আয়াতুলাহ সাদরঃ আমিরুল মুমিনিন আলী (আঃ) হচ্ছেন আল্লাহর একজন বান্দা। যাকে আলাহ তা’য়ালা অন্য সকলের মধ্য থেকে নির্বাচন করেছেন। সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। যাতে করে তিনি নবুওয়াতের পরে ইমামতের গুরু দায়িত্বকে নিজের ঘাড়ে তুলে নিতে পারেন। আর তিনি হচ্ছেন নবীর (সাঃ) ওয়াসি ও স্থলাভিষিক্ত। যেহেতু সকল নবীরই একজন প্রতিনিধি ছিলেন, তেমনই আলী (আঃ) হচ্ছে হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) প্রতিনিধি। আর আমরা তাকে অন্যান্য সকল সাহাবীর থেকে উচ্চে স্থান দিয়ে থাকি। কেননা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) তাকে মর্যাদা দিয়েছেন। এই বিষয়টি কোরআন ও হাদীসের আলোকে বিভিন্ন আক্বলী (বিবেক সম্মত) ও নাকলী (বর্ণনাকৃত) দলিল আমাদের হাতে রয়েছে। আর এই দলিলসমূহে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। কেননা তা আমাদের পক্ষ থেকেই শুধু মুতাওয়াতির নয় বরং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের কাছেও তা মুতাওয়াতির বলে বিবেচিত। [অর্থাৎ এত অধিক পরিমানে তার বয়ান হয়েছে যে, তা যে নবীর (সাঃ) কাছ থেকে এসেছে এ ব্যাপারে বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পারবে।]
এই বিষয়ের উপর আমাদের আলেমগণ প্রচুর পরিমানে বই লিখেছেন। আর যেহেতু খিলাফতে বনি উমাইয়্যা এই নিগুড় ও অটুট সত্যকে ধ্বংশ করার লক্ষ্যে আলী (আঃ) ও তাঁর সন্তানদের সাথে যুদ্ধ করেছিল, তাদেরকে হত্যা করেছিল; মিম্বারের উপরে তার ব্যাপারে লানত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল এবং মুসলমানদেরকে তা বলার জন্য তাদের উপর উপর্যপরী চাপ সৃষ্টি করেছিল তাই শিয়ারা ও তাঁর অনুসারীগণ আযানে সাক্ষ্য দিয়ে থাকে যে, তিনি হচ্ছেন আল্লাহর অলি। আর এটা উচিৎ নয় যে, মুসলমান আল্লাহর অলির উপর লানত প্রদান করবে। এটা ছিল অত্যাচারী বনি উমাইয়াদের বিরুদ্ধে শিয়াদের এক ধরনের যুদ্ধ। যাতে করে আল্লাহ ও তার রাসূল (সাঃ) এবং মুমিনগণের ইজ্জত সম্মানকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আর তা যেন একটি ঐতিহাসিক বিষয় হয়ে থাকে এবং এ থেকে আগামী প্রজন্ম আলীর (আঃ) প্রকৃত অধিকারের ব্যাপারে ও তার শত্রুদের গোমরাহীর পথ সম্পর্কে অবগত হতে পারে।
আর এই কারণেই আমাদের ফকীহগণ (যারা ফীকাহ শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী) এই প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়ে আলীর (আঃ) বিলায়তকে আযান ও ইকামতে সংযােজন করেছিলেন। যদিও তা আযান ও ইকামতে বলাটা হচ্ছে মুসতাহাব বা আযান ও ইকামতের কোন অংশ নয়। সুতরাং যখনই কেউ আযান বা ইকামত দেয় তখন সে যদি এই মর্মে নিয়ত করে সাক্ষ্য দেয় যে, এটা আযান বা ইকামতের একটি অংশ তবে তার আযান ও ইকামত বাতিল বলে গন্য হবে। [ইকতিবাস, অবশেষে সত্য পথের সন্ধান পেলাম বইয়ের মূল আরাবী থেকে, পৃঃ-৮৮, ৮৯।]
ডঃ তিজানী সামাভী বলেনঃ যখন আমি সুন্নী ছিলাম এবং সবে মাত্র ইরাকের নাজাফে আশরাফে পা রেখেছিলাম তখন আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে হযরত আয়াতুল্লাহ আল উযমা সাইয়্যেদ আবুল কাসেম খুইর (রহঃ) সাক্ষাতে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধুটি তার কানে কানে কি যেন বলল, তারপর আমাকে আয়াতুল্লাহর পাশে বসতে ইঙ্গিত করলো। আমার বন্ধুটি অনেক পীড়াপীড়ি করলো যে, আমি যেন শিয়াদের সম্পর্কে তিউনিসিয়ার জনগণের অভিমতকে আয়াতুল্লাহর কাছে বয়ান করি।
বললামঃ আমাদের জনগণের কাছে শিয়া হচ্ছে ইয়াহুদী ও নাসারাদের থেকেও অনেক খারাপ একটি মাযহাব। কেননা ইয়াহদী ও নাসারা আল্লাহর উপাসনা করে এবং মুসা ও ঈসার (আঃ) উপর বিশ্বাসী। কিন্তু আমরা শিয়া সম্পর্কে যা জানি তা হচ্ছে তারা আলীকে (আঃ) উপাসনা ও তার ইবাদত করে থাকে। সাথে সাথে তাকে পুজাও করে থাকে। আর শিয়াদের মধ্যে এমন অনেক দল আছে যারা আল্লাহর উপাসনা করে ঠিকই কিন্তু আলীর (আঃ) মর্যাদাকে নবীর (সাঃ) উপরে মনে করে থাকে। তারা বলে যে, জিব্রাঈল (আঃ) পবিত্র কোরআনকে আলীর (আঃ) নিকট নিয়ে আসবে এটা নির্দিষ্ট ছিল কিন্তু সে তা না করে পবিত্র কোরআনকে নবীর (সাঃ) কাছে নিয়ে গেছে। তারা আরো বলে থাকে যে, জিব্রাঈল আমিন খিয়ানত করেছে।
আয়াতুল্লাহ খুই, কিছু সময় মাথা নিচের দিকে রেখেই বললেনঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন মাবুদ নেই এবং তিনি এক ও অদ্বিতীয়। মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর রাসূল (শান্তি বর্ষিত হোক তার নিজের এবং তাঁর পরিবারবর্গের উপর)। আর আলী (আঃ) হচ্ছেন আল্লাহ তা’য়ালার অন্যান্য বান্দাদের মত একজন বান্দা। তারপর তিনি উপস্থিতদের দিকে ফিরে আমাকে ইশারা করে বললেনঃ এই অসহায়দের দিকে লক্ষ্য কর, দেখ তারা কিভাবে মিথ্যা অপবাদের সম্মুখে ধোঁকা খেয়ে থাকে। এটা আশ্চর্যের কিছু নয়, কেননা
এর থেকেও আরো বেশী কিছু অন্যের কাছ থেকে শুনেছি।
لا حول و لا قوة الا بالله العلي العظيم
তারপর তিনি আমার দিকে ফিরে বললেনঃ তুমি কি কোরআন পড়েছে? বললামঃ তখনও আমার দশ বছর বয়স পূর্ণ হয় নি অর্ধেক কোরআন মুখস্ত ছিলাম।
তিনি বললেনঃ তুমি কি জান যে, ইসলামী সব দলগুলো তাদের মাযহাবী কোন্দল ব্যতীরেকে কোরআন যে সত্য সে ব্যাপারে একমত পোষণ করে। আর যে কোরআন আমাদের কাছে আছে সেই কোরআন তোমাদের কাছেও আছে।
বললামঃ হ্যাঁ, এটা জানি।
তিনি বললেনঃ এই আয়তটি কি পড়েছে?
وما محمد الا رسول قد خلت من قبله الرسل
– আর মুহাম্মদ (সাঃ) রাসূল ব্যতীত অন্য কিছুই নয় যেমন তার আগে আরাে অনেক নবী এসেছিলেন। [আলে ইমরানঃ ৪৪]
অনুরূপ এই আয়াতটিঃ
محمد رسول الله و الذين معه اشداء على الكفار ………
– মুহাম্মদ (সাঃ) হচ্ছেন আল্লাহর রাসূল এবং যারা তার সাথে আছেন তারা কাফিরদের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠিন ও দৃঢ়। [ফাতহঃ ২৯]
অনুরূপ এই আয়াতটিঃ
ما كان محمد ابا احد من رجالکم و لکن رسول الله و خاتم النبيين
– মুহাম্মদ (সাঃ) তোমাদের কারো পিতা ছিলেন না, কিন্তু তিনি আল্লাহর রাসূল ও সমস্ত নবীর শেষ নবী ছিলেন। [আহযাবঃ ৪০]
এই আয়াতগুলো পড়েছে কি?
বললামঃ জ্বি হ্যাঁ, এ আয়াতসমূহ পড়েছি।
তিনি বললেনঃ এই আয়াতসমূহের মধ্যে আলী (আঃ) কোথায়? দেখছ এখানে শুধু নবীর (সাঃ) রিসালতের ব্যাপারে বলা হয়েছে, আলীর (আঃ) ব্যাপারে নয়। আর আমরা ও তোমরা দুই দলই কোরআনকে গ্রহণ করি। সুতরাং কিভাবে আমাদের উপর অপবাদ দিতে পার যে, আমরা আলীকে (আঃ) নবীর (সাঃ) উপরে স্থান দিয়ে থাকি?
আমি নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। আমার কাছে কোন জবাবই ছিল না।
তিনি আরো বললেনঃ জিব্রাঈলের (আঃ) খিয়ানতের ব্যাপারে যে অপবাদ আমাদেরকে দিচ্ছ তা প্রথম অপবাদের থেকে বেশী লজ্জাজনক। কেননা জিব্রাঈল (আঃ) যখন নবীর (সাঃ) কাছে এসেছিলেন তখন আলীর (আঃ) বয়স কি ১০ বছরের কম ছিল না? তাহলে কিভাবে তিনি ভুল করলেন? তিনি কি মুহাম্মদ (সাঃ) ও আলীর (সাঃ) মধ্যে কোন পার্থক্য দেখতে পান নি?
আমি পুনরায় চুপ হয়ে গেলাম। কেননা এ বারও আমার কাছে কোন জবাব ছিল না। কারণ তার কথা ছিল সত্য ও যুক্তিসংগত।
তিনি আরো বললেনঃ এখন তা মাকে বলছি যে, ইসলামের অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র শিয়া মাযহাবই আছে যারা নবীগণ ও ইমামগণের (আঃ) ব্যাপারে বিশেষ ইজ্জত সম্মান দিয়ে থাকে। অবশ্যই জিব্রাঈল (আঃ) হচ্ছেন রুহুল আমিন এবং সমস্ত ধরনের ভুল থেকে তিনি নিস্পাপ।
বললামঃ তাহলে এই গুজবসমূহ কি?
তিনি বললেনঃ এগুলো হচ্ছে মিথ্যা অপবাদ। মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে এই মিথ্যা রটনা করেছে। তুমি আল্লাহর রহমতে বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি সে কারণে ভাল-মন্দকে দ্রুত বুঝতে পার। এখন এই বিষয়গুলোকে বিশেষভাবে গবেষণা করে দেখ, আমাদের মধ্যে এসব কিছু আছে কিনা?
আমি নাজাফে আশরাফে বেশ কিছু দিন ছিলাম এবং সেখানকার দ্বীনি শিক্ষালয়গুলো পরিদর্শণ করেছিলাম। কিন্তু ঐ অপবাদ ও গুজব যা শিয়াদের সম্পর্কে দেয়া হয়ে থাকে তার কিছুই সেখানে দেখতে পাই নি।
[অবশেষে সত্য পথের সন্ধান পেলাম আরবী বইয়ের সংকলন, পৃঃ-৭৬,৭৮।]