অনুবাদ: মোহাম্মাদ মুনীর হোসাইন খান
শাফাআতের অর্থ
শাফা’ (شفع) ধাতু থেকে ‘শাফাআত’ শব্দের উৎপত্তি। এ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে । যেমন বিজোড় (فرد) এর বিপরীত জোড় (جفت) এর অর্থে; বাড়ানো (বৃদ্ধি করা), অনুরোধ করা, মধ্যস্থতা করা এবং পৃষ্ঠপোষকতা দানের অর্থে।( মাজামাউল লুগাহ,পৃ, ৫৩৪)
আল্লামা তাবাতাবাঈ বলেন : ‘মূলে ‘শাফাআত’, ‘শাফ’ (شفع) অর্থাৎ জোড় বা জোড়া থেকে গৃহীত হয়েছে। আসলে শাফাআতকারী যেন শাফাআত প্রার্থনাকারীর অপূর্ণাঙ্গ মাধ্যমের সাথে যুক্ত হয়ে এমন এক যুগল গঠন করে যার ফলে ঐ সব অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়া সম্ভব হয় যা অপূর্ণাঙ্গ মাধ্যম অপূর্ণ ও দুর্বল হওয়ার কারণে (যুগল গঠন করার আগে) এককভাবে তার পক্ষে সেগুলোয় উপনীত হওয়া সম্ভব হয় নি। ( আল- মীযান ফী তাফসীরিল কোরআন, খ, ১, পৃ ১৫৫ )এ কারণেই শাফাআত হচ্ছে অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার মাধ্যম বা কারণের পরিপূরক। তাই, প্রকৃতপক্ষে শাফাআত হচ্ছে প্রথম কারণ ও ফলাফলের (مسبب ) মধ্যকার মাধ্যম ।
শাফাআতের প্রকারভেদ
ক. তাকভীনী (প্রাকৃতিক বা অস্তিত্বমূলক) শাফায়াত : ধরনের শাফাআতের সর্বজনীন অর্থ আছে যা সকল অস্তিত্বময় সত্তাকেই শামিল করে। অর্থাৎ মানুষের জন্য সকল সৃষ্টিই (সৃষ্ট জীব ও পদার্থসমূহ) মহান আল্লাহ্র রহমতের মাধ্যম। আসলে সকল সৃষ্টি মানুষের অভীষ্ট লক্ষ্যস্থলে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে বেশি বেশি সহায়তা প্রদান করে বলে বিবেচনা করা হয়।
খ. তাশরীয়ী শাফাআত এ ধরনের শাফাআত ঐ সকল মাধ্যমকে শামিল করে যা মানুষকে সরল সঠিক পথ ও সত্য শরীয়তের (সঠিক আইনব্যবস্থা) দিকে পরিচালিত করে। স্বয়ং এ ধরনের শাফাআতেরও আবার বিভিন্ন ধরন আছে যা এ প্রবন্ধে বর্ণনা করা জরুরি নয়। তবে এখানে একটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে। আর তা হলো যে, এ তাশরীয়ী শাফাআতের একটি ধরন হচ্ছে মাগফিরাত অর্থাৎ ক্ষমার শাফাআত (شفاعت مغفرت) যা এ প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব। মাগফিরাতের ক্ষেত্রে শাফাআতের অর্থ হচ্ছে পাপ মোচনের জন্য মধ্যস্থতা করা।
পবিত্র কোরআনে শাফাআত
যে সব আয়াতে শাফাআত প্রসঙ্গ আলোচনা করা হয়েছে তা দুভাগে বিভক্ত। প্রথম প্রকারের আয়াতসমূহে সার্বিকভাবে শাফাআতের ধারণা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় প্রকারের আয়াতসমূহে বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ্র অনুমতি ও ইচ্ছাক্রমে শাফাআত
১. শাফাআত প্রত্যাখ্যানকারী আয়াতসমূহ
أَمِ اتَّخَذُوا مِن دُونِ اللَّهِ شُفَعَاء قُلْ أَوَلَوْ كَانُوا لَا يَمْلِكُونَ شَيْئًا وَلَا يَعْقِلُونَ قُل للَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا
“তারা কি মহান আল্লাহকে ছেড়ে অন্য সুপারিশকারীদের গ্রহণ করেছে? আপনি বলে দিন, যদিও এরা কোন কিছুরই মালিক নয় এবং এদের কোন বোধশক্তিও নেই (তদুপরি তারা কি এ সব শাফাআতকারীর কাছে শাফাআত প্রার্থনা করছে)। আপনি বলে দিন : একমাত্র মহান আল্লাহরই অধীনে আছে সকল শাফাআত।”
( সূরা যুমার: ৪৩-৪৪)
وَاتَّقُوا يَوْمًا لَّا تَجْزِى نَفْسُ عَن نَّفْسٍ شَيْاً وَ لَا يُقْبَلُ مِنها عَدْلُ وَلَا تَنفَعُهَا شَفَاعَةُ وَلَا هُمْ يُنصَرُونَ
তোমরা সেই দিনকে ভয় কর যেদিন না কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র রক্ষা করতে পারবে; না কারো কাছ থেকে কোন শাফাআত গৃহীত হবে; না কারো কাছ থেকে কোন প্রতিদান নেয়া হবে; আর না তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে।” ( সূরা বাকারা : ১২৩)
يَأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا أَنفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُم مِّن قَبْلِ أَن يَأْتِي يَوْمٌ لَّا بَيْعٌ فِيهِ وَلَا خُلَةٌ وَلَا شَفَاعَةٌ
“হে ঈমানদারগণ! সে দিন আসার আগেই আমরা যা তোমাদেরকে জীবিকাস্বরূপ দান করেছি তা থেকে ব্যয় কর যেদিন না থাকবে কোন বেচা-কেনা, আর না থাকবে কোন বন্ধুত্ব ও সুপারিশ। ( সূরা বাকারা: ২৫৪)
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, উপরিউক্ত আয়াতসমূহে শাফাআত করার বিষয়টি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বিশেষ করে শেষোক্ত তিন আয়াতে সুস্পষ্ট ভাষায় কিয়ামত দিবসে শাফাআত প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
২. শাফাআতের বৈধতা প্রতিপন্নকারী আয়াতসমূহ
إِنَّ رَبَّكُمُ اللهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يَدَبَّرُ الْأَمْرَ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ…
‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রভু (মহান আল্লাহ) হচ্ছেন তিনি যিনি ছয় দিনে আকাশসমূহ এবং পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন; অতঃপর তিনি ক্ষমতার (কুদরত) আসনে (আরশ) অধিষ্ঠিত হয়ে সমগ্র বিষয় (বিশ্বজগৎ) পরিচালনা করছেন; আর তার অনুমতি ব্যতীত কোন শাফাআতকারীই নেই।”
( সূরা ইউনুস : ৩)
يَوْمَئِذٍ لَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَرَضِي لَهُ قَوْلًا
‘সে দিন (কিয়ামত দিবসে) যাকে দয়াময় আল্লাহ অনুমতি দেবেন এবং যার কথায় তিনি সন্তুষ্ট থাকবেন কেবল সে ব্যতীত আর কারো শাফাআত বিন্দুমাত্র উপকারে আসবে না।
(সূরা ত্বহা ১০)।
﴿إِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ مِيقَاتُهُمْ أَجْمَعِينَ يَوْمَ لَا يَغْنِي مَوْلَى عَنْ مَوْلى شَيئًا وَلَا هُمْ يَنْصَرُونَ * إِلَّا مَنْ رَحِمَ اللهُ إِنَّهُ هُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ
“নিশ্চয় পৃথক হবার দিবসই হচ্ছে তাদের (সবার) জন্য প্রতিশ্রুত দিবস যেদিন কোন বন্ধুই বন্ধুকে ন্যূনতম উপকারও সাধন করতে পারবে না এবং কেউই সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না, তবে সেই ব্যক্তি ব্যতীত যার প্রতি মহান আল্লাহ্ দয়া করবেন: কেননা, তিনিই হচ্ছেন অতি পরাক্রমশালী ও দয়ালু। ( সূরা দুখান : ৪০)
وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَنُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ بَلْ عِبَادُ مُكْرَمُونَ * لَا يسْبِقُونَهُ بِالْقَوْلِ وَهُمْ بِأَمْرِهِ يَعْمَلُونَ * يَعْلَمُ مَا بَينَ أَيدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَى وَهُمْ مِنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ
‘তারা বলেছে : দয়াময় আল্লাহ (নিজের জন্য) সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি পবিত্র, মহান। বরং তারা (কাফির মুশরিকরা যাদেরকে খোদার সন্তান বলে সাব্যস্ত করত তারা) তো (মহান আল্লাহর) সম্মানিত বান্দা। তারা আগে বেড়ে কোন কথা বলে না; তারা তাঁর (আল্লাহর) আদেশ অনুসারেই কেবল কাজ করে থাকে। তাদের সামনে ও পিছনে যা কিছু আছে তা তিনি জানেন। তারা শাফায়াত করে কেবল ঐ সকল ব্যক্তির জন্য যাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট (হয়েছেন)। আর তারা তো কেবল তাঁর ভয়েই ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। ( সূরা আম্বিয়া : ২৬-২৮)
এ সব আয়াতের বাহ্য অর্থ থেকে কিয়ামত দিবসে যে মহান আল্লাহর অনুমতিক্রমে শাফাআত করা হবে তা প্রমাণিত হয়। তাই শাফাআত সংক্রান্ত এ দুধরনের আয়াতসমূহ একত্রে বিবেচনা করে আমরা এ ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, কিয়ামত দিবসে হাশরের ময়দানে যে শাফাআত করা হবে সেটার ক্ষেত্রে একটি সর্বজনীন নিয়ম রয়েছে। আর তা হচ্ছে, হাশরের ময়দানে এই শাফাআত স্বাধীনভাবে করা হবে না, বরং তা মহান আল্লাহর অনুমতিক্রমেই হবে। অর্থাৎ শাফাআতের ক্ষেত্রে মৌলিক ধারণা হচ্ছে এই যে, এ বিষয়টি হচ্ছে একান্তভাবে মহান আল্লাহর। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মহান প্রভুর কৃপা ও অনুগ্রহে অন্যরাও (যেমন মহান আল্লাহর নবী ও ওয়ালিগণ) তাঁর অনুমতি নিয়ে শাফাআত করতে পারবেন। সুতরাং কিয়ামত দিবসে যে শাফায়াত করা বৈধ হবে তা সন্দেহাহীত এবং সর্বজনগৃহীত একটি বিষয়। মুসলিম চিন্তাবিদ ও আলেমগণও বিষয়টি স্বীকার করেছেন ও মেনে নিয়েছেন। আর যদি কোন মতপার্থক্য থেকে থাকে তাহলে শাফাআতের অর্থকে কেন্দ্র করেই, তবে মূল শাফাআতের ক্ষেত্রে কোন মতপার্থক্য নেই। মুসলমানদের সাথে কেবল মুতাযিলা ও খারেজী সম্প্রদায় মূল শাফাআত মেনে নিলেও ‘শাফাআত’ ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে অন্যদের সাথে ি পোষণ করে থাকে। তারা ধারণা করেছে যে, পাপীদেরকে নয়, শাফাআত কেবল আল্লাহর আনুগত্যকারী সৎকর্মশীল বান্দাদেরকেই শামিল করে। অর্থাৎ মহা (সা.)-এর শাফাআতের পরিণতি হচ্ছে পাপী-তাপীদের মুক্তি ও নাজাত নয়; বরং তা হচ্ছে সৎকর্মশীল ও পুণ্যবানদের মর্যাদা ও পুরস্কার বৃদ্ধি।’ ( ক্বাযী আব্দুল জব্বার প্রণীত শারহুল উসূলিল খামসাহ। পৃ: ৪৬৩-৪৬ , ড. সামীহ দাঘীম প্রণীত ইসলামী কালাম শাস্ত্রের পরিভাষাসমূহ সংক্রান্ত বিশ্বকোষ, পৃ. ১৫৫-১৫৭।)
কতিপয় আলেমের অভিমত
আল্লামা তাবাতাবাঈ (র.) সূরা বাকারার ৪৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় যে সব আয়াতে শাফাআত প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে সেগুলো এবং যে সব আয়াতে শাফাআত প্রমাণিত হয় সেগুলো উল্লেখ করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
“যদিও কতিপয় আয়াতে শাফাআত প্রত্যাখ্যাত হয়েছে তবুও যে সব আয়াত থেকে শাফাআত প্রমাণিত হয় সেগুলো বিবেচনা করলে আমাদেরকে অবশ্যই এ বিষয়টি মেনে নিতেই হবে যে, পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ থেকে নিঃসন্দেহে শাফাআতই প্রমাণিত হয়। তবে কতিপা আয়াতে শাফাআত মূলত যে মহান আল্লাহর তা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে এবং মহান আল্লাহর অনুমতিক্রমে অন্যদের যে শাফাআত করা বৈধ তা প্রমাণিত হয়। ( আল – মীযান পৃ ১৫৫-১৫৭)
আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী ও সূরা বাকারার ৪৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় শাফাআতকে একটি অকাট্য সন্দেহাতীত এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মত বিষয় বলে গণ্য করেছেন। তবে তিনি শাফাআত ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে অন্যান্য ফির্কার সাথে মুকাবিলা সম্প্রদায়ের মতপার্থক্যের কথাও উল্লেখ করেছেন। ( ইমাম মুহাম্মাদ রাযী, তাফসীর ই কবীর, খ. ৩, পৃ. ৫৯)
শেখ তুসি এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন: এ আয়াতটি কাফিরদের সাথে সংশ্লিষ্ট। কারণ, মহানবী (সা.) মুমিনদের ব্যাপারে শাফাআত করবেন। আর তাঁর শাফাআতের পরিণতিতে পাপীরা (পারলৌকিক) শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে।( শেখ তুসি প্রণীত আত তিবইয়ান ফী তাফসীরিল কোরআন, খ. ১, পৃ. ২১৩, সূরা বাকারার ৪৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা।)
ফান্ডাল নিশাপুরী عسی أن یبعثک ربک مقاما محمودا ‘অতিশীঘ্রই আপনার প্রভু আপনাকে এক প্রশংসনীয় মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে উন্নীত করাবেন’- এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ‘প্রশংসনীয় মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান’ ( مقاما محمودا) কে মহানবী (সা.)-এর শাফায়াত বলে ব্যাখ্যা করেছেন এবং মহানবী (সা.) থেকে একটি রেওয়ায়াতও বর্ণনা করেছেন। মহানবী (সা.) ঐ রেওয়ায়াতে বলেন
المقام الذي أشفع فيه لأمتى
মাকাম-ই মাহমুদ (প্রশংসনীয় মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান) হচ্ছে সেই মাকাম (অবস্থান) যেখানে আমি আমার উম্মতের জন্য শাফাআত করব। (মুহাম্মাদ ইবনে ফাত্তাহ নিশাবুরী, রওযাতুল ওয়ায়েযীন, পূ. ৫৪৯।)
আল্লামাহ্ তাবারসী সূরা বাকারার ৪৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন ‘সকল মুসলমান বিশ্বাস করে ও মেনে নিয়েছে যে, কিয়ামত দিবসে মহানবী (সা.)-এর শাফাআত গৃহীত হবে যদিও শাফাআতের ধরন, প্রক্রিয়া ও স্বরূপকে কেন্দ্র করে মুতাযিলা সম্প্রদায় ও অন্যান্য ফির্কার মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। মুতাযিলা সম্প্রদায়ের বিশ্বাস শাফাআত কেবল আল্লাহর অনুগত বান্দাদের ক্ষেত্রেই কার্যকর হবে। কিন্তু আমরা (শিয়ারা) বিশ্বাস করি যে, কেবল মহানবী (সা.)-এর শাফাআতই নয় বরং তাঁর সাহাবী, নিষ্পাপ ইমাম এবং ঈমানদার সৎকর্মশীল বান্দাদের শাফাআতও গৃহীত হবে। (মাজমাউল বায়ান, খ. ১, পৃ. ২২৩)
আবুল ফুতূহ রাখী সূরা বাকারার ৪৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন : এ আয়াতটি কাফির ও ইহুদীদের সাথে সংশ্লিষ্ট। একমাত্র মুকাবিলা সম্প্রদায় ব্যতীত সকল মুসলমান ‘শাফাআত’-এ বিশ্বাস করে এবং তা মেনে নিয়েছে। এরপর তিনি যে সব আয়াত থেকে কিয়ামত দিবসে শাফাআত প্রমাণিত হয়। সেগুলো উল্লেখ করেছেন। (রূহুল জিনান, খ. ১, পৃ. ১৬৪-১৭৫)।
মায়মূন ইবনে মুহাম্মাদ নাসাফীও এ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন এবং কিয়ামত দিবসে মহানবী (সা.)-এর সার্বিকভাবে শাফাআতকে মুসলমানদের কাছে অকাটা ও সন্দেহাতীত বিষয় বলে গণ্য করেছেন। ( তাফসিরাতুল আদিল্লা ফী উসূলিদ দ্বীন, খ ২, পৃ ৭৯২)
প্রশ্ন : শাফাআত কি সূরা বাকারার ১২৩ নং আয়াতের পরিপন্থী?
আর সেই দিনকে তোমরা ভয় কর যে দিন না কেউ কাউকে রক্ষা করবে, না কারো কাছ থেকে কোন বিকল্প প্রতিদান গ্রহণ করা হবে, না কোন শাফাআত কারো উপকারে আসবে এবং না তারা (মানবজাতি) (কোনভাবে) সাহায্যপ্রাপ্ত হবে।
সূরা বাকারার ১২৩ নং আয়াতের মূল অর্থের সাথে মহানবী (সা.) এবং মাসুম ইমামগণের শাফাআত যে পরিপন্থী এতদসংক্রান্ত ধারণা দুটি কারণে উত্থাপিত হয়ে থাকে :
প্রথমত: ১২৩ নং আয়াতের আগের ও পরের আয়াতের অর্থের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে এ আয়াতের বাহ্য (জাহেরী) অর্থের প্রতি দৃষ্টি দেয়া;
দ্বিতীয়ত: অসংখ্য আয়াতে যে আল্লাহর অনুমতিক্রমে মহানবী (সা.) ও মাসুম ইমামদের শাফাআত বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলো উপেক্ষা করা। উত্তর : কিয়ামত দিবসে শাফাআত প্রসঙ্গ হচ্ছে মুসলমানদের কাছে একটি অকাট্য ও সন্দেহাতীত বিষয় এবং কেউ তা অস্বীকার করে নি। সূরা বাকারার ১২৩ নং আয়াতেও দুই কারণে শাফায়াত প্রত্যাখ্যান করা হয় নি। কারণদ্বয় হলো;
১. ১২৩ নং আয়াতের পূর্বের ও পরের আয়াতের অন্তর্নিহিত বিষয়। এ আয়াতে ঐ শাফাআতের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করা হয়েছে যার প্রবক্তা ছিল বনী ইসরাঈল। তারা বিশ্বাস করত যে, এ ধরনের শাফাআত করার অধিকার একমাত্র তাদেরই আছে। তারা মনে করত যে, মহান আল্লাহর সাথে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকার কারণে ইহকালের মত পরকালেও তারা আল্লাহর শাস্তি থেকে রেহাই পাবে। (আল-মীযান ফী তাফসীরিল কোরআন, খ. ১, পৃ. ১৫৫)। এ কারণে (واتقوا) তোমরা ভয় কর’-এ বাক্যটির মাধ্যমে বনী ইসরাঈলকে সম্বোধন করা হয়েছে। এ আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতটি হচ্ছে :
يا بَنِي إِسْرَائِيلَ اذْكُرُوا نِعْمَتِي الَّتِي أَنْعَمْتُ عَلَيْكُمْ وَأَنَّى فَضَّلْتُكُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ
‘হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের ওপর আমার যে নেয়ামত অনুগ্রহস্বরূপ দিয়েছিলাম তা এবং আমি যে জগৎবাসীর ওপর তোমাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলাম সে কথা স্মরণ কর।
(সূরা বাকারা : ১২২)
২. এ আয়াতে মহান আল্লাহ্র অনুমতি ছাড়াই স্বাধীনভাবে অন্য কোন সত্তা যে আল্লাহ্র কাছে শাফাআত করতে পারে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। সুতরাং এ আয়াতটি (আল্লাহ্র অনুমতিক্রমে) পাপীতাপী বান্দাদের জন্য শাফাআত গৃহীত না হওয়ার দলীল হতে পারে না ।
আলোচনা আরও স্পষ্ট ও বোধগম্য হওয়ার জন্য কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা প্রয়োজন :
যে ওয়াহাবী সম্প্রদায়কে বহু আলেমই ‘শাফাআত প্রত্যাখ্যানকারী সম্প্রদায়ী বলে গণ্য করে থাকেন, এমনকি সেই ওয়াহাবীরাও সার্বিকভাবে শাফাআতকে অস্বীকার করে না; বরং তারা মহান আল্লাহর অনুমতিক্রমে কিয়াম দিবসে যে মহানবী (সা.) শাফাআত করবেন তা স্বীকার করে। ( সাইয়েদ মহসিন আমিন প্রণীত কাশফুল ইরতিয়াব ফী আতবাই মোহাম্মদ ইবনে আদিল ওয়াহহাব পৃ, ১৯২)
সুতরাং, সূরা বাকারার ১২৩ নং আয়াতের মত যে সব আয়াতে শাফাআত প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে সেগুলোয় ঐ শাফাআতকে বিবেচনা করা হয়েছে যা অনুমতি ব্যতীত হয় (বলে কাফির-মুশরিকরা ধারণা করে)। এ কারণেই শাফাআ হচ্ছে এমন একটি অকাট্য ও সন্দেহাতীত মূলনীতি ও বিষয় যাতে সন্দেহ পোষণ আসলে ইসলামের মৌলিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে সন্দেহ পোষণেরই নামান্তর।
অধিক অধ্যয়নের জন্য নিমোক্ত গ্রন্থসমূহ দ্রষ্টব্য
১. আয়াতুল্লাহ মুরতাযা মুতাহহারীর রচনাসমগ্র, খ. ১, পৃ. ৪৫৩।
২. আয়াতুল্লাহ্ জাফর সুবহানী প্রণীত আইনে ওয়াহাবিয়্যাত (ওয়াহাবী মতবাদ)
৩. আলী আসগার রিজওয়ানী প্রণীত ওয়াহাবী ও সালাফী সংশয়সমূহের অপনোদন, পৃ. ৪৫৭ থেকে পরবর্তী পৃষ্ঠাসমূহ।
তথ্যসূত্র:
– মোজতামায়ে আমুজেশে আলিয়ে ফেক্বহ্।