সংকলন: আবাবিল গ্রুপ
ভূমিকা
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর উম্মতের জন্য তাঁর রেখে যাওয়া বারোজন ইমামের মধ্যে ইমাম আবু মুহাম্মদ হাসান বিন আলী আসকারী (আ.) হলেন একাদশ ইমাম। তাঁর পিতা হচ্ছেন দশম ইমাম হযরত হাদী (আ.) ও মাতা মহীয়সী নারী হুদাইসা, যিনি সুসান নামেও পরিচিত ছিলেন। যেহেতু ইমাম সামররা শহরের আসকার১ অঞ্চলে বসবাস করতেন সে কারণেই তিনি আসকারী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি যাকী ও নাকী উপাধিতে ভূষিত হন এবং আবু মুহাম্মদ হচ্ছে তাঁর উপনাম।
ইমামের ২২ বছর বয়সে তাঁর পিতা হযরত হাদী (আ.) শাহাদাত বরণ করেন। তিনি ৬ বছর ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন ও ২৮ বছর বয়সে ২৬০ হিজরী সনে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর একমাত্র সন্তান “ হযরত হুজ্জাত ইবনুল হাসান আল মাহ্দী ” দ্বাদশ ইমামের পদে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। মেঘের অন্তরালে লুকায়িত সূর্য্যরে ন্যায় আমাদের যুগের নেতা ও কর্তৃত্বশালী, ইমাম মাহ্দী (আ.) আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতি ক্রমে আবির্ভূত হয়ে পৃথিবীকে করবেন ন্যায় বিচারে পরিপূর্ণ।
যারা ইমাম আসকারী (আ.)-এর সাক্ষাৎ পেয়েছেন তারা তাঁর ব্যাপারে বলেছেন যে, তিনি উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের, সুনয়ন ও আকর্ষণীয় চেহারা বিশিষ্ট ও তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ভাবমূর্তি অন্যকে প্রভাবিত ও আচ্ছন্ন করে ফেলতো। চারিত্রকভাবেও তিনি সকল মহৎ গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন।
আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কেল, মুনতাসের, মোস্তা’ইন, মো’তায, মোহতাদি ও মো’তামেদ এর শাসনামলে ইমাম তাঁর জীবন অতিবাহিত করেন এবং খলিফা মো’তামেদের শাসনামলে শাহাদাত বরণ করেন।২
মহান ইমামের ইমামত
বারো ইমামের প্রত্যেকের নাম ও পরিচয় রাসূল (সা.)-এর বর্ণিত হাদিস থেকে স্পষ্টভাবে পাওয়া গেলেও প্রত্যেক ইমাম তাঁদের পরবর্তী ইমামকে নিজস্ব বন্ধুমহল ও অনুসারীদের নিকট পরিচয় করাতেন। ইমাম আসকারী (আ.)-এর ব্যাপারেও তদ্রুপ বহু রেওয়ায়েত বর্ণিত আছে যার কয়েকটি এখানে উল্লিখিত হলো :
১. “আবু হাশেম জা’ফরী” (শিয়াদের নির্ভরযোগ্য ও প্রসিদ্ধ হাদিস বর্ণনাকারীদের একজন এবং কয়েকজন ইমামের বিশেষ সহযোগী) বলেন : একদিন ইমাম হাদী (আ.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করতে গেলে তিনি বললেন : আমার পুত্র হাসান আমার উত্তরাধিকারী, আমার উত্তরাধিকারীর উত্তরাধিকারীর সাথে তোমরা কেমন আচরণ করবে?
বললাম : কেন, আল্লাহ্ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুক।
বললেন : যেহেতু তাঁকে দেখবে না, তাই তার নাম ( م ح م د )উচ্চারণ করা সমীচীন নয়।৩ জিজ্ঞেস করলাম : তাহলে কিভাবে তাঁকে স্মরণ করব ?
বললেন : বল ( اَلْحُجَّةُ مِنْ آلِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَ آلِهِ )৪
২.“সাকীর ইবনে আবি দালাফ” বলেন : ইমাম হাদী (আ.)-এর কাছ থেকে শুনেছি যে, আমার পরবর্তী ইমাম আমার পুত্র হাসান এবং তারপর তার পুত্র মাহ্দী। আর সে অন্যায় অত্যাচারে ভরপুর পৃথিবীকে ন্যায় বিচারে পরিপূর্ণ করবেন।৫
৩.নওফেলী বলেন : ইমাম হাদী (আ.)-এর সাথে তাঁর বাড়ীর আঙ্গিনায় বসেছিলাম। এমন সময় তাঁর ছেলে মুহাম্মদ আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, আমি ইমামকে বললাম : আপনার জন্য আমি উৎসর্গীত, আপনার পরবর্তী ইমাম কি ইনিই ?
না, আমার পর তোমাদের ইমাম হবে আমার জ্যেষ্ঠ ছেলে হাসান।৬
৪.“ইয়াহিয়া ইবনে ইয়াসার” বলেন : ইমাম হাদী (আ.)-এর মৃত্যুর চার মাস পূর্বে তিনি আমাকে ও তাঁর কিছু সংখ্যক অনুসারী এবং বন্ধু মহলকে হাসান আসকারী (আ.)-এর ইমামত ও খেলাফতের ব্যাপারে আমাদেরকে সাক্ষী রেখে ওসিয়ত করেছেন।৭
“আবুবকর ফাহ্ফাকী” বলেন : ইমাম আবুল হাসান আল হাদী (আ.) আমাকে লিখেছিলেন : “আমার সন্তান আবু মুহাম্মদ (ইমাম আসকারী) রাসূল (সা.)-এর অভিজাত বংশের শ্রেষ্ঠতর সন্তান ও আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং আমার পরবর্তীতে আমার স্থলাভিষিক্ত। অতএব, আমার কাছে তোমাদের যা কিছু জানার ছিল তা তার কাছে জানতে চাইবে এবং তোমার যা কিছু প্রয়োজন সবই তার নিকট বিদ্যমান।৮
সমকালীন খলিফাদের সাথে ইমাম
ইমামের ৬ বছরের স্বল্পকালীন ইমামতকালটি তিনজন আব্বাসীয় খলিফার (মো’তায, মোহ্তাদী ও মো’তামেদ) শাসনামলে অতিবাহিত হয়।
আব্বাসীয় খলিফা মো’তায তার পূর্ব খলিফা তারই চাচাতো ভাই মোস্তাইন এর পর খেলাফতে অধিষ্ঠিত হয়। আর ইমাম হাদী (আ.) এই খলিফার শাসনামলেই শহীদ হন। বেশ কিছু সংখ্যক আলাভী বংশের লোকদেরকেও তারই শাসনামলে বিষ প্রয়োগে ও অন্যভাবে শহীদ করা হয়। খলিফা মো’তায একবার তার ভাই মুয়াইয়েদকে বন্দী করে এবং চল্লিশটি বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দেয়। ফলে মুয়াইয়েদ স্বেচ্ছায় যুবরাজের পদ থেকে ইস্তফা দান করে মুক্তি লাভ করে । কিন্তু পরে যখন জানতে পারলো যে তুর্কীদের কিছু অংশ মুয়াইয়েদের যুবরাজ পদের প্রতি বিশ্বস্ত। তখন তাকে হত্যার আদেশ দেয়। অতঃপর মুয়াইয়েদকে বিষ মাখানো কম্বল দিয়ে পেচিয়ে কাফনের কাপড়ের ন্যায় উভয় প্রান্ত বেঁধে রাখে । এভাবে তার মৃত্যু হলে দরবারী কিছু ফকীহ্ ও বিচারকদেরকে আমন্ত্রণ করে উক্ত মৃতদেহ পর্যবেক্ষণ করায় তাদের থেকে স্বীকারোক্তি নেয় যে, কোন প্রকার নির্যাতন ব্যতীতই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।৯
মো’তাযের পর মোহ্তাদী খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হয়। সে মুনাফেকের মত ছদ্দবেশ ধারণ করে গোপনে অত্যাচার ও জুলুম করে কিন্তু প্রকাশ্যে সাধু মানুষের বেশে ইবাদত-বন্দেগীতে মগ্ন থেকে তার দরবার থেকে নর্তকীদের বিতাড়ন করে, পাপাচার নিষিদ্ধ করে, ন্যায়বিচারের ঘোষণা দেয় । অপরদিকে ইমাম আসকারী (আ.)-কে বন্দী করে। এমনকি ইমামকে হত্যার সিদ্ধান্তও নেয় কিন্তু মৃত্যু তাকে ফুরসত দিলো না। নিজেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। মোহ্তাদীর শাসনামলে বেশ কিছু আলাভী তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করেন। তারা এই অভ্যুত্থানে সফল হয় নি। তাদের কেউ কেউ বন্দী হয় এবং বন্দী দশাতেই মৃত্যু বরণ করে।
আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ বলেন : মোহ্তাদী যখন মাওয়ালীদের (অনারব মুসলমান) হত্যা করতে লাগলো, ইমাম আসকারী (আ.)-কে লিখলাম : “মহান আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি যিনি মোহ্তাদীর হাত থেকে আমাদের এখন পর্যন্ত রক্ষা করেছেন, আমার কাছে এই মর্মে খবর পৌঁছেছে যে, সে (মোহ্তাদী) আপনাকে হত্যার হুমকি প্রদান করে বলেছে -আল্লাহর কসম, আমি মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশধরকে দুনিয়ার মাটি থেকে সমূলে উৎপাটন করব।”
ইমাম সেই চিঠির জবাবে নিজ হাতে লিখেন : “কত সীমিত আয়ূ তার! মাত্র পাঁচ দিন পর অপমান ও লাঞ্ছনাসহ মৃত্যু বরণ করবে।”
ঠিক তাই ঘটলো যেমনটি ইমাম বলেছিলেন।১০ এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভাল যে মোহ্তাদীও তুর্কী সৈন্যদের অভ্যুত্থানে নিহত হয়। মো’তামেদ তার স্থলাভিষিক্ত হয়।১১
মো’তামেদও তার পূর্ব পরুষদের ন্যায় ভোগবিলাসিতা ও জুলুম-নির্যাতন ব্যতীত কিছুই বুঝতো না। ভোগবিলাসিতায় এতই মগ্ন থাকতো যে, এই সুযোগে তার ভাই “মুয়াফ্ফাক” ধীরে ধীরে তার স্থলাভিষিক্তের পদ দখল করে দেশ শাসনের সার্বিক কাজ পরিচালনা করতে থাকে । মো’তামেদ পুতুলের ন্যায় নাম মাত্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে । মুয়াফ্ফাকের মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র মো’তাযেদ তার পিতার পদে অধিষ্ঠিত হয় । অবশেষে ২৭৯ হিজরীতে মো’তামেদের মৃত্যু হলে মো’তাযেদ নিয়মতান্ত্রিক ভাবে খেলাফতে অধিষ্ঠিত হয়।১২
মো’তামেদের শাসনামলেই ইমাম হাসান আসকারী (আ.) শহীদ হন। বেশ কিছু সংখ্যক আলাভীও তার হাতেই নিহত হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে নিকৃষ্টতম পন্থায় হত্যা করে। এমনকি হত্যার পর তাদের মৃতদেহ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে।১৩ কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, মো’তামেদের শাসনামলে যথেষ্ট যুদ্ধ বিগ্রহ হয় যাতে প্রায় ৫ লক্ষ লোক নিহত হয়।১৪
যা হোক, জনগণের দৃষ্টি সর্বদাই ইমামদের দিকে ছিল। তারা এও বুঝতে পারতো যে, জালিম খলিফাদের সাথে ইমামদের আপোষহীনতার ফলেই ইমামগণ তাদের রোষানল ও কঠোর নির্যাতনের শিকার হতেন । ইমাম আসকারী (আ.)ও তার পূর্ব পুরুষদের ন্যায় শাসকদের নির্যাতন ও নিয়ন্ত্রণের শিকার হন। ইমাম এশবার মোহ্তাদীর শাসনামলে (সালেহ্ ইবনে ওয়াসিফের কারাগারে) বন্দী হয়েছিলেন। খলিফা ইমামকে নির্যাতন করার জন্য দু’জন দুষ্কৃতকারী ব্যক্তিকে নিয়োজিত করে। কিন্তু ঐ দু’জন লোক ইমামের ইবাদতে আকৃষ্ট হয়ে নির্যাতন করা থেকে বিরত থাকে।
খলিফা আরও একবার ইমামকে নাহরীরের (মোহ্তাদীর জনৈক কর্মচারী) কারাগারে বন্দী করে । কারাগারের প্রহরী ইমামের প্রতি রূঢ় আচরণ করে। নাহরীরের স্ত্রী প্রহরীকে বললেন, “আল্লাহকে ভয় কর, তুমি জানো না, কতবড় মহান ব্যক্তি তোমার কারাগারে অবস্থান করছেন।” অতঃপর ইমামের ইবাদত ও গুণাবলীর কথা বর্ণনা করে বললেন, “আমার ভয় হয় ইমামের প্রতি তুমি যে অত্যাচার করছো তোমাকেই তার ফল ভোগ করতে হবে।”১৫
মো’তামেদ নিজেও তার শাসনামলে ইমাম আসকারী (আ.) ও তার ভ্রাতা জাফর (জাফর কাজ্জাব)-কে আলী জারীনের কারাগারে বন্দী করে নিয়মিত ইমামের অবস্থার খবরা খবর রাখতো। সংবাদদাতাগণ তাকে জানাতো যে, ইমাম সারাদিন রোজা রাখে ও সারারাত নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকেন।
কয়েকদিন পর আবার যখন ইমামের সম্পর্কে জানতে চাইলো আলী জারীন তার কাছে পূর্বে দেয়া সংবাদেরই পুনারাবৃত্তি করেন। খলিফা একথা শুনে আলী জারীনকে আদেশ করলো : এখনই ইমামের কাছে গিয়ে আমার সালাম জানিয়ে তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে তার বাড়ীতে পৌঁছে দাও।
আলী জারীন বলল : কারাগারে গিয়ে দেখলাম … ইমাম পোশাক পরে রওয়ানা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন । তিনি আমাকে দেখা মাত্রই উঠে দাঁড়ালেন। তাকে খলিফার দেয়া নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত করলাম । ইমাম বাহনে আরোহণ করলেন কিন্তু রওয়ানা হলেন না; এর কারন জিজ্ঞেস করলাম।
বললেন : যতক্ষণ জাফর না আসবে, আমি যাব না।
বললাম : খলিফা শুধুমাত্র আপনাকেই মুক্ত করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। জাফরের ব্যাপারে কোন কথা বলেন নি।
বললেন : তোমার খলিফার কাছে গিয়ে বল, “আমরা দু’জন একই পরিবার থেকে এসেছি, যদি তাকে না নিয়ে একা ফিরে যাই তাহলে এ রহস্য তার কাছে লুকিয়ে থাকবে না।
আলী জারীন খলিফার কাছে গেল এবং ফিরে এসে বলল : খলিফা জাফরকে আপনার সম্মানে মুক্তি দিয়েছেন। তিনি জাফরকে তার ও আপনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং খেয়ানতের কারণেই বন্দী করেছিলেন।
অতঃপর জাফর মুক্তি পেল এবং ইমামের সাথেই বাড়ী ফিরলো।১৬
এতক্ষণ খলিফাদের শাসনামলের অবস্থা ও ইমামের সাথে খলিফাদের আচরণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হলো। তাতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ইমাম আসকারী (আ.) এক শাসরুদ্ধকর ও কঠিন পরিবেশে জীবন-যাপন করতেন। খলিফাগণ ইমামের প্রতি সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতো, তাকে একাধিকবার বন্দীও করেছে। ইতিহাস এভাবে সাক্ষী দেয় : যখন ইমাম বন্দী দশা থেকে মুক্ত থাকতেন তখনও ইমামের গতিবিধি তাদের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। ইমামের অনুসারী, সমর্থক ও বন্ধুমহল সহজভাবে তার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারতেন না। কিছু শিয়াগণ আলাভীদের সহযোগিতায় ইমামের বাড়ীর সন্ধান নিতেন। “কাশফুল গুম্মাহ্” নামক গ্রন্থে পাওয়া যায় :
এক আলাভী জীবন ধারণের উদ্দেশ্যে সামাররা থেকে জাবাল (পশ্চিম ইরানের পাহাড়ী এলাকা থেকে হামাদান ও কাযভীন পর্যন্ত অঞ্চল) শহরে চলে যায়। হালওয়ান গোত্রের এক লোক তার সাক্ষাত লাভ করে জিজ্ঞেস করলো :
কোথা থেকে এসেছো?
বলল : সামররা।
জিজ্ঞেস করলো : অমুক এলাকার অমুক গলি কোথায় বলতে পারো ?
বলল : হ্যাঁ।
জিজ্ঞেস করলো : হাসান ইবনে আলী (আ.)-এর সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে?
বলল : না।
জিজ্ঞেস করলো : কি কারণে জাবালে এসেছো ?
বলল : জীবন ধারণের জন্য।
হালওয়ানী বলল : আমার কাছে ৫০ দিনার আছে তা তোমাকে দিচ্ছি, তার বিনিময়ে আমাকে সামররায় হাসান আসকারী (আ.)-এর বাড়ীতে পৌঁছে দাও।
আলাভী বংশের লোকটি প্রস্তাবটি মেনে নিয়ে তাকে ইমামের বাড়ীতে পৌঁছে দিলো।১৭
এ ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বন্দী দশার বাইরে ইমামের জীবন-যাপন কেমন ছিল এবং এই মহান ব্যক্তি কতটা সীমাবদ্ধতা ও সতর্ক দৃষ্টির মধ্যে অবস্থান করতেন। যে অবস্থায় ইমামের সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখা মোটেই সহজ ছিল না। অনেক চেষ্টা তদবীর করে ইমামের সাক্ষাত লাভ সম্ভব হতো। এমনকি আলাভীগণ এবং তাঁর নিকট আত্মীয়-স্বজনও তাঁর সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ রাখতে পারতেন না।
ইমামের ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক গুণাবলী
ইমামের চারিত্রিক গুণাবলী ও আধ্যাত্মিক সাধনার ফলে বন্ধুমহল এমনকি শত্রুরাও তাঁর মহত্ত্বও শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিয়েছেন। হাসান ইবনে মুহাম্মদ আ’শআরী ও মুহাম্মদ ইয়াহিয়া এবং আরও অনেকে বর্ণনা করেছেন যে, আহমাদ ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে খাকান আব্বাসীয় খলিফার কোম অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল। একদা তার এক আলোচনা সভায় শিয়াদের আকিদা বিশ্বাস সম্পর্কিত কথা উঠলে সে (কট্টর নাসেবী)১৮ বললো : “সামেরায় আমি আলাভীদের মধ্যে হাসান ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী রেযা (ইমাম আসকারী)-এর মত ভদ্র, অমায়িক, মহৎ ও মহান ব্যক্তিত্ব তার পরিবার ও হাশেমী বংশের মধ্যে অন্য কাউকে দেখি নি। তিনি যেমন তার পরিবারের মধ্যে সম্মানিত ছিলেন তেমনই জনসাধারণের মধ্যেও। আমার মনে আছে একদিন আমার পিতার১৯ সান্নিধ্যে ছিলাম এমন সময় রক্ষিগণ খবর দিল আবু মুহাম্মদ ইবনে রেযা (ইমাম আসকারী) এসেছেন, বাবা বললেন, ঠিক আছে তাকে আসতে দাও। রক্ষীদের এমন সম্বোধন শুনে আমি বিস্মিত হলাম। কারণ ইতোপূর্বে খলিফা অথবা তার উত্তরাধিকারী অথবা তার প্রেরিত বিশিষ্ট ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো উপনামে ২০ বাবার সামনে সম্বোধন করতো না। তখন উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের উচা-লম্বা, সুন্দর চেহারার বলিষ্ঠ ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন এক যুবক প্রবেশ করলো। বাবার দৃষ্টি তার দিকে পড়া মাত্রই উঠে দাঁড়ালেন এবং এগিয়ে গিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। বাবা আগে কখনও কাউকে এভাবে সম্বোধন করেন নি। তার সাথে কোলাকুলি করলেন, তার মুখে ও বুকে চুমু খেলেন এবং তার হাত ধরে নিজের নামাজ পড়ার স্থানে বসালেন। নিজে ইমামের সামনা-সামনি বসে কথা বলতে লাগলেন। কথোপকথনের মাঝে প্রায়ই বলতে শুনলাম “আমি আপনার জন্য উৎসর্গীত”। সেখানে যা কিছুই দেখলাম বিস্মিত হলাম।
হঠাৎ দাররক্ষী এসে বললো খলিফা এসেছেন। প্রথা অনুযায়ী খলিফা আসলে তার সম্মুখে দেহরক্ষী, কমান্ডার ও সৈন্যবহর সজ্জিত থাকত এবং বাবার আলোচনার স্থল থেকে প্রবেশদ্বার পর্যন্ত দু’সারিতে সৈন্যবাহিনী অপেক্ষা করতে থাকতো যতক্ষণ পর্যন্ত খলিফা ফিরে না যেত। বাবা নির্দ্বিধায় ইমামের সাথে কথা বলতে লাগলেন। যখন খলিফার বিশেষ গোলাম তার সামনে এসে উপস্থিত হলো তখন বাবা বললেন, আমি আপনার জন্য উৎসর্গীত। যদি চান চলে যেতে পারেন। অন্যদিকে নিজের দ্বাররক্ষীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ইমামকে সারিবদ্ধ সৈন্যদের পিছন দিক দিয়ে নিয়ে যেতে যাতে খলিফা ইমামকে দেখতে না পায়। ইমাম উঠে দাঁড়ালে বাবাও উঠে দাঁড়ান, ইমামের সাথে কোলাকুলি করেন। অতঃপর ইমাম চলে গেলেন। বাবার দ্বাররক্ষিগণ ও ভৃত্যদের জিজ্ঞেস করলাম : আহ! এই ব্যক্তি কে ছিল যে তার সম্মানে তার উপনামে সম্বোধন করলে এবং বাবাও এরূপ অকল্পনীয় সম্মান প্রদর্শন করলেন?
‘বললেন : তিনি একজন আলাভী, হাসান ইবনে আলী ও ইবনে রেযা২১ নামে প্রসিদ্ধ।
আমার বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। রাত পর্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলাম। বাবা সাধারণত রাতে এশার নামাজের পর বসে যে সংবাদগুলো খলিফার গোচরীভূত করা প্রয়োজন সেগুলোকে পর্যালোচনা করতেন। বাবা যখন নামাজ পড়ে বসলেন আমিও তার পাশে বসলাম। তখন সেখানে অন্য কেউ ছিল না। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন :
আহমাদ! তুমি কি কিছু বলবে?
বললাম : হ্যাঁ, যদি অনুমতি দেন।
বললেন : বল।
বললাম : বাবা! সকালে যে লোকটা এসেছিল এবং যাকে আপনি এত সম্মান দেখালেন আর প্রায়ই বলতে শুনলাম “আমি আপনার জন্য উৎসর্গীত, উৎসর্গীত আমার পিতা ও মাতা”। লোকটা কে ছিল?
বললেন : তিনি রাফেজীদের ইমাম২২ হাসান ইবনে আলী, ইবনে রেযা নামে প্রসিদ্ধ।
অতঃপর বাবা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন : খেলাফত যদি আব্বাসীয়দের হাত থেকে চলে যায় তাহলে তিনিই হচ্ছেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি খলিফা হওয়ার যোগ্য। এর কারণ তাঁর সততা, পরহেজগারী, উত্তম চরিত্র বৈশিষ্ট্য, ইবাদত ও দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তি। তাঁর পিতাকে যদি দেখতে বুঝতে পারতে তিনি কত মহাজ্ঞানী ও মর্যাদা সম্পন্ন লোক ছিলেন।
এমন বক্তব্য শুনে আমার চিন্তা ও উদ্বিগ্নতা আরও বাড়তে লাগলো। একই সাথে বাবার প্রতি ক্রোধও বৃদ্ধি পেতে লাগলো। যে বিষয়টি আমার একমাত্র কর্মে পরিণত হলো তা হলো ইমাম সম্পর্কে যতদূর সম্ভব তথ্য সংগ্রহ ও অনুসন্ধান চালানো। বনি হাসেমের লোকজন, সৈন্যবাহিনীর কমান্ডার, লেখক ও বিচারক যার কাছেই ইমাম সম্পর্কে জানতে চেয়েছি মূলত তার মহত্ত্ব, সম্মান ও উচ্চ মর্যাদা ব্যতীত অন্য কিছুই শুনিনি। সবাই তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কথা স্বীকার করেছেন এবং সকল বংশ ও গোত্র প্রধানদের চেয়ে তাঁকে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন। এ কারণে ইমামের মর্যাদা আমার কাছে আরও স্পষ্ট হলো। কারণ এমন কোন বন্ধু অথবা শত্রু কাউকেই দেখিনি যারা ইমামের অনুগ্রহ ও বদান্নতার কথা স্বীকার করেন নি অধিকন্তু তাঁর প্রশংসা করেছেন।২৩
ইমামের দুনিয়া বিমুখতা
‘কামেল মাদানী’ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের জন্য ইমামের সাক্ষাত লাভ করেছিলেন। তিনি বলেন :
যখন ঐ মহান ব্যক্তির ঘরে প্রবেশ করলাম, তিনি সাদা মসৃণ পোশাক পরেছিলেন। মনে মনে বললাম : “আল্লাহর ওলি ও হুজ্জাত নরম ও মসৃণ পোশাক পরিধান করেন অথচ আমাদেরকে এ ধরনের পোশাক পরিধানে নিষেধ করেন।”
ইমাম মুচকি হেসে জামার হাতা উঠিয়ে দেখালেন ঐ জামার নিচে কালো রুক্ষ পোশাক পরে আছেন। অতঃপর বললেন : ওহে কামেল! (هَذا لِلَّهِ وَ هَذا لَكُمْ ) এই রুক্ষ পোশাক পরেছি আল্লাহর জন্য আর উপরে যা দেখতে পাচ্ছো তা তোমাদের জন্য।২৪
দুই অভাবীর আগমন
মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে ইবরাহীম ইবনে মুসা ইবনে জা’ফর বলেন : একবার প্রকট অভাব অনটনে পড়ে গিয়েছিলাম। বাবা বললেন, ‘চল প্রখ্যাত দানশীল ইমাম আসকারী (আ.)-এর কাছে যাই।
জিজ্ঞেস করলাম : তাঁকে তুমি চেন?
বললেন : না, তাঁকে কখনও দেখিনি।
একসাথে রওনা হলাম। রাস্তার মাঝে বাবা বললেন, “হায় আল্লাহ্! কি ভাল হতো যদি ইমাম আমাকে ৫০০ দেরহাম সাহায্য করতেন। ২০০ দেরহাম ঋণ পরিশোধ করতাম, ২০০ দেরহাম দিয়ে জামা-কাপড় কিনতাম ও বাকী ১০০ দেরহাম দিয়ে অন্যান্য খরচাদি চালাতাম।”
আমিও মনে মনে বললাম, “হায় আল্লাহ্! যদি তিনি আমাকেও ৩০০ দেরহাম দান করতেন। ১০০ দেরহাম দিয়ে একটা উট কিনতাম, ১০০ দেরহাম দিয়ে জামা-কাপড় কিনতাম ও বাকী ১০০ দেরহাম দিয়ে অন্যান্য খরচাদি চালাতাম। অতঃপর জাবাল শহরে যেতাম। ইমামের বাড়ীতে পৌঁছা মাত্রই তাঁর ভৃত্য এসে বললেন, আলী ইবনে ইবরাহীম ও তাঁর পুত্রকে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে।” আমরা সেখানে প্রবেশ করে ইমামকে সালাম করলাম। তিনি বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওহে আলী তোমার কি হয়েছে! এ পর্যন্ত আমার কাছে আসনি?
বাবা বললেন : এমন দরিদ্র দশায় আপনার সাথে দেখা করতে আসতে লজ্জিত হচ্ছিলাম।
যখন বাইরে এলাম ইমামের ভৃত্য আমাদের দু’জনকে দু’থলি টাকা দিয়ে বললেন : তোমার এখানে (বাবাকে দেয়া থলিতে) ৫০০ দেরহাম আছে, ২০০ দেরহাম ঋণ পরিশোধের জন্য, ২০০ দেরহাম জামা-কাপড় কেনার জন্য, বাকী ১০০ দেরহাম অন্যান্য খরচাদির জন্য। এবং আমাকে বললেন : তোমার এখানে ৩০০ দেরহাম আছে। ১০০ দেরহাম দিয়ে উট কিনবে, ১০০ দেরহাম দিয়ে জামা-কাপড় ও বাকী ১০০ দেরহাম দিয়ে অন্যান্য খরচাদি চালাবে। কিন্তু জাবাল শহরের দিকে যেওনা। ইরাকের শুরা শহরের দিকে যাও। তা তোমার জন্য ভাল হবে..।২৫
ইমামের ইবাদত
ইমাম আসকারী (আ.) নিজেও তাঁর সম্মানিত পূর্ব পূরুষদের ন্যায় ইবাদত ও বন্দেগীতে আদর্শ দৃষ্টান্ত পেশ করেন। নামাজের সময় হলে সব কাজ বাদ দিয়ে প্রথমেই নামাজ আদায় করতেন। আবু হাশেম জা’ফরী বলেন :
একদা ইমাম আসকারী (আ.)-এর সাক্ষাতে হাজির হলাম। তিনি কোন একটা বিষয়ে লেখায় মগ্ন ছিলেন এমন সময় নামাজের ওয়াক্ত হলো। তিনি এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন…।২৬
ইমামের নামাজের ধরণ অন্যদেরকে আল্লাহর দিকে (ইবাদতে) আকৃষ্ট করতো। এমনও দেখা গিয়েছে পথভ্রষ্ট কোন লোককে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন। ইমাম যখন সালেহ্ ইবনে ওয়াসিফের কারাগারে বন্দী ছিলেন তৎকালীন খলিফা কারাধ্যক্ষ কে নির্দেশ দিয়েছিল যাতে সে ইমামের সাথে রূঢ় আচরণ করে ও কঠিন শাস্তি দেয়। এজন্য দু’জন নিকৃষ্ট জল্লাদ নিয়োজিত ছিল। কিন্তু তারা ইমামের সঙ্গ পেয়ে নিজেদেরকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে পরহেজগার হয়ে যায়।
কারাধ্যক্ষ জল্লাদদ্বয়কে ডেকে বলল : তোদের প্রতি ধিক্কার, এই বন্দীর সাথে কেমন আচরণ করেছিস?
তারা বললো : আমরা কি করব, যে ব্যক্তি সারাদিন রোজা রেখে সারা রাত নামাজে মগ্ন থাকেন, এবং ইবাদত ব্যতীত অন্য কিছুই করেন না। যখনই আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত করতেন আমরা নিজেদের অজান্তেই কাঁপতে থাকতাম এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতাম …।২৭
মুলসমানদের সত্য পথ প্রদর্শন
ইবনে সাব্বাগ মালেকী ও আবু হাশেম জা’ফারী এর মত কয়েকজন প্রখ্যাত সুন্নি আলেম বর্ণনা করেন :
“…একবার সামাররায় কঠিন দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। তৎকালীন খলিফা মো’তামেদ দেশবাসীকে ইসতেসকার নামাজ (বৃষ্টি কামনা করে যে নামাজ পড়া হয়) পড়ার জন্য আদেশ জারি করে। জনগণ পর পর তিন দিন নামাজ পড়ে দোয়া করা সত্ত্বেও বৃষ্টি হয় নি। অতঃপর চতুর্থদিনে খৃস্টানদের প্রধান পাদ্রী তার মাযহাবের লোকজনদের সাথে নিয়ে মরুভূমিতে গেলেন। তাদের মধ্যে এক সন্ন্যাসী ছিল যখনই হাত তুলে দোয়া করতো পর্যাপ্ত বৃষ্টি হতো। সেদিনও ঐ সন্ন্যাসীদের দিয়ে দোয়া করালো এবং এত বৃষ্টি হলো যে, দেশবাসীর আর বৃষ্টির প্রয়োজন রইলো না। এই বিস্ময়কর ঘটনা দেখে মানুষের মনে সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দিল এবং অনেক মুসলমান খৃস্টান ধর্মের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লো। এ ঘটনা খলিফার কাছে একেবারে অপ্রীতিকর মনে হলো। খলিফা ইমাম আসকারী (আ.)-এর শরণাপন্ন হলো। ইমামকে কারাগার থেকে মুক্ত করে বলল :
“আপনার পূর্বপুরুষদের উম্মত গোমরাহ্ ও পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এদেরকে ঠেকান।”
ইমাম বললেন : প্রধান পাদ্রী ও ঐ সন্ন্যাসীকে আগামীকাল মঙ্গলবার মরুভূমিতে আসতে বলো।
খলিফা বলল : আমাদের তো আর বৃষ্টির প্রয়োজন নেই। মরুভূমিতে গিয়ে কি হবে?
ইমাম বললেন : এ কারণে যে, ইনশাআল্লাহ্ এই সন্দেহের অবসান ঘটাবো।
খলিফা ইমামের কথা মত আদেশ জারি করে দিল। ইমাম নিজেও জনগণের সাথে মরুভূমিতে গেলেন। সন্ন্যাসী ও তার লোকজন হাত তুলে দোয়া শুরু করলো, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলো এবং বৃষ্টি এলো। ইমাম সন্ন্যাসীর হাত ধরে তার হাতে লুকায়িত বস্তুটি বের করে আনার আদেশ দিলেন। সন্ন্যাসীর আঙ্গুলের ফাঁকে কালো রংয়ের একটা মানব হাড় রাখা ছিল। ইমাম ঐ হাড়টি নিয়ে কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে নিলেন এবং বললেন এখন তুমি বৃষ্টির জন্য দোয়া কর। সন্ন্যাসী এবারও দোয়া করতে লাগলো কিন্তু মেঘ সরে গিয়ে সূর্য স্পষ্ট হলো। মানুষের বিস্ময় ভেঙ্গে গেল। খলিফা ইমামকে জিজ্ঞেস করলো : এটা কিসের হাড়?
ইমাম : আল্লাহর কোন এক নবীর শরীরের হাড়। কোন এক নবীর সমাধিস্থল থেকে সে এটি সংগ্রহ করেছে এবং নবীদের শরীরের হাড় প্রকাশ পেলে অবশ্যই বৃষ্টি হবে।
খলিফা ইমামের প্রশংসা করলো এবং পরীক্ষা করে দেখলো তিনি যা বলেছেন তাই ঠিক …।২৮
ইরাকী দার্শনিককে দিক নির্দেশনা
বস্তুবাদী ইরাকী দার্শনিক ইসহাক কিন্দি বই লেখার উদ্যেগ নেয়। সে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, কোরআনে বহু বৈপরীত্য বিদ্যমান। এজন্য জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লেখার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে। একদা তার এক শিষ্য ইমামের সাক্ষাত লাভ করলে ইমাম জিজ্ঞেস করেন : তোমাদের মাঝে এমন কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি নেই যে, তাকে এই অনর্থক কাজের সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রাখবে ?
বলল : আমরা তার শিষ্য, কিভাবে সম্ভব আমরা তার কাজে বিরোধিতা করব!
ইমাম বললেন : আমি যা বলবো তার কাছে তা পৌঁছাতে পারবে ?
বললো : হ্যাঁ, পারবো।
ইমাম বললেন : তার কাছে যাও এবং তার সাথে বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্টতা সৃষ্টি কর, তার ঐ কাজে সহযোগিতা কর। অতঃপর তাকে এভাবে বল যে, আমার একটা প্রশ্ন আছে, আপনি অনুমতি দিলে তা ব্যক্ত করতে পারি। সে তোমাকে অনুমতি দিবে। অতঃপর তাকে বলবে : এমন কি হতে পারে না যে, মহান আল্লাহ্ যিনি পবিত্র কোরআনের প্রেরক, তার উদ্দেশ্য তুমি যা বুঝেছো তা থেকে ভিন্ন কিছু হবে। সে বলবে : হতে পারে। কারণ যদি সে তোমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে তবে তা বুঝতে পারবে। যখন এরূপ জবাব দিবে তখন জিজ্ঞেস কর : কিভাবে নিশ্চিত হলে যে, কোরআনের বিষয়ে তুমি যে ধারণা রাখ তাই সঠিক ? এমনও হতে পারে আল্লাহর উদ্দেশ্য এক রকম এবং কোরআনের শব্দসমূহ ও বাক্য বিন্যাস থেকে তুমি তার ভিন্ন অর্থ বুঝেছো।
ঐ লোকটি ইসহাক কিন্দির নিকট গেল এবং ইমামের নির্দেশিত পন্থায় তার সাথে সদাচরণ করলো। অতঃপর একসময় প্রশ্ন উত্থাপন করলো। কিন্দি তাকে প্রশ্নটি পুনরাবৃত্তি করতে বলল। অতঃপর চিন্তায় মগ্ন হলো এবং অর্থ ও ব্যাকরণগত দৃষ্টিতে সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করে বিষয়টি সম্ভব বলে স্বীকার করলো। অতঃপর তার শিষ্যকে কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো এই প্রশ্ন তুমি কোথা থেকে পেয়েছো? শিষ্য বলল : হঠাৎ করেই আমার মাথায় এসেছে ।
কিন্দি বলল : তুমি এবং তোমার মত লোকের মাথায় এমন প্রশ্ন আসতেই পারে না, সত্যি করে বল কে শিখিয়েছে তোমাকে ?
শিষ্য বলল : আবু মুহাম্মদ (ইমাম আসকারী) আমাকে এরূপ নির্দেশনা দিয়েছেন।
কিন্দি বলল : এতক্ষণে সত্য কথা বলেছো। এমন প্রশ্ন ঐ বংশের লোক ব্যতীত অন্য কারো চিন্তায় আসতে পারে না।
অতঃপর তার ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটলো এবং তার ঐ ভিত্তিহীন লেখাগুলো আগুনে পুড়িয়ে ফেললো ২৯
কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর
ক) আবু হাশেম জা’ফরী বলেন : এক ব্যক্তি ইমামকে জিজ্ঞেস করেন, অসহায় সত্ত্বেও নারী জাতি পিতার সম্পত্তির একভাগ পায় অথচ ছেলে পায় তার দ্বিগুণ ?
ইমাম বললেন : কারণ জিহাদ করা, সাংসারিক খরচাদি চালানো পুরুষের দায়িত্ব এবং ভুলবশত কাউকে হত্যা করলে তার জরিমানাও (দীয়া৩০) পুরুষের উপর অর্পিত। এর সব কিছুই মহিলাদের দায়িত্ব বহির্ভূত।
আবু হাশেম বলেন : আমি মনে মনে বললাম এর আগেও শুনেছি যে, ইবনে আবিল উজজা ইমাম সাদিক (আ.)-এর কাছে ঠিক একই প্রশ্ন করেছিল এবং ঠিক এরকমই জবাব পেয়েছিল।
ইমাম আসকারী (আ.) তখন আমার দিকে ফিরে বললেন : হ্যাঁ, ঠিক একই প্রশ্ন ইবনে আবিল উজজা করেছিল। আমাদের যে কারো কাছেই এক প্রশ্ন করা হবে তার উত্তরও আমরা একই রকম দিয়ে থাকি। পরবর্তী ও পূর্ববর্তী ইমামের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। জ্ঞানগত বিষয়ে আমাদের প্রথম ও শেষ সমমর্যাদার অধিকারী তবে হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.)-এর বিশেষত্ব ও মর্যাদা অতুলনীয়।৩১
খ) হাসান ইবনে জারিফ ইমাম আসকারী (আ.)-এর নিকট লিখেন : হযরত আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) সম্পর্কে রাসূল (সা.)-এর বাণী,
(مَنْ كُنْتُ مَوْلاهُ فَعَلىُّ مَوْلاَهُ) এর অর্থ কি?
ইমাম বললেন : রাসূল (সা.)-এর উদ্দেশ্য ছিল আলী (আ.) কে ইমামতের পদে নিযুক্ত করবেন যাতে তার উম্মতের মধ্যে সৃষ্ট বিভেদ ও অনৈক্যের ক্ষেত্রে সত্যপন্থী সহজে চেনা যায়।৩২
গ) হারভী বলেন : আসবাতের এক ছেলে আমাকে বললো, একদা ইমাম আসকারী (আ.)-কে লিখে জানালাম যে, তাঁর প্রতি ভালবাসা পোষণকারীদের মধ্যে বিভেদ বিদ্যমান। এ জন্য আমি চাইলাম ইমাম যাতে এমন কিছু মুজেজা দেখান যাতে এই সমস্যার সমাধান হয়।
ইমাম জবাবে লিখেন : “ সত্য এই যে আল্লাহ্ তা’য়ালা শুধুমাত্র জ্ঞানী ব্যক্তির সাথে কথা বলেন। রাসূল (সা.) যে সকল নিদর্শন (মুজেজা) দেখিয়ে ছিলেন তার অধিক কোন নিদর্শন আর কেহই কখনও দেখাতে পারবে না। তথাপি তার সম্প্রদায় তাকে যাদুকর বলে আখ্যায়িত করেছিল। যে সকল লোক হেদায়েত পাওয়ার যোগ্য ছিল তাদেরকে তিনি হেদায়েত করেছেন। তবে কিছু লোক এমনও আছে যারা মুজেজার মাধ্যমে হেদায়েত প্রাপ্ত হয়। আর এই মুজেজা একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালার অনুমতি সাপেক্ষে। আল্লাহ্ তা’য়ালা যেখানে আমাদেরকে নিষেধ করেন আমরা সেখানে একটি কথাও বলি না।
যদি আল্লাহ্ তা’য়ালা না চাইতেন সত্য প্রকাশিত হোক তাহলে রাসূলগণকে মানুষের সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্র্রেরণ করতেন না। আল্লাহর নবী রাসূলগণ দুর্বল অথবা সবল যে অবস্থায়ই ছিলেন সত্যকে প্রকাশ করেছেন। তারা মাঝে মাঝে কিছু কিছু আদেশ ও হুকুম প্রদান করতেন আর আল্লাহ্ তা’য়ালার অনুমতিক্রমে তা কার্যকর ও বাস্তবায়িত হতো।
মানুষ কয়েক ভাবে বিভক্ত; একদল এমন যে, জেনে বুঝে মুক্তির পথে অবস্থিত, সত্য প্রাপ্ত ও দীনের মুখ্য ও গৌণ বিষয়ে আমল করতে দৃঢ় প্রত্যয়ী। তাদের অন্তরে নেই কোন সন্দেহ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন আশ্রয়স্থলও তারা খোঁজে না।
আর একদল লোক এমন যে, সত্যকে তার ধারক ও বাহকের কাছ থেকে গ্রহণ করেনা; এরা সমুদ্রে ভ্রমণকারী ঐ লোকদের ন্যায় যারা সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে তাদের হৃদয় চমকিত হয় আবার সমুদ্র যখন শান্ত হয় তাদের হৃদয়ও শান্ত হয়।
তৃতীয় দলটি এমন যে, শয়তান তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে। তারা হিংসার বশবর্তী হয়ে সত্যের বিরোধিতা করে এবং সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখে। যারা (সত্য ও সঠিক পথ বাদ দিয়ে) ডানে-বায়ে চলছে তুমি তা করিস না। রাখাল তার সুশৃংখল পশু পালকে সহজেই একত্রিত করতে পারে। ঠিক তেমন যারা আমাকে অনুসরণ করে আমিও তাদের পরিচালনা করতে সক্ষম।
অনারব মুসলমান (মাওয়ালী) ও আমাদের অনুসারীদের মাঝে মত পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেছো; যদি মহত্ত্বই সত্যের মাপকাঠি হয়ে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে যে ব্যক্তি ইমামতের পদে নিযুক্ত, তিনি সিদ্ধান্ত নেয়া ও আদেশ দানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত। যাদের সম্পর্কে তুমি অভিযোগ করেছো তাদের সাথে সদাচরণ কর, আমাদের গোপন তথ্যাদি প্রকাশ ও নেতৃত্বের লিপ্সা থেকে বিরত থাক। এই কাজ দুটি মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
পারস্যে যাওয়ার আকাঙ্খা পোষণ করেছো, যেতে পারো, আল্লাহর কাছে তোমার মঙ্গল কামনা করি, ইনশাআল্লাহ্ সুস্থ ও নিরাপদে মিসরে যাবে।
আমার নির্ভরযোগ্য সহযোগীদের নিকট আমার সালাম পৌঁছাবে। তাদেরকে বলো : আমাদের গোপন তথ্যাদি নিয়ে আলোচনা করা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করা আমাদের সাথে যুদ্ধের সমতুল্য।”
হারভী বলেন : ইমামের এ কথাটি “সুস্থ ও নিরাপদে মিশরে যাবে” প্রথমে বুঝতে পারি নি। যখন বাগদাদে এলাম পারস্যের দিকে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হলো। ফলে সেদিকে আর যাওয়া হলো না। অতঃপর মিশরে গেলাম এবং তখন বুঝতে পারলাম ইমাম কেন ঐ কথাটি বলেছিলেন।৩৩
ঘ) মুহাম্মদ ইবনে হাসান ইবনে মায়মুন বলেন : একবার ইমাম আসকারী (আ.)-এর নিকট আমার অভাব অভিযোগের কথা জানিয়ে অনুযোগ করে চিঠি লিখলাম; অতঃপর মনে মনে বললাম, ইমাম সাদিক (আ.) তো বলেছেন :
الْفَقْرُ مَعَناخَيْرٌ مِنَ الْغِنىَ مَعَ غَيْرِنا وَ الْقَتْلُ مَعَنا خَيْرٌ مِنَ الْحَياةِ مَعَ عَدوِّنا
-সম্পদশালী অবস্থায় অন্যদের সাথে থাকার চেয়ে অভাবী হয়ে আমাদের সাথে থাকাও উত্তম, ঠিক তেমন আমাদের শত্রুদের সাথে থেকে বেঁচে থাকার চেয়ে আমাদের সাথে থেকে মৃত্যুবরণ করাও শ্রেয়।
জবাবে ইমাম (আ.) লিখেন : আল্লাহর ওলি ও আমাদের অনুসারীরা যখন অনেক বেশী গুনাহ করে ফেলে তখন আল্লাহ্ তা’য়ালা তাদেরকে অভাব অনটন দিয়ে সে ওসিলায় গুনাহ ও ভুলত্রুটিসমূহ ক্ষমা করে দেন এবং অধিকাংশ গুনাহ এইভাবে মাফ হয়ে যায়। যেমনটি তুমি নিজেই বলেছো, “সম্পদশালী অবস্থায় অন্যদের সাথে থাকার চেয়ে অভাবী হয়ে আমাদের সাথে থাকাও উত্তম, ঠিক তেমন আমাদের শত্রুদের সাথে থেকে বেঁচে থাকার চেয়ে আমাদের সাথে থেকে মৃত্যুবরণ করাও শ্রেয়।” যারা আমাদের কাছে জ্ঞান কামনা করে আমরা তাদেরকে জ্ঞান দিয়ে থাকি এবং আমাদেরকে যারা আঁকড়ে ধরে আমরা তাদেরকে পাহারা দিয়ে রাখি, যারা আমাদেরকে ভালবাসে তারা আমাদের কাছে গর্বিত এবং যারা আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যায় তারা আগুনে পতিত হয়।৩৪
কোমের এক বিশিষ্ট আলেমের নিকট ইমামের চিঠি
বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ইমাম তাঁর অনুসারী ও সহযোগিদের চিঠি লিখে দিক নির্দেশনা দিতেন। এমনই এক চিঠি কোমের মহান শিয়া ফকীহ্ আলী ইবনে হুসাইন ইবনে বাবুইয়ে কোমীকে লিখেন। চিঠির ভূমিকা নিম্নরূপ :
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمْ اَلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعالَمِين وَ الْعاقِبَةُ لِلمُتَّقِين وَ الْجَنَّةُ لِلمُوحِّدِين وَ النَّارُ لِلمُلحِدِين وَ لاَ عُدوانَ اِلاَّ عَلى الظالِمين وَ لاَ اِلَهَ اِلاَّ اللَّه اَحْسُنُ الْخالِقِين وَ الصَّلوةُ عَلى خَيْرِ خَلْقِهِ مُحَمَّدٍ وَ عِتْرَتِهِ الطاهرين
– মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি যিনি পরম দাতা ও দয়ালু, সকল প্রশংসা তার জন্যই যিনি সারা জাহানের প্রতিপালক। পরকালের মঙ্গল মুত্তাকিদের জন্য, বেহেশত একত্ববাদীদের জন্য ও দোযখের আগুন কাফেরদের (মুরতাদ) জন্য। প্রকাশ্য দুশমনি ও যুদ্ধ শুধুমাত্র জালিমদের জন্য। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন উত্তম সৃষ্টিকর্তা নেই। মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের উপর দরূদ ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।
আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তনের পর তোমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছি, তিনি তোমাকে একটি শ্রেষ্ঠ সন্তান দান করুক। নামাজ কায়েম করা, যাকাত আদায় করা ও পরহেজগারীতার জন্য তোমাকে আদেশ করছি (কারণ যাকাত না দিলে তার নামাজ কবুল হয় না)। তোমাকে আরও আদেশ করছি যে, মানুষের ভুল ভ্রান্তি ক্ষমা করে দিবে, নিজের ক্রোধ দমন করবে, আত্মীয় স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলবে, তাদের সুসময়ে ও দুঃসময়ে সহযোগিতা করবে। অজ্ঞ ও মুর্খদের প্রতি নম্র ও সহনশীল থাকবে, সচ্চরিত্রতা, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে। আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেন :
لاَ خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْويَهُمْ اِلاَّ مَنْ اَمَرَ بِصَدقَةٍ اَوْ مَعْرُوفٍ اَوْ اِصْلاحٍ بَيْنَ النَّاسِ
– একমাত্র যারা মানুষকে ছদকা, সৎ কাজ ও মানুষের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করার আদেশ দেয় তারা ব্যতীত অধিকাংশ লোকের কথায় কোন মঙ্গল নেই। (সূরা নিসা : ১১৪)
সব ধরণের অন্যায় ও অপকর্ম থেকে বিরত থাকবে, তাহাজ্জুত নামাজ পড়বে ঠিক যেমনটি মুহাম্মদ (সা.) আলী (আ.)-কে তাহাজ্জুত নামাজ পড়ার জন্য তাগিদ দিয়ে বলতেন, আমিও তোমাকে তা পড়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছি।
يا عَلىُّ عَلَيْكَ بِصَلَوةِ الْليْلِ، عَلَيْكَ بِصَلَوةِ الْليْلِ، عَلَيْكَ بِصَلَوةِ الْليْلِ وَ مَنْ اسْتَحَفَّ بِصَلَوةِ الْلَيْلِ فَلَيْسَ مِنَّا
– হে আলী! তাহাজ্জুত নামাজের প্রতি যত্নবান হও, তাহাজ্জুত নামাজের প্রতি যত্নবান হও, তাহাজ্জুত নামাজের প্রতি যত্নবান হও। যে ব্যক্তি তাহাজ্জুতের প্রতি গুরুত্ব দেয় না সে আমাদের মধ্যে শামিল নয়।
অতএব, আমার নির্দেশনানুসারে আমল কর এবং ঠিক যেভাবে তোমাকে আমল করার জন্য পরামর্শ দিলাম আমার অনুসারীদেরকেও সেভাবে আমল করতে বল। ছবর ও ধৈর্য ধারণ কর এবং শেষ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের প্রত্যাশায় অধীর অপেক্ষায় থাকবে, এ ব্যাপারে মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন : আমার উম্মতের জন্য শ্রেষ্ঠ আমল হল “ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর জন্য প্রতীক্ষা করা।” আমার সন্তান ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের অনুসারিগণ দুঃখ বেদনায় নিমজ্জিত থাকবে। অতঃপর যেমন রাসূল (সা.) সুখবর দিয়েছেন জুলুম ও নির্যাতনে ভরপুর পৃথিবীকে ইমাম মাহ্দী ন্যায় বিচার ও শান্তিতে পরিপূর্ণ করবে। (পরহেজগার মুসলমানগণ দুর্নীতিপূর্ণ সমাজে জালিমদের মুকাবেলায় কঠিন বালা-মুসিবত সহ্য করে আল্লাহর বিধানকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকে। এতসব সমস্যার মধ্যে দীনকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয় এবং তাই ধৈর্য ধারণের পাশাপাশি আশা তার একমাত্র ভেলা। যদি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আশা না থাকতো তাহলে তারা সত্য থেকে দূরে সরে যেত। )
হে আমার বিশ্বাসভাজন মহান আবুল হাসান, নিজেও ধৈর্যাবলম্বন কর এবং আমার অনুসারীদেরকেও ধৈর্যের পরামর্শ দাও, আল্লাহর জমিনে তাঁর বান্দাদেরই রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। পরকালের শান্তি পরহেজগারদের জন্যই। আমার সালাম, আল্লাহর শান্তি ও বরকত আমার অনুসারী এবং তোমার উপর বর্ষিত হোক।
وَ حَسْبُنا اللَّهُ وَ نِعْمَ الوَكيلْ نِعْمَ المَولىَ وَ نِعْمَ النَّصير (আনওয়ারুল বাহিয়াহ্, মাশহাদ ছাপাখানা, পৃ. ১৬১)
মুজেজা ও অদৃশ্য জগতের সাথে ইমামের সম্পর্ক
ইমাম আসকারী (আ.)-এর পূর্ব পুরুষ ও ইমামগণ মহান আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের কারণে অদৃশ্য জগত ও ফেরেস্তাগণের উপর জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ করেছিলেন। ইমামও এরূপ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। ইমামের অসংখ্য মুজেজা ও অলৌকিক কর্মকান্ডের বিবরণ দিতে গেলে পৃথক একটি বই লেখার প্রয়োজন হবে। আমরা এখানে এর কয়েকটি নমুনা পেশ করবো মাত্র।
১.আবু হাশেম জা’ফরী বলেন : একদা চেয়েছিলাম ইমাম আসকারী (আ.)-এর কাছে একটি আংটি তৈরী করার মতো কিছু পরিমান রৌপ্য সাহায্য চাইবো। ইমামের সাক্ষাতে গেলাম, বসলাম কিন্তু যে উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম বেমালুম ভুলে গেলাম। অতঃপর যখন আসার জন্য রওনা হলাম ইমাম আমাকে একটি আংটি দিয়ে বললেন, “রৌপ্য চেয়েছিলে আমি তোমাকে দিলাম এবং আংটির পাথর মুজুরী অতিরিক্ত লাভ হিসাবে পেলে। তোমার মঙ্গল হোক।
বললাম : হে আমার মাওলা, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর ওলি ও আমার ইমাম। আপনার অনুসরণ আমার দ্বীনেরই কর্তব্য।
বললেন : হে আবুল হাসেম, আল্লাহ্ তোমাকে ক্ষমা করুক। (উসুলে কাফি, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫১২)
২.সাবলানজী আবু হাশেম জা’ফরীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন : এক সময় আমি এবং আরও চারজন লোক সালেহ ইবনে ওয়াসিফের কারাগারে বন্দী ছিলাম। একদিন ইমাম আসকারী (আ.) ও তাঁর ভাই জা’ফর কারাগারে প্রবেশ করলেন। আমরা ইমামের খেদমত করার জন্য ইমামের চার পাশে অবস্থান নিলাম। বনি জাম গোত্রের এক ব্যক্তি আমাদের সাথে ছিল সে নিজেকে আলী (আ.)-এর বংশধর বলে দাবি করতো। ইমাম আমাদের বললেন যদি তোমাদের মাঝে তোমাদের ঘনিষ্ট লোক ব্যতীত অন্য কেহ না থাকতো তাহলে বলে দিতাম কখন তোমরা মুক্তি পাবে। অতঃপর ঐ লোকটিকে বাহিরে যাওয়ার ইঙ্গিত করলেন। লোকটি বাইরে চলে গেলে ইমাম বললেন : এই লোকটি তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নয় তার থেকে সাবধান থাকবে। এ পর্যন্ত তোমরা যা বলেছ সব তথ্যই খলিফাকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে সে লিখে রেখেছে এবং তা এখনও তার পোশাকের ভিতর লুকায়িত আছে। আমাদের কয়েকজন তাকে তল্লাশী চালিয়ে তার পোশাকের ভিতর থেকে লুকায়িত তথ্য সমূহ কেড়ে নিলো। তখন বুঝতে পারলাম সত্যই বিপদজনক অনেক তথ্যই সে লিখে রেখেছে …।৪
৩.মুহাম্মদ ইবনে রাবি শাইবানী বলেন : একবার আহ্ওয়াজে এক দ্বিত্ববাদীর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলাম অতঃপর সামাররা গিয়ে পৌঁছলাম। ঐ দ্বিত্ববাদীর যুক্তির কিছু প্রভাব আমার উপর পড়েছিল। ফলে একত্ববাদের উপর কিছু সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। একদিন আহমদ ইবনে খোসাইব এর বাড়িতে বসে ছিলাম এমন সময় ইমাম আসকারী (আ.) এক সভা থেকে এলেন, আমাকে লক্ষ্য করে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বললেন, اَحَدٌ اَحَدٌ فَوحِّدهُ» «আল্লাহ্ এক আল্লাহ্ এক এবং তাকে অদ্বিতীয় মেনে নাও। আমি বেহুশ হয়ে পড়লাম।৫
৪.ইসমাইল ইবনে মুহাম্মদ বলেন : একদিন ইমাম আসকারী (আ.)-এর বাড়ির দরজায় বসে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যখন তিনি বাইরে এলেন তাঁর সামনে গিয়ে আমার দুঃখ দুর্দশার কথা জানিয়ে অভিযোগ করলাম এবং কসম খেয়ে বললাম আমার এমন অবস্থা যে একটি দিরহামও আমার কাছে নেই।
ইমাম বললেন : কসম খেয়ে ফেললে অথচ ২০০ দিরহাম মাটির নিচে পুঁতে রেখে এসেছো!
অতঃপর বললেন : এ কথা বললাম বলে তোমাকে সাহায্য করব না এমন নয়। এরপর তিনি তার ভৃত্যকে ইশারা করে বললেন, তোমার কাছে যা আছে তা ইসমাইলকে দিয়ে দাও। ভৃত্যটি আমাকে ১০০ দিনার দিলো। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিলাম। এমন সময় ইমাম বললেন আমার ভয় হয় যখন ঐ ২০০ দিরহাম তোমার খুব প্রয়োজন পড়বে তখন ওটাকে আর পাবে না।
আমি ফিরে এসে দিনারগুলি যেখানে পুঁতে রেখেছিলাম তুলে নিয়ে জায়গা পরিবর্তন করে এমনভাবে লুকিয়ে রাখলাম যাতে কেউ খুঁজে না পায়। কিছু দিন পর আমার অর্থের প্রয়োজন পড়লে ঐ দিনারগুলো যেখানে লুকিয়ে রেখেছিলাম তা উঠিয়ে আনতে গেলাম কিন্তু একটি দিরহামও সেখানে পেলাম না। আমার আক্কেল সেলামি হলো। পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার ছেলে ওখান থেকে সবগুলো দিনার তুলে নিয়েছিল এবং তার এক দিনারও আমার হাতে আর ফিরে আসে নি। ঠিক যেমন ইমাম বলেছিলেন।৬
৫.মুহাম্মদ ইবনে আইয়াশ বলেন : একদিন আমরা কয়েকজন একত্রে বসে ইমাম আসকারী (আ.)-এর মুজেজা সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। আমাদের মাঝে এক নাসেবী ছিল সে বললো আমি কয়েকটা প্রশ্ন একটা কাগজের উপর কালি বিহীন কলমে লিখবো। যদি ইমাম জবাব দিতে পারেন তাহলে বিশ্বাস করবো তিনি সত্যিকার ইমাম। আমরা সে কথা মত কতগুলো বিষয় লিখলাম নাসেবীও কালি বিহীন কলমে তার প্রশ্নগুলো লিখলো। আমরা সেগুলো ইমাম আসকারী (আ.)-এর নিকট পাঠালাম। ইমাম সবগুলো প্রশ্নের উত্তর লিখে পাঠালেন এবং নাসেবীর কাগজের উপর তার নাম, তার পিতার নাম, তার মাতার নাম লিখে পাঠালেন। নাসেবী তা দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। তার হুশ ফিরে আসার পর ইমামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলো। এরপরে সে ইমামের একনিষ্ঠ অনুসারীদের মধ্যে শামিল হলো।৭
৬.ওমর ইবনে আবি মুসলেম বলেন : সামিউম মুসমায়ি আমার এক প্রতিবেশী, যার বাড়ী আমার বাড়ির দেয়ালের সাথে লাগানো ছিল। সে আমাকে অত্যন্ত জ্বালাতন করতো। আমি চিঠি লিখে ইমামকে এ ব্যাপারে দোয়া করতে অনুরোধ করলাম। তিনি জবাবে লিখলেন : অতি শীঘ্রই তোমার দুঃখ বেদনা লাঘব হবে এবং তুমি উক্ত প্রতিবেশীর বাড়ির মালিক হবে।
একমাস পরেই লোকটি মারা গেল এবং আমি বাড়িটি কিনে নিলাম ও ইমামের দোয়ার বরকতে ঐ বাড়িটি আমার বাড়ির সাথে সংযুক্ত হলো।৮
৭.আবু হামজা বলেন : অনেকবার দেখেছি ইমাম তার ভৃত্যদের (যারা বিভিন্ন দেশী তুর্কী, রোমীয়, দাইলামী ও অন্যান্য ভাষাভাষী ছিল) সাথে তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলতেন। আমি অবাক হয়ে যেতাম এবং মনে মনে বলতাম… ইমাম মদীনায় জন্মগ্রহণ করেছেন… অথচ কিভাবে তিনি এত ভাষায় কথা বলেন; ইমাম আমার দিকে ফিরে বললেন : মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রতিনিধিদের অন্যান্য সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং সব কিছুর উপর জ্ঞান দান করেছেন। ইমামগণ বিভিন্ন ভাষা, বিভিন ব্যক্তির বংশ পরিচয় ও ভবিষ্যতের ঘটনাবলী সম্পর্র্কে সম্যক অবগত থাকেন। যদি এরকম না হতো তাহলে সাধারণ মানুষ ও ইমামদের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকতো না। ৯
ইমাম আসকারী (আ.)-এর কিছু বাণী
১. «عَلَيْكَ بِالْاَقْتِصادِ وَ اِياَّكَ وَ الْاِسْرافَ»
মিতব্যয়ী হও এবং অপচয় ও অপব্যয় করো না।১০
ইমাম যখন ছোট ছিলেন এক ব্যক্তি দেখলেন কিছু ছেলে খেলাধুলায় মগ্ন আর ইমাম পাশে বসে কাঁদছেন। লোকটি ভাবলেন হয়তো অন্যান্য ছেলেদের মত খেলাধুলা করতে পারছে না বলে ইমাম কাঁদছেন। জিজ্ঞেস করলেন : তোমাকে কি কিছু খেলনা কিনে দেব?
ইমাম বললেন : » « يا قَليلَ الْعَقْلِ ما لِلَّعِبِ خُلِقْنا হে অল্প বিদ্যার অধিকারী, আমাদেরকে খেলাধুলার জন্য সৃষ্টি করা হয় নি।
লোকটি জিজ্ঞেস করলো : তাহলে কিজন্য সৃষ্ট হয়েছো ?
বললেন : » لِلْعِلْمِ وَ الْعِبادَةِ « জ্ঞানার্জন ও ইবাদতের জন্য।
জিজ্ঞেস করলো : একথা কোথায় পেয়েছো ?
বললেন : মহান আল্লাহর বাণী থেকে। যেমন কোরআনে উল্লিখিত আছে :
» اَفَحَسِبْتُمْ انَّما خَلَقْناكُمْ عَبَثاً وَ اَنَّكُمْ اِلَيْنا لاَ تُرْجَعُونَ «
আমরা কি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা কি আমাদের নিকট কি প্রত্যাবর্তন করবে না।১১
২. » لاَ تُمارِ فَيَذْهَبُ بَهاَؤُكَ وَ لاَ تُمازِحْ فَيُجْتَرَئُ عَلَيْكَ «
ঝগড়াঝাটি করো না তাহলে মানসম্মান থাকবেনা, ঠাট্টা (ইয়ার্কি) করো না তাহলে অন্যরা সাহস পেয়ে যাবে।১২
৩. » مِنَ التَّواضُعِ السَّلامُ عَلَى كُلِّ مَنْ تَمُرُّبِهِ وَ الْجُلُوسُ دُونَ شَرَفِ الْمَجْلِس «
সবাইকে (যার সাথেই দেখা হোক) সালাম করা এবং সভা সমাবেশের নিচে ও পিছনে বসা বিনয় ও নম্রতার লক্ষণ।১৩
৪. » اِذا نَشَطَتِ الْقُلُوبُ فَاَوْدِعُوها وَ اِذا نَفَرَتْ فَوَدِّعُوها «
যখন মন উৎফুল্ল থাকে তখন জ্ঞানার্জন কর, আর যখন বিষণ্ন থাকে তখন বিরত থাকো।১৪
৫. » لَيْسَ مِنَ الْاَدَبِ اِظْهارُ الْفَرَحِ عِنْدَ الْمَحْزُونِ «
শোকার্ত লোকের সামনে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করা অভদ্রতার লক্ষণ।১৫
৬. » اَلتَّواضُعُ نِعْمَةُ لاَ يُحْسَدُ عَلَيْها «
বিনয় এমন এক নিয়ামত যে, বিনয়ীর প্রতি কেহই ঈর্ষা করে না।১৬
৭. » مَنْ وَعَظَ اَخاهُ سِرّاً فَقَدْ زانَهُ وَ مَنْ وَعَظَهُ عَلانِيَةً فَقَدْ شانَهُ «
যে ব্যক্তি কাউকে গোপনে উপদেশ দেয় সে তাকে অলংকৃত করলো, আর যে ব্যক্তি সকলের সামনে প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করলো (উপদেশ দিলো) শুধু তার বদনামই করলো সংশোধন করতে পারলো না।১৭
৮. » كَفاكَ اَدَباً لِنَفْسِكَ تَجَنُّبُكَ ما تَكْرَهُ مِنْ غَيْرِكَ «
অন্যের যে কাজ তোমার অপছন্দ যদি তা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পার তাই তোমার আত্মশুদ্ধির জন্য যথেষ্ট।১৮
৯. » حُسْنُ الصُّورَةِ جمالٌ ظاهِرٌ وَ حُسْنُ الْعَقْلِ جَمالٌ باطِنٌ «
চেহারার সৌন্দর্য কেবলমাত্র বাহ্যিক কিন্তু জ্ঞানের সৌন্দর্য অন্তরেও বিদ্যমান।১৯
১০. » اِنَّ الْوُصُولَ اِلىَ اللَّهِ عَزَّوَجَلَّ سَفَرٌ لاَ يُدْرِكُ اِلاَّ بِاسْتِطاءِ اللَّيْلِ «
আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে হলে এমন এক সফর (ভ্রমন) করতে হবে যেখানে রাত্রি জাগরণ ব্যতীত বিকল্প কোন রাস্তা নেই।২০
১১. » جُعِلَتِ الْخَبائِثُ فِي بَيْتٍ وَ الْكِذْبُ مِفاتيحُها «
অপবিত্রতাসমূহ একটি ঘরে একত্রিত করা হয়েছে যাদের চাবি হচ্ছে মিথ্যা।২১
১২. » اِنَّ لِلْجُودِ مِقْداراً فَاِذا زادَ عَلَيْهِ فِهوَ سَرَفٌ «
দান করারও একটা পরিমান আছে যদি তা লংঘন করা হয় তা হবে অপচয়।২২
১৩. » وَ اِنَّ لِلْحَزْمِ مِقْداراً فَاِذا زادَ عَلَيْهِ فَهُوَ جُبْنٌ «
সংযমেরও একটা সীমা আছে যদি তা অতিক্রম করা হয় তাহলে তা ভীতি বলে গণ্য।২৩
ইমামের কয়েকজন সহযোগী
শাসকদের দ্বারা সৃষ্ট শ্বাস রুদ্ধকর পরিবেশ ও ইমামের উপর কড়া নজর থাকার কারণে ইমামের সহযোগীদের সংখ্যা নিতান্ত কম হলেও যারা ইমামের বিশেষ সান্নিধ্য লাভ করতে পেরেছে তারাই মহান দীনী ব্যক্তিত্ব ও পরহেজগার আলেমে পরিণত হয়েছেন। তাদের কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরবো :
১.আহমাদ ইবনে ইসহাক আশআরী কোমী : তিনি কোমের মহান ব্যক্তিদের মধ্যে ইমামের একজন বিশেষ সহযোগী ও প্রতিনিধি ছিলেন। কোমবাসীদের বিভিন্ন বিষয়ের সমস্যামূলক প্রশ্নাদি ইমামের কাছে নিয়ে যেতেন এবং ইমামের কাছ থেকে প্রাপ্ত জবাব কোমবাসীদের নিকট পৌঁছে দিতেন। তিনি ইমাম জাওয়াদ ও ইমাম হাদী (আ.)-এরও সাহাবী ছিলেন। এই দুই ইমামের কাছ থেকেও হাদীস বর্ণনা করেছেন।২৪
“আহমাদ ইবনে ইসহাক” হুসাইন ইবনে রুহ নওবাখতী (ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময়ের তৃতীয় বিশেষ প্রতিনিধি) এর কাছে হজ্বে যাওয়ার জন্য অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখেন। হজ্বের অনুমতিপত্রের সাথে কিছু পরিমান কাপড়ও হস্তগত হলো। আহমাদ বললো আমার মৃত্যু সংবাদ এসেছে (যে কাপড়টি পাঠানো হয়েছিল তা ছিল কাফনের কাপড় এটা দেখেই সে বুঝে নিয়েছিল তার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে) এবং হজ্ব থেকে ফেরার পথে হালওয়ান যার বর্তমান নাম পুলে জাহাব সেখানে তার মৃত্যু হয়।২৫
“সাদ ইবনে আব্দুল্লাহ্” আহমাদ ইবনে ইসহাকের মৃত্যু সম্পর্কে বলেন : হালওয়ানে পৌঁছার তিন ফারসাখ (এক ফারসাখ = ৬.২৪ কি.মি.) পূর্বেই তার জ্বর হয় এবং মারাত্বক অসুস্থ হয়ে পড়েন ফলে আমরা নিরাশ হয়ে পড়লাম। বুঝতে পারলাম সে আর বাঁচবে না। যখন হালওয়ানে পৌঁছালাম সরাই খানায় আশ্রয় নিলাম। আহমদ বললো আজ রাতে আমাকে একা থাকতে দাও তোমরা তোমাদের গন্তব্যে চলে যাও। সবাই চলে গেলেও আমি গেলাম না। ফজর নামাজের ঠিক পূর্বে জেগে দেখি ইমাম আসকারী (আ.)-এর খাদেম কাফুর সেখানে উপস্থিত। সে বললো :
اَحْسَنَ اللَّهُ بالْخَيْرِ عَزائَكُمْ وَ جَبَرَ بِالْمَحْبوبِ رَزِيَّتَكُمْ » «
– আল্লাহ্ তোমার মঙ্গল করুন এবং তোমার ঊপর আপতিত এই মুসিবতের প্রতিদান স্বরূপ উত্তম পুরস্কার দান করুন।
অতঃপর বললেন : তোমার সাথী আহমাদের গোসল ও কাফন সম্পন্ন হয়েছে। এখন যাও তার দাফনের ব্যবস্থা কর। সত্যিই আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের কারণে ইমামের দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে আহমাদ শ্রেষ্ঠ ছিল। একথা বলে কাফুর অদৃশ্য হয়ে গেল।২৬
২.আবু হাশেম দাউদ ইবনুল কাসেম জা’ফরী : তিনি জনাব জা’ফর তাইয়ার এর বংশধর এবং তার বংশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বাগদাদে বসবাস করতেন। ইমামদের কাছে তার যথেষ্ট মূল্য ও কদর ছিল। তিনি ইমাম জাওয়াদ, ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারী (আ.)-এর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং মাহ্দী (আ.) এর বিশেষ উকিল ও বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন।
আবু হাশেম ইমামদের খুব ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ সাথিদের মধ্যে পরিগণিত। ইমামদের হতে প্রচুর হাদিস তিনি বর্ণনা করেন এবং এ সম্পর্কিত একটি বইও লিখেন। শিয়াদের প্রসিদ্ধ আলেমগণ তার এ বইয়ের প্রশংসা ও তা থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।২৭
আবু হাশেম একজন স্বাধীনচেতা, অকুতোভয় ও সাহসী লোক ছিলেন। যখন ইয়াহিয়া ইবনে ওমর জায়দী২৮ এর কর্তিত মাথা বাগদাদের গর্ভণর মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ তাহের এর নিকট নিয়ে আসা হয় অনেকেই তখন এ ঘটনাকে মহা বিজয় উল্লেখ করে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। আবু মুহাম্মদ গভর্ণরের কাছে গিয়ে সম্মান ও সম্বোধন ব্যতীরেকেই বললেন : হে আমির, তোমাকে এমন এক বিষয়ে সম্বর্ধনা জানাতে এসেছি যদি রাসূল (সা.) এখন জীবিত থাকতেন তার জন্য শোক প্রকাশ করতেন। গভর্ণর আবু হাশেমের এ কথার কোন প্রকার জবাব দিল না।২৯
৩. আবদুল্লাহ্ ইবনে জা’ফর হামিরী : তিনি কোম শহরের এক মহান ব্যক্তি এবং ইমাম আসকারী (আ.)-এর বিশিষ্ট সঙ্গীদের একজন। তিনি অনেক বই লেখেন এর মধ্যে “কুরবুল আসনাদ” আজও পর্যন্ত মহান শিয়া আলেম ও ফকীহদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। আবদুল্লাহ্ ইবনে জা’ফর ২৯০ হিজরীতে কুফায় গমন করেন। কুফার জনগণ তার কাছ থেকে হাদিস শিক্ষা নিত।৩০
৪. আবু আমর ও উসমান ইবনে যাইদ আমরী : ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময়কার প্রথম প্রতিনিধি। তিনি ইমাম হাদী, ইমাম আসকারী ও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে যাকাত ও খোমস সংগ্রহের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি ১১ বছর বয়স থেকে ইমাম হাদী (আ.)-এর বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভে ধন্য হন। ইমাম হাদী, ইমাম আসকারী ও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আমলে জনগণ এবং ইমামদের মাঝে যোগ সূত্র হিসেবে কাজ করতেন। তার থেকে মাঝে মাঝে জনগণ কেরামতিও লক্ষ্য করেছেন। পূর্বেও বলা হয়েছে তিনি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রথম ও বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন এবং এর আগেও ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারী (আ.) শিয়াদেরকে তার কাছ থেকে ধর্মীয় ও শরিয়তী বিষয়াদি শিক্ষা নেয়ার জন্য বলতেন। ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারী (আ.) তার ব্যাপারে বলেছেন : আবু ওমর আমাদের বিশ্বাসভাজন ও আস্থাবান, সে যাই বলুক তা সবই আমাদের কথা এবং তোমাদের নিকট যে খবরই পৌঁছাবে তা সবই আমাদের পক্ষ থেকে। ৩১
শাহাদাত
আব্বাসী খলিফাগণ ও উচ্চ পদস্থ কর্মচারিগণ অবগত ছিল যে, আহলে বাইতের ইমামগণ সর্বমোট ১২ জন। তাদের মধ্যে দ্বাদশ ইমাম একটা মেয়াদ কাল অন্তর্ধানে থাকার পর আবির্ভূত হবেন। তিনি অত্যাচারী ও জালিম শাসকদের মূলোৎপাটন করবেন এবং তাদের দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বব্যাপী সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। এ বিষয়টি বিশেষ করে ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারীর আমলে খলিফাদের দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ কারণেই ইমাম আসকারী (আ.)-এর উপর কড়া সতর্ক দৃষ্টি রাখতো এবং চাইতো যাতে ইমাম আসকারী (আ.)-এর কোন সন্তান না হয়। সব দিক দিয়েই তাঁর প্রতি কড়া নজর রাখতো এমনকি কয়েকবার তাঁকে বন্দীও করে। অবশেষে আব্বাসীয় খলিফা মো’তামেদ বুঝতে পারে যে বন্দী করেও ইমামের প্রতি ভালবাসা থেকে মানুষকে দূরে সরানো যাবে না। বরং উত্তরোত্তর ইমামের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও উদ্দীপনা বেড়ে চলছে। অধিকন্তু বন্দীদশা ও কারারুদ্ধতা খেলাফতের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে ফলে বন্দী করে রাখতে আর সাহস পেল না। অতঃপর ইমামকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়। অবশেষে ইমামকে গোপনে বিষ প্রয়োগ করে এবং ইমাম ২৬০ হিজরীর ৮ই রবিউল আউয়াল শাহাদাত বরণ করেন (ইমামের উপর এবং তার পবিত্র বংশের উপর শান্তি বর্ষিত হোক)।
সমাজের উপর ইমামের প্রভাব এবং বিশেষ করে আলাভী ও শিয়াদের ভয়ে আব্বাসীয় খলিফা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। কারণ ইমামকে হত্যা করার গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার নিতান্ত সম্ভাবনা ছিল। ফলে সার্বিকভাবে চেয়েছিল এই অপরাধটি ঢেকে রাখতে। ইবনে সাব্বাগ মালেকী তার লেখা বই “ফুসুলুল মুহিম্মাহ্” এ আবদুল্লাহ্ ইবনে খাকান এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন যে, একজন আব্বাসীয় দরবারী কর্মকর্তা লিখেন :
(…ইমাম আবু মুহাম্মদ হাসান ইবনে আলী আসকারী (আ.)-এর নিহত হওয়ার সময় আব্বাসীয় খলিফা মো’তামেদের এমন এক অবস্থা হয়েছিল যে আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা মোটেই কল্পনা করিনি যে, তৎকালীন খলিফা এবং মুসলিম জাহানের সমগ্র ক্ষমতা তার হাতে সত্ত্বেও কিরূপে তার এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। যখন আবু মুহাম্মদ ইমাম আসকারী (আ.) বিষাক্রান্ত হয়েছিল তখন খলিফার ৫ জন বিশেষ দরবারী ফকীহ্ ইমামের বাড়িতে দ্রুত প্রেরিত হয়েছিল। খলিফা তাদেরকে আদেশ করেন ইমাম যে কাজ ও কথাই বলুক তৎক্ষণাৎ যেন তা খলিফাকে অবগত করা হয়। কয়েকজন সেবক প্রেরণ করে যাতে ইমামের সার্বক্ষনিক পরিচর্যা করা হয়। কাজী বখতিয়ারকে আদেশ দেন ১০ জন বিশ্বস্ত লোক ঠিক করে তাদেরকে সকাল বিকাল দু’বার ইমামের বাড়িতে পাঠিয়ে তার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। দুই অথরা তিনদিন পরে খলিফাকে খবর দেয়া হলো যে ইমামের অবস্থা আশংকাজনক এবং তার ভাল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। খলিফা ইমামের বাড়িতে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখার আদেশ জারী করে। নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ খলিফার আদেশ মতো ইমামের বাড়িতে কড়া নজর রাখলো এবং কয়েকদিন পরেই ইমাম পরলোক গমন করলেন। যখন ইমামের মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো তখন সমগ্র সামাররার অলি-গলি, রাস্তা-ঘাট জনতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সর্বত্র কান্না ও চিৎকার ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। বাজারে দোকান-পাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বনি হাশেম, প্রশাসনিক কর্মচারী ও কর্মকর্তা, সৈন্য ও কমান্ডার, শহরের বিচারপতি, কবি-সাহিত্যিক সহ আপামর জনসাধারণ শোক জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল। সামাররা যেন সেদিন কিয়ামতের মাঠে পরিণত হয়েছিল। যখন লাশ দাফনের সময় হলো তখন খলিফা তার ভাই ঈসা ইবনে মোতাওয়াক্কেলকে জানাজার নামাজ পড়ানোর জন্য পাঠান। যখন জানাজার নামাজ পড়ার জন্য লাশ রাখা হলো ঈসা কাছে গিয়ে ইমামের মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে নিলেন। উপস্থিত জনতা, আব্বাসীয়, আলাভী(আলী বংশীয়), বিচারক, লেখক ও অন্যান্যদেরকে সাক্ষী রেখে বলেন : ইমাম আবু মুহাম্মদ আসকারী এর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। খলিফার অমুক অমুক সহকারী সাক্ষী আছেন।
অতঃপর লাশটি আবৃত করে জানাজার নামাজ পড়ান। তারপর লাশ দাফনের আদেশ দেন। ইমাম আবু মুহাম্মদ হাসান আসকারী (আ.) ২৬০ হিজরীর ৮ ই রবিউল আউয়াল, শুক্রবার মৃত্যু বরণ করেন। ইমামের নিজস্ব ঘর যেখানে পিতা ইমাম হাদী (আ.)-কে দাফন করা হয়েছিল সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। ৩২
উপরের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে ইমাম কেমন পরিবেশে বাস করতেন এবং ইমামকে হত্যার গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার আশংকায় খলিফা আতঙ্কিত ছিল। তার ইচ্ছা এমনও ছিল যে ইমামকে হত্যা করে তা স্বাভাবিক মৃত্যু বলে প্রচার করবে। সত্যিই খলিফাগণ ভালভাবেই বুঝতো যে পবিত্র ইমামদের অস্তিত্ব তাদের ক্ষমতার জন্য বিপদ জনক এবং তাই ইমামদের উপর কড়া নজর রাখতো এবং যত সম্ভব সমাজ ও জনগণ থেকে ইমামকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করতো। পরিশেষে হত্যার পথ বেছে নিয়ে ইমামকে হত্যা করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতো। যদিও বাস্তবে অবস্থা হতো তার প্রতিকূল।
আব্বাসীয় খলিফা মো’তামেদ ইমাম আসকারী (আ.)-কে হত্যা করার পর ইমামের সম্পত্তি ও অর্থ সমূহ ইমামের মা ও ভাই জা’ফরের মাঝে বন্টন করে জনসাধারণকে বুঝাতে চেয়েছিল যে ইমামের কোন সন্তান নেই এবং শিয়াদের আর কোন ইমামই অবশিষ্ট রইলো না। ফলে জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। অন্য দিকে গোপনে লোক নিয়োগ করেছিল সন্ধান চালিয়ে ইমামের পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত সন্তানকে খুঁজে বের করে গ্রেফতার করতে। খলিফার প্রতিনিধিগণ ইমামের পরিবারবর্গের উপর যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করা সত্ত্বেও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর কোন সন্ধান নিতে পারে নি। আল্লাহ্ তা’য়ালা তাঁকে জালিম শাসকদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। যদিও ইমাম মাহ্দী (আ.) জালিম শাসকদের হাত থেকে নিরাপত্তার অভাবে প্রকাশ্যে জনসাধারণ ও সমাজের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আল্লাহর আদেশে লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে যান কিন্তু ইমাম আসকারী (আ.)-এর বিশেষ সাহাবিগণ ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে একাধিকবার দেখেছেন। ইমামের অস্তিত্বের ব্যাপারে তারা নিশ্চিত ছিলেন। এ ব্যাপারে তাদের কোন রকম সন্দেহের অবকাশ ছিলনা। ইমাম আসকারী (আ.)-এর শাহাদাতের পর যখন বাড়ির আঙ্গিনায় জানাজার নামাজ পড়ানোর জন্য জা’ফর ইমামতির লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিয়েছিল তখন ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হন এবং জা’ফরকে সরিয়ে নিজেই পিতার জানাজার নামাজ পড়ান। ৩৩
ইমাম মাহ্দী (আ.) এর স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের যুগে ইমামের মনোনীত নির্দিষ্ট প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শিয়াগণ তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখতেন। ইমাম মাহ্দী (আ.) তাঁর প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই জনগণের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। ইমাম মাহ্দী (আ.) তাঁর বিশেষ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বেশ কিছু অলৌকিক বিষয় প্রকাশ করে ছিলেন যার ফলে ইমামের অনুসারী ও বিশ্বাসীদের সংখ্যা বেড়েই চলছিল।
কোমের এক বিশিষ্ট আলেমের নিকট ইমামের চিঠি
বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ইমাম তাঁর অনুসারী ও সহযোগিদের চিঠি লিখে দিক নির্দেশনা দিতেন। এমনই এক চিঠি কোমের মহান শিয়া ফকীহ্ আলী ইবনে হুসাইন ইবনে বাবুইয়ে কোমীকে লিখেন। চিঠির ভূমিকা নিম্নরূপ :
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمْ اَلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعالَمِين وَ الْعاقِبَةُ لِلمُتَّقِين وَ الْجَنَّةُ لِلمُوحِّدِين وَ النَّارُ لِلمُلحِدِين وَ لاَ عُدوانَ اِلاَّ عَلى الظالِمين وَ لاَ اِلَهَ اِلاَّ اللَّه اَحْسُنُ الْخالِقِين وَ الصَّلوةُ عَلى خَيْرِ خَلْقِهِ مُحَمَّدٍ وَ عِتْرَتِهِ الطاهرين
– মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি যিনি পরম দাতা ও দয়ালু, সকল প্রশংসা তার জন্যই যিনি সারা জাহানের প্রতিপালক। পরকালের মঙ্গল মুত্তাকিদের জন্য, বেহেশত একত্ববাদীদের জন্য ও দোযখের আগুন কাফেরদের (মুরতাদ) জন্য। প্রকাশ্য দুশমনি ও যুদ্ধ শুধুমাত্র জালিমদের জন্য। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন উত্তম সৃষ্টিকর্তা নেই। মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের উপর দরূদ ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।
আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তনের পর তোমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছি, তিনি তোমাকে একটি শ্রেষ্ঠ সন্তান দান করুক। নামাজ কায়েম করা, যাকাত আদায় করা ও পরহেজগারীতার জন্য তোমাকে আদেশ করছি (কারণ যাকাত না দিলে তার নামাজ কবুল হয় না)। তোমাকে আরও আদেশ করছি যে, মানুষের ভুল ভ্রান্তি ক্ষমা করে দিবে, নিজের ক্রোধ দমন করবে, আত্মীয় স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলবে, তাদের সুসময়ে ও দুঃসময়ে সহযোগিতা করবে। অজ্ঞ ও মুর্খদের প্রতি নম্র ও সহনশীল থাকবে, সচ্চরিত্রতা, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে। আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেন :
لاَ خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْويَهُمْ اِلاَّ مَنْ اَمَرَ بِصَدقَةٍ اَوْ مَعْرُوفٍ اَوْ اِصْلاحٍ بَيْنَ النَّاسِ
– একমাত্র যারা মানুষকে ছদকা, সৎ কাজ ও মানুষের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করার আদেশ দেয় তারা ব্যতীত অধিকাংশ লোকের কথায় কোন মঙ্গল নেই। (সূরা নিসা : ১১৪)
সব ধরণের অন্যায় ও অপকর্ম থেকে বিরত থাকবে, তাহাজ্জুত নামাজ পড়বে ঠিক যেমনটি মুহাম্মদ (সা.) আলী (আ.)-কে তাহাজ্জুত নামাজ পড়ার জন্য তাগিদ দিয়ে বলতেন, আমিও তোমাকে তা পড়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছি।
يا عَلىُّ عَلَيْكَ بِصَلَوةِ الْليْلِ، عَلَيْكَ بِصَلَوةِ الْليْلِ، عَلَيْكَ بِصَلَوةِ الْليْلِ وَ مَنْ اسْتَحَفَّ بِصَلَوةِ الْلَيْلِ فَلَيْسَ مِنَّا
– হে আলী! তাহাজ্জুত নামাজের প্রতি যত্নবান হও, তাহাজ্জুত নামাজের প্রতি যত্নবান হও, তাহাজ্জুত নামাজের প্রতি যত্নবান হও। যে ব্যক্তি তাহাজ্জুতের প্রতি গুরুত্ব দেয় না সে আমাদের মধ্যে শামিল নয়।
অতএব, আমার নির্দেশনানুসারে আমল কর এবং ঠিক যেভাবে তোমাকে আমল করার জন্য পরামর্শ দিলাম আমার অনুসারীদেরকেও সেভাবে আমল করতে বল। ছবর ও ধৈর্য ধারণ কর এবং শেষ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের প্রত্যাশায় অধীর অপেক্ষায় থাকবে, এ ব্যাপারে মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন : আমার উম্মতের জন্য শ্রেষ্ঠ আমল হল “ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর জন্য প্রতীক্ষা করা।” আমার সন্তান ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের অনুসারিগণ দুঃখ বেদনায় নিমজ্জিত থাকবে। অতঃপর যেমন রাসূল (সা.) সুখবর দিয়েছেন জুলুম ও নির্যাতনে ভরপুর পৃথিবীকে ইমাম মাহ্দী ন্যায় বিচার ও শান্তিতে পরিপূর্ণ করবে। ৩৮
হে আমার বিশ্বাসভাজন মহান আবুল হাসান, নিজেও ধৈর্যাবলম্বন কর এবং আমার অনুসারীদেরকেও ধৈর্যের পরামর্শ দাও, আল্লাহর জমিনে তাঁর বান্দাদেরই রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। পরকালের শান্তি পরহেজগারদের জন্যই। আমার সালাম, আল্লাহর শান্তি ও বরকত আমার অনুসারী এবং তোমার উপর বর্ষিত হোক।
وَ حَسْبُنا اللَّهُ وَ نِعْمَ الوَكيلْ نِعْمَ المَولىَ وَ نِعْمَ النَّصير ৩৯
মুজেজা ও অদৃশ্য জগতের সাথে ইমামের সম্পর্ক
ইমাম আসকারী (আ.)-এর পূর্ব পুরুষ ও ইমামগণ মহান আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের কারণে অদৃশ্য জগত ও ফেরেস্তাগণের উপর জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ করেছিলেন। ইমামও এরূপ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। ইমামের অসংখ্য মুজেজা ও অলৌকিক কর্মকান্ডের বিবরণ দিতে গেলে পৃথক একটি বই লেখার প্রয়োজন হবে। আমরা এখানে এর কয়েকটি নমুনা পেশ করবো মাত্র।
১.আবু হাশেম জা’ফরী বলেন : একদা চেয়েছিলাম ইমাম আসকারী (আ.)-এর কাছে একটি আংটি তৈরী করার মতো কিছু পরিমান রৌপ্য সাহায্য চাইবো। ইমামের সাক্ষাতে গেলাম, বসলাম কিন্তু যে উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম বেমালুম ভুলে গেলাম। অতঃপর যখন আসার জন্য রওনা হলাম ইমাম আমাকে একটি আংটি দিয়ে বললেন, “রৌপ্য চেয়েছিলে আমি তোমাকে দিলাম এবং আংটির পাথর মুজুরী অতিরিক্ত লাভ হিসাবে পেলে। তোমার মঙ্গল হোক।
বললাম : হে আমার মাওলা, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর ওলি ও আমার ইমাম। আপনার অনুসরণ আমার দ্বীনেরই কর্তব্য।
বললেন : হে আবুল হাসেম, আল্লাহ্ তোমাকে ক্ষমা করুক। ৪০
২.সাবলানজী আবু হাশেম জা’ফরীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন : এক সময় আমি এবং আরও চারজন লোক সালেহ ইবনে ওয়াসিফের কারাগারে বন্দী ছিলাম। একদিন ইমাম আসকারী (আ.) ও তাঁর ভাই জা’ফর কারাগারে প্রবেশ করলেন। আমরা ইমামের খেদমত করার জন্য ইমামের চার পাশে অবস্থান নিলাম। বনি জাম গোত্রের এক ব্যক্তি আমাদের সাথে ছিল সে নিজেকে আলী (আ.)-এর বংশধর বলে দাবি করতো। ইমাম আমাদের বললেন যদি তোমাদের মাঝে তোমাদের ঘনিষ্ট লোক ব্যতীত অন্য কেহ না থাকতো তাহলে বলে দিতাম কখন তোমরা মুক্তি পাবে। অতঃপর ঐ লোকটিকে বাহিরে যাওয়ার ইঙ্গিত করলেন। লোকটি বাইরে চলে গেলে ইমাম বললেন : এই লোকটি তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নয় তার থেকে সাবধান থাকবে। এ পর্যন্ত তোমরা যা বলেছ সব তথ্যই খলিফাকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে সে লিখে রেখেছে এবং তা এখনও তার পোশাকের ভিতর লুকায়িত আছে। আমাদের কয়েকজন তাকে তল্লাশী চালিয়ে তার পোশাকের ভিতর থেকে লুকায়িত তথ্য সমূহ কেড়ে নিলো। তখন বুঝতে পারলাম সত্যই বিপদজনক অনেক তথ্যই সে লিখে রেখেছে …। ৪১
৩.মুহাম্মদ ইবনে রাবি শাইবানী বলেন : একবার আহ্ওয়াজে এক দ্বিত্ববাদীর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলাম অতঃপর সামাররা গিয়ে পৌঁছলাম। ঐ দ্বিত্ববাদীর যুক্তির কিছু প্রভাব আমার উপর পড়েছিল। ফলে একত্ববাদের উপর কিছু সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। একদিন আহমদ ইবনে খোসাইব এর বাড়িতে বসে ছিলাম এমন সময় ইমাম আসকারী (আ.) এক সভা থেকে এলেন, আমাকে লক্ষ্য করে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বললেন, اَحَدٌ اَحَدٌ فَوحِّدهُ» «আল্লাহ্ এক আল্লাহ্ এক এবং তাকে অদ্বিতীয় মেনে নাও। আমি বেহুশ হয়ে পড়লাম। ৪২
৪.ইসমাইল ইবনে মুহাম্মদ বলেন : একদিন ইমাম আসকারী (আ.)-এর বাড়ির দরজায় বসে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যখন তিনি বাইরে এলেন তাঁর সামনে গিয়ে আমার দুঃখ দুর্দশার কথা জানিয়ে অভিযোগ করলাম এবং কসম খেয়ে বললাম আমার এমন অবস্থা যে একটি দিরহামও আমার কাছে নেই।
ইমাম বললেন : কসম খেয়ে ফেললে অথচ ২০০ দিরহাম মাটির নিচে পুঁতে রেখে এসেছো!
অতঃপর বললেন : এ কথা বললাম বলে তোমাকে সাহায্য করব না এমন নয়। এরপর তিনি তার ভৃত্যকে ইশারা করে বললেন, তোমার কাছে যা আছে তা ইসমাইলকে দিয়ে দাও। ভৃত্যটি আমাকে ১০০ দিনার দিলো। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিলাম। এমন সময় ইমাম বললেন আমার ভয় হয় যখন ঐ ২০০ দিরহাম তোমার খুব প্রয়োজন পড়বে তখন ওটাকে আর পাবে না।
আমি ফিরে এসে দিনারগুলি যেখানে পুঁতে রেখেছিলাম তুলে নিয়ে জায়গা পরিবর্তন করে এমনভাবে লুকিয়ে রাখলাম যাতে কেউ খুঁজে না পায়। কিছু দিন পর আমার অর্থের প্রয়োজন পড়লে ঐ দিনারগুলো যেখানে লুকিয়ে রেখেছিলাম তা উঠিয়ে আনতে গেলাম কিন্তু একটি দিরহামও সেখানে পেলাম না। আমার আক্কেল সেলামি হলো। পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার ছেলে ওখান থেকে সবগুলো দিনার তুলে নিয়েছিল এবং তার এক দিনারও আমার হাতে আর ফিরে আসে নি। ঠিক যেমন ইমাম বলেছিলেন। ৪৩
৫.মুহাম্মদ ইবনে আইয়াশ বলেন : একদিন আমরা কয়েকজন একত্রে বসে ইমাম আসকারী (আ.)-এর মুজেজা সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। আমাদের মাঝে এক নাসেবী ছিল সে বললো আমি কয়েকটা প্রশ্ন একটা কাগজের উপর কালি বিহীন কলমে লিখবো। যদি ইমাম জবাব দিতে পারেন তাহলে বিশ্বাস করবো তিনি সত্যিকার ইমাম। আমরা সে কথা মত কতগুলো বিষয় লিখলাম নাসেবীও কালি বিহীন কলমে তার প্রশ্নগুলো লিখলো। আমরা সেগুলো ইমাম আসকারী (আ.)-এর নিকট পাঠালাম। ইমাম সবগুলো প্রশ্নের উত্তর লিখে পাঠালেন এবং নাসেবীর কাগজের উপর তার নাম, তার পিতার নাম, তার মাতার নাম লিখে পাঠালেন। নাসেবী তা দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। তার হুশ ফিরে আসার পর ইমামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলো। এরপরে সে ইমামের একনিষ্ঠ অনুসারীদের মধ্যে শামিল হলো। ৪৪
৬.ওমর ইবনে আবি মুসলেম বলেন : সামিউম মুসমায়ি আমার এক প্রতিবেশী, যার বাড়ী আমার বাড়ির দেয়ালের সাথে লাগানো ছিল। সে আমাকে অত্যন্ত জ্বালাতন করতো। আমি চিঠি লিখে ইমামকে এ ব্যাপারে দোয়া করতে অনুরোধ করলাম। তিনি জবাবে লিখলেন : অতি শীঘ্রই তোমার দুঃখ বেদনা লাঘব হবে এবং তুমি উক্ত প্রতিবেশীর বাড়ির মালিক হবে।
একমাস পরেই লোকটি মারা গেল এবং আমি বাড়িটি কিনে নিলাম ও ইমামের দোয়ার বরকতে ঐ বাড়িটি আমার বাড়ির সাথে সংযুক্ত হলো। ৪৫
৭.আবু হামজা বলেন : অনেকবার দেখেছি ইমাম তার ভৃত্যদের (যারা বিভিন্ন দেশী তুর্কী, রোমীয়, দাইলামী ও অন্যান্য ভাষাভাষী ছিল) সাথে তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলতেন। আমি অবাক হয়ে যেতাম এবং মনে মনে বলতাম… ইমাম মদীনায় জন্মগ্রহণ করেছেন… অথচ কিভাবে তিনি এত ভাষায় কথা বলেন; ইমাম আমার দিকে ফিরে বললেন : মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রতিনিধিদের অন্যান্য সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং সব কিছুর উপর জ্ঞান দান করেছেন। ইমামগণ বিভিন্ন ভাষা, বিভিন ব্যক্তির বংশ পরিচয় ও ভবিষ্যতের ঘটনাবলী সম্পর্র্কে সম্যক অবগত থাকেন। যদি এরকম না হতো তাহলে সাধারণ মানুষ ও ইমামদের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকতো না। ৪৬
ইমাম আসকারী (আ.)-এর কিছু বাণী
১. «عَلَيْكَ بِالْاَقْتِصادِ وَ اِياَّكَ وَ الْاِسْرافَ»
মিতব্যয়ী হও এবং অপচয় ও অপব্যয় করো না। ৪৭
ইমাম যখন ছোট ছিলেন এক ব্যক্তি দেখলেন কিছু ছেলে খেলাধুলায় মগ্ন আর ইমাম পাশে বসে কাঁদছেন। লোকটি ভাবলেন হয়তো অন্যান্য ছেলেদের মত খেলাধুলা করতে পারছে না বলে ইমাম কাঁদছেন। জিজ্ঞেস করলেন : তোমাকে কি কিছু খেলনা কিনে দেব?
ইমাম বললেন : » « يا قَليلَ الْعَقْلِ ما لِلَّعِبِ خُلِقْنا হে অল্প বিদ্যার অধিকারী, আমাদেরকে খেলাধুলার জন্য সৃষ্টি করা হয় নি।
লোকটি জিজ্ঞেস করলো : তাহলে কিজন্য সৃষ্ট হয়েছো ?
বললেন : » لِلْعِلْمِ وَ الْعِبادَةِ « জ্ঞানার্জন ও ইবাদতের জন্য।
জিজ্ঞেস করলো : একথা কোথায় পেয়েছো ?
বললেন : মহান আল্লাহর বাণী থেকে। যেমন কোরআনে উল্লিখিত আছে :
» اَفَحَسِبْتُمْ انَّما خَلَقْناكُمْ عَبَثاً وَ اَنَّكُمْ اِلَيْنا لاَ تُرْجَعُونَ «
আমরা কি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা কি আমাদের নিকট কি প্রত্যাবর্তন করবে না। ৪৮
২. » لاَ تُمارِ فَيَذْهَبُ بَهاَؤُكَ وَ لاَ تُمازِحْ فَيُجْتَرَئُ عَلَيْكَ «
ঝগড়াঝাটি করো না তাহলে মানসম্মান থাকবেনা, ঠাট্টা (ইয়ার্কি) করো না তাহলে অন্যরা সাহস পেয়ে যাবে। ৪৯
৩. » مِنَ التَّواضُعِ السَّلامُ عَلَى كُلِّ مَنْ تَمُرُّبِهِ وَ الْجُلُوسُ دُونَ شَرَفِ الْمَجْلِس «
সবাইকে (যার সাথেই দেখা হোক) সালাম করা এবং সভা সমাবেশের নিচে ও পিছনে বসা বিনয় ও নম্রতার লক্ষণ। ৫০
৪. » اِذا نَشَطَتِ الْقُلُوبُ فَاَوْدِعُوها وَ اِذا نَفَرَتْ فَوَدِّعُوها «
যখন মন উৎফুল্ল থাকে তখন জ্ঞানার্জন কর, আর যখন বিষণ্ন থাকে তখন বিরত থাকো।৫০
৫. » لَيْسَ مِنَ الْاَدَبِ اِظْهارُ الْفَرَحِ عِنْدَ الْمَحْزُونِ «
শোকার্ত লোকের সামনে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করা অভদ্রতার লক্ষণ। ৫১
৬. » اَلتَّواضُعُ نِعْمَةُ لاَ يُحْسَدُ عَلَيْها «
বিনয় এমন এক নিয়ামত যে, বিনয়ীর প্রতি কেহই ঈর্ষা করে না।স ৫২
৭. » مَنْ وَعَظَ اَخاهُ سِرّاً فَقَدْ زانَهُ وَ مَنْ وَعَظَهُ عَلانِيَةً فَقَدْ شانَهُ «
যে ব্যক্তি কাউকে গোপনে উপদেশ দেয় সে তাকে অলংকৃত করলো, আর যে ব্যক্তি সকলের সামনে প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করলো (উপদেশ দিলো) শুধু তার বদনামই করলো সংশোধন করতে পারলো না। ৫৩
৮. » كَفاكَ اَدَباً لِنَفْسِكَ تَجَنُّبُكَ ما تَكْرَهُ مِنْ غَيْرِكَ «
অন্যের যে কাজ তোমার অপছন্দ যদি তা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পার তাই তোমার আত্মশুদ্ধির জন্য যথেষ্ট। ৫৪
৯. » حُسْنُ الصُّورَةِ جمالٌ ظاهِرٌ وَ حُسْنُ الْعَقْلِ جَمالٌ باطِنٌ «
চেহারার সৌন্দর্য কেবলমাত্র বাহ্যিক কিন্তু জ্ঞানের সৌন্দর্য অন্তরেও বিদ্যমান। ৫৫
১০. » اِنَّ الْوُصُولَ اِلىَ اللَّهِ عَزَّوَجَلَّ سَفَرٌ لاَ يُدْرِكُ اِلاَّ بِاسْتِطاءِ اللَّيْلِ «
আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে হলে এমন এক সফর (ভ্রমন) করতে হবে যেখানে রাত্রি জাগরণ ব্যতীত বিকল্প কোন রাস্তা নেই। ৫৬
১১. » جُعِلَتِ الْخَبائِثُ فِي بَيْتٍ وَ الْكِذْبُ مِفاتيحُها «
অপবিত্রতাসমূহ একটি ঘরে একত্রিত করা হয়েছে যাদের চাবি হচ্ছে মিথ্যা। ৫৭
১২. » اِنَّ لِلْجُودِ مِقْداراً فَاِذا زادَ عَلَيْهِ فِهوَ سَرَفٌ «
দান করারও একটা পরিমান আছে যদি তা লংঘন করা হয় তা হবে অপচয়। ৫৮
১৩. » وَ اِنَّ لِلْحَزْمِ مِقْداراً فَاِذا زادَ عَلَيْهِ فَهُوَ جُبْنٌ «
সংযমেরও একটা সীমা আছে যদি তা অতিক্রম করা হয় তাহলে তা ভীতি বলে গণ্য। ৫৯
ইমামের কয়েকজন সহযোগী
শাসকদের দ্বারা সৃষ্ট শ্বাস রুদ্ধকর পরিবেশ ও ইমামের উপর কড়া নজর থাকার কারণে ইমামের সহযোগীদের সংখ্যা নিতান্ত কম হলেও যারা ইমামের বিশেষ সান্নিধ্য লাভ করতে পেরেছে তারাই মহান দীনী ব্যক্তিত্ব ও পরহেজগার আলেমে পরিণত হয়েছেন। তাদের কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরবো :
১.আহমাদ ইবনে ইসহাক আশআরী কোমী : তিনি কোমের মহান ব্যক্তিদের মধ্যে ইমামের একজন বিশেষ সহযোগী ও প্রতিনিধি ছিলেন। কোমবাসীদের বিভিন্ন বিষয়ের সমস্যামূলক প্রশ্নাদি ইমামের কাছে নিয়ে যেতেন এবং ইমামের কাছ থেকে প্রাপ্ত জবাব কোমবাসীদের নিকট পৌঁছে দিতেন। তিনি ইমাম জাওয়াদ ও ইমাম হাদী (আ.)-এরও সাহাবী ছিলেন। এই দুই ইমামের কাছ থেকেও হাদীস বর্ণনা করেছেন। ৬০
“আহমাদ ইবনে ইসহাক” হুসাইন ইবনে রুহ নওবাখতী (ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময়ের তৃতীয় বিশেষ প্রতিনিধি) এর কাছে হজ্বে যাওয়ার জন্য অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখেন। হজ্বের অনুমতিপত্রের সাথে কিছু পরিমান কাপড়ও হস্তগত হলো। আহমাদ বললো আমার মৃত্যু সংবাদ এসেছে (যে কাপড়টি পাঠানো হয়েছিল তা ছিল কাফনের কাপড় এটা দেখেই সে বুঝে নিয়েছিল তার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে) এবং হজ্ব থেকে ফেরার পথে হালওয়ান যার বর্তমান নাম পুলে জাহাব সেখানে তার মৃত্যু হয়। ৬১
“সাদ ইবনে আব্দুল্লাহ্” আহমাদ ইবনে ইসহাকের মৃত্যু সম্পর্কে বলেন: হালওয়ানে পৌঁছার তিন ফারসাখ (এক ফারসাখ = ৬.২৪ কি.মি.) পূর্বেই তার জ্বর হয় এবং মারাত্বক অসুস্থ হয়ে পড়েন ফলে আমরা নিরাশ হয়ে পড়লাম। বুঝতে পারলাম সে আর বাঁচবে না। যখন হালওয়ানে পৌঁছালাম সরাই খানায় আশ্রয় নিলাম। আহমদ বললো আজ রাতে আমাকে একা থাকতে দাও তোমরা তোমাদের গন্তব্যে চলে যাও। সবাই চলে গেলেও আমি গেলাম না। ফজর নামাজের ঠিক পূর্বে জেগে দেখি ইমাম আসকারী (আ.)-এর খাদেম কাফুর সেখানে উপস্থিত। সে বললো :
اَحْسَنَ اللَّهُ بالْخَيْرِ عَزائَكُمْ وَ جَبَرَ بِالْمَحْبوبِ رَزِيَّتَكُمْ » «
– আল্লাহ্ তোমার মঙ্গল করুন এবং তোমার ঊপর আপতিত এই মুসিবতের প্রতিদান স্বরূপ উত্তম পুরস্কার দান করুন।
অতঃপর বললেন : তোমার সাথী আহমাদের গোসল ও কাফন সম্পন্ন হয়েছে। এখন যাও তার দাফনের ব্যবস্থা কর। সত্যিই আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের কারণে ইমামের দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে আহমাদ শ্রেষ্ঠ ছিল। একথা বলে কাফুর অদৃশ্য হয়ে গেল। ৬২
২.আবু হাশেম দাউদ ইবনুল কাসেম জা’ফরী : তিনি জনাব জা’ফর তাইয়ার এর বংশধর এবং তার বংশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বাগদাদে বসবাস করতেন। ইমামদের কাছে তার যথেষ্ট মূল্য ও কদর ছিল। তিনি ইমাম জাওয়াদ, ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারী (আ.)-এর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং মাহ্দী (আ.) এর বিশেষ উকিল ও বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন।
আবু হাশেম ইমামদের খুব ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ সাথিদের মধ্যে পরিগণিত। ইমামদের হতে প্রচুর হাদিস তিনি বর্ণনা করেন এবং এ সম্পর্কিত একটি বইও লিখেন। শিয়াদের প্রসিদ্ধ আলেমগণ তার এ বইয়ের প্রশংসা ও তা থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। ৬৩
আবু হাশেম একজন স্বাধীনচেতা, অকুতোভয় ও সাহসী লোক ছিলেন। যখন ইয়াহিয়া ইবনে ওমর জায়দী২৮ এর কর্তিত মাথা বাগদাদের গর্ভণর মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ তাহের এর নিকট নিয়ে আসা হয় অনেকেই তখন এ ঘটনাকে মহা বিজয় উল্লেখ করে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। আবু মুহাম্মদ গভর্ণরের কাছে গিয়ে সম্মান ও সম্বোধন ব্যতীরেকেই বললেন : হে আমির, তোমাকে এমন এক বিষয়ে সম্বর্ধনা জানাতে এসেছি যদি রাসূল (সা.) এখন জীবিত থাকতেন তার জন্য শোক প্রকাশ করতেন। গভর্ণর আবু হাশেমের এ কথার কোন প্রকার জবাব দিল না। ৬৪
৩. আবদুল্লাহ্ ইবনে জা’ফর হামিরী : তিনি কোম শহরের এক মহান ব্যক্তি এবং ইমাম আসকারী (আ.)-এর বিশিষ্ট সঙ্গীদের একজন। তিনি অনেক বই লেখেন এর মধ্যে “কুরবুল আসনাদ” আজও পর্যন্ত মহান শিয়া আলেম ও ফকীহদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। আবদুল্লাহ্ ইবনে জা’ফর ২৯০ হিজরীতে কুফায় গমন করেন। কুফার জনগণ তার কাছ থেকে হাদিস শিক্ষা নিত। ৬৫
৪. আবু আমর ও উসমান ইবনে যাইদ আমরী : ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময়কার প্রথম প্রতিনিধি। তিনি ইমাম হাদী, ইমাম আসকারী ও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে যাকাত ও খোমস সংগ্রহের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি ১১ বছর বয়স থেকে ইমাম হাদী (আ.)-এর বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভে ধন্য হন। ইমাম হাদী, ইমাম আসকারী ও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আমলে জনগণ এবং ইমামদের মাঝে যোগ সূত্র হিসেবে কাজ করতেন। তার থেকে মাঝে মাঝে জনগণ কেরামতিও লক্ষ্য করেছেন। পূর্বেও বলা হয়েছে তিনি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রথম ও বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন এবং এর আগেও ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারী (আ.) শিয়াদেরকে তার কাছ থেকে ধর্মীয় ও শরিয়তী বিষয়াদি শিক্ষা নেয়ার জন্য বলতেন। ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারী (আ.) তার ব্যাপারে বলেছেন : আবু ওমর আমাদের বিশ্বাসভাজন ও আস্থাবান, সে যাই বলুক তা সবই আমাদের কথা এবং তোমাদের নিকট যে খবরই পৌঁছাবে তা সবই আমাদের পক্ষ থেকে। ৬৬
শাহাদাত
আব্বাসী খলিফাগণ ও উচ্চ পদস্থ কর্মচারিগণ অবগত ছিল যে, আহলে বাইতের ইমামগণ সর্বমোট ১২ জন। তাদের মধ্যে দ্বাদশ ইমাম একটা মেয়াদ কাল অন্তর্ধানে থাকার পর আবির্ভূত হবেন। তিনি অত্যাচারী ও জালিম শাসকদের মূলোৎপাটন করবেন এবং তাদের দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বব্যাপী সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। এ বিষয়টি বিশেষ করে ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারীর আমলে খলিফাদের দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ কারণেই ইমাম আসকারী (আ.)-এর উপর কড়া সতর্ক দৃষ্টি রাখতো এবং চাইতো যাতে ইমাম আসকারী (আ.)-এর কোন সন্তান না হয়। সব দিক দিয়েই তাঁর প্রতি কড়া নজর রাখতো এমনকি কয়েকবার তাঁকে বন্দীও করে। অবশেষে আব্বাসীয় খলিফা মো’তামেদ বুঝতে পারে যে বন্দী করেও ইমামের প্রতি ভালবাসা থেকে মানুষকে দূরে সরানো যাবে না। বরং উত্তরোত্তর ইমামের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও উদ্দীপনা বেড়ে চলছে। অধিকন্তু বন্দীদশা ও কারারুদ্ধতা খেলাফতের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে ফলে বন্দী করে রাখতে আর সাহস পেল না। অতঃপর ইমামকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়। অবশেষে ইমামকে গোপনে বিষ প্রয়োগ করে এবং ইমাম ২৬০ হিজরীর ৮ই রবিউল আউয়াল শাহাদাত বরণ করেন (ইমামের উপর এবং তার পবিত্র বংশের উপর শান্তি বর্ষিত হোক)।
সমাজের উপর ইমামের প্রভাব এবং বিশেষ করে আলাভী ও শিয়াদের ভয়ে আব্বাসীয় খলিফা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। কারণ ইমামকে হত্যা করার গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার নিতান্ত সম্ভাবনা ছিল। ফলে সার্বিকভাবে চেয়েছিল এই অপরাধটি ঢেকে রাখতে। ইবনে সাব্বাগ মালেকী তার লেখা বই “ফুসুলুল মুহিম্মাহ্” এ আবদুল্লাহ্ ইবনে খাকান এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন যে, একজন আব্বাসীয় দরবারী কর্মকর্তা লিখেন :
(…ইমাম আবু মুহাম্মদ হাসান ইবনে আলী আসকারী (আ.)-এর নিহত হওয়ার সময় আব্বাসীয় খলিফা মো’তামেদের এমন এক অবস্থা হয়েছিল যে আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা মোটেই কল্পনা করিনি যে, তৎকালীন খলিফা এবং মুসলিম জাহানের সমগ্র ক্ষমতা তার হাতে সত্ত্বেও কিরূপে তার এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। যখন আবু মুহাম্মদ ইমাম আসকারী (আ.) বিষাক্রান্ত হয়েছিল তখন খলিফার ৫ জন বিশেষ দরবারী ফকীহ্ ইমামের বাড়িতে দ্রুত প্রেরিত হয়েছিল। খলিফা তাদেরকে আদেশ করেন ইমাম যে কাজ ও কথাই বলুক তৎক্ষণাৎ যেন তা খলিফাকে অবগত করা হয়। কয়েকজন সেবক প্রেরণ করে যাতে ইমামের সার্বক্ষনিক পরিচর্যা করা হয়। কাজী বখতিয়ারকে আদেশ দেন ১০ জন বিশ্বস্ত লোক ঠিক করে তাদেরকে সকাল বিকাল দু’বার ইমামের বাড়িতে পাঠিয়ে তার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। দুই অথরা তিনদিন পরে খলিফাকে খবর দেয়া হলো যে ইমামের অবস্থা আশংকাজনক এবং তার ভাল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। খলিফা ইমামের বাড়িতে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখার আদেশ জারী করে। নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ খলিফার আদেশ মতো ইমামের বাড়িতে কড়া নজর রাখলো এবং কয়েকদিন পরেই ইমাম পরলোক গমন করলেন। যখন ইমামের মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো তখন সমগ্র সামাররার অলি-গলি, রাস্তা-ঘাট জনতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সর্বত্র কান্না ও চিৎকার ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। বাজারে দোকান-পাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বনি হাশেম, প্রশাসনিক কর্মচারী ও কর্মকর্তা, সৈন্য ও কমান্ডার, শহরের বিচারপতি, কবি-সাহিত্যিক সহ আপামর জনসাধারণ শোক জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল। সামাররা যেন সেদিন কিয়ামতের মাঠে পরিণত হয়েছিল। যখন লাশ দাফনের সময় হলো তখন খলিফা তার ভাই ঈসা ইবনে মোতাওয়াক্কেলকে জানাজার নামাজ পড়ানোর জন্য পাঠান। যখন জানাজার নামাজ পড়ার জন্য লাশ রাখা হলো ঈসা কাছে গিয়ে ইমামের মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে নিলেন। উপস্থিত জনতা, আব্বাসীয়, আলাভী(আলী বংশীয়), বিচারক, লেখক ও অন্যান্যদেরকে সাক্ষী রেখে বলেন : ইমাম আবু মুহাম্মদ আসকারী এর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। খলিফার অমুক অমুক সহকারী সাক্ষী আছেন।
অতঃপর লাশটি আবৃত করে জানাজার নামাজ পড়ান। তারপর লাশ দাফনের আদেশ দেন। ইমাম আবু মুহাম্মদ হাসান আসকারী (আ.) ২৬০ হিজরীর ৮ ই রবিউল আউয়াল, শুক্রবার মৃত্যু বরণ করেন। ইমামের নিজস্ব ঘর যেখানে পিতা ইমাম হাদী (আ.)-কে দাফন করা হয়েছিল সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। ৬৭
উপরের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে ইমাম কেমন পরিবেশে বাস করতেন এবং ইমামকে হত্যার গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার আশংকায় খলিফা আতঙ্কিত ছিল। তার ইচ্ছা এমনও ছিল যে ইমামকে হত্যা করে তা স্বাভাবিক মৃত্যু বলে প্রচার করবে। সত্যিই খলিফাগণ ভালভাবেই বুঝতো যে পবিত্র ইমামদের অস্তিত্ব তাদের ক্ষমতার জন্য বিপদ জনক এবং তাই ইমামদের উপর কড়া নজর রাখতো এবং যত সম্ভব সমাজ ও জনগণ থেকে ইমামকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করতো। পরিশেষে হত্যার পথ বেছে নিয়ে ইমামকে হত্যা করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতো। যদিও বাস্তবে অবস্থা হতো তার প্রতিকূল।
আব্বাসীয় খলিফা মো’তামেদ ইমাম আসকারী (আ.)-কে হত্যা করার পর ইমামের সম্পত্তি ও অর্থ সমূহ ইমামের মা ও ভাই জা’ফরের মাঝে বন্টন করে জনসাধারণকে বুঝাতে চেয়েছিল যে ইমামের কোন সন্তান নেই এবং শিয়াদের আর কোন ইমামই অবশিষ্ট রইলো না। ফলে জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। অন্য দিকে গোপনে লোক নিয়োগ করেছিল সন্ধান চালিয়ে ইমামের পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত সন্তানকে খুঁজে বের করে গ্রেফতার করতে। খলিফার প্রতিনিধিগণ ইমামের পরিবারবর্গের উপর যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করা সত্ত্বেও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর কোন সন্ধান নিতে পারে নি। আল্লাহ্ তা’য়ালা তাঁকে জালিম শাসকদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। যদিও ইমাম মাহ্দী (আ.) জালিম শাসকদের হাত থেকে নিরাপত্তার অভাবে প্রকাশ্যে জনসাধারণ ও সমাজের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আল্লাহর আদেশে লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে যান কিন্তু ইমাম আসকারী (আ.)-এর বিশেষ সাহাবিগণ ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে একাধিকবার দেখেছেন। ইমামের অস্তিত্বের ব্যাপারে তারা নিশ্চিত ছিলেন। এ ব্যাপারে তাদের কোন রকম সন্দেহের অবকাশ ছিলনা। ইমাম আসকারী (আ.)-এর শাহাদাতের পর যখন বাড়ির আঙ্গিনায় জানাজার নামাজ পড়ানোর জন্য জা’ফর ইমামতির লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিয়েছিল তখন ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হন এবং জা’ফরকে সরিয়ে নিজেই পিতার জানাজার নামাজ পড়ান। ৬৮
ইমাম মাহ্দী (আ.) এর স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের যুগে ইমামের মনোনীত নির্দিষ্ট প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শিয়াগণ তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখতেন। ইমাম মাহ্দী (আ.) তাঁর প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই জনগণের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। ইমাম মাহ্দী (আ.) তাঁর বিশেষ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বেশ কিছু অলৌকিক বিষয় প্রকাশ করে ছিলেন যার ফলে ইমামের অনুসারী ও বিশ্বাসীদের সংখ্যা বেড়েই চলছিল।
তথ্যসূত্র :
১ । কারণ ঐ এলাকায় আব্বাসীয় শাসনকর্তাদের সৈন্যরা বসবাস করতো বলে ঐ এলাকা আসকার নামে প্রসিদ্ধ ছিল। কেননা আসকার এর অর্থই হচ্ছে সৈন্যবাহিনী। (দ্র. আখবারুল বাশার ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৮)।
২। বিহারুল আনওয়ার, ৫০তম খণ্ড, পৃ. ২৩৫-২৩৯ ও ৩২৫।
৩। ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নাম স্মরণ করার ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সাম্প্রতিক কালের কিছু আলেমদের (শেখ আনসারী, মোল্লা মুহাম্মদ কাযেম খোরাসানী, সাইয়্যেদ মুহাম্মদ কাযেম ইয়াযদী ) মতে তাঁর নাম উচ্চারণ করা মাকরূহ্, ভূতপূর্ব আলেমগনের (শেখ তুসি, শেখ মুফিদ ও …) মতে হারাম এবং অন্যান্য আলেমদের ( হাজী নূরী ও মুহাক্কেক দামাদ) মতে শুধুমাত্র মজলিস ও সভাসমুহে উচ্চারণ হারাম। মরহুম হাজী নূরী বলেন : খাজা নাসিরুদ্দিন তুসির আমল পর্যন্ত শিয়া আলেমদের নিকট সন্দেহাতীত ও সুনিশ্চিতভাবে হারাম ছিল এবং শেখ বাহায়ী এর আমল থেকে এ ব্যাপারে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে (দ্রঃ নাজমুস্সাকেব, পৃ. ৪৮)।
৪। কামালুদ্দীন, শেখ সাদুক, পৃ. ৩৮১।
৫। কামালুদ্দীন, শেখ সাদুক, পৃ. ৩৮৩।
৬। এরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ৩১৫।
৭। আ’লামুল ওয়ারা, পৃ. ৩৭০।
৮। এরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ৩১৭।
৯। মোরুজুয যাহাব, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৯১-৯৫; তাতিম্মাতুল মুনতাহা, পৃ. ২৫৪।
১০। এরশাদ, শেখ মুুফিদ, পৃ. ৩২৪।
১১। তাতিম্মাতুল মুনতাহা, পৃ. ২৫৪-২৫৮।
১২। তাতিম্মাতুল মুনতাহা, পৃ. ২৬৮; মুরুজুজ জাহাব, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৪০-১৪২।
১৩। মুরুজুজ জাহাব, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২০।
১৪। এরশাদ, শেখ মুুফিদ, পৃ. ৩২৪; মাহজুদ্দাওয়াত, সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, পৃ. ২৭৪, বিহারুল আনওয়ার, ৫০তম খণ্ড, পৃ. ৩৩০।
১৫। এরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ৩২৪-৩২৫।
১৬। মাহ্জুদ্দাওয়াত, সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, পৃ. ২৭৫।
১৭। কাশফুল গুম্মাহ্, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩০৭।
১৮। যারা ইমামদের সাথে বিরোধিতা ও শত্র“তা করে থাকে তাদেরকে নাসেবী বলা হয়।
১৯। আহমাদের পিতা আবদুল্লাহ্ ইবনে খাকান সামররায় আব্বাসীয় শাসকদের দরবারী কর্মকর্তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তিত্ব।
২০। আরবদের মধ্যে অতীতকালে এমন প্রথা ছিল যে কাউকে তার সম্মানের খাতিরে তার নাম উল্লেখ না করে তার উপনামে ডাকতো।
২১। ইমাম রেযা (আঃ) এর পরবর্তী তিন ইমাম (ইমাম জাওয়াদ, ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারী) কে ইমাম রেযা (আঃ) এর সম্মানে সমাজ ও রাজ দরবাবে ইবনে রেজা বলে সম্বোধন করা হতো।
২২। আহলে বাইতের বিরোধী মহল শিয়াদেরকে রাফেজি বলতো।
২৩। এরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ৩১৮।
২৪। বিহারুল আনওয়ার, ৫০তম খণ্ড, পৃ. ২৫৩।
২৫। উসুলে কাফি, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫০৬।
২৬। বিহারুল আনওয়ার, ৫০তম খণ্ড, পৃ. ৩০৪।
২৭। এরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ৩২৪।
২৮। এহ্কাকুল হাক্ক, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৪৬৪। এই হাদিসটি আরও ছয়জন সুন্নি আলেম বর্ণনা করেছেন।
২৯। মানাকেব, ইবনে শাহ্রে অশুব, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৫২৫।
৩০। ভুলবশত কেউ কাউকে হত্যা করে ফেললে তার ‘দীয়া’ বা রক্তপণ পরিশোধ করার দায়িত্ব হত্যাকারীর পুরুষ অবিভাবক : ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্র, চাচা, চাচাত ভাই, বাবা অথবা হত্যাকারীর পুত্র সন্তানের উপর অর্পিত।
৩১। এলামুল ওয়ারা, নাজাফ ছাপা, পৃ. ৩৭৪।
৩২। কাশফুল গুম্মাহ, তাবরীজ প্রিন্ট, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩০৩।
৩৩। কাশফুল গুম্মাহ, তাবরীজ ছাপা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৯৩-২৯৪।
৩৪। কাশফুল গুম্মাহ, তাবরীজ ছাপা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩০০।
৩৫। পরহেজগার মুসলমানগণ দুর্নীতিপূর্ণ সমাজে জালিমদের মুকাবেলায় কঠিন বালা-মুসিবত সহ্য করে আল্লাহর বিধানকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকে। এতসব সমস্যার মধ্যে দীনকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয় এবং তাই ধৈর্য ধারণের পাশাপাশি আশা তার একমাত্র ভেলা। যদি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আশা না থাকতো তাহলে তারা সত্য থেকে দূরে সরে যেত।
৩৬। আনওয়ারুল বাহিয়াহ্, মাশহাদ ছাপাখানা, পৃ. ১৬১।
৩৭। উসুলে কাফি, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫১২।
৩৮। এলামুল ওয়ারা, পৃ. ৩৭৩, নুরুল আফসার, পৃ. ১৮৩, ফুসুলুল মুহিম্মাহ, ইবনে সাব্বাগ মালেকী কিছুটা পার্থক্যসহ বর্ণনা করেছেন, পৃ. ২৮৬।
৩৯। কাশফুল গুম্মাহ ফি মারিফাতিল আয়িম্মা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩০৫।
৪০। এহকাকুল হাক্ক, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৪৭০; ইবনে সাব্বাগ মালেকী এর ফুসুলুল মুহেম্মা গ্রন্থের ২৮৬ পৃ. হতে উদ্ধৃত।
৪১ । মানাকেবে আলে আবু তালেব, নাজাফ ছাপা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৫৩৮।
৪২। কাশফুল গুম্মাহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩০২।
৪৩। এরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ৩২২।
৪৪। এহ্কাকুল হাক্ক, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৪৬৭।
৪৫। এহ্কাকুল হাক্ক, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৪৭৩।
৪৬। আনওয়ারুল বাহীয়্যাহ্, মাশহাদ ছাপা, পৃ. ১৬০-১৬১।
৪৭। প্রাগুক্ত ।
৪৮। প্রাগুক্ত।
৪৯। প্রাগুক্ত ।
৫০। প্রাগুক্ত ।
৫১। প্রাগুক্ত ।
৫২। প্রাগুক্ত ।
৫৩। প্রাগুক্ত ।
৫৪। প্রাগুক্ত ।
৫৫। প্রাগুক্ত ।
৫৬। প্রাগুক্ত ।
৫৭। প্রাগুক্ত ।
৫৮। প্রাগুক্ত ।
৫৯। এখতিয়ারে মা’রেফাতুর রেজাল, পৃ. ৫৫৭।
৬০। মুনতাহাল আমাল, পৃ. ২৭৯।
৬১। জামেয়ার রুয়াত, ১ম খণ্ড, পৃঃ- ৩০৭, (দাউদ ইবনুল কাসেম ইবনে ইসহাক ইবনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে জা’ফর ইবনে আবু তালেব।
৬২। তানকিহুল মাকাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১২-৪১৩, ও বিহারুল আনওয়ার, ৯ম ও ১১তম খণ্ড।
৬৩। ইয়াহিয়া আলী (আ.)-এর বংশধর, একজন ধর্মপ্রাণ ও সাহসী পুরুষ ছিলেন। যিনি আব্বাসীয় শাসক মুসতা’ইনের আমলে অভ্যুত্থান করে নিহত হয়।
৬৪। কামুসুর রেজাল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৫৯।
৬৫। তানকিহুল মাকাল, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৭৩।
৬৬। তানকিহুল মাকাল, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪৫, কামুসুর রেজাল, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৪৫।
৬৭। ফুসুসুল মুহিম্মাহ, নাজাফ থেকে প্রকাশিত, পৃ. ২৯৮।
৬৮। কামাল উদ্দিন, আখন্দি প্রিন্ট, পৃ. ৪৭৫।