অনুবাদ: মোহাম্মাদ মুনীর হোসাইন খান
মেরাজ কি দৈহিক না আত্মিক?
মে’রাজ প্রসঙ্গে এ প্রশ্নটিও উত্থাপিত হয় যে, মেরাজ কি দৈহিক না আত্মিক? এ বিষয়টি উল্লিখিত সংশয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ, মে’রাজ সংক্রান্ত আপত্তি মে’রাজের দৈহিক (শারীরিকভাব সংঘটিত) হওয়ার সাথেই একান্ত সংশ্লিষ্ট। এতদসংক্রান্ত যে সব তত্ত্ব ও অভিমত প্রচলিত আছে সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো:
ইসরা ও মে’রাজ আত্মিক (আধ্যাত্মিক)
জাহমিয়া সম্পদায় বিশ্বাস করে যে, মে’রাজ ছিল আধ্যাত্মিক (আত্মিক) এবং তা স্বপ্নে সংঘটিত হয়েছিল। যারা এ তত্ত্ব গ্রহণ করেছে তারা তাদের এ দাবী প্রমাণ করার জন্য দুটি প্রমাণ উত্থাপন করেছেন :
ক. দৈহিক মে’রাজ বুদ্ধিবৃত্তির সাথে মোটেও খাপ খায় না। কারণ, মুসলিম দার্শনিকগণ বিশ্বাস করেন যে, প্রথমত স্থূল দেহ ঊর্ধ্বলোকে উড্ডয়ন করতে ও যেতে সক্ষম নয় কারণ সূক্ষ্ম দেহ ব্যতীত আকাশের দিকে উড্ডয়ন অসম্ভব। দ্বিতীয়ত আমরা যদি দৈহিক মে’রাজ মেনে নেই তাহলে এর ফলে নভোমণ্ডলে ফাটল ও চিড় দেখা দেবে।
(এ দার্শনিক মতানুযায়ী নভোমণ্ডল অভেদ্য বিধায় তা বিদীর্ণ করা অসম্ভব)
কারণ, স্থূল দেহ তা ভেদ করবে বিধায় আবার সেই ফাটল মিলে যাবে অথচ নভোমণ্ডলের ফাটল এবং তা মিলে যাওয়া দার্শনিক দলিল-প্রমাণাদি অনুসারে মোটেও সিদ্ধ নয়। তৃতীয়ত স্থূলদেহের ঊর্ধ্বে গমন এবং জগৎসমূহে ভ্রমণ অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার অথচ মে’রাজ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত স্থায়ী হয় নি; বরং কেউ কেউ বলেন যে, মে’রাজ এক মুহূর্তেরও বেশি স্থায়ী হয় নি। আর এটাই হচ্ছে মে’রাজের আধ্যাত্মিক হওয়ার প্রমাণ। (ইবনে সিনা, মেরাজনামা, পৃ. ১৮)
দার্শনিকদের এ আপত্তির জবাবে ইসলামী কালাম শাস্ত্রবিদ ও আলেমগণ বলেন : মহানবী (সা.)-এর মে’রাজ দৈহিক ছিল এবং এই জড় দেহ নিয়ে তিনি সকল জগৎ পরিক্রমণ করেন, এমনকি আরশ ও কুরসি যা হচ্ছে তাঁদের (কালাম শাস্ত্রবিদ ও আলেমগণ) বিশ্বাসে অষ্টম ও নবম নভোমণ্ডল, সে পর্যন্ত তিনি গমন করেন এবং যাবতীয় নভোমণ্ডলীয় সৃষ্টিকেও প্রত্যক্ষ করেন। তবে যে সব আপত্তি দার্শনিকরা করেছেন, যেমন এ আপত্তি- ‘মে’রাজ যদি দৈহিক হয়ে থাকে এর ফলে নভোমণ্ডলে ফাটল দেখা দেবে’, সেগুলো নভোমণ্ডল সংক্রান্ত তাঁদের বিশ্বাস থেকে উৎসারিত। আর তা হচ্ছে, আকাশ (নভোমণ্ডল) হচ্ছে স্থূল পদার্থ। তাই যদি মহানবী (সা.) স্থুল দেহ নিয়ে আকাশে গমন করে থাকেন তাহলে আকাশ অবশ্যই বিদীর্ণ হবে এবং তারপর এই ফাটল আবার মিলে যাবে। আর এটা মানব বুদ্ধিবৃত্তির সাথে মোটেও খাপ খায় না। অথচ আকাশ যে স্থল পদার্থ এতদসংক্রান্ত দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গির অসারত্ব আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে প্রমাণিত হয়ে যায়।
খ. বেশ কিছু সংখ্যক হাদীসও আছে যেগুলোর বাহ্য অর্থ হচ্ছে, মে’রাজ হলো আত্মিক। যেমন ইয়াকূব ইবনে উত্তার বর্ণিত রেওয়ায়াতঃ
كانت رؤيا من الله صادقة
মে’রাজ ছিল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য স্বপ্ন’ (ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ. ৩, পৃ. ১৪১)
অর্থাৎ এ মে’রাজ তাঁর নিদ্রাবস্থায় সংঘটিত হয়েছিল। হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত হয়েছে :
ما فقد جسد رسول الله له و لكن الله أسرى بروحه
‘মহান আল্লাহর শপথ, মহানবী (সা.)-এর পবিত্র দেহ আমাদের মধ্য থেকে (ঊর্ধ্বলোকে) নিয়ে যাওয়া হয় নি; বরং মহান আল্লাহই তাঁর আত্মাকে আসমানসমূহে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। তবে এ সব রেওয়ায়াত প্রথমত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং মে’রাজ এসঙ্গে যে সংশয় সৃষ্টি করা হয়েছিল তা দূর করার লক্ষ্যেই এ সব রেওয়ায়াতের অবতারণা করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত এ বিষয়টি শিয়া-সুন্নী সূত্রে বর্ণিত অগণিত রেওয়ায়াত ও হাদীসেরও পরিপন্থী। তৃতীয়ত মহানবী (সা.)-এর নৈশ ভ্রমণ (ইস্রা) ও মে’রাজকালে হযরত আয়েশা জন্মগ্রহণ করেন নি নতুবা শিশু ছিলেন এবং (মে’রাজ সংঘটিত হওয়ার) বহু বছর পরে তিনি বধু হয়ে মহানবী (সা.)- এর গৃহে পদার্পণ করেছিলেন। আহলে সুন্নাতের প্রখ্যাত আলেম ইবনে হাজার আসকালানীও লিখেছেন :
“হযরত আয়েশা মহানবী (সা.)-এর বে’সাতের (নবুওয়াত ঘোষণার ৪/৫ বছর পরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১ম বা ২য় হিজরীতে ৯ বছর বয়সে মহানবীর সাথে তাঁর বিবাহ হয়।
সুতরাং মহানবী (সা.)-এর ইস্রা ও মে’রাজ বেসাতের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষে সংঘটিত হয়েছিল। আর হযরত আয়েশা তখনও জন্মগ্রহণ করেন নি । তবে যদি আমরা বলি যে, এ ক্ষেত্রে তিনি ইজতিহাদ করেছিলেন তাহলে তা হবে ভিন্ন কথা। ( মাহদী পিশওয়ায়ী, তারিখে ইসলাম, পৃ. ১৩৩)
আংশিক দৈহিক ও আংশিক আত্মিক
পবিত্র মক্কা নগরী থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত তাঁর ভ্রমণ ছিল দৈহিক আলামে মালাকৃত পানে তাঁর উড্ডয়ন ছিল আত্মিক-আধ্যাত্মিক। এ অভিমত এবং বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে মহাকাশসমূহ এবং ঐশী মহিমার জগৎ অর্থাৎ শেখ আহ্মাদ্ আল-আসাঈ-এর অনুসারীরা (শাইথিয়াহ্ সম্প্রদায় বলে পরিচিত) উত্থাপন করেছে। তারা বিশ্বাস করে যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) স্থূল দেহের প্রতিটি গাঠনিক উপাদান বা মৌল (عنصر) কে উক্ত মৌলের জগতেই রেখে যান এবং পানি, মাটি, বায়ু ও অগ্নি জগৎ অতিক্রম করার পর হুরাক্লিয়াঈ দেহ (যা হচ্ছে মিসালী অর্থাৎ জড় এবং অজড়ের মধ্যবর্তী অবস্থার সূক্ষ দেহ। নিয়ে আসমানসমূহ পরিক্রমণ করেন। ( সাদরুল মুতাআল্লিহীন শিরাজি মোল্লা সাদরা), তিনটি দার্শনিক প্রবন্ধ, পৃ.৫৯)
যায়দিয়াহ্ ও মু’তাযিলাহ্ সম্প্রদায়ও এ অভিমত গ্রহণ করে বলেছে যে, বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত মহানবী (সা.)-এর মে’রাজ ছিল আত্ম-দৈহিক। সূরা ইসরার আয়াতে ‘মসজিদুল আক্সার দিকে’ (إلی المسجد الآقصی ) বাকাটি বিদ্যমান এবং এরপর সেখান থেকে আসমানসমূহে তাঁর ভ্রমণটা ছিল আত্মিক- আধ্যাত্মিক। ( হাশমতুল্লাহ রিয়াজি, বায়ানুস সায়াদা ফি মাকামাতিল ইবাদাহ’ গ্রন্থেও অনুবাদ, খ, ৮, পৃ ২২৩)
ইসরা ও মে’রাজ দৈহিক এবং জাগ্রত অবস্থায় সংঘটিত হয়েছিল
মুসলিম কালামশাস্ত্রবিদ, পণ্ডিত এবং আলেমদের মধ্যে প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে, মহানবী (সা.)-এর মে’রাজ ছিল বাস্তব ও দৈহিক। আর এটা ইসলামের সন্দেহাতীত বিষয়াবলীর অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য। উল্লেখ্য, মে’রাজ সংক্রান্ত অভিমতটিই আসলে সঠিক; আর পবিত্র কোরআনের আয়াত এবং হাদীস ও রেওয়ায়াতসমূহও সুস্পষ্ট ভাষায় মহানবীর মে’রাজ যে দৈহিক ও আত্মিকভাবে সংঘটিত হয়েছিল তা ব্যক্ত করে। আর প্রখ্যাত শিয়া মুফাসসির ও ফকীহ আল্লামা তাবারসীও স্বীয় তাফসীর গ্রন্থ মাজমাউল বায়ানে মহানবী (সা.)-এর মে’রাজ যে দৈহিকভাবে সংঘটিত হয়েছিল এতদসংক্রান্ত (শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে) সকল মুসলিম আলেমের ঐকমত্য রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন ।
একইভাবে আল্লামা মাজলিসী এবং আহলে সুন্নাতের প্রখ্যাত মুফাস্সির ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী বিশ্বাস করেন যে, গবেষক আলেমগণ এ বিশ্বাস পোষণ করেন, পবিত্র কোরআনের আয়াত এবং শিয়া-সুন্নী সূত্রে বর্ণিত মুতাওয়াতির হাদীসসমূহ অনুসারে মহান আল্লাহ্ মহানবী (সা.)-কে তাঁর আত্মা ও দেহসমেত পবিত্র মক্কা নগরী থেকে মসজিদুল আকসায় এবং এর পর সেখান থেকে আসমানসমূহে নিয়ে যান। আর এ বিষয়টিকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান অথবা এটাকে আত্মিক উরজ (মে’রাজ) বলে তাবীল ও ব্যাখ্যা করা অথবা নিদ্রায় তাঁর মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল ইত্যাদি বলা আসলে স্বল্প অধ্যায়ন ও অল্প বিদ্যা অথবা দুর্বল ধর্ম বিশ্বাস থেকে উৎসারিত।
তথ্যসূত্র:
মোজতামায়ে আমুজেশে আলিয়ে ফেক্বহ্।
চলবে…..