Press "Enter" to skip to content

আধুনিক বিজ্ঞানে মে’রাজ – ৪

অনুবাদ: মোহাম্মাদ মুনীর হোসাইন খান

মেরাজের আকাশের ব্যাখ্যা
প্রশ্ন: মেরাজের ঘটনায় ‘আকাশ’ বলতে কী বুঝানো হয়েছে?
‘আকাশ’ বলতে যদি পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানের বিশাল মহাশূনাকে বোঝানো হয়ে থাকে তাহলে এক্ষেত্রে মেরাজ বলে আর কিছুই বিদ্যমান থাকবে। না (অর্থাৎ মেরাজের কথা চিন্তাও করা যাবে না)। আর আকাশ বলতে যদি সূর্যের ও দৃশ্যমান আকাশের উর্ধ্বে কোন কিছু বুঝানো হয়ে থাকে যার সপ্তম ছাদের ওপর মহান আল্লাহ অবস্থান করছেন তাহলে এ ধরনের ছাদসমূহের বাস্তবে কোন অস্তিত্বই নেই ।
উত্তর : পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টিজগতের অন্যতম রহস্য যার স্বরূপ মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এতসব উন্নতি সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত বুঝতে পারে নি। পবিত্র কোরআনের মুফাসসিরগণ ‘আকাশ’ এর সাথে সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহের ব্যাখ্যায় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আমরা এখানে এর গুটিকতক আলোচনার দিকে ঈঙ্গিত করব যাতে যে আকাশে মহানবী (সা.) মেরাজের রাতে সফর করেছিলেন তা কোন্ আকাশ ছিল তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
এ প্রশ্নটা বাহ্যত মেরাজ সংক্রান্ত নব্য উত্থাপিত প্রশ্নসমূহের অন্তর্ভুক্ত। তাই এ প্রশ্নের যথাযথ জবাব পেতে হলে অত্যাবশ্যকভাবে শুরুতেই আকাশ শব্দের অর্থ, সাত আকাশ এবং ঐ সব আকাশ যেখানে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নিজেও ভ্রমণ করেছেন সেগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট পবিত্র কোরআনের আয়াত এবং রেওয়ায়েতসমূহের ব্যাখ্যা প্রদান করব।
‘আকাশ’ শব্দের অর্থ
সু (سمو) ধাতুমূল থেকে সামা (سماء ) শব্দের উৎপত্তি। আর যে কোন জিনিস বা বস্তুর আকাশ বলতে উক্ত বিষয় বা বস্তুর ঊর্ধ্বলোককে বোঝানো হয় ।
এমনকি কতিপয় অভিধান রচয়িতার মতে প্রতিটি উচ্চতাই হচ্ছে এর নিয়ে ক্ষেত্রে আকাশ এবং যে কোন নিম্নের অংশই হচ্ছে এর উচ্চ অংশের জন্য জমিন। স্বরূপ। ইসলামী বিশ্বকোষে ‘আকাশ হচ্ছে একটি বাহ্য গম্বুজ যা পৃথিবীবাসী সব জায়গা থেকে নিজেদের মাথার ওপরে প্রত্যক্ষ করে থাকে’- এ কথা বলার পর প্রখ্যাত অভিধান প্রণেতা ইবনে মানযুর থেকে বর্ণিত হয়েছে আরবী ভাষায় ‘আসমান’ শব্দের সমার্থক হচ্ছে সামা (سماء) শব্দ অর্থাৎ যা কিছু কোন কিছুর ঊর্ধ্বে থাকবে। যেমন ছাদ অথবা শামিয়ানা- সেটাই হচ্ছে সামা।
আল্লামা তাবারসী মাজমাউল বায়ানে বলেছেন : ‘প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে এই যে, কোন কিছু তোমার ওপরে আছে অথবা আংশিকভাবে হলেও তোমার ওপর ছায়া ফেলে সেটাই হচ্ছে সামা। সুতরাং ঘরের সামা হচ্ছে ছাদ। মেঘ ও
বৃষ্টিকেও সামা (আকাশ) বলা হয়। আধুনিক পদার্থ বিদ্যায় ‘আকাশ’ হচ্ছে অস্তিত্বহীন ও গম্বুজবৎ একটি প্রপঞ্চ যা গ্রহ-নক্ষত্র দৃষ্টিগোচর হওয়ার ক্ষেত্র বা পটভূমি স্বরূপ ।
সামা (سماء ) অর্থাৎ আকাশ শব্দটি পবিত্র কোরআনে একবচন (سماء) ও বহু বচন আকারে (سموات) ৩১০ বারেরও বেশি উল্লিখিত হয়েছে। তবে সবক্ষেত্রেই এ শব্দটি একই অর্থে এবং একই উপমা ও দৃষ্টান্তে ব্যবহার করা হয় নি। সার্বিকভাবে, পবিত্র কোরআনে আকাশ শব্দ পার্থিব ও অবস্তুগত (অজড়)- এ দুই
অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর কতিপয় প্রয়োগক্ষেত্র হচ্ছে নিম্নরূপ :
১. উচ্চ ও ঊর্ধ্ব অর্থে এ অর্থ ‘আকাশ’ (سماء) শব্দের আভিধানিক অর্থের সাথে পূর্ণ সংগতিসম্পন্ন। আর তা নিম্নোক্ত আয়াত থেকে প্রতিপন্ন হয়।
كما طيبة كشجرة طيبةٍ أَصْلُهَا ثَابِتٌ وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ
ঐ পবিত্র বরকতময় বৃক্ষের মত যার মূল মাটিতে দৃঢ় প্রোথিত এবং শাখা-প্রশাখাসমূহ আকাশে উন্মুক্ত ও প্রসারিত (হয়ে আছে)? ( সূরা ইব্রাহীম : ২৪)
এ অর্থই সমসাময়িক কালের কতিপয় মুফাসির উল্লেখ করেছেন। তবে অন্যান্য তাত্ত্বিক আলেম নিম্নোক্ত এ অভিমত পোষণ করেন : পবিত্র কোরআনে সামা শব্দটি ‘ঊর্ধ্ব, ওপর ও উঁচু দিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। নি তবে রূপকভাবে এ অর্থেও (পবিত্র কোরআনে) ব্যবহৃত হতে পারে। কারণ, ঊর্ধ্ব, উঁচু বা ওপর (سماء) এর বহুবচন হয় না এবং ওপর বা উঁচু একাধিকও (বহু) হতে পারে না। অথচ পবিত্র কোরআনে সামা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আস-সামাওয়াত (السموات ) অর্থাৎ বহুবচন আকারে ব্যবহৃত হয়েছে।( আয়াতুল্লাহ তাকী মিসবাহ ইয়াজদি, মায়ারিফে কোরআন, ১-৩ সমিতি বা পৃ ২০) সমান (السموات السبع) উঁচু, ঊর্ধ্ব দিক বা ওপর অর্থে হতে পারে না।
২. ভূপৃষ্ঠ বা পৃথিবীর চারপাশের বায়ুমণ্ডল অর্থাৎ যে স্থানে মেঘমালা ও বাতাস রয়েছে সেই স্থান
اوْ نَزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً مُبَارَكاً
এবং আমরা আকাশ থেকে বরকতময় (কল্যাণ) | (বৃষ্টি) অবতীর্ণ করেছি (ভূপৃষ্ঠে)  ( সূরা আল ক্বাফ : ৯ )
৩. গ্রহ ও নক্ষত্রসমূহের স্থান
تبارك الَّذِي جَعَلَ فِي السَّمَاءِ بُرُوجاً وَ جَعَلَ فِيهَا سِرَاجًا وَ
ঐ সত্তাই হচ্ছেন সুমহান যিনি আকাশে সৃষ্টি করেছেন রাশিচক্র এবং তাতে স্থাপন করেছেন প্রদীপ ও জ্যোতির্ময় চন্দ্র।
( সূরা আল ফুরকান : ৬১)
৪. (মহান আল্লাহর) নৈকট্য ও সান্নিধ্য স্থল: যা হচ্ছে গোটা অস্তিত্বজগতের সমুদয় বিষয় পরিচালনা করার স্থান বা কেন্দ্র। কতিপয় মুফাসসির, যেমন আল্লামা তাবাতাবাঈ (রহ) কয়েকটি ক্ষেত্রে সামা শব্দটির এ অর্থ নির্দেশ করেছেন । যে সব আয়াত সামা শব্দের এ অর্থ নির্দেশ করে অনুধ্যে রয়েছে এ আয়াতটি ।
يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مِنَ السَّمَاءِ إِلَى الْأَرْضِ
তিনিই (মহান আল্লাহ) আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সময় বিশ্বের যাবতীয় বিষয় পরিচালনা করছেন। ( সূরা আয যারিয়াত: ২২)
৫. শ্রেষ্ঠ ও প্রকৃত অস্তিত্বশীল সত্তা : কতিপয় তাত্ত্বিক আলেমের মতে যেমনভাবে আকাশ (সামা) শব্দটি পবিত্র কোরআনে পার্থিব (জগতের) আকাশ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন সাত আকাশ (السموات السبع), তেমনি উচ্চ পর্যায়ের অস্তিত্ব ও অস্তিত্বশীল সত্তা অর্থেও এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আর এই আকাশ (সামা) হচ্ছে জড় জগতের ঊর্ধ্বে অবস্থিত অজড় আকাশ ও জগৎ এবং এ পার্থিব ও জড় জগতের যাবতীয় অস্তিত্ব উক্ত উচ্চতর (ও শ্রেষ্ঠতর) পর্যায়ে থেকে (নিম্ন জগতে অর্থাৎ জড় পার্থিব জগতে) অবতীর্ণ হয়ে থাকে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে:
او إن من شيءٍ إِلَّا عِندنا خزائنه و ما تنزله إلا بقدر معلوم
প্রতিটি বস্তুর (উপায়-উপকরণের) ভাঙার আমাদের কাছেই বিদ্যমান এক আমরা সুনির্দিষ্ট পরিমাণেই কেবল তা (এ পার্থিব জগতে) অবতীর্ণ করি। ( সূরা হিজর: ২১)
সুতরাং আভিধানিক অর্থে এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও পবিত্র কোরআনের ভাষায়ও সামা (আকাশ) শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
সাত আকাশ
পবিত্র কোরআনে মোট আটবার সাত আকাশ (السموات السبع) বাক্যাংশটি বর্ণিত হয়েছে। এই আট স্থানে ব্যবহৃত ‘সাত আকাশ” বাক্যাংশটি নিয়ে একটু গভীর ও সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই সাত আকাশ একের পর এক আবৃত অবস্থায় বিদ্যমান, ঠিক যেমন পিয়াজের স্তর সমূহ একের পর এক বিন্যস্ত; কারণ, অধিকাংশ মুফাস্সির (طباقا বা তিবাক্বান) শব্দটি পরস্পরের ওপর অবস্থিত স্তরসমূহ বলে অর্থ ও ব্যাখ্যা করেছেন। পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ অনুসারে এ সকল স্তর আসলে গাঢ় (ঘনীভূত) গ্যাস থেকে সৃষ্ট ও গঠিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
اثم استوى إلى السَّمَاءِ وَ فِي دُخان
অতঃপর তিনি (মহান আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করার পর) আকাশসমূহের দিকে (সৃষ্টি করার জন্য) মনোনিবেশ করেন: অথচ তখন সেগুলো (সপ্তাকাশ) ধোঁয়া ও বাষ্প আকারে বিরাজ করছিল। ( সূরা ফুসসিলাত : ১১)
অর্থাৎ মহান আল্লাহ আদি গ্যাস থেকে গ্রহ-নক্ষত্ররাজি সৃষ্টি করেন। কারণ, (পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার আগে) ঐ সময় আকাশ ( সামা) ধোঁয়া ও ঘনীভূত (গাঢ় গ্যাস ছিল এবং ধীরে ধীরে তা তরল বা পাতলা হয়ে সাত আকাশে পরিণত হয়। সার্বিকভাবে সাত আকাশ সংক্রান্ত দুটি সম্ভাবনা রয়েছে :
ক. সাত আকাশ বলতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের স্তরসমূহকেও নির্দেশ করা হয়ে থাকতে পারে। কারণ, পবিত্র কোরআনের কতিপয় আয়াত থেকে এ বিষয়টি প্রতীয়মান হয় যে, আকাশসমূহ হচ্ছে সাতটি এবং সেগুলো স্তরে স্তরে বিন্যস্ত। মহান আল্লাহই সাত আকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং এগুলোর মত সাত জমীনও (পৃথিবী) সৃষ্টি করেছেন।
ভূতত্ত্ববিদগণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের স্তরসমূহকে এগুলোর বৈশিষ্ট্য ও ক্রিয়াকলাপ অনুসারে সাত স্তরে বিভক্ত করেছেন :
১. ট্রপোনস্ফেয়ার : ট্রপো শব্দের অর্থ পরিবর্তনশীল এবং ফেয়ার শব্দের
অর্থ হচ্ছে গোল, বৃত্ত ও অঞ্চল। বিষুব রেখার কাছে অর্থাৎ বিষুবীয় অঞ্চলে এর উচ্চতা ১৬ কি.মি. এবং মেরুতে এর উচ্চতা ১০ কি.মি। বায়ুমণ্ডলের এ অংশেই মেঘমালা গঠিত হয় এবং পৃথিবীর আবহাওয়া সুনির্দিষ্ট হয়ে থাকে।
২. স্ট্যাটোস্ফেয়ার : এ স্তরটি ট্রপোস্ফেয়ারের ঊর্ধ্ব হতে শুরু হয়ে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩২ কি.মি. উচ্চতা পর্যন্ত প্রসারিত। এ অংশে সর্বদা প্রবল ঝড়ো বাতাস বইতে থাকে ।
৩. ওজোনোস্ফেয়ার : এ স্তর দ্বিতীয় স্তরের কিছু অংশকেও ধারণ করেছে। এর উচ্চতা ২০ কি.মি. থেকে শুরু হয়ে ৫০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্তরে এক ধরনের অক্সিজেন আছে যা ওজোন নামে অভিহিত। এই অংশ বায়ুমণ্ডলের অন্যান্য অংশের তুলনায় অধিক উষ্ণ এবং এর উষ্ণতা প্রায় শূন্য ডিগ্রীর কাছাকাছি । এর কারণ হচ্ছে এই যে, ওজোন সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি শোষণ করে (যার ফলে তা ভূপৃষ্ঠে পৌঁছতে পারে না)।
৪. মেজোস্ফেয়ার : এ স্তর বা অংশে মহাশূন্য থেকে আগত নভোমণ্ডলীয় জড়পদার্থ বা বস্তুকণাসমূহ তীব্র গতিবেগ থাকার কারণে বায়ুমণ্ডলের সাথে ঘর্ষণের ফলে প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে জ্বলে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায় এবং এগুলোর ভস্ম ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়।
৫. আয়োনোস্ফেয়ার এ স্তরটি এমন এক অঞ্চল যা সত্যিই বিস্ময়কর ও রহস্যময়। বায়ু এ অংশে এতটা পাতলা হয়ে গেছে যে, এ কারণে তা প্রায় বায়ুশূন্যই বলা চলে । ৫০ কি.মি. উচ্চতা থেকে এ অংশের শুরু এবং ঊর্ধ্বে ৩০০ কি.মি. বা ৮০০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে কোন জীব বা প্রাণী সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি, মহাজাগতিক রশ্মি এবং উল্কাপাত থেকে নিরাপদ ও জীবিত থাকতে সক্ষম নয়। তবে নভোযানসমূহে যে সব যন্ত্রপাতি আছে সেগুলো ব্যবহার করে মানুষ বা জীব বায়ুমণ্ডলের এ অংশে নিরাপদ এবং বেঁচে থাকতেও পারবে।
৬. থার্মোস্ফেয়ার : এ অংশে বায়ু-কণাসমূহ বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত হয়ে থাকে অর্থাৎ বৈদ্যুতিক চার্জ গ্রহণ করে।
৭. এক্সোস্ফেয়ার এ অংশ বা স্তরে বিদ্যমান কণাসমূহ নিম্নবর্তী স্তরসমূহে বিদ্যমান কণাসমূহের চেয়ে পরিমাণে অনেক কম। আর এ কারণেই এ সব কথা এই স্তরে যেমন দ্রুত গতিতে ছুটে বেড়াতে সক্ষম, তেমনি কিছু কিন্তু ক স্তর থেকে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি উপেক্ষা করে বায়ুমণ্ডলের বাইরে চলে যেতেও সক্ষম।
খ. কতিপয় তাত্ত্বিক আলেমের মতে মহানবী (সা.) মেরাজের রাতে যে স আকাশ সফর করেছিলেন সেগুলো আসলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ৭ স্তর ছিল না; বরং এ ক্ষেত্রে সাত আকাশ বলতে আমাদের দৃষ্টির প্রথম আকাশ যা সমর্থ নক্ষত্রপুঞ্জ ও তারকাজগতকে শামিল করে তা ছাড়াও আরো এমন ছয় আকাশকে বুঝানো হয়েছে যেগুলো সংক্রান্ত বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি তথ্য ও জ্ঞান আমাদের নেই। তাঁরা তাঁদের এ দাবী ও বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি দেখান এ বলে : আমরা যদি সাত আকাশ এবং সাত সংখ্যাটি সংখ্যা হিসেবেই গণ্য করি তাহলে এর অর্থ হবে সাত আকাশ। সূরা সাফফাতের ৬ নং আয়াত :
إِنَّا زَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِزِينَةِ الْكَوَاكِبِ
“আমরা (পৃথিবীর) নিকটবর্তী আকাশ অর্থাৎ প্রথম আকাশকে গ্রহ ও নক্ষত্রসমূহ দিয়ে সৌন্দর্যমণ্ডিত ও সুশোভিত করেছি।
এবং সূরা ফুসসিলাতের ১২ নং আয়াত :
وَزَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيحَ وَحِفْظًا
“আমরা নিম্নবর্তী আকাশকে (তারকা ও নক্ষত্ররাজির) প্রদীপসমূহ দিয়ে সুসজ্জিত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছি- এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, আমরা যা দেখি এবং যা মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নাগালে রয়েছে তা সবকিছু প্রথম আকাশের সাথেই সংশ্লিষ্ট। আর প্রথম আকাশের এ সব গ্রহ-তারকার পরেও আরো ছয়টি জগৎ বা বিশ্ব আছে যা আমাদের জ্ঞানের নাগালের বাইরে (আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজি, তাফসীরে নেমুনে, খ, ২৪, পৃ. ২৬১)
এ সব আয়াত থেকে ভালোভাবে বোঝা যায় যে, আমরা যা কিছু দেখি তা অর্থাৎ তারকারাজির জগৎ এসব কিছুই আসলে প্রথম আকাশেরই অংশবিশেষ। আর এ প্রথম আকাশের পরেই আরো ছয় আকাশ রয়েছে যেগুলোর খুঁটিনাটি বিষয় সংক্রান্ত বর্তমানে কোন সূক্ষ্ম তথ্যই আমাদের হাতে নেই। তাই উক্ত ছয় আকাশ আমাদের কাছে অজানা এবং অজ্ঞাত রয়ে গেছে। (আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজি, তাফসীরে নেমুনে, খ, ১, পৃ. ১৬৭-১৬৮)
 তবে ভবিষ্যতে সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, মানুষের অপূর্ণাঙ্গ জ্ঞান যত উন্নত হচ্ছে তা তত বেশি সৃষ্টিজগতের নতুন নতুন আশ্চর্যজন ও রহস্য উদ্ঘাটন করছে। যা বর্ণনা করা হলো তদনুসারে উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব এভাবে দেয়া যায় :
১. মেরাজের রাতে যে আকাশে মহানবী (সা.) উড্ডয়ন করেছিলেন তা নিশ্চিতভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের স্তরসমূহ ছিল না। আপত্তি তখনই অবধারিত হয়ে যাবে যখন আমরা মহানবী (সা.)-এর মেরাজকে পৃথিবী বা ভূপৃষ্ঠের বায়ুমণ্ডলের স্তরসমূহে পরিক্রমণ বলে গণ্য করব। কারণ, মহানবী (সা.) বহু আকাশের অস্তিত্বের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন ও কথা বলেছেন এবং তাঁর কথার বাহ্য অর্থই হচ্ছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে অবস্থিত বা বিদ্যমান আকাশসমূহ। কতিপয় মুফাসসির যেমন বিশ্বাস করেন তদনুসারে এ পৃথিবীর আকাশের পরে বা পশ্চাতে আরো ছয় আকাশের অস্তিত্ব রয়েছে। ( দ্রষ্টব্য : আল্লামা তারাতাবাঈ, আল মাঁধান, খ. ১৭, পৃ.৩৭০)
২. সুউচ্চ আকাশসমূহ এবং সপ্তম আকাশে মহানবী (সা.)-এর উড্ডয়ন সৃষ্টিজগতের অন্যতম রহস্য এবং তাঁর অন্যতম মোজেযা। পবিত্র কোরআনে যে সাত আকাশের কথা বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর মধ্য থেকে আমরা কেবল এ পৃথিবীর আকাশকেই দেখি। কিন্তু আমরা জানি না যে, এই আকাশ, পৃথিবী, সৌরজগৎ এবং ছায়াপথসমূহের পশ্চাতে কোন্ কোন্ গ্রহ, নক্ষত্র ও জীব বিদ্যমান। মানুষের জ্ঞান ও তথ্যের এ সীমাবদ্ধতা অন্যান্য আকাশ ও জগৎ যে বিদ্যমান নেই- এ কথার দলিল হতে পারে না।
৩. বর্তমান যুগের মানুষ, সকল বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নতি ও অগ্রগতি সঙ্গেও নিশ্চিত করে দাবী করতে সক্ষম নয় যে, এই সৌরভঙ্গে বিদ্যমান গ্রহসমূহেরই সব বিষয় তারা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। তাই দৃশ্যমান এ আকাশ ব্যতীতও যে আরো আকাশের অস্তিত্ব আছে তা কিভাবে অস্বীকার করা যাবে?
ফলাফল
যা আলোচনা করা হলো তা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, মেরাজের ঘটনায় বর্ণিত আকাশ বলতে ভূপৃষ্ঠের বায়ুমণ্ডলের স্তরসমূহ এবং সূর্য ও পৃথিবীর অন্তর্বর্তী সীমাহীন মহাশূন্য বুঝানো হয় নি; বরং আকাশ বলতে আকাশের স্তরসমূহকে বুঝানো হয়েছে, যেগুলোর মধ্য থেকে আমরা প্রথম আকাশ অর্থাৎ প্রথম বিশ্বের (দুনিয়ার) পদার্থ ও বিষয়াবলী সম্পর্কেই কেবল জ্ঞাত।
মানবজাতি অপরাগতার কারণে এখন পর্যন্ত আরো ছয় আকাশের নাগাল পায় নি। এ দাবীর সপক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত নর নব আবিষ্কার। যে সব বিষয় মানুষ তার চর্মচক্ষু অর্থাৎ জড় দৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে উপলব্ধি করতে সক্ষম নয় সেগুলোর অস্তিত্ব অস্বীকার করার অধিকারও তার নেই। কারণ, মানুষের জ্ঞান সীমিত এবং এই সীমিত ও অপূর্ণাঙ্গ জ্ঞান দিয়ে সে অসীমকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করতে পারে না।
অধিক অধ্যয়নের জন্য নিম্নোক্ত গ্রন্থসমূহ দ্রষ্টব্য
১. সাইয়্যেদ আলী আকবার কোরাইশী প্রণীত পবিত্র কোরআনের অভিধান, দারুল কুতুব আল-ইসলামিয়াহ, তেহরান, (১৩৭১ ফার্সী সাল) কর্তৃক প্রকাশিত।
২. আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ তাকী মিসবাহ ইয়াযদী প্রণীত মাআরেফে কোরআন (১-৩), ইমাম খোমেইনী শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত, কোম, ১৩৮৪ ফার্সী সাল ।
৩. আল্লামা সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হুসাইন তাবাতাবাঈ প্রণীত আল-মীয়ান ফী তাফসীরিল কোরআন, ১৬ ও ১৯তম খণ্ড, দাফতারে তাবলীগাতে ইসলামী, কোন কর্তৃক প্রকাশিত (১৪১৭ হিজরি)।
তথ্যসূত্র:
মোজতামায়ে আমুজেশে আলিয়ে ফেক্বহ্।