আব্বাসী খলিফাগণ ও উচ্চ পদস্থ কর্মচারিগণ অবগত ছিল যে, আহলে বাইতের ইমামগণ সর্বমোট ১২ জন। তাদের মধ্যে দ্বাদশ ইমাম একটা মেয়াদ কাল অন্তর্ধানে থাকার পর আবির্ভূত হবেন। তিনি অত্যাচারী ও জালিম শাসকদের মূলোৎপাটন করবেন এবং তাদের দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বব্যাপী সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। এ বিষয়টি বিশেষ করে ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারীর আমলে খলিফাদের দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ কারণেই ইমাম আসকারী (আ.)-এর উপর কড়া সতর্ক দৃষ্টি রাখতো এবং চাইতো যাতে ইমাম আসকারী (আ.)-এর কোন সন্তান না হয়। সব দিক দিয়েই তাঁর প্রতি কড়া নজর রাখতো এমনকি কয়েকবার তাঁকে বন্দীও করে। অবশেষে আব্বাসীয় খলিফা মো’তামেদ বুঝতে পারে যে বন্দী করেও ইমামের প্রতি ভালবাসা থেকে মানুষকে দূরে সরানো যাবে না। বরং উত্তরোত্তর ইমামের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও উদ্দীপনা বেড়ে চলছে। অধিকন্তু বন্দীদশা ও কারারুদ্ধতা খেলাফতের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে ফলে বন্দী করে রাখতে আর সাহস পেল না। অতঃপর ইমামকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়। অবশেষে ইমামকে গোপনে বিষ প্রয়োগ করে এবং ইমাম ২৬০ হিজরীর ৮ই রবিউল আউয়াল শাহাদাত বরণ করেন (ইমামের উপর এবং তার পবিত্র বংশের উপর শান্তি বর্ষিত হোক)।
সমাজের উপর ইমামের প্রভাব এবং বিশেষ করে আলাভী ও শিয়াদের ভয়ে আব্বাসীয় খলিফা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। কারণ ইমামকে হত্যা করার গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার নিতান্ত সম্ভাবনা ছিল। ফলে সার্বিকভাবে চেয়েছিল এই অপরাধটি ঢেকে রাখতে। ইবনে সাব্বাগ মালেকী তার লেখা বই “ফুসুলুল মুহিম্মাহ্” এ আবদুল্লাহ্ ইবনে খাকান এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন যে, একজন আব্বাসীয় দরবারী কর্মকর্তা লিখেন:
…ইমাম আবু মুহাম্মদ হাসান ইবনে আলী আসকারী (আ.)-এর নিহত হওয়ার সময় আব্বাসীয় খলিফা মো’তামেদের এমন এক অবস্থা হয়েছিল যে আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা মোটেই কল্পনা করিনি যে, তৎকালীন খলিফা এবং মুসলিম জাহানের সমগ্র ক্ষমতা তার হাতে সত্ত্বেও কিরূপে তার এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। যখন আবু মুহাম্মদ ইমাম আসকারী (আ.) বিষাক্রান্ত হয়েছিল তখন খলিফার ৫ জন বিশেষ দরবারী ফকীহ্ ইমামের বাড়িতে দ্রুত প্রেরিত হয়েছিল। খলিফা তাদেরকে আদেশ করেন ইমাম যে কাজ ও কথাই বলুক তৎক্ষণাৎ যেন তা খলিফাকে অবগত করা হয়। কয়েকজন সেবক প্রেরণ করে যাতে ইমামের সার্বক্ষনিক পরিচর্যা করা হয়। কাজী বখতিয়ারকে আদেশ দেন ১০ জন বিশ্বস্ত লোক ঠিক করে তাদেরকে সকাল বিকাল দু’বার ইমামের বাড়িতে পাঠিয়ে তার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। দুই অথরা তিনদিন পরে খলিফাকে খবর দেয়া হলো যে ইমামের অবস্থা আশংকাজনক এবং তার ভাল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। খলিফা ইমামের বাড়িতে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখার আদেশ জারী করে। নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ খলিফার আদেশ মতো ইমামের বাড়িতে কড়া নজর রাখলো এবং কয়েকদিন পরেই ইমাম পরলোক গমন করলেন। যখন ইমামের মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো তখন সমগ্র সামাররার অলি-গলি, রাস্তা-ঘাট জনতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সর্বত্র কান্না ও চিৎকার ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। বাজারে দোকান-পাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বনি হাশেম, প্রশাসনিক কর্মচারী ও কর্মকর্তা, সৈন্য ও কমান্ডার, শহরের বিচারপতি, কবি-সাহিত্যিক সহ আপামর জনসাধারণ শোক জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল। সামাররা যেন সেদিন কিয়ামতের মাঠে পরিণত হয়েছিল। যখন লাশ দাফনের সময় হলো তখন খলিফা তার ভাই ঈসা ইবনে মোতাওয়াক্কেলকে জানাজার নামাজ পড়ানোর জন্য পাঠান। যখন জানাজার নামাজ পড়ার জন্য লাশ রাখা হলো ঈসা কাছে গিয়ে ইমামের মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে নিলেন। উপস্থিত জনতা, আব্বাসীয়, আলাভী (আলী বংশীয়), বিচারক, লেখক ও অন্যান্যদেরকে সাক্ষী রেখে বলেন : ইমাম আবু মুহাম্মদ আসকারী এর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। খলিফার অমুক অমুক সহকারী সাক্ষী আছেন।
অতঃপর লাশটি আবৃত করে জানাজার নামাজ পড়ান। তারপর লাশ দাফনের আদেশ দেন। ইমাম আবু মুহাম্মদ হাসান আসকারী (আ.) ২৬০ হিজরীর ৮ ই রবিউল আউয়াল, শুক্রবার মৃত্যু বরণ করেন। ইমামের নিজস্ব ঘর যেখানে পিতা ইমাম হাদী (আ.)-কে দাফন করা হয়েছিল সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। (ফুসুসুল মুহিম্মাহ, নাজাফ থেকে প্রকাশিত, পৃ. ২৯৮)
উপরের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে ইমাম কেমন পরিবেশে বাস করতেন এবং ইমামকে হত্যার গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার আশংকায় খলিফা আতঙ্কিত ছিল। তার ইচ্ছা এমনও ছিল যে ইমামকে হত্যা করে তা স্বাভাবিক মৃত্যু বলে প্রচার করবে। সত্যিই খলিফাগণ ভালভাবেই বুঝতো যে পবিত্র ইমামদের অস্তিত্ব তাদের ক্ষমতার জন্য বিপদ জনক এবং তাই ইমামদের উপর কড়া নজর রাখতো এবং যত সম্ভব সমাজ ও জনগণ থেকে ইমামকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করতো। পরিশেষে হত্যার পথ বেছে নিয়ে ইমামকে হত্যা করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতো। যদিও বাস্তবে অবস্থা হতো তার প্রতিকূল।
আব্বাসীয় খলিফা মো’তামেদ ইমাম আসকারী (আ.)-কে হত্যা করার পর ইমামের সম্পত্তি ও অর্থ সমূহ ইমামের মা ও ভাই জা’ফরের মাঝে বন্টন করে জনসাধারণকে বুঝাতে চেয়েছিল যে ইমামের কোন সন্তান নেই এবং শিয়াদের আর কোন ইমামই অবশিষ্ট রইলো না। ফলে জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। অন্য দিকে গোপনে লোক নিয়োগ করেছিল সন্ধান চালিয়ে ইমামের পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত সন্তানকে খুঁজে বের করে গ্রেফতার করতে। খলিফার প্রতিনিধিগণ ইমামের পরিবারবর্গের উপর যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করা সত্ত্বেও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর কোন সন্ধান নিতে পারে নি। আল্লাহ্ তা’য়ালা তাঁকে জালিম শাসকদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। যদিও ইমাম মাহ্দী (আ.) জালিম শাসকদের হাত থেকে নিরাপত্তার অভাবে প্রকাশ্যে জনসাধারণ ও সমাজের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আল্লাহর আদেশে লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে যান কিন্তু ইমাম আসকারী (আ.)-এর বিশেষ সাহাবিগণ ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে একাধিকবার দেখেছেন। ইমামের অস্তিত্বের ব্যাপারে তারা নিশ্চিত ছিলেন। এ ব্যাপারে তাদের কোন রকম সন্দেহের অবকাশ ছিলনা। ইমাম আসকারী (আ.)-এর শাহাদাতের পর যখন বাড়ির আঙ্গিনায় জানাজার নামাজ পড়ানোর জন্য জা’ফর ইমামতির লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিয়েছিল তখন ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হন এবং জা’ফরকে সরিয়ে নিজেই পিতার জানাজার নামাজ পড়ান।৬৮ ইমাম মাহ্দী (আ.) এর স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের যুগে ইমামের মনোনীত নির্দিষ্ট প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শিয়াগণ তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখতেন। ইমাম মাহ্দী (আ.) তাঁর প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই জনগণের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। ইমাম মাহ্দী (আ.) তাঁর বিশেষ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বেশ কিছু অলৌকিক বিষয় প্রকাশ করে ছিলেন যার ফলে ইমামের অনুসারী ও বিশ্বাসীদের সংখ্যা বেড়েই চলছিল।