমি উক্ত কাফেলাকে জানালাম যে, পালাতক উটটি কোথায়? ফেরার সময় আমি দাজুনান্ (মক্কা নগরী থেকে ২৫ কি. মি. দূরে) মঞ্জিলে অমুক কাফেলাকে দেখি যাদের সবাই ঘুমিয়ে ছিল। আর তাদের পানির পাত্র তাদের মাথার কাছে রাখা ছিল এবং তারা ঐ পাত্রটির মুখ একটা কিছু দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। উক্ত কাফেলা এখনই তানঈম্ উপত্যকা দিয়ে পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করবে। আর এর নিদর্শন হচ্ছে, তাদের অগ্রভাগে ছাই রঙের একটি উট আছে এবং ঐ উটের ওপর রয়েছে দুটি বোঝা। আর উক্ত বোঝাদ্বয়ের একটি কালো রঙের। যখন লোকেরা এ কথা শুনল তখন তারা তাঈম উপত্যকার দিকে ছুটে গেল এবং মহানবী (সা.) যে সব নিদর্শন উল্লেখ করেছিলেন সেগুলোসমেত উক্ত কাফেলাকে তানঈম উপত্যকা দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করতে দেখল। অপর কাফেলাটি মক্কা নগরীতে আসলে লোকজন তাদের কাছে তাদের উটগুলোর আতঙ্কিত হওয়া এবং তাদের একটি উটের পালিয়ে যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করে এবং উক্ত কাফেলার লোকজনও তাঁকে সত্যায়ন করে। (সিরাতে ইবনে হিশাম, খ. ১, পৃ. ২৫৬)
অতঃপর মূল মে’রাজ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। আল্লামা তাবাতাবাঈ এতদপ্রসঙ্গে বলেন মূল ইসূরা (নৈশ ভ্রমণ) এবং মে’রাজ হচ্ছে ঐ সব বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত যাতে কোন সন্দেহ-সংশয় নেই। কারণ, পবিত্র কোরআনে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবং শিয়া-সুন্নী মাযহাব নির্বিশেষে মুতাওয়াতির সূত্রে মাহানবী (সা.) থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
আর আহলে বাইতের ইমামদের থেকেও এতদপ্রসঙ্গে অগণিত রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে। আমরা এখন কয়েকটি হাদীস নমুনাস্বরূপ নিচে উল্লেখ করব:
১. সূরা ইসরার ১ম আয়াত
سبحان الذي أسرى بعبده ليلا من المسجد الحرام إلى المسجد الأقصى الذي باركنا حوله لنريه من آياتينا إنه هو السميع البصير
‘সেই সত্তা পবিত্র যিনি নিজ বান্দাকে এক রাতে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে গেলেন যার চার পাশ আমরা বরকতময় করেছি যাতে আমরা তাকে আমাদের নিদর্শনসমূহ দেখাতে পারি। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।
২. ইমাম জাফর সাদেক (আ.) এতদপ্রসঙ্গে বলেন
ليس من شيعتنا من أنكر أربعة أشياء: المعراج والمسألة في القبر و خلق الجنة والنار و الشفاعة
যে কেউ মেরাজ, কবরে সওয়াল-জবাব, বেহেশত ও দোযখের সৃষ্টি এবং শাফায়াত- এ চারটি বিষয় অস্বীকার করবে সে আমাদের শিয়া (অনুসারী) হবে না।”
( বিহারুল আনওয়ার, খ. ১৮, পৃ. ৩১২)
৩. ইমাম রেযা (আ.) বলেন
من كذب بالمعراج فقد كذب رسول الله
‘যে ব্যক্তি মে’রাজ অস্বীকার করল আসলে সে মহানবী (সা.)-কেই অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করল।
( ইবনে শাহরে আশুব মানাকিব, খ. ১, পৃ. ১৫৩)
তথ্যসূত্র:
– মোজতামায়ে আমুজেশে আলিয়ে ফেক্বহ্।
চলবে…