অনুবাদ-ড.আবু উসামা মুহাররম
১২. ইবনে রোজবাহান বলেছেন:
“তিনিই সেই সত্তা, যিনি তাঁর স্বমহিমায় প্রত্যেক অবাধ্য কাফেরকে সমূলে উৎখাত করেন। তিনি সেই ব্যক্তি যিনি, আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মহান আল্লাহর পবিত্রতা এবং তাঁর মহিমা, গৌরব ও সম্মান সমুন্নত রাখার কারণে শাস্তি পেয়েছিলেন। তিনি আল্লাহর নৈকট্যের পথে পরিভ্রমণ করে একত্ববাদের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছিলেন।
বিচারের মাপকাঠিতে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর অভ্যুত্থান
১৩. আশ’আরি মতবাদের প্রবক্তা আবুল হাসান আশ’আরি (মৃত্যু ৩২৪ হিজরি), বলেছেন:
“ইয়াযিদের অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় ইমাম হুসাইন (আ.) তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাথীদের নিয়ে উঠে দাঁড়ান এবং কারবালায় শহিদ হন।”
১৪. আল্লামা আলুসি (মৃত্যু ১২৭০ হিজরি), যিনি ইরাকি আহলে সুন্নাতের একজন নির্ভরযোগ্য মুফতি ছিলেন, তিনি “তাফসিরে রুহ আল-মাআনি”
فهل عسیتم ان تولیتم . . . ان تفسدوا فی الارض و تقطعوا ارحامکم اولئک الذین لعنهم الله[i]
এই আয়াতের তাফসিরে হাম্বলি মাযহাবের নেতা আহমাদ বিন হাম্বল থেকে বর্ণনা করেছেন যে:
তার ছেলে তাকে ইয়াজিদের অভিশাপের কথা জিজ্ঞেস করল। উত্তরে তিনি বলেন: আল্লাহ যেখানে তার কিতাবে অভিশাপ দিয়েছেন তাকে কেন অভিশপ্ত করা যাবে না?! আহমাদ বিন হাম্বলের পুত্র আবদুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেনঃ আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি কিন্তু ইয়াজিদের অভিশাপ দেখিনি? আহমাদ ইবনে হাম্বল এর জবাবে উক্ত আয়াত পাঠ করলেন তিলাওয়াত করলেন এবং তারপর বললেনঃ ای فساد و قطیعة اشد مما فعله یزید ইয়াজিদ যে দুর্নীতি করেছিল তার চেয়েও কী ধরনের দুর্নীতি বেশি হতে পারে? !
১৫. আলুসি এই শব্দগুলি উদ্ধৃতি করার পরে বলেছেন:
“ইয়াজিদের অভিশাপের ব্যাপারে কোন অপেক্ষা নয়, কারণ সে একজন কবিরা গুনাহকারী এবং খারাপ গুণাবলীর অধিকারী ছিল। সে মদিনার [জনগণকে] অত্যাচার করেছিল এবং হুসাইন (আঃ) কে হত্যা করেছিল এবং তাঁর আহলে বাইতকে অপমান করেছিল।”
১৬. মৌলভি মুহাম্মদ শাহদাদ হানাফি সাইয়্যেদুশ শুহাদা ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর পদক্ষেপ সম্পর্কে লিখেছেন:
“যাকে তিনি সঠিক মনে করেছেন, এ জন্য তিনি তার জীবনকে সমর্পণ করেছেন কিন্তু তিনি মিথ্যার কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। তার পর্যাপ্ত বন্ধু ও সাহায্যকারী না থাকা সত্ত্বেও তিনি মহান শাহাদাতের মর্যাদায় পৌঁছনো পর্যন্ত তার সমস্ত শক্তি ও সাহস নিয়ে মিথ্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
১৭. ইবনে রোজবাহান লিখেছেন:
“সেই মহান ব্যাক্তিত্ব কারবালায় তীব্রতা ও বিপর্যয়ের ঢেউয়ের মধ্যে শাহাদাতের শরবত পান করেন এবং তাকে সেখানে সমাহিত করা হয়। এর চেয়ে মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে আর ঘটেনি! আল্লাহর জ্ঞানের সমান অভিশাপ তাদের প্রত্যেকের উপর যারা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং এতে সন্তুষ্ট ছিল।
১৮. ইবনে খালদুন বলেছেন:
“এটা বলা যাবে না: ইয়াজিদ ইমাম হুসাইন (আঃ)-কেও হত্যা করার চেষ্টা করেছিল, তাই তিনি নির্দোষ; কারণ যেসব সাহাবি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সাথে বিদ্রোহে অংশ নেননি, তারা কখনোই তাকে হত্যার অনুমতি দেননি। ইয়াজিদই ইমামের সাথে যুদ্ধ করেছিল। ইয়াজিদের এই কাজটি তার অধঃপতনের একটি চিহ্ন এবং হুসাইন (আঃ) তার শাহাদাতে ন্যায়সঙ্গত ছিলেন, যখন ইয়াজিদ ন্যায়বিচার থেকে দূরে ছিল এবং হুসাইন (আঃ) একজন নিষ্ঠুর শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন।
১৯. ড. তোহা হুসাইন (মৃত্যু ১৯৭৩ খ্রি.), লেখক এবং সমসাময়িক সুন্নি সমালোচক, বিশ্বাস করেন:
“যেহেতু হুসাইন একদিকে ধর্ম রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর এবং অন্যদিকে, স্বাধীন এবং বীর। তিনি কখনোই ইয়াজিদের আনুগত্যের অনুরোধের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন না। সুতরাং, তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য, তাকে বৈধ কিছু করা উচিত। তাই আনুগত্যের বিষয়টি এড়াতে ও দূরে থাকার জন্য তিনি কুফায় ফিরে যান এবং ইয়াজিদের আনুগত্যের চেয়ে শাহাদাতকে প্রাধান্য দেন, যা ছিল ইয়াযিদের অত্যাচারের এক প্রকার নিশ্চিতকরণ।
২০. শেখ আবদুল্লাহ আলাইলি (মৃত্যু ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে), সুন্নি গবেষক এবং লেখক (নিজের মতে, আলাইলি নামটির কারণ তাদের বংশীয় পরম্পরা ইমাম আলি বিন আবি তালিব (আ.)-এর কাছে ফিরে যায়) মনে করেন ইয়াজিদের বিসয় বিশ্লেষণ করে নীরবতা পালন করা কোন ধার্মিক বা মুক্তমনা ব্যক্তির জন্য জায়েয নয়। সেই সময়ের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির প্রতিবাদ করার সবচেয়ে গুরু দায়িত্ব ও যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.)। হুসাইন (আঃ)-এর অভ্যুত্থান ছিল সকল মুসলমানের কামনা; এই বিদ্রোহ একটি বিস্তৃত প্রতিধ্বনি। উমাইয়া রাজবংশের সিংহাসনকে কাঁপিয়ে শেষ পর্যন্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
২১. শেখ আবদুল্লাহ আলাইলি আরও বলেন:
“প্রত্যেকের জীবনে দুটি দিন আছে: জন্মদিন এবং মৃত্যুর দিন; কিন্তু আপনি হুসাইন! আপনার মাত্র একদিন ছিল। জন্ম এবং জীবন; কেননা আপনি কখনো মৃত্যুবরণ করেননি। আপনি আপনার শুদ্ধ আকিদা, আপনার মহান লক্ষ্য ও পবিত্র আদর্শের উপর আপনার মধুর জীবন দান করেছেন, এই জন্য যতদিন পৃথিবীতে সত্য ও ইসলাম বেঁচে আছে, আপনিও বেঁচে আছেন।
ইমাম হুসাইন (আ.) মুসলমান ও মুক্ত মানুষের আদর্শ
২২. পাকিস্তানের মহান নেতা মোহাম্মদ আাল জিন্নাহ বলেছেন:
“আমার মতে, সকল মুসলমানের উচিত এই শহিদের উদাহরণ অনুসরণ করা, যিনি ইরাকের ভূমিতে আত্মত্যাগ করেছেন।”
২৩. শেখ মুহাম্মাদ আবদুহু, সুন্নি পণ্ডিত এবং একজন মহান সংস্কারক, তিনি লিখেছেন:
“যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বে ন্যায়বিচার অবশিষ্ট থাকে এবং যার লক্ষ্য খোদায়ী আইন প্রতিষ্ঠা করা। এই ন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি অত্যাচারী সরকার মাথাচারা দেয় এবং যা ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্থ করতে চায়, তখন প্রত্যেক মুসলমানের জন্য তাকে সাহায্য করা বাধ্যতামূলক। ইমাম হোসাইনের বিপ্লব হলো সেই ন্যায় বিচার যিনি ইয়াজিদের শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, (যাকে আল্লাহ অভিশাপ দিয়েছেন)।
ইমাম হুসাইন (আ.) এর শানে আহলে সুন্নাতদের শোকগাঁথা কবিতা
২৪. ইমাম শাফিয়ি যিানি আহলে সুন্নাতের চারটি মাযহাবের একজন নেতা; যার আহলে বাইত (আঃ)-এর প্রতি গভীর আগ্রহ ও ভক্তি রয়েছে – আশুরার ঘটনা সম্পর্কে সুন্দর কবিতা লিখেছেন, যার কিছু আমরা অনুবাদ করেছি। যেমন:
“এই ভয়ংকর ঘটনা কেড়ে নিয়েছে আমার ঘুম এবং
আমার চুল শুভ্র হয়েছে।
আমার হৃদয় ও দৃষ্টি আমাকে ব্যকুল করেছে,
আমাকে দুঃখিত করেছে এবং অশ্রু প্রবাহিত হয়েছে
এবং ঘুম চোখ থেকে পালিয়ে গেছে।
মহানবি (সা.) এর পরিবারের এ ঘটনায় বিশ্ব প্রকম্পিত
যার বেদনায় পাহাড় আজ অশ্রুতে প্লাবিত।
কে আছো যে আমার পক্ষ থেকে হোসাইনের কাছে
পৌঁছে দিবে বার্তা; যদিও অন্তর তাতে অসন্তুষ্ট হয়? !
হুসাইনকে বিনা অপরাধে হত্যা করা হয় এবং
তার পোশাক রক্তে রঞ্জিত।
আশ্চর্যজনক আমরা একদিকে নবির পরিবারকে সালাম পাঠাই, অন্যদিকে আমরা তার সন্তানদের হত্যা ও নির্যাতন করি!
আমার পাপ যদি হয় নবি পরিবারের সাথে বন্ধুত্ব,
আমি কখনোই এই পাপের জন্য অনুতপ্ত হব না।
আহলে বাইতগণ কিয়ামতের দিনে আমার সুপারিশকারী
এবং তাদের প্রতি আমার থাকে যদি ক্ষোভ
তাহলে আমি ক্ষমার অযোগ্য গুনাহ করেছি।
তথ্যসূত্র:
১. ওয়াসিলাতুল খাদিম ইলাল মাখদুম, পৃ. ১৬১।
২. মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন ওয়া ইখতিলাফুল মুসলিহিন, পৃ. ৪৫।
৩. মাজাল্লায়ে বাসাইর, ২৮ খণ্ড, “মুকতালুল হুসাইন”, পৃ. ৩০ থেকে উদ্ধৃত।
৪. যিন্দেগিয়ে ইমাম হুসাইন, সাইয়েদ হাশেম রসুলি মহল্লাতি, পৃ. ১৫২।
৫. সারওয়ারে শহিদান ইমাম হুসাইন, পৃ. ৪৪।
৬. ওয়াসিলাতুল খাদিম ইলাল মাখদুম, পৃ. ১৬১।
৭. মুকাদ্দামা ইবনে খালদুন, পৃ. ৪১৫, (গোনাবাদী কর্তৃক অনূদিত)
৮. আলি ও ফারযান্দানশ, মোহাম্মদ আলি শিরাজী কর্তৃক অনূদিত, পৃষ্ঠা ৪৫৬।
৯. বারতারিন হাদাফ দার বারতারিন নিহাদ, অনুবাদ ডক্টর মোহাম্মদ মেহেদি জাফরি, পৃ. ৮৮।
১০. যিয়ারাতে আশুরা, আলি কাজেমি এর অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত,
১১. দারসি কে হুসাইন বে ইনসানহা আমুখত, বই থেকে উদ্ধৃত, শহীদ হাশমি নেজাদ, পৃ. ৪৪৭।
১২. তাফসিরুল মানার, খণ্ড ১, পৃ. ৩৬৭ এবং খণ্ড ২, পৃ. ১৮৩।
১৩. নামে দানিশওয়ারান নাসেরি, খণ্ড, ৯, পৃ. ২৯৮।