অনুবাদ: মোহাম্মাদ মুনীর হোসাইন খান
প্রশ্ন :
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
রাসূল (সা.) যা (যে বিধান) তোমাদের জন্য আনেন তা গ্রহণ কর এবং যা তিনি নিষেধ করেন তা থেকে তোমরা বিরত থাক।” (সূরা হাশর : ৭ )
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيُ يُوحَى
‘তিনি নিজ প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কিছু বলেন না, (এবং) তা ওহী ব্যতীত কিছু নয় যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়। ( সূরা নাজম : ৩-৪ )
এ দুটি আয়াত অনুসারে আমরা মহানবী (সা.)-এর নিরঙ্কুশ নিষ্পাপত্বে বিশ্বাস করি (তা বিধি-বিধান বর্ণনা ও প্রচারের ক্ষেত্রেই হোক বা বিভিন্ন বিষয় বর্ণনা করার ক্ষেত্রে হোক), কিন্তু ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ’- এ আয়াতটি কি উপরিউক্ত আয়াতসমূহের মুখাসসিস নয়। ( মুখসসिস (مخصص) কোন বাক্য বা শব্দের সর্বজনীন, সাধারণ, ব্যাপক অর্থকে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ করে এমন কোন বাক্য বা শব্দ।) যদি তা মুখাসসিস হয়ে থাকে তাহলে উপরিউক্ত আয়াতসমূহ থেকে কি মহানবী (সা.) যে কেবল বিধি-বিধান বর্ণনা ও প্রচার করার ক্ষেত্রেই মাসুম (নিষ্পাপ) ছিলেন তা-ই প্রমাণিত হয় না?
“নবুওয়াত’ অধ্যায়ের সাথে সংশিষ্ট যে সব বিষয় কালাম শাস্ত্রের গ্রন্থসমূহে আলোচনা করা হয়েছে সেগুলোর অন্যতম বিষয় হচ্ছে নবীদের ইসমাত (নিষ্পাপ)। তাফসীর গ্রন্থসমূহেও আলোচনার সাথে সঙ্গতি রেখে এ ব্য বেশ কিছু বিষয় বর্ণিত হয়েছে। নবীদের নিষ্পাপড় এমন সব বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত যেগুলো নিয়ে বিভিন্ন ইসলামী ফির্কা ও মাযহাবের আলেমদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য আছে। তবে ইমামীয়া শিয়া মাযহাবই হচ্ছে একমাত্র মাযহাব যারা নবীদের নিষ্পাপড় সংক্রান্ত স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। শেখ মুফিদ (র.) এ ব্যাপারে বলেন : ‘ইসলামী ফির্কাসমূহের মাঝে একমাত্র ইমামীয়া শিয়া ব্যতীত আর কোন ফিকা নেই যারা নবীদের ব্যাপারে নিরঙ্কুশ নিষ্পাপড়ে বিশ্বাসী।” (মুহাম্মদ বিন নুমান (শেখ মফীদ) প্রণীত আওয়ায়েলুল মাকালাত খন্ড, ৪, পৃষ্ঠা ১৬৫ ) সুতরাং এ ব্যাপারে সঠিক উত্তর দেয়ার লক্ষ্যে প্রথমে আমরা নিরঙ্কুশ নিষ্পাপত্ব প্রমাণ এবং এরপর انا بشر مثلکم আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ’- এ আয়াতটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।
উত্তর : আমাদের জবাব যাতে আরও বেশি স্পষ্ট ও বোধগম্য হয় সেজন্য ইসমাত” (عصمت) শব্দের অর্থের দিকে ইঙ্গিত করা প্রয়োজন ।
‘ ‘ইসমাত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ : عصم (আসম) ধাতুর ক্ষেত্রে মাকায়িদুল লুগাহ অভিধানে লেখা হয়েছে : এ শব্দটি (আসম عصم) হচ্ছে এমন একটি عصم আসল (اصل) অর্থাৎ ধাতুমূল যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে সযত্ন সংরক্ষণ ও সার্বক্ষণিক সংশ্লিষ্টতা। আর ‘ইসমাত’ (عصمت) শব্দটিও এই عصم ধাতুমূল থেকেই উৎসারিত। ( আহমদ ইবনে ফারেস ইবনে জাকারিয়া প্রণীত মাকায়ীসুল লুগাহ খ, ৪, পৃ, ১১৩)
“ইসমাত’ শব্দের পারিভাষিক অর্থ : কেউ কেউ (عصمت) শব্দটির পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রদানের ক্ষেত্রে এ শব্দটিকে ‘লুতফ’ (لطف) অর্থাৎ ‘অনুগ্রহ’ অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। শেখ মুফাদ (র.) বলেন: কালাম শাস্ত্রবিদদের পরিভাষায় ‘ইসমাত’ শব্দটি ঐ ব্যক্তির সাথে একান্ত সংশ্লিষ্ট যে আল্লাহ পাকের অনুগ্রহে এবং নিজ ইখতিয়ার (স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি) বলে নিজেকে পাপ এবং সব ধরনের মন্দ গর্হিত কার্যকলাপ থেকে সংযত ও বিরত রাখে।” ( আওয়ায়েলুল মাকালাত, খ, ৪ পৃ ১৬৪)
তবে কতিপয় আলেম ইসমাতাকে অপরিবর্তনীয় আত্মিক গুণ ( ملکه نفسانیه)বলেও অভিহিত করেছেন। আয়াতুল্লাহ জাওয়াদী আমোলী বলেন ইসমাত হচ্ছে এমন একটি শক্তিশালী অপরিবর্তনীয় আত্মিক গুণ যা সর্বদা একজন নিষ্পাপ ব্যক্তির মাঝে প্রকাশ্যে বিরাজমান এবং ক্রোধ ও প্রবৃত্তির মত অন্য যে কোন শক্তি তা বিলুপ্ত করে না। ( পবিত্র কোরআনের বিষয়ভিত্তিক তাফসীর, পবিত্র কোরআনে ওহী ও নবুওয়াত খন্ড ৩,পৃষ্ঠা ৯৭)
ইসমাত ও আদালত (ন্যায়পরায়ণতা)-এর মধ্যে পার্থক্য
‘ইসমাত’ শব্দটিকে অপরিবর্তনীয় গুণ বলে অভিহিত করার কারণে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। আর তা হলো : ‘ইসমাত’ ও ‘আদালত’ এর মধ্যে পার্থক্যটা কেমন? কারণ, আদালতের সংজ্ঞায়ও অপরিবর্তনীয় আত্মিক গুণ উল্লেখ ও ব্যবহার করা হয়েছ।
এ দুই শব্দের মধ্যকার পার্থক্য সংক্ষেপে এভাবে বলা যেতে পারে : অস্তিত্বগত পর্যায়ে আদালত ইসমাত অপেক্ষা দুর্বল। অন্যদিকে ভুল, অসাবধানতা, উদাসীনতা-উপেক্ষা এবং বিস্মৃতি আদালতের পরিপন্থী নয়। কিন্তু এগুলো ইসমাতের সাথে মোটেও খাপ খায় না। উল্লেখ্য যে, আদালত জ্ঞানগত ও তাত্ত্বিক অপরিবর্তনীয় গুণাবলীর অন্তর্গত।
মানব হওয়ার সাথে ইসমাতের কোন বিরোধ নেই
সকল সৃষ্ট জীবের মধ্যে মানব সৃষ্টি হচ্ছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। প্রজ্ঞাবান স্রষ্টা মানব অস্তিত্বকে বিভিন্ন বিপরীতধর্মী শক্তি ও উপাদানের সমন্বয়ে এমনভাবে সংমিশ্রিত করে গঠন করেছেন যে, এই গাঠনিক জটিলতাই হচ্ছে তার পূর্ণতা ও জৈব অভিব্যক্তির মূল প্রতীক ।
মানুষ তার নিজের অভ্যন্তরীণ শক্তিসমূহের মাঝে ভারসাম্য স্থাপন করে পূর্ণতায় উপনীত হওয়ার পথ সুগম করতে এবং মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি ও নৈকট্য প্রাপ্তির মাধ্যমে ইমামতের মাকামে (নিষ্পাপত্বের অবস্থান) উপনীত হতে সক্ষম। যদিও আমাদের মত যারা নাফসের কামনা-বাসনার বেড়াজালে আবদ্ধ ও রিপুর পর্দাসমূহের অন্তরালে বন্দী, তাদের পক্ষে এ বাস্তবতা উপলব্ধি করা কঠিন। তবে সুউচ্চ এ মাকামে উপনীত হওয়া অসম্ভব নয়। আর ইসমাতের মাকাম এবং মানব হওয়ার মাঝেও কোন বিরোধ নেই। কারণ, প্রত্যেক মানুষ তার নিজ অস্তিত্বগত ধারণ ক্ষমতা অনুসারে আপেক্ষিক ( আংশিক বা সীমিত পর্যায়ের) ইসমাতের অধিকারী। কিন্তু উক্ত নিরঙ্কুশ ইসমাত একমাত্র মহান নবীদের সাথেই সংশ্লিষ্ট যা বুদ্ধিবৃত্তিক ও কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক দলী প্রমাণাদির আলোকে প্রমাণিত। যদি কিছু সংখ্যক কোরআনভিত্তিক দলীলের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, মহানবী (সা.) ব্যাপক সর্বজনীন নিরঙ্কুশ) ইসনাতের অধিকারী তাহলে এই সর্বজনীন ইসমাত কখনই قل انما انا بشر مثلکم অর্থাৎ বলুন : আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ- এ আয়াতের পরিপন্থা মানুষের নিষ্পাপ হওয়া যে অসম্ভব, এতদসংক্রান্ত কোন প্রমাণ বিদ্যমান নেই। তাই যে সব আয়াত নবীদের ইসমাতের দলীল সে সব আয়াত এবং উপরিউক্ত আয়াতের মাঝে সর্বজনীনতা ও বিশেষতা ( عموم و خصوص) -এর কোন সম্পর্ক বিদ্যমান নেই। তাই এ আয়াতের ভিত্তিতে কেউ নবীদের আপেক্ষিক (আংশিক) ও সীমিত পর্যায়োর ইসমাতে বিশ্বাসী হতে পারে না।
যে সব বুদ্ধিবৃত্তিক ও কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক দলীল প্রমাণ পরে বর্ণনা করা হবে সেগুলোর ভিত্তিতে নবী-রাসূলগণ অবশ্যই মাসুম এবং একইভাবে নবী- রাসূলগণকে অবশ্যই মানব হতে হবে। কারণ, নবী-রাসূলগণের প্রেরিত হওয়ার হলে বা কার্যস্থল হচ্ছে মানব সমাজসমূহ।
مَالِ هَذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ لَوْلَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكَ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيرًا
‘কেন এই রাসূল (হযরত মুহাম্মাদ সা.) খাবার খান এবং বাজারসমূহের মধ্য দিয়ে হাঁটেন (না তিনি ফেরেশতাদের পন্থা অবলম্বন করেন, আর না তিনি রাজা-বাদশাহদের রীতি-নীতি মেনে চলেন)? কেন তার ওপর একজন ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়ে তার সাথে জনগণকে ভয় প্রদর্শন ও সাবধান করছে না (এবং তাঁর নবুওয়াতের দাবী যে সত্য, সে ব্যাপারে সাক্ষ্য দিচ্ছে না)। ( সূরা ফুরকান : ৭)
পবিত্র কোরআন কাফির-মুশরিকদের এ ধরনের কথার তীব্র সমালোচনা করেছে। সূরা আন’ আমেও কাফির-মুশরিকদের এ ধরনের উক্তি ( لولا أنزل علیه ملک ولو أنزلنا ملکا যদি না তার ওপর একজন ফেরেশতা অবতীর্ণ হত…) ( সূরা আনআম: ৮) তুলে ধরা হয়েছে। তাফসীরুল মীযানে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় সম্ভাব্য দুটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে:
১. তাদের এ ধরনের বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, রাসূল (সা.) তাদেরকে যে শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন
২. স্বয়ং ফেরেশতারা তা আনয়ন করুক এবং এ নবীর হলে তারাই জনগণকে ধর্মের দিকে আহ্বান জানাক (বা হযরত মুহাম্মা সা.-এর আহ্বান যে সত্য, সে ব্যাপারে সাক্ষ্য দান করুক)। ( তাফসিরুল মীযান, খ, ৭ পৃ, ২০-৩০)
পবিত্র কোরআনে মুশরিকদের এ উক্তির জবাবে বলা হয়েছে: ( ولو جعلناه ملکا لجعلناه رجلا ) ( সূরা আনআম, ৯) যদি (ধরে নেয়া যায় যে,) আমরা আমাদের রাসূলকে ফেরেশতা বানাতাম (অর্থাৎ ফেরেশতাকে রাসূল হিসেবে মানবজাতির কাছে প্রেরণ করতাম) তাহলে তার (ফেরেশতার) ভিতরে যাবতীয় মানবীয় গুণ সৃষ্টি করা এবং তাকে মানুষের আকৃতি ও স্বভাব প্রদান করা অপরিহার্য হয়ে যেত।অর্থাৎ রাসূল হিসেবে প্রেরিত এই ফেরেশতার অন্তর ও বাহির মানবসদৃশ করা অপরিহার্য হয়ে যেত। ( তাফসীরে নমুনা, খ. ৫. পূ. ১৬০-১৬২)।তাই এ কারণে উভয় অবস্থায় কোন পার্থক্যই আর বিদ্যমান থাকত না। আর যে ব্যক্তি নবী-রাসূল হিসেবে প্রেরিত হবে তাঁকে অবশ্যই মানবজাতির অন্তর্ভুক্ত হতে হবে এবং তাঁর মানবজাতি বহির্ভূত হওয়া সম্ভব নয়।
আল্লামা তাবাতাবাঈ এ ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, মানব সমাজের কাছে ‘মানব রাসূল প্রেরণ করার ফলে যে কল্যাণ অর্জিত হয় তদাপেক্ষা বেশি কল্যাণ মানবজাতির ওপর কোন ফেরেশতাকে রাসূল হিসেবে অবতীর্ণ করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান নেই।( তাফসীরুল মীযান, খ. ৭, পৃ. ২৩)।
তাই পবিত্র কোরআনে ইসমাতসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় শর্ত ও যোগ্যতার অধিকারী কোন মানুষকে মানবজাতির কাছে নবী-রাসূল হিসেবে প্রেরণ করা নিতান্ত স্বাভাবিক বিষয় বলেই গণ্য হয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ইসমাত আলোচনা করার পরই সংশ্লিষ্ট দলীল-প্রমাণাদির ওপর আলোকপাত করা বাঞ্ছনীয়।
বিভিন্ন ধরনের ইসমাত (নিষ্পাপত্ব)
ইসমাতকে জ্ঞানগত বা তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক- এ দুভাগে বিভক্ত করা যায়। এ দুই ধরনের ইসমাতকে পরস্পর থেকে পৃথক করা সম্ভব। আর নবী- রাসূলদের ইসমাত দু’ধরনের ইসমাতকেই শামিল করে। অর্থাৎ যিনি মাসুম (নিষ্পাপ) তিনি স্বীয় জ্ঞানগত পর্যায়ে যেমন ইসমাতের অধিকারী, ঠিক তেমনি আচরণ ও কর্মপর্যায়েও ইসমাত এর অধিকারী।
ইসমাতের ধাপ বা পর্যায়সমূহ:
ক. পাপমুক্ত থাকা : নবীদের ইসমাতের অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে তাদের পাপমুক্ত থাকা অর্থাৎ সব ধরনের পাপ ও গুনাহ থেকে পবিত্র থাকা। যে সব মানুষ অন্যদের হেদায়াতকারী (সুপথ প্রদর্শনকারী), তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে আদর্শ স্বরূপ এবং মানবজাতির কাছে আল্লাহ্ পাকের ওহী আনয়নকারী তাদের অবশ্যই চূড়ান্ত পর্যায়ের পবিত্রতার অধিকারী হতে হবে। আর ও কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক দলীল-প্রমাণাদির আলোকে মহান নবীদের নিরঙ্কুশ ইসমাতই প্রমাণিত হয়। আর সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) হচ্ছেন মনীকুল শিরোমণি অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। সুতরাং পবিত্র আত্মার অধিকারী সব ধরনের পাপ ও কদর্য থেকে মুক্ত ও পবিত্র ।
খ. ওহী প্রাপ্তি ও রিসালাত অর্থাৎ ঐশী ধর্ম প্রচার করার ক্ষেত্রে ইসমাত : নবীদের ইসমাতের দ্বিতীয় ক্ষেত্র হচ্ছে ওহী প্রাপ্তি ও তার সুষ্ঠু সংরক্ষণ এবং ঐশীধর্ম প্রচার করার ক্ষেত্রে মাসুম হওয়া যাতে তাঁদেরকে নবুওয়াত ও রিসালাতের দায়িত্ব সহকারে প্রেরণের লক্ষ্য অর্জিত হয় এবং তা যেন কোন ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। কারণ, এক্ষেত্রে ভুল-ভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকলে নবীদের প্রতি জনগণের আস্থা থাকবে না।
গ. জীবনের দৈনন্দিন বিষয়াদি এবং শরীয়তের বাস্তব প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ভুল-ত্রুটি করা থেকে মুক্ত থাকা : যে সব ক্ষেত্রে সব ধরনের ভুল-ত্রুটি ও স্খলন থেকে নবীদের মুক্ত, পবিত্র ও সংরক্ষিত থাকা অপরিহার্য সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে শরীয়তের বাস্তব ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভুল ভ্রান্তি, যেমন নামাযের রাকাতসমূহ ভুলে যাওয়া ইত্যাদি থেকে তাঁদের মুক্ত থাকা, শীরয়তের দণ্ডবিধি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকা এবং দৈনন্দিন জীবন সংক্রান্ত বিষয়াদির ক্ষেত্রে ভুল করা থেকে পবিত্র থাকা।(সূরা নাজম : ১-৩) নবীদের জীবনের এ অংশও যেমন সব ধরনের ভুল-ভ্রান্তি, ত্রুটি ও বিস্মৃতি থেকে সুরক্ষিত, ঠিক তেমনি তা তাঁদের ব্যাপক সর্বজনীন ইসমাতেরই অধীন। যে সব অকাট্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক দলীল-প্রমাণ পরে ও বর্ণনা করা হবে সেগুলোর আলোকে মহান নবিগণ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) উপরিউক্ত ক্ষেত্রত্রয়ে ইসমাতের অধিকারী অর্থাৎ মাসুম। “তারকার শপথ যখন তা আন্তমিত হয়। তোমাদের সাথী (এ নবী) পথভ্রষ্ট হন নি এবং বিপথগামীও নন (সূরা নাজম : ১-৩ )
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় শেখ মুফিদ বলেছেন: এ আয়াতের মাধ্যমে তাঁর (মহানবী) থেকে সকল পাপ-পঙ্কিলতা (খোদাদ্রোহিতা) ও বিস্মৃতি প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়। ( শেখ মুফিদের রচনাবলী, খ. ৪, পৃ. ৬৩)
যদিও মহানবী (সা.)-এর ভুল হওয়া (সাউন্নাবী) সংক্রান্ত কথা প্রচলিত আছে এবং এতদপ্রসঙ্গে কিছু হাদীসও বর্ণিত হয়েছে, তবে অকাট্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক প্রমাণসমূহের আলোকে এ ধরনের রেওয়ায়াত ও হাদীসসমূহের সত্যতা ও যৌক্তিকতা আর বিদ্যমান থাকে না। শেখ মুকিদ এ সব রেওয়ায়াত ও হাদীসের অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তুর দিকে লক্ষ্য করে বলেন :
…..মাসুমের ভূল-ভ্রান্তি, ত্রুটি ও বিস্মৃতি যে আদৌ সম্ভব নয়। এতদসংক্রান্ত অকাট্য বুদ্ধিবৃত্তিক দলীল-প্রমাণ বিদ্যমান থাকার কারণে আমাদের (ইমামীয়া শিয়া মাযহাবের) দৃষ্টিতে নবীর ভূল-ভ্রান্তি সংক্রান্ত হাদীস ও রেওয়ায়াতসমূহ বাতিল ও এগুলোর কোন নির্ভরযোগ্যতা নেই… | ( আল ইসতিসার, ১ম ও ২য় সম্মিলিত খণ্ড, পৃ. ৩৬৭-৬৬৮ )।
তাহযীব গ্রন্থে শেখ তৃসী বলেন : “বুদ্ধিবৃত্তি (আকল) ও বিবেক এ ধরনের হাদীসসমূহ প্রত্যাখ্যান করে।” (তাহযীবুল আহকাম, খ. ২, পৃ. ১৮১)।
মহান আল্লাহ্র পরিচিতি, নবীদের জ্ঞান এবং নবী-রাসূল প্রেরণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ এ ধরনের হাদীস ও রেওয়ায়াতসমূহ যে বানোয়াট ও মিথ্যা তা স্পষ্ট করে দেয়। শেখ সাদৃক (রহ.) বলেন : “যারা নবীদের যে কোন বিষয়ে তাঁদের ইসমাত অস্বীকার করে আসলে তারা নবীদের ব্যাপারে অজ্ঞ ….(বিহারুল আনওয়ার খ. ১১, পৃ. ৭২)।
আর আরেফদের (আধ্যাত্মিক সাধনাকারীদের) দৃষ্টিতে “নবুওয়াত” ‘ইমামত’ পৃথিবীতে মহান আল্লাহর খিলাফতের মাকাম ব্যতীত আর কিছুই নয় অর্থাৎ নবী ও ইমামই হচ্ছেন পৃথিবীতে মহান আল্লাহ্র খলিফা। এ কারণেই পূর্ণমানব বা ইনসানে কামিলের (নিষ্পাপ নবী ও ইমামদের) মাঝে মহান আল্লাহর গুণাবলী বিকশিত ও প্রকাশিত হওয়া অপরিহার্য অর্থাৎ মহান আল্লাহর সৌন্দর্য ও মহিমার সমুদয় গুণের প্রকাশস্থল (مظهر) হচ্ছেন ইনসানে কামিল। আয়াল্লাহ, জাওয়ানী আমোলীর দৃষ্টিতে এক্ষেত্রে খলিফাতুল্লাহ্ অর্থাৎ আল্লাহর প্রতিনিধি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি নিজের মাঝে নিরঙ্কুশ ইসমাতের (عصمت مطلقه) পূর্ণ প্রতিফলন ও বিকাশ ঘটাতে সক্ষম। (পবিত্র কোরআনের বিষয় ভিত্তিক তাফসীর, পৃ. ২৩৭।)
মহান নবীদের ইসমাত সংক্রান্ত প্রমাণসমূহ
মহান নবীদের ইসমাত সংক্রান্ত বুদ্ধিবৃত্তিক ও কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক দলীল-প্রমাণাদি বিদ্যমান যেগুলো নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো :
ক. বুদ্ধিবৃত্তিক দলীল : তাজরীদুল ই’তিকাদ গ্রন্থে ইসমাত সংক্রান্ত দলীল ঠিক এভাবে বর্ণিত হয়েছে : ( ویحب علی النبی العصمة لیحصل الوثوق فیحصل الغرض ) নবীর জন্য ইসমাত ওয়াজিব ও জরুরি যাতে (তাঁর ব্যাপারে) আস্থা অর্জিত হয় এবং পরিণতিতে নবী-রাসূল প্রেরণ করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও বাস্তবায়িত হয়…।
শেখ তূসীর উল্লিখিত উক্তি আরও স্পষ্ট ও বোধগম্য হওয়ার জন্য আল্লামা হিল্লী বলেন : ‘যাদের কাছে নবিগণ প্রেরিত হয়েছেন তারা যদি নবীদের ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা ও অপরাধ করা সম্ভব বলে জানে (ও বিশ্বাস করে) তাহলে তারা এ ধারণাও করবে যে, তাদের (নবীদের) দ্বারা ঐশী আদেশ-নিষেধ এবং কর্মকাণ্ডের বেলায়ও যে কোন ধরনের মিথ্যা ও পাপাচার সংঘটিত হওয়া সম্ভব। এর ফলে তখন আর তারা নবীদের বিধি-নিষেধ মেনে চলা ও পালন করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে না।
উপরিউক্ত দলীল অতি সংক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও নবীদের ইসমাতের বিষয়টি পূর্ণাঙ্গভাবে বর্ণনা করে এবং নবীদের ইসমাতের বিষয়টি বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার আলোকে অত্যন্ত জরুরি ও অপরিহার্য বিষয় বলে প্রমাণিত করে। কারণ, এর ফলে জনগণ নবীদের বাণীর সত্যতার ব্যাপারে সুনিশ্চিত হতে পারবে। আর সেই সাথে নবীদের ওপর মিথ্যা আরোপের অভিযোগ উত্থাপনের মত ধ্বংসাত্মক পাপ থেকেও তারা নিরাপদ থাকবে।
খ. কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক দলীল (دلیل نقلی ) : পবিত্র কোরআনের বেশ কিছু আয়াতে এ বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয় যে, নবীদের ইসমাত একটি সুস্পষ্ট বিষয়। আলোচনার কলেবর ও ধারণা ক্ষমতার আলোকে নিচে কতিপয় আয়াত উল্লেখ করা হলো। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন :
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى
আর নবী (সা.) নিজ প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কিছু বলেন না: (যা কিছু তিনি বলেন) তা তার প্রতি প্রত্যাদেশকৃত ওহী ব্যতীত আর কিছু নয়।
( সূরা নাজম : ৩-৪)
এ আয়াতের ভিত্তিতে মহানবী (সা.)-এর শরীয়ত যা তিনি ওহী হিসেবে লাভ করেছেন এবং জনসাধারণের কাছে প্রচার ও বর্ণনা করেন তা হচ্ছে সেই বিষয় যা মহান আল্লাহ্ তাঁর ওপর অবতীর্ণ করেছেন অর্থাৎ এ হলে মহা (সা.) সম্পূ নিষ্পাপ এবং সব ধরনের ভুল-ত্রুটি থেকে পবিত্র ও সংরক্ষিত (মাসুম)।
যে সব আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, মহান নবিগণ ওহী অর্থাৎ প্রেরিত প্রত্যাদেশ ও ঐশী বাণী (বিধি-বিধান) ইত্যাদি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে সব ধরনের দোষ-ত্রুটি ও ভুল-ভ্রান্তি থেকে মুক্ত ও পবিত্র অর্থাৎ তাঁরা ওহী প্রাপ্তি, সংরক্ষণ, প্রচার ও বাস্তবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ইসমাতের অধিকারী, সেগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ :
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يحكمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَينَهُمْ ثُمَّ لَا يجدوا في أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
“আপনার প্রভুর শপথ, সে পর্যন্ত তারা মুমিনই হতে পারবে না যে পর্যন্ত না তারা আপনাকে নিজেদের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তি ও মীমাংসা করার জন্য বিচারক হিসেবে গ্রহণ করবে। অতঃপর আপনি যে বিচার ও ফয়সালা প্রদান করবেন সে ক্ষেত্রে তারা মনে কোন অসন্তোষ ও দ্বিধা পোষণ করবে না এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেবে।
( সূরা নিসা: ৬৫)
ولولا فضل الله عَليكَ وَرَحْمَتُهُ لَهَمَّتْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ أَنْ يضلوك وما يصلون إلا الفسهُمْ وَمَا يَطرُونَكَ مِنْ شَيءٍ وأنزل الله عليك الكتاب والحكمة وَعَلَّمَك مَا لَمْ تَن العلم وكان فَضْلُ اللهِ عَلَياكَ عَظِيمًا
‘যদি মহান আল্লাহর দয়া আপনার ওপর না থাকত তাহলে তাদের (জনগণের) মধ্য থেকে একটি গোষ্ঠী আপনাকে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করার ব্যাপারে সাহস করত ও চেষ্টা চালাত। আর তারা নিজেদেরকে ব্যতীত আর কাউকে বিচ্যুত করে না এবং তারা আপনার কোন ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম নয়। মহান আল্লাহ আপনাকে আপনার ওপর কিতাব (কোরআন) ও প্রজ্ঞা (হিকমত) অবতীর্ণ করেছেন এবং আপনি যা জানতেন না তা আপনাকে শিখিয়েছেন। আর আপনার ওপর আল্লাহর মহাঅনুগ্রহ রয়েছে।
(সুরা নিসা : ১১৩)।
আয়াতুল্লাহ্ জাওয়াদী আমোলী উপরিউক্ত আয়াতদ্বয়ের ব্যাখ্যায় লিখেছেন: ‘এ দুই আয়াতের ব্যাখ্যার সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে এই যে, একদিক থেকে ঐশী গ্রন্থসমূহ অবতীর্ণ করার মূল লক্ষ্য হচ্ছে নবীকে আল্লাহ্ পাক যে জ্ঞান দান করেছেন তার ভিত্তিতে জনগণের মাঝে বিচার করা ও ফয়সালা প্রদান। অন্যদিকে, সঠিক ও সুষ্ঠু বিচার কার্য পরিচালনা ও ফয়সালা প্রদানের বিষয়টি বিধি-বিধান ও আইনের বিষয়বস্তু সংক্রান্ত জ্ঞানের ওপর একান্ত নির্ভরশীল। আর এ বিষয়টি সূরা নিসার ১১৩ নং আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান ও বোধগম্য হয়ে যায়।
( পবিত্র কোরআনের বিষয়ভিত্তিক তাফসীর, পৃ. ২১৮-২১৯)
আল্লামা তাবাতাবাঈ (রহ.) আল-মীযান গ্রন্থে এ দুটি আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন :
“যে বিষয়ের মাধ্যমে ইসমাত বাস্তবায়িত হয় তা হচ্ছে এমন এক ধরনের জ্ঞান যা তার ধারককে পাপ ও ভুল-ভ্রান্তিতে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখে। অন্যভাবে বলা যায়, তা হচ্ছে এমন এক জ্ঞান যা বিচ্যুতির হাত থেকে রক্ষা করে। ( وأنزل الله علیک الکتاب والحکمه ) ‘মহান আল্লাহ্ আপনার ওপর কিতাব ও প্রজ্ঞা অবতীর্ণ করেছেন”- ( সূরা নিসা : ১১৩) এর অর্থ হচ্ছে কিতাব ও প্রজ্ঞা আপনার প্রতি ওহী করেছেন; আর এ ওহী হচ্ছে মহানবী (সা.)-এর জন্য এক ধরনের ঐশী শিক্ষা (তালীম-ই ইলাহী)। তবে ( وعلمک ما لم تکن تعلم ) ‘আপনি যা জানতেন না তা আপনাকে আল্লাহ্ পাক শিখিয়েছেন’- এ আয়াতস্থ শিক্ষা বা জ্ঞানের অর্থ ঐ জ্ঞান (علم) যা ওহীর মাধ্যমে তিনি (সা.) অর্জন করেছেন। কারণ, সূরা নিসার ৬৫ নং আয়াতের বিষয়বস্তু হচ্ছে বিরোধ ও বিবাদ নিষ্পত্তি ও মীমাংসা করার ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর বিচারকার্য পরিচালনা। আগ বিবদমান পক্ষসমূহ এক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর কাছে ফয়সালা প্রদানের আহ্বান জানাত। তাই উল্লিখিত দুই আয়াতের কাঙ্ক্ষিত অর্থ হচ্ছে দুধরণের জ্ঞান:
১. ওহীর মাধ্যমে শিক্ষাদান (تعلیم) অর্থাৎ ওহীলব্ধ জ্ঞান এবং
২ মহানবী (সা.)-এর হৃদয়ের ওপর প্রক্ষিপ্ত জ্ঞান অর্থাৎ ইলহামলব্ধ জ্ঞান। ( তাফসীরুল মীযান, খ. ৫, পৃ. ৭৭-৮০)
অতএব, উপরিউক্ত আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মহানবী (সা.) দুধরনের জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন: ১. এক ধরনের জ্ঞান যা বিচারকার্য পরিচালনা এবং রায় ও ফয়সালা প্রদানের উৎস; ২. আরেক ধরনের জ্ঞান যা বিষয়বস্তুসমূহের মধ্যে পার্থক্য সূচিত করে। এ কারণে উপরিউক্ত আয়াতের শানে নুযূল এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যে, দুই ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে অভিযোগ পেশ করে প্রত্যেকেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ এবং প্রতিপক্ষকে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। এ হলে এ আয়াত অবতীর্ণ হলে বাতিল (মিথ্যা) থেকে সত্য পৃথক হয়ে যায়। অতএব, উপরিউক্ত আয়াতসমূহ এবং আরও কতিপয় আয়াত যেগুলো উল্লেখ করার অবকাশ এখন নেই সেগুলো অনুসারে আলোচ্য বিষয় সম্পূর্ণ সুস্পষ্ট।
মহান নবিগণ সবাই নিষ্পাপ ও পবিত্র ছিলেন বিশেষ করে সেই সব নবী যাঁরা হচ্ছেন ‘উলুল আযম’ যাদের শীর্ষে রয়েছেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.), যিনি সর্বোচ্চ পর্যায়ে ইসমাত-এর অধিকারী। পবিত্র কোরআন মহানবী (সা.)-এর আনুগত্যকে মহান আল্লাহ্র আনুগত্য বলেই গণ্য করেছে। বর্ণিত হয়েছে :
مَنْ يطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا
*যে রাসূলের আনুগত্য করে সে মহান আল্লাহরই আনুগত্য করে। আর যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আমরা আপনাকে তাদের ওপর তত্ত্বাবধায়করূপে প্রেরণ করি নি।” ( সূরা নিসা: ৮০ )
ইমাম ফখরুদ্দীন আল-রাযী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন : এ আয়াতটি হচ্ছে মহানবী (সা.) যে সকল বিধি-নিষেধ প্রদান করার ক্ষেত্রে ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত তার দলীল।… আর সকল কাজকর্মেও তাঁর মাসুম হওয়া অপরিহার্য ও জরুরি। ( ইমাম ফখরুদ্দীন রায়ী প্রণীত আত-তাফসীর আল-কাবীর, খ. ১, পৃ. ১৯৩)
এ পর্যন্ত যে সব দলীল (বুদ্ধিবৃত্তিক ও কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক দলীল) উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর ভিত্তিতে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, নবিগণ বিশেষ করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, তিনি নিরঙ্কুশ ইসমাতের অধিকারী। এ কারণেই উপরিউক্ত দলীল-প্রমাণাদির নিরঙ্কুশ ও সর্বজনীন হওয়ার আলোকে আমরা (ইমামীয়া শিয়া) বিশ্বাস করি যে, ইসমাত মহান নবীদের জীবনের সকল বিষয় ও দিককে পরিব্যাপ্ত করে আছে ।
এতদপ্রসঙ্গে জামীল হামূদ ( و جعلنی نبیا و جعلنی مبارکا ..) অর্থাৎ ‘(মহান আল্লাহ্) আমাকে নবী করেছেন এবং আমাকে তিনি বরকত ও কল্যাণময় করেছেন… ‘ – এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন : ‘যদি আমরা ধরে নেই যে, মুহাম্মাদ (সা.) বিষয়সমূহ সুনির্দিষ্ট ও পৃথক করে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে মাসুম নন তাহলে এর ফলে অনিবার্য হয়ে যাবে যে, তিনি মুবারক (বরকত ও কল্যাণময়) নন । (মোহাম্মাদ জামীল হাম্দ, শুবহাতু ইলকাইল মাসূম নাফসাহু ফিত তাহলুকাহ, খ. ২ ১. পূ. ৩২০)
“আমি তোমাদের মত একজন মানুষ – এ আয়াতের প্রকৃত অর্থ
আমরা এখানে অকাট্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক (নাকলী) দলীল-প্রমাণাদির আলোকে নবীদের নিরঙ্কুশ ইসমাত বর্ণনা ও প্রমাণ করার পর ‘আমি তোমাদের মত একজন মানুষ এ আয়াতের অন্তর্নিহিত অর্থ পর্যাে ও বিশ্লেষণ করব। কারণ, এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়ে থাকে। আর যা হলো যে, উপরিউক্ত আয়াতটি কি ঐ সব আয়াতের অন্তর্নিহিত অর্থকে সীমিত করে যেগুলোয় সকল নবী, বিশেষ করে মহানবী (সা.)-এর নিরঙ্কুশ ইসমাতের (عصمت مطلقه) প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে? আর প্রশ্নকারী বিশেষ করে মহানবী (সা.)- এর ইসমাত সম্পর্কেই প্রশ্ন তুলেছেন। আর প্রশ্নটা সঠিক বলে ধরে নিলে বলা যাবে যে, মহানবী (সা.) বিধি-বিধান বর্ণনা, প্রচার, ব্যাখ্যা, প্রয়োগ ও কার্যকর করার ক্ষেত্রেই কি কেবল মাসুম ছিলেন?
এ প্রশ্নের জবাবে অবশ্যই বলতে হয় যেমনভাবে নিরঙ্কুশ ইমামতের ইসমাতের দলীল-প্রমাণ ও প্রাগুক আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয়েছে যে, মহানবী (সা.) নিরঙ্কুশভাবে মাসুম ছিলেন। অর্থাৎ ওহী প্রাপ্তি, সংরক্ষণ, প্রচার, কার্যকর ও বলবৎ করাসহ দৈনন্দিন জীবনের সকল বিষয়ে তিনি ইসমাতের অধিকারী ছিলেন। (যেমনভাবে সূরা কাহফ ও ফুসসিলাতে বর্ণিত হয়েছে তদনুসারে) উপরিউক্ত আয়াত এবং অন্যান্য আয়াতের মাঝে সর্বজনীনতা এবং বিশেষায়িতকরণের (সীমিতকরণ) ( تعمیم و تخصیص) কোন সম্পর্ক বিদ্যমান নেই যার ফলে তা অবলম্বন করে কেউ আংশিক বা সীমিত ইসমাতের ( تبعیض و عصمت) প্রবক্তা হতে পারে। আল্লামা তাবাতাবাঈ, তাফসীর আল-মীযানে সূরা কাহফে উক্ত আয়াতের ব্যাখার লিখেছেন: ‘আয়াতটি সীমাবদ্ধতা আরোপকারী পদ ‘ইন্নামা’ -নিশ্চয়ই) দিয়ে তার হয়েছে। অন্য সকল মানুষের মত বা সদৃশ হওয়ার ক্ষেত্রেই কেবল মহানবী (সা.)-এর সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এ আয়াতে। অর্থাৎ বাড়তি কিছু তাঁর নেই জাহেলি যুগে ধারণা করা হত যে, যে কেউ নবুওয়াতের দাবী করবে সে নিজেকে ইলাহ (উপাস্য) ও গায়েবী শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী বলেও দাবী ও জাহির করবে। এ কারণেই কাফির-মুশরিকরা তাঁর নিকট এমন সব জিনিস দারী করত যা আল্লাহ আর কেউ জানে না অথবা তা করার ক্ষমতা রাখে না। মহান আল্লাহর অনুমতি ভিন্ন যে এ সব জিনিস তাঁর অধিকারে নেই, তিনি তা স্পষ্ট করেছেন। তিনি যে নবী এবং তাঁর কাছে ওহী করা হয়, কেবল এটাই তিনি ব্যক্ত ও প্রমাণ করেছেন। ( সূরা ফুসসিলাত: ৫)
সূরা ফুসসিলাতে মুশরিকদের উক্তির জবাব এ আয়াতে দেয়া হয়েছে। বালা হয়েছে আর তারা বলল: ‘আমাদের অন্তঃকরণ এমনই যে, তুমি (নবী) যে বিষয়ের দিকে আমাদেরকে আহ্বান করছ তা বোঝে না এবং আমাদের কর্ণকুহরে একটি ভারী পর্দা আছে যার ফলে তা এই আহবানের কোন কিছুই শুনতে পায় না। আমাদেরকে তোমার কাছে আসতে দেয় না।’
এ কারণেই কাফির-মুশরিকদেরকে এ উক্তির জবাবে আয়াতটিতে বলা হয়েছে : নিশ্চয়ই আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ। তোমাদের মাঝেই আমি জীবন যাপন করি, তোমরা যেভাবে একে অপরের সাথে কথা বল। আমি তোমাদের (মানবজাতি) থেকে ভিন্ন কোন প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত নই যার ফলে তোমাদের ও আমার মাঝে দৈহিকভাবে বিস্তর ব্যবধান থাকবে।
(তাফসীরুল মীযান. . . খ, ১৭ পৃ ৩৬১। কিন্তু নিঃসন্দেহে সাধারণ সকলের সাথে আত্মিক দৃষ্টিতে নবীদের অতুলনীয় পার্থক্য রয়েছে। তাদের আত্মিক এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের ওহী লাভের উপযোগিতা দান করেছে। ) অর্থাৎ আমি তোমাদের মতই স্বাভাবিক পদ্ধতিতেই কথা বলি। তবে তোমরা কেন আমার কথা বোঝা না? এতদভিত্তিতে আলোচ্য আয়াতটি অন্যান্য আয়াতের অন্তর্নিহিত ব্যাপক অর্থকে সীমিত ও বিশেষায়িত করে না। তবে এ সূরায় মুশরিকদের কতিপয় অমূলক ধারণা ও ভিত্তিহীন অজুহাত বাতিল করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং মহানবী (সা.) যে একজন মানুষ এবং সেই সাথে তিনি যে আল্লাহ্ পাকের নবী ও ঐশী বাণীর বাহক কেবল সেটাই এ আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে।
ফলাফল
নবিগণ সবাই মাসুম (নিষ্পাপ)। আর মহানবী (সা.), যিনি উল আযম নবীদের অন্তর্ভুক্ত, বরং তাঁদের সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তিনিও নিরঙ্কুশ ইসমাতের অধিকারী। বুদ্ধিবৃত্তিক ও কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক দলীল প্রমাণাদির আলোকে মহান নবিগণ তথা মহানবী (সা.)-এর ইসমাত নিরঙ্কুশ ও নিঃশর্ত হওয়ার কারণে তা ব্যাপক পরিসরে প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত হয়ে যায়। এ জন্যই ‘আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ’- এ আয়াতটি মুখাসসিস (বিশেষক ও সীমায়িতকারী) না অর্থাৎ এ আয়াতটি মহান নবিগণ এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নিরঙ্কুশ ইসমাতকে সীমিত করে না। শেখ সাদৃক এতদপ্রসঙ্গে বলেন: ‘আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে এই যে, তাঁরা (নবিগণ) যেমন পূর্ণতার বিশেষণে বিশেষিত, ঠিক তেমনি তাঁরা বিদ্যা ও জ্ঞান দ্বারাও ভূষিতঃ তাঁদের জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, এমনকি খুঁটি-নাটি ক্ষেত্রেও তাঁদের কোন ভুল-ভ্রান্তি, পাপ ও অজ্ঞতা নেই। ( আয়াতুল্লাহ্ জাফর সুবহানী প্রণীত মানুষের জভীদ, খ, ৫ পৃ, ৪-১৭)
অধিক অধ্যয়ন ও অবগতির জন্য নিম্নোক্ত গ্রন্থসমূহ দ্রষ্টব্য
১. আয়াতুল্লাহ্ জাফর সুবহানী প্রণীত মানশুরে জভীদ, খ. ৫ , পৃ. ৪-১৭। ২. আয়াতুল্লাহ্ মিসবাহ ইয়াদী প্রণীত নেতা পরিচিতি (রাহ্নামা শেনাসা), পূ ৯০-১০৪।
৩. আলী শিরাভানী প্রণীত শহীদ মোতাহ্হারীর রচনাসমূহে ইসলামী জ্ঞান- বিজ্ঞান (মা’আরিফ), পৃ. ২৭৬-২৭৮।
৪. মুহাম্মাদ আমীন আরযেগনী প্রণীত ইমাম খোমেইনীর ইরফানী (আধ্যাত্মিক) দৃষ্টিতে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.), পৃ. ৪৮-৫০।
৫. মুহাম্মাদ সাঈদী মে প্রণীত ইসলামী কালাম শাস্ত্র শিক্ষা, পৃ. ৭০-৮০।
তথ্যসূত্র:
মোজতামায়ে আমুজেশে আলিয়ে ফেক্বহ্।